সেই সকাল থেকে বেরিয়ে গেছেন অনিমেষবাবু। স্ত্রী পরমাদেবী রাস্তায় পায়চারি করছেন। লক্ষ্য রাখছেন কখন বয়স্ক মানুষটা আসবেন। দু’বছর এমনি করে যাতায়াতে পকেট থেকে খসেছে অনেক। অবশেষ বলতে কিছু নেই।
তিনি যখন রিটায়ার্ড হন উনি শিক্ষক সমিতির ব্লক সভাপতি। ফলে প্রতিনিয়ত সভা-সমাবেশে প্রাসঙ্গিক আলোচ্য বিষয়ের উপরে ভালো বক্তব্য রাখতেন। মানুষ ওনাকে চেনেন। শিক্ষক হিসেবে আদর্শবান কিংবা ভদ্র ব্যবহার মিষ্টি কথায় পারস্পরিক আচার-আচরণে বিশেষ দায়বদ্ধ ছিলেন। আজও আছেন। শিক্ষক জীবনে দায়িত্বপূর্ণ পদে আসীন থাকলেও স্কুলে শিক্ষকতার ক্ষেত্রে কোনো ছুটি নেই। কামাই করতেন না বরঞ্চ অতিরিক্ত ক্লাশ করে মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র-ছাত্রীদের ভালো রেজাল্টের জন্য অভিভাবকমণ্ডলী, শিক্ষক মন্ডলী ও ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে অত্যন্ত সমীহ সম্মান পেতেন। তখনই নিজেকেই খুবই গর্ববোধ করতেন। ছাত্র-ছাত্রীর সুবিধা-অসুবিধা কর্ণগোচর হলেই তার সমাধান না করে বসে থাকতেন না, এমনকি বাড়িতে ফ্রিতে পড়াতেন। যাকে বলে নিবেদিতপ্রাণ। সৎ সাহসী চরিত্রবানও বটে গুণমুগ্ধরা কুশল বিনিময় করতেন।
এমন পরোপকারী অনিমেষবাবুর কর্মজীবনের শেষ ফাইলটি বন্দি হয়ে বিকাশ ভবনে গেছে। এভাবে ছয় ছয়বার কেবলই গেছে। তারপর আর সে ফাইল পাওয়া যায়নি। এই টেবিল থেকে ওই টেবিলে খোঁজ নিতে তিন বছর অতিক্রান্ত হল। আজও তাই গেছেন। যেই তিমিরে সেই তিমিরে।
সারাদিন না খাওয়ার পর অফিস থেকে ফেরার পথে খুব ক্লান্তি লাগছে। তারপর সদ্য পুত্র হারানোর বিষাদগ্রস্ততা যেন আরও মর্মাহত করেছে উভয়কে। অনিমেষকে দেখে পরমা যেন সম্বিত ফিরে পেল।
বলছে শিক্ষাদপ্তর তো পাঠিয়েছে মুখ্যমন্ত্রীকে।
তুমি একটু বিশ্রাম নাও। খাও, খেতে বসো। হাত পা ধুয়ে এসে খেতে বসলেন। অবেলায় খেয়ে বয়স্ক লোক বারান্দায় বসে খবর কাগজের পাতায় মুখ গুঁজে আছেন।
মাস তো শেষ হয়ে এলো। ভূষিমাল দোকানে আর বাকি দেবে না বলেছে। গহনা কটা যা ছিল দিয়েছ- এই পলা জোড়াটা আর কেন থাকে। যা হয় দোকানে কিছু দিয়ে হাট-বাজার এনো, না কি?
হুম আর উপায় কি আছে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বুকটা তোলপাড় করছে। গলা বুজে আসছে। এত জল কোথা থেকে আসে চোখে ভরেও জোয়ারের মতো উপচে পড়ছে।
ছেলের কথা তুমি তো কানে নিলে না।
সে বড় হয়েছে। শিক্ষিত হয়েছে। তার ভালোটা সে বুঝবে না? আমি না বলেছি কিন্তু সেতো শুনল না। ব্যাগ ভর্তি করে বাড়ি বয়ে দিয়ে আসল। এতগুলো টাকা! যেদিন দেয় সেদিনও যদি আমি জানতে পারতাম।
ছেলেকে ডক্টরেট করিয়ে উঠতে কতগুলো টাকা! অনিমেষের হার্ট অপারেশন, পরমার কিডনি স্থাপন করে শেষ সঞ্চয়টুকু নিয়ে দিয়ে দিল দালালের হাতে। কোন প্রয়োজন ছিল না। overall যার first-class সে দালালকে টাকা দিয়ে চাকরি খুঁজবে?
