১৫ আগস্ট। ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে। অনেক অনেক রক্ত, বহু তাজা প্রাণের বিনিময়ে বিগত শতকের চারের দশকের স্বাধীনতা নামী সেই শিশু ভারত আজ হাঁটি হাঁটি পা পা করে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে।
আমাদের সামনে এখন নানা প্রশ্ন— এই স্বাধীনতা পেয়ে কতটা খুশি হয়েছি আমরা? আদৌ খুশি হয়েছি কি? হলে কতটা? আমরা যা চেয়েছিলাম তা পেয়েছি কি? যদি পেয়েই থাকি তা হলে স্বাধীনতার মহানন্দে আমাদের মন প্রফুল্ল হয়ে যায় না কেন? কেন চারিদিকে এখন শুধুই হতাশা, হাহাকার, আক্রোশ? কেন দারিদ্র আর বেকারত্বের বুকফাটা আর্তনাদ? কেন আমাদের চারিদিকে আজ নীতি-নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়? এতদিনের স্বাধীনতা আমাদের কী দিয়েছে? এসবের একটু উত্তর খোঁজা যাক।
নতুন প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতার ৭৫ বছর নিছকই একটি ‘সেলিব্রেশন।’ ‘ফেস্টিভ মুড’ ছাড়া আর কিছু নয়। বিশ্বায়নের খোলা হাওয়ায় বাজার অর্থনীতি নির্ভর ভারতবর্ষে এই সাত দশকের স্বাধীনতার ৭৫ শতাংশ ডিসকাউন্টের মজা বা হুল্লোড় ছাড়া যেন আর কিছুই নয়। তাই ১৫ আগস্ট দিনটি শপিং মলগুলির কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। অন্তত ‘সেলিব্রেট’ করার ক্ষেত্রে।
শুধু তাই নয়, গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষে স্বাধীনতা তো দেওয়ার নয়। নেওয়ার। তাই একটু ভিন্নভাবে বলা যায়— স্বাধীনতার এই প্লাটিনাম জুবিলি অত্যন্ত এক স্বতন্ত্র পরিস্থিতির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আমাদের। সেই পরিস্থিতি অবশ্যই দেশের কাছে অত্যন্ত বিপজ্জনক। স্বাধীনতার সাত দশকে ভারতের জনসংখ্যা ১৩২ কোটি বিপজ্জনক রেখা অতিক্রম করে গিয়েছে। অথচ আমাদের দেশ এখনও সাধারণ মানুষের জন্য অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান, শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে পুরোপুরি সফল হতে পারেনি। ফলে স্বাধীনতা আজ বহু ক্ষেত্রে পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচন করতে পারেনি। শান্তি-শৃঙ্খলা ও জীবনের মূল্যবোধ আজ সত্যিই এক কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন।
১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা লাভের পেছনে ছিল দু’শো বছরের আপসহীন সংগ্রামের এক কঠিন আত্মত্যাগ। শুধু কংগ্রেস পরিচালিত অহিংস আন্দোলন নয়, চরমপন্থীদের হিংসাত্মক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, ফরাজি আন্দোলন, ওয়াহাবি আন্দোলন, নীল বিদ্রোহ, নৌ বিদ্রোহ, সর্বোপরি শ্রমিক-কৃষক-সৈনিকের গণঅভ্যুত্থান— প্রতিটি আন্দোলনের সমান গুরুত্ব রয়েছে স্বাধীনতা লাভের পেছনে।
হ্যাঁ, স্বাধীনতার পর ভারত যখন বেছে নিল সংসদীয় গণতন্ত্রের পথ, তখন বিশ্বের তাবড় তাবড় দেশগুলির ভ্রু কুঞ্চিত হয়েছিল। তাদের আশঙ্কা ছিল, একটা দেশের দুই তৃতীয়াংশ মানুষ যেখানে নিরক্ষর সেখানে সংসদীয় গণতন্ত্র কখনও সফল হতে পারে না। ব্যর্থ হবে। ভেঙে পড়বে ভারতের শাসন ব্যবস্থা। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, বাস্তবে তা হল না। ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক বোধ এতটাই প্রখর যে ,তথাকথিত ধনীর দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন চুপ করে গেল। অস্ত্র নয়, ঐশ্বর্য নয়, শুধুমাত্র ব্যালট বক্সের মধ্য দিয়েই একটা নীরব বিপ্লব যে ঘটানো যেতে পারে, তা গোটা বিশ্বকে দেখিয়ে দিল ভারতবর্ষ। হ্যাঁ, স্বাধীনতার বড় প্রাপ্তি এই গণতন্ত্র। যেখানে জনগণই শেষ কথা বলার অধিকারী।
