৪৩ বছর বয়সী মাসুদা সামার একজন শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করতেন আফগানিস্তানের একটি মন্ত্রণালয়ে। তার অফিসে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। গতবছর ১৫ আগস্ট আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন এবং রাজধানী কাবুল দখলে নিয়েছে তালেবান এমন খবরে দ্রুত বাড়ি চলে যান তিনি।
তালেবান ক্ষমতাগ্রহণের কয়েকদিন পর তাদের নির্যাতন এড়াতে তার নাম পরিবর্তনেরও অনুরোধও আসে। যে অফিসে তিনি ১৭ বছর ধরে কাজ করেছেন সেই অফিসে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায় তার।
ক্ষমতায় ফিরে আসার পর তালেবান সরকার নারীদের স্বাধীনতার ওপর বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছে। সামার বলেন, তিনি খুব অপমানিত বোধ করছেন।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, যদিও নতুন শাসনব্যবস্থায় সরাসরি সামারের মতো নারী সরকারি কর্মচারীদের বরখাস্ত করা হয়নি। তবে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশে সীমাবদ্ধতা আনা হয়েছে। তাদের বাড়িতে থাকার জন্য উল্লেখযোগ্যভাবে কম বেতন প্রদান করা হচ্ছে।
সামার বলেন, ‘আমরা চাকরিতে ফেরার জন্য গত বছর থেকে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছি। তিনি আরও বলেন, আমরা ভেবেছি যে এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য, নতুন মন্ত্রীকে রাজি করানোর জন্য শেষ পর্যন্ত কয়েকদিন ধরে মন্ত্রণালয়ের গেটে অপেক্ষা করার, কিন্তু তারা আমাদের হয়ত দূরে ঠেলে দেবে’।
পরিবারের আর্থিক সংকটের কারণে সামার নিয়মিত তার সামান্য বেতন তুলে নিচ্ছেন। কিন্তু এতেও তিনি অপমানিত বোধ করেন। তিনি বলেন, ‘ আমি যখন ব্যাংকে টাকা তুলতে যাই, প্রত্যেকবার কান্না পায়। খুব অপমান বোধ হয় টাকা নিতে। আমার কাজ করার এবং উপার্জনের কোনো অধিকার নেই। নিজেকে একজন ভিক্ষুক মনে হয়’।
সামার আরও জানান, ‘গত মাসে আমি মানবসম্পদ বিভাগ থেকে একটি ফোনকল পাই। আমাকে জিজ্ঞেস করা হয় কোনো পুরুষ সদস্য আছে কিনা আমার পরিবারে, যে আমার পরিবর্তে কাজ করতে পারবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানটির ওই কর্মকর্তা বলেন, নারী কর্মীর অভাবে ব্যাহত হচ্ছে কাজ এবং তারা তার পরিবর্তে একজন পুরুষকে নিতে চায়’ সামার উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, আমি একমাত্র আমার পরিবারে পড়ালেখা জানা। আমি প্রচুর পরিশ্রম করে ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এতো দূর পৌঁছেছি। আমি কেন আমার চাকরিটা আমার স্বামী কিংবা ভাইকে দেবো? কথাগুলো বলার সময় তার কণ্ঠ ভারী হয়ে যায়।
আর্থিক সংকট আর তালেবানের ক্রোধ এড়াতে এরই মধ্যে বেসরকারি খাতেও নারী কর্মীর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। বিশ্ব শ্রম সংস্থার (আইএলও) একটি সমীক্ষার মাধ্যমে জানা গেছে যে, আফগানিস্তানে কর্মসংস্থানে নারীর সংখ্যা অসম হারে কমেছে। তালেবান ক্ষমতা দখলের পর এর পরিমাণ হচ্ছে ১৬ শতাংশ। কর্মসংস্থানে পুরুষের সংখ্যা কমেছে ৬ শতাংশ। নারীদের এই সংখ্যা ২৮ শতাংশে পৌঁছতে পারে বলেও সতর্ক করেছে সংস্থাটি।
দেশটিতে তালেবান ক্ষমতাগ্রহণের আগে কর্মক্ষেত্রে নারী উপস্থিতি ছিল ২২ শতাংশ। যদিও বাস্তব চিত্র এখনো হতাশাজনক। তবে এটি আফগানিস্তানের মতো পিতৃতান্ত্রিক ও রক্ষণশীল সমাজে সামাজিক অগ্রগতির প্রতিফলন ঘটায়।
আফগান অর্থনীতিবিদ সায়েদা নাজাফিজাদা বলেছেন, ‘আফগানিস্তানে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ গত কয়েক দশকে ব্যাপকভাবে বেড়েছে, কিছু ক্ষেত্রে আমাদের আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের তুলনায় ভালো।’
তিনি আরও বলেন, আফগানিস্তানে কর্মজীবী নারীরাও বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট, চলাচলে বিধিনিষেধ ও প্রচলিত পিতৃতন্ত্রের কারণে বেকারত্বের চরম ধাক্কার ঝুঁকিতে রয়েছে। সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রে নারীরা তাদের ক্ষমতা হারাচ্ছে। এটি অর্থনীতির জন্য বড় বিপর্যয়। অনেক মানুষ তাদের নিত্যদিনের প্রয়োজন মেটাতে পারছে না এবং তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। তিনি আরও যোগ করেন, কর্মক্ষেত্রে নারীদের অনুপস্থিতি শুধু তাদের পরিবারের ওপর বিরুপ প্রভাব ফেলে না বরং পুরো অর্থনীতির কাঠামো ভেঙে ফেলে।
তালেবান সরকারের ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে আফগান অর্থনীতি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। নারীদের ওপর অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞার কারণে নারীকেন্দ্রিক ব্যবসাগুলোও দাঁড়াতে পারছে না।
বিশ্বব্যাংকের সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে যে পুরুষদের ২৬ শতাংশের তুলনায় আফগানিস্তানে ৪২ শতাংশ নারী মালিকানাধীন ব্যবসা সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।
সূত্র: আল-জাজিরা