কথাগুলো যেন আজ এ বুকে খোঁচা মারে। সারা জীবনের স্মৃতি রোমন্থন করেন। শিক্ষক জীবনের কৃতী উজ্জল মুহূর্তের হীরা -মনি- মুক্তা নেড়ে দেখেন। স্বামী স্ত্রীর কথা ভাবেন। উভয়ের কেউ কাউকে যদি ছেড়ে অজানা ঠিকানায় যায় এই বান্ধবহীন দুনিয়ায় নিঃসঙ্গকে কে সান্ত্বনা দেবে! ছাত্র-শিক্ষক -প্রতিষ্ঠানের ভালোবাসার মেলবন্ধনে একটা সময় অতিবাহিত হয়েছে। বেলা গড়িয়েছে বেশ। যেকোনও মুহূর্তে সাঁঝের সন্ধ্যাতারা উদয় হবেই হবে। একটা ছেলে ছিল বংশপ্রদীপ রক্ষার জন্য। একবারও ভাবলো না- ও চলে গেলে সম্বলহীন মানুষগুলো কার প্রশ্রয়ে টানে ভালোবাসায় সংসারে ইতি টানবে? কার ডানায় ভর করে বেলাশেষে অস্তাচলের গোধুলী রঙ ধরিত্রীকে চুমু খাবে? প্রতিষ্ঠানে অজস্র প্রদীপে আগুন জ্বালিয়েছেন। পথের স্রোতে ব্যক্তিস্বার্থে নৈতিক দায়িত্ব পালনে যে যার মত দিশারী সংসারী দায়িত্বপ্রাপ্ত সচেতন নাগরিক তথা প্রাক্তন ছাত্র ছাত্রীরা।
কিন্তু এখন, মুখ ফুটেও বলতে পারছেন না অভাব যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট বুড়োবুড়ির সংসার। একমাত্র ভরসা সরকারি কর্মতৎপরতা যে কারণে দু’বেলা দু’মুঠো নুন ভাত জুটত।
রাজনীতির পালাবদলের কারণে অসহায় সরকারি অবসরপ্রাপ্ত অনিমেষ আর পারছেন না। টিউশনে কোনওদিন পয়সা নিতেন না। আজ নিতে হবে কিন্তু কর্মরত শিক্ষকের টিউটোরিয়ালে যে ভীড় তিনি কাকে বলবেন। নিন্দুকের অভাব নেই। ইতিমধ্যে অনেক কিছু সংসারে আসে না। মাছ -মাংস -কোনওফল, ভালো জামা -কাপড় ইত্যাদি কিছুই না। বাস্তুবাড়ি সমেত বন্ডনামা লিখে দিয়েছেন গত বছর। নির্দিষ্ট দিনের আগে আগামী কয়েক দিনের পরে ছেড়ে দিতে হবে।
খবর কাগজও পড়তে পড়তে কত ভাবনার লুকোচুরি মন ছুঁয়ে যায়। পত্রিকার দ্বিতীয় পৃষ্ঠার মাঝের কলমে ছোট্ট লেখা, “অফিস বিয়ারার চাই, বেতন ছয় হাজার,এক বছর পর বৃদ্ধি পাবে। কোনও বয়সের সীমা নেই। মহিলা পুরুষ যে কেউ চলবে। আগে আসার ভিত্তিতে সুযোগ আগেই পাবে। ঠিকানা: মহকুমা অফিস: কাকদ্বীপ, দক্ষিণ 24 পরগণা। ব্লক অধীনস্থ নাগরিক অগ্রাধিকার পাবেন।
অনিমেষ সারারাত ঘুমাননি। দু’চোখের পাতায় স্নেহের পুত্র ঘুম নিয়ে চলে গেছে। এত গুলো টাকা দিয়েছিল কলেজে অধ্যাপনা করার জন্য। এভাবে অনেকের থেকে টাকা নিয়ে অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মৃন্ময়েশ দত্ত এলাকা ছেড়ে কোথায় চলে গেছেন কেউ তার খোঁজ খবর রাখে না। টানা দু’বছর অনুসন্ধান করে যখনই পেলেই না সে ঘুমের ওষুধে চিরঘুমের দেশে চলে গেছে।
গভীররাত সারাদিনের গাড়ি জার্নিতে ক্লান্তিবোধ করছেন। নিদ্রাহীন রাত তাঁর সাথে জীবন খাতার প্রতিটি মোড়ে বসে কথা বলেছে পরমা পাশে ঘুমিয়ে ন্যাতা হয়ে বিছানায়।