দুঃখের বিষয় এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আপামর মানুষ এখনও সচেতন হয়নি। গবেষণাগারের বিজ্ঞানমনস্কতা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছয়নি। দেশের কোটি কোটি মানুষ আজও ভুগছে অপুষ্টিতে। সেই সঙ্গে রয়েছে অশিক্ষা ও অসচেতনতা। আর এরই সুযোগ নিচ্ছে চক্রান্তকারীরা। বিচ্ছিন্নতাবাদ, উগ্রপন্থা, মৌলবাদ, কামতাপুরী, মাওবাদ এবং নানা হঠকারী আন্দোলন অনেকটা অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে যেত, যদি মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজনকে মিটিয়ে দেওয়া যেত অনেক আগে।
অথচ আমাদের দেশে সম্পদের অভাব নেই। শুধু অভাব আছে সেই সম্পদের সুষম বন্টনের। অভাব আছে নীতি নির্ধারণের। সম্প্রতি সম্পদের ‘রিসোর্স’ খোঁজা হচ্ছে। অথচ বলতে দ্বিধা নেই, মানুষের চারিত্রিক সম্পদের রিসোর্স বাড়ানোর কোনও চেষ্টাই নেই। সেই সঙ্গে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন ও রাজনীতিকদের লাগাম ছাড়া দুর্নীতি দেশের পক্ষে হিতকর নয়। এখানেই আমাদের রাজনীতিক চূড়ান্ত ব্যর্থতা।
কাশ্মীর সমস্যা চিরদিনের একটি অমীমাংসিত সমস্যা। যে সীমান্তরেখা দেশবিভাগের সময় নির্ধারিত হয়েছিল, আজ সেই সীমান্তরেখা ইসলামাবাদ মানতে রাজি নয়। তাদের দাবি, কাশ্মীরের সিংহভাগ ভূমিপুত্র ইসলাম ধর্মাবলম্বী। সুতরাং ভূস্বর্গ কাশ্মীর তাদের সীমানার মধ্যে চাই।
এদিকে বিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে ভারতবর্ষের রাজ্য রাজনীতিতে এক অস্থিরতার পটভূমি সূচিত হয়েছে। উগ্রপন্থীর নির্মম আঘাতে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি বুলেটবিদ্ধ হয়েছেন। তাঁর পুত্র রাজীব গান্ধিও অকালে চলে গিয়েছেন। এখন ভারতের পূর্বাঞ্চলে ক্ষোভ। পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবি উঠেছে। ক্ষোভ ত্রিপুরার উপজাতিদের। রক্ত ঝরছে সর্বত্র। অসম স্বতন্ত্র হতে চায়। পঞ্জাবের অকালি দল চায় আলাদা হতে। উল্লেখ্য, মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার আগে পর্যন্ত কয়েকটি লোকসভা নির্বাচনে কোনও একক দল সরকার গঠনে সক্ষম হয়নি। ফলে কেন্দ্রে দুর্বল সরকারের সুযোগ নিয়ে চলেছে মাওবাদী, উগ্রপন্থী সংগঠন সহ বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক দল ও ব্যক্তিবর্গ। এখন একদিকে পাকিস্তান অন্যদিকে চিন— সুকৌশলে যুদ্ধের হুঙ্কার ছাড়ছে। এখন দেখার, মোদি সরকার বিষয়টি কীভাবে মোকাবিলা করে। তাই ভারতের রাজনৈতিক অস্থিরতা আমাদের ভাবিয়ে তুলছে।
অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে জাতীয় সংহতি আজ সত্যিই বিপন্ন। সাম্প্রদায়িকতা আজ দিকে দিকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। গোটা ভারতবর্ষ আজ রাজনীতি ও জাতপাতের লড়াইয়ে মেতে উঠেছে। অন্যদিকে, সীমান্ত রাজ্যগুলিতে পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গিয়েছে রাষ্ট্রবিরোধী সন্ত্রাসবাদের আবির্ভাব। কাশ্মীরের কথা আগেই বলেছি। পঞ্জাব, অসম। ত্রিপুরা ও ঝাড়খণ্ড আজ অগ্নিগর্ভ ও রক্তাক্ত। ঘর ও বাইরের ‘আশীর্বাদপুষ্ট’ সন্ত্রাসবাদীরা হত্যা, লুণ্ঠন, গৃহদাহ ও জাতীয় সম্পদ ক্ষয়কে হাতিয়ার করে ভারতের জাতীয় সংহতি নষ্ট করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষে ঐক্য ও চেতনার এ এক বিপজ্জনক পরিস্থিতি। ভারতকে অতি সত্বর এই বিপজ্জনক পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতেই হবে।
স্বাধীনতা পরবর্তীতে ২০১৬-র নভেম্বরে কেন্দ্রের নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত দেশ জুড়ে সোরগোল ফেলে দিয়েছিল। নোট বাতিল ঘোষণার সময় তিনটি সম্ভাব্য লাভের কথা বলা হয়েছিল। প্রথমত, এর ফলে কালো টাকা ধরা পড়বে এবং দুর্নীতি দূর হবে। দ্বিতীয়ত, জাল টাকার সমস্যা দূর হবে। তৃতীয়ত, জাল টাকার সমস্যা কমলে নাকি আতঙ্কবাদীদের অর্থের জোগান বন্ধ হবে। ফলে কাশ্মীর সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে।
অথচ নোট বাতিল ঘোষণার প্রায় ৬ বছর অতিক্রান্ত হল। বিশেষজ্ঞ মহল যে মন্দার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল, সেই মন্দার কালো ছায়া দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রেকে গ্রাস করেছে। হঠাৎ কোনও প্রস্তুতি ছাড়াই একটা অর্থনীতি থেকে ৮৬ শতাংশ নগদ ক্রয় ক্ষমতা কেড়ে নিলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। অর্থনীতির চাহিদা ও জোগান দুটি স্তরেই বড়সড় বিপর্যয় বা ধাক্কা লাগে। যার ফলে অর্থনীতির গতি রুদ্ধ হয়েছে। অত্যন্ত অপটূভাবে সমস্যা মোকাবিলার চেষ্টা করা হয়েছে। সরকার মানুষের দুর্দশাকে লঘু করে দেখাতে চাইল এবং এই সমস্যা লাঘবের জন্য তেমন কোনও ইতিবাচক ব্যবস্থা গ্রহণ করল না। মানুষের ভোগান্তির সীমা রইল না। যে ধাক্কা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি দেশের মানুষ।
অন্যান্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা নীরব থাকলেও একমাত্র পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গোটা দেশজুড়ে নোট বাতিলের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁর বক্তব্যছিল, ‘কোনও গণতান্ত্রিক সরকার মানুষের নিজস্ব টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তোলার ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ আরোপ করতে পারে না। কোনও ব্যক্তি কেনাকাটা নগদে করবেন না ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে করবেন— সেটি নির্বাচনের দায়িত্ব সেই ব্যক্তির থাকা উচিত। কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব সেই অপশন নির্বাচনের উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তোলা।‘
কোভিড পরিস্থিতি আসার ফলে দেশে গড়ে ওঠা আন্দোলনগুলিকে দমন করতেও সরকারের সুবিধা হয়। এনআরসি, সিএএ, এনপিআর-এর মতো বিভাজনমূলক আইনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা দেশজুড়ে আন্দোলন মোদি সরকারকে ধাক্কা দিয়েছিল। দিল্লির শাহিনবাগে চলা ধর্না হয়ে উঠেছিল আন্দোলনের ভরকেন্দ্র। কোভিড পরিস্থিতি এই ধর্না তুলে দেওয়ার অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করে ও মোদি সরকারের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে।
স্বাধীনোত্তর পর্বে দেশের সবচেয়ে বিতর্কিত ও উল্লেখযোগ্য ইস্যু কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের এনআরসি, সিএএ ও এনপিআর। মোদি সরকারের এই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ হঠকারী। মুসলিম নাগরিকরা এই আইন নিয়ে বিশেষভাবে ভাবিত এবং তা নিয়ে চলছে দেশজোড়া বিতর্ক। কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, ‘গোটা দেশে সিএএ, এনআরসি ও এনপিআর লাগু হবে।‘