কখন যে শয্যা ত্যাগ করে বাঁচার নেশাকে ধ্রুবতারা মনে করে বেরিয়ে মহাকুমা অফিসের কলাপসিবল গেটের সামনে এসে প্রথম দাঁড়িয়েছেন। দীর্ঘ সারি ধীরে ধীরে ক্রমবর্ধমান। দীর্ঘ সারি যত আরও দীর্ঘতর হয় নিজের প্রতি নিষ্ফলতার বা হতাশার ঘেন্না লাগে। নিজে প্রথম দাঁড়িয়েও অনাস্থা বোধহয়। যদি বয়স্ক লোক না চলে। অকেজো মনে হতে পারে। বয়স বেড়ে যাওয়ায় দক্ষতা তৎপরতার শ্লথগতি অনুভূত হলেও পছন্দ-অপছন্দ কর্তৃপক্ষের তথা নির্বাচক কমিটির। সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি। কেউ যেন পিছন থেকে বলল, প্রথম মাস্টারমশাই আছেন। তবু শুনে গর্ববোধ হচ্ছে মনে মনে।
বেলা দ্বিপ্রহর এরপরে ডি,এম, সরেজমিনে থেকে ইন্টারভিউ হবে।
বেকার মানুষের ভিড়ে ঠাসা কার্যালয় চত্বর। দরকার দু’জন — বিয়ারার এন্ড কুকার। এম,এ, -ডবল এম,এ, -ডক্টরেট, – এম,ফিল,- এম,এড, – ছাড়াও আরও অনেক নিম্ন ডিগ্রিধারী বেকারের দীর্ঘ সারি। পাঁচজন করে প্রবেশের অনুমতি দিয়ে সামনে রক্ষী নিয়ন্ত্রণ করছে।
অনিমেষ সাদা কালো চুলে বিবর্ণ হতাশাগ্রস্ত উপায়ন্তর হয়ে দাঁড়িয়ে । সাদা ধুতি পাঞ্জাবিতে ধূসর পরিপাটি।
অত্যন্ত ধীর স্থির হয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন। টেবিলের পাশে যেতে জিজ্ঞেস করলেন, নাম বলুন, কি করতেন, বয়স কত, কোথায় থাকেন?
আমার নাম শ্রী অনিমেশ গুপ্ত, পেশায় শিক্ষক ছিলাম, বয়স তেষট্টি , কাকদ্বীপ এলাকার বাসিন্দা।
শিক্ষাগত যোগ্যতা?
ট্রিপল এম, এ দর্শন- বাংলা -ইংরেজি।
পাশে এমএলএ, নীলাক্ষ সান্যাল বসে। বললে, উনি পূর্বতন শিক্ষক সমিতির সম্পাদক/সভাপতি, তাই না?
হ্যাঁ আপনি তো জানেন দেখছি! ধন্যবাদ।
না না এত বয়স্ক লোক হলে তো চলবে না।
ডিএম, আসন ছেড়ে এসে অনিমেষকে প্রণাম করলো।
আপনি? সে কি! আমাকে–!
হ্যাঁ। হ্যাঁ মাস্টার মশাই। আপনার মত শিক্ষক ছিলেন বলে আজ এত বড় পদে বসে আপনারই ইন্টারভিউ নিচ্ছি। আমি উদয়ন দাস। আপনার ছেলের ক্লাসমেট। অনেকদিন খুঁজেছিলাম নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থাকি বলে ঠিক পৌঁছাতে পারিনি। সব খবরই শুনেছি। নাহ, আপনি আমার বিয়ারার হবেন কেন? আমার মা-বাবা গতবছর অমরনাথ ভ্রমণ করতে গিয়ে মারা গেছেন গাড়ি এক্সিডেন্ট । এ বয়সে আর চাকরি নয়। আজ আপনাদের ঠিকানা আমার ছেলে মেয়ের ঘরে। চলুন…
উদয়ন! বাবা!!
তিনি কিন্তু বোধ করলেন।
কোনও অজুহাত আমি শুনব না। এই জন্য বিজ্ঞপ্তি খবরের কাগজে দিয়েছিলাম। আমার রেজাল্ট দেখে আমার বাবা -মার অমতে জোরপূর্বক গাঁটের পয়সা দিয়ে আপনি না ডব্লিউ বি সি এস পড়তেই দিয়েছিলেন?
অনিমেশের চিবুকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।