ভারতের রেজিস্ট্র্রার জেনারেল দফতর ইতিমধ্যেই ১১২টি গ্রাম ৪০টি ছোট-বড় শহরে পাইলট প্রজেক্ট চালু করেছে। যার মধ্যে ৫২১৮টি ব্লকে তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। সিএএ এনপিআর এনআরসির কোনও প্রয়োজন নেই ভারতে, এই কথা উল্লেখ করে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন ১০৬জন অবসরপ্রাপ্ত আমলা। তাঁদের কথায়, সিএএ, এনআরসি ও এনপিআর অপ্রয়োজনীয় এবং তা অপব্যয়ও বটে। ফলে বিপুলসংখ্যক মানুষ অসুবিধায় পড়বেন। এবং যে অর্থ ব্যয় হবে তা গরিব ও অন্যান্য অসহায় ও অনগ্রসর মানুষের কল্যাণের জন্য প্রকল্পে খরচ করার পক্ষে মত দিয়েছেন তাঁরা।
এই আইনে সজ্ঞানে মুসলিম সম্প্রদায়কে বাদ দেওয়া হয়েছে। যারা ভারতের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ। অর্থনৈতিক মন্দার পরিস্থিতিতে যখন দেশের সেদিকেই সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়া দরকার, তখন এমন পরিস্থিতি তৈরি করে বিজেপি সরকার জনতার সঙ্গে সরাসরি মুখোমুখি সংঘর্ষ রাস্তায় নামিয়ে আনতে বাধ্য করেছে। অধিকাংশ রাজ্য সরকারি সিএএ, এনআরসি ও এনপিআর মেনে নেয়নি। ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোয় এমন পরিস্থিতি মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয়। এর ফলে ভারতের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গেও সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটবে।
এদিকে ২০১৭-র জুলাই থেকে দেশজুড়ে চালু হয়েছে পণ্য ও পরিষেবা কর (জিএসটি)। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ি প্রথম অভিন্ন পণ্য ও পরিষেবা কর পদ্ধতি চালুর বিষয়ে সওয়াল করেছিলেন। কারণ, আর্থিকভাবে উন্নত যে কোনও দেশেই এই পদ্ধতি চলে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় এই বিলে স্বাক্ষর করেছিলেন। এখন এই পণ্য ও পরিষেবা করের সুফল কবে মিলবে, কতটা মিলবে, আদৌ মিলবে কিনা— তা নিয়ে ধন্দে তাবড় অর্থনীতিবিদরা।
গোটা দেশ তথা সারা বিশ্ব প্রায় তিন বছর কোভিড অতিমারির পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। বিজেপি সরকার এই পরিস্থিতি মোকাবিলার বদলে অতিমারির সুযোগ নিয়ে কীভাবে জনগণের সমস্ত অধিকার কেড়ে নেওয়া যায়, কীভাবে একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে সংস্কারগুলিকে দ্রুত সম্পন্ন করে নেওয়া যায় তারও চেষ্টা করে গিয়েছে। তীব্র গতিতে বেসরকারিকরণ ও দীর্ঘ লড়াইয়ের মাধ্যমে জনগণ যে অধিকারগুলি অর্জন করেছিল, তাকে হরণ করার উদগ্র প্রচেষ্টা এই সময়েই তীব্রতর করেছে।
এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্র সরকার কৃষকদের জন্য তিনটি বিল আনে। (১) ফার্মার্স প্রডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স (প্রমোশন অ্যান্ড ফেসিলিটেশন) বিল ২০২০। (২) ফারমার্স (এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড প্রোটেকশন) এগ্রিমেন্ট অফ প্রাইস অ্যাসিওরেন্স অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিসেস বিল ২০২০। (৩) এসেনসিয়াল কমোডিটিস (আমেন্ডমেন্ট) বিল বা অত্যাবশ্যক পণ্য আইন। দ্বিতীয় বিলটি লোকসভায় ও রাজ্যসভায় যথাক্রমে ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ও ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০ পাশ হওয়ার পর ২৭ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাভ করায় তা বর্তমানে আইনে পরিণত হয়েছে। ঠিক এই পরিস্থিতির মধ্যেই গোটা দেশ জুড়ে শুরু হয় ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন। দিল্লির সঙ্গে পঞ্জাব, হরিয়ানা ও হিমাচলপ্রদেশের সংযোগকারী জাতীয় সড়কে চলে অবস্থান বিক্ষোভ। যার ভরকেন্দ্র ছিল রাজধানীর উত্তর প্রান্ত। সাতশো’র বেশি কৃষকের প্রাণের বিনিময়ে শেষপর্যন্ত কেন্দ্র সরকার কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। ফলে ঐতিহাসিক কৃষক সংগ্রাম জয়যুক্ত হয়।
গোটা বিশ্বে করোনা পরিস্থিতি এখনও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসেনি। দেশের অর্থনীতির বেহাল অবস্থা। রাজ্যের আর্থিক অবস্থাও সংকটময়। বিশ্বের তাবড় তাবড় অর্থনীতিবিদরা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, করোনা-উত্তর পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হবে। হয়েছেও তাই। মানুষ চাকরি হারিয়েছে। নতুন নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। কর্মসংস্থান কমেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ধাক্কা খেয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। বিনা চিকিৎসায় মানুষ মারা গিয়েছে। এখনও যাচ্ছে। অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক কর্মীদের সমস্যা আরও ভয়াবহ হয়েছে। সংকট দেখা দিয়েছে সমাজের সর্বস্তরে। মানুষ এখনও অর্ধাহারে রয়েছে। অনাহার রয়েছে। বেকারত্ব বেড়েছে। নতুন করে তেমন কোনও কর্মসংস্থান হয়নি। কর্মচ্যুতি ঘটেছে বহুলাংশে। অথচ সরকারের কোনও হেলদোল নেই। দেশের বেকারত্ব এই সময় আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।
কোভিড পরিস্থিতির সময়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার বলেছিল, শ্রমিকরা সবেতন ছুটি পাবেন। কিন্তু কোনও সরকারই বেসরকারি মালিকদের লকডাউন পিরিয়ডের জন্য বেতন দিতে বাধ্য করেনি। অসংগঠিত শ্রমিকদের ভাতা দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেও কেউই ভাতা পাননি। খেতমজুর, ভূমিহীন ও বেকার যুবকদের অবস্থা মারাত্মক। রাজ্যে কাজ না পেয়ে দলে দলে ভিনরাজ্যে পাড়ি জমাতে বাধ্য হয় তাঁরা। এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর একটি নির্বাচনী ঘোষণা ছিল, তাঁর সরকার ক্ষমতায় এলে যুবকদের ভিনরাজ্যে পাড়ি দিতে হবে না। রাজ্যেই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। তৃতীয় বারের জন্য সরকার ক্ষমতায় এল। কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি আজও পূরণ হয়নি।
করোনা পরিস্থিতির পর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য আকাশছোঁয়া হয়েছে। জ্বালানির দাম কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে। পেট্রোল, ডিজেলের দাম লিটার প্রতি একশো টাকা অতিক্রম করেছে। রান্নার গ্যাস এখন ১২০০ টাকা ছুঁই ছুঁই। তবুও সরকার নির্বিকার। উদাসীন।
এত কিছু পদক্ষেপ সত্ত্বেও দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অতীব মন্থর। অথচ জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি দ্রুত। তাই কর্মসংস্থানের অভাবে বেকার সমস্যা অত্যন্ত প্রকট হয়ে উঠেছে। সেইসঙ্গে পণ্যমূল্যবৃদ্ধি দুর্বিষহ আকার ধারণ করেছে। আগামী কয়েক বছরে তা উপনীত হবে এক অসহনীয় স্তরে। এক কথায়, জীবন-সংকট হয়ে উঠবে সুতীব্র। বর্তমানে শিক্ষা জগতের চিত্রটাও অত্যন্ত নৈরাশ্যজনক। একদিকে সরকারি মদতে গোরক্ষকদের তাণ্ডব। অন্যদিকে, পরিকল্পিতভাবে শিক্ষায় গৈরিকীকরণের প্রচেষ্টা চলছে। তাই গোটা দেশেই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে সাংঘাতিক অবনতি হয়েছে।
এবার মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। ২৯ জুলাই,২০২০ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পৌরহিত্যে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০’ অনুমোদন করা হয়েছে। কেন্দ্রের তরফে বলা হচ্ছে, এর ফলে বিদ্যালয়ে এবং উচ্চশিক্ষাস্তরে বিপুল সংস্কারের সুযোগ তৈরি হবে। একবিংশ শতাব্দীতে এটি প্রথম শিক্ষানীতি। ৩৪ বছর আগে ১৯৮৬-র শিক্ষানীতির পরিবর্তে এটি কার্যকরী হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় সমদর্শিতা, গুণমান, আয়ত্তের মধ্যে পঠন-পাঠনের সুযোগ এবং দায়বদ্ধতার ওপর ভিত্তি করে এই নীতি তৈরি করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই দেশের অন্যান্য রাজ্যে জাতীয় শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে জোরদার বিরোধিতা চলছে। অনেক রাজ্য এখনও কেন্দ্রের এই শিক্ষানীতি মানতে নারাজ।
স্বাধীনতার এই সাত দশকে মানুষের মূল্যবোধগুলির পরিবর্তন আমাদের অত্যন্ত ব্যথিত করে। মর্মাহত করে। সমাজের শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক ধরনের অবক্ষয়িত চেতনা, কর্মসংস্কৃতির ক্ষেত্রে রুগ্ন কলকারখানা ও কর্মীদের কাজের প্রতি উদাসীনতা কোনও সমৃদ্ধ ভারত (পড়ুন ডিজিটাল ইন্ডিয়া) গঠনের ইঙ্গিত দেয় না। মানুষ ক্রমশ হারিয়ে ফেলছে তার মনুষ্যত্ব। সংকীর্ণ স্বার্থপরতায় আবদ্ধ করছে নিজেদের। সময়ানুবর্তিতা বিষয়টি সরকারি কোনও অফিসের অভিধানে লেখা নেই। কর্মবিমুখ সস্তা দরের রাজনীতি আর লাগামছাড়া দুর্নীতি আজ কেড়ে নিয়েছে মানুষের বিবেকবোধ, মূল্যবোধ। এগুলি যদি অতিসত্বর দূরীভূত না হয়— তবে নিশ্চিত যে, ভারতবর্ষের সভ্যতা-সংস্কৃতি সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার বদলে পিছিয়ে যাবে।
বিশ্বায়নের পর অর্থনীতির সমীকরণ বদলে যাওয়ায় ভারতের অর্থনীতি অনেকটা চিরাচরিত ঐতিহ্য ছেড়ে ভিন্ন পথে পরিক্রমা করছে। কিছুটা অর্থনৈতিক মুক্তি এসেছে ঠিকই। কিন্তু এই মুক্তি দেশের মধ্যে আর এক পরাধীনতাকে আহ্বান করে এনেছে। শপিংমল আর মাল্টিপ্লেক্সের দৌলতে আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। আজ ভয়ানক হয়ে উঠেছে মানবিক মূল্যবোধের মহামারি।
আমাদের রুচি, পোশাক-পরিচ্ছদ, আদব-কায়দা, খাদ্যাভ্যাস সবেতেই বিদেশি অনুকরণ। সেই সঙ্গে আছে কে কী পরবে, কে কোন খাদ্য খাবে তার ‘স্বদেশি’ ফতোয়া। আর এ এক ধরনের পরাধীনতা। দুর্বৃত্তায়ন ও সন্ত্রাসবাদের বিশ্বায়ন ঘটেছে। ঘটেছে পরিবেশের সামগ্রিক অবনমন। সর্বত্র দূষণের ছড়াছড়ি। মানসিক দূষণ তো এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা। এ থেকে উত্তীর্ণ হতে না পারলে তো আর এক পরাধীনতা। তা হলে মুক্তির পথ কোথায়?
মুক্তির পথ অবশ্যই আছে। মুক্তি মানুষের শুভবুদ্ধির উদয়, চিন্তা ও চেতনার জাগরণে। স্বাধীনতার ৭৫ বছরের পূর্তিতে আনন্দ আত্মহারা না হয়ে আমাদের আত্মবিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। এই জন্য প্রয়োজন মানুষে মানুষে প্রীতির বন্ধন রচনা করা। মানবিক মূল্যবোধ সম্পর্কে সচেতন হওয়া। স্বাধীনতা মানে শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, জরুরি হল চারিত্রিক সম্পদের উন্নয়ন। লক্ষ লক্ষ শহিদের রক্তে অর্জিত স্বাধীনতা যেন উচ্ছৃঙ্খলার নামান্তর না হয়, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। তা হলেই স্বাধীনতার প্লাটিনাম জুবিলি উদযাপনের একটা ইতিবাচক অর্থ খুঁজে পাওয়া যাবে বলে বিশ্বাস করি।