প্রদীপ বিরক্ত হতে হতে এত তিক্ত হয়ে উঠল যে তার ভিতরে ধৈর্য ভেঙে একেবারে চুরমার হয়ে গেল। আর সহ্য করতে পারছে না, শেষতম অবস্থান তৈরি করার জন্য মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হল। নিজস্ব তাড়নায় বেশ অনুভব করতে পারল, সুচরিতার সঙ্গে তার সম্পর্ক দিন দিন ফলকা হয়ে উঠছে। যে সম্পর্কটা এতদিনে দুপুরের সূর্য হয়ে ওঠার কথা, সেটাই বেলা শেষে যেন অস্তমিত সূর্য। স্মৃতির সাগর নিয়ে ডুবে যেতে চায় গভীর অন্ধকারে। এর পিছনে যে সুবিমলের হাত রয়েছে, তা নিয়ে প্রদীপের মধ্যে কোনো সন্দেহ ছিল না। লোকটার প্রকৃত মতলব প্রদীপের কাছে দিন দিন আলাদিনের প্রদীপের মতো রহস্যময় হয়ে উঠছে। সুবিমল সুচরিতাকে নিয়ে ঠিক কী করতে চান, মাথায় আসছে না প্রদীপের। জোর করে কী কাউকে নেত্রী করে তোলা সম্ভব? সুচরিতাকে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গ প্রদীপের কাছে একান্তই মিথ্যে বলে মনে হচ্ছে। হঠাৎ সুচরিতার সুবিধার জন্যে সুবিমল কেন এভাবে উঠে পড়ে লাগলেন, সেই প্রশ্ন প্রদীপের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিল। আরেকটা বিপরীত চিন্তা প্রদীপকে বার বার পীড়া দিতে থাকল। সুচরিতা কেন বুঝতে পারল না যে সুবিমল তাকে সংগঠনের কাজে লাগিয়ে কেবলমাত্র নিজেকে শক্তিশালী করে তুলতে চাচ্ছেন। নিজেই রাজি না হলে সুবিমলের পক্ষে কিছুতেই সুচরিতাকে রাজনীতিতে টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত না। তা নিয়ে সুবিমলের কাছে জবাবদিহি চাওয়া কোনো যুক্তির কাজও নয়। প্রদীপের সব মানসিক বিরাগ সুচরিতার উপর আছড়ে পড়তে লাগল, কালো আকাশ থেকে প্রবল বর্ষণের ঝাঁক ঝাঁক বৃষ্টি নেমে আসার মতো। মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হল, সুচরিতার কাছে এসব জানতেই হবে।
ফাল্গুন মাস, মাদকতা পূর্ণ বিকেল, বাতাসের বুকে উতলা দোল, কোকিল নিজস্ব আনন্দ প্রকাশে উদ্বেল, প্রদীপ আনমনা হয়ে মথুরাপুর স্টেশনে দাঁড়িয়ে। কৃষ্ণচূড়া গাছের পাতার ঝুপড়িতে বসে কোকিল ডেকেই চলেছে। বিকেল পাঁচটা। তাহলে কী সুচরিতা আসবে না? নিজেই বলেছিল, পাঁচটার অনেক আগে মথুরাপুর স্টেশনে পৌঁছে যাবে। ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা বাজতে চলল। কলেজ জীবন থেকে যে সুচরিতার সঙ্গে তার পরিচয়, তাকে সে ভালো করেই চেনে, মনের অলি গলি পার হয়ে ভালোলাগার পরীক্ষণে একসময় সে সোনা হয়ে উঠতে পেরেছিল।
কতক্ষণ আগে এসেছ? পিছন থেকে সুচরিতার আন্তরিক প্রশ্ন ভেসে এল। কোনো উত্তর দিল না প্রদীপ, রাগত মুখে দাঁড়িয়ে থাকল। সুচরিতা বুঝল, দেরিতে আসার জন্যে প্রদীপের মধ্যে বিরাগ তৈরি হয়েছে, মান ভাঙাতে বলল, অমন চুপ করে থাকলে যে?
যাতে রাগ হয়, সেসব করতে এখন তোমার ভালো লাগে?
সুচরিতার মুখে মিষ্টি হাসি, এসব কী বলছ গো?
একটু আগে এলে কী মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত?
বাজারে সুবিমলদার সঙ্গে দেখা, অনেকগুলো প্রোগ্রাম জানিয়ে দিলেন, না শুনে তো আসা যায় না।
প্রদীপ আরও গম্ভীর হল। যে সুবিমলের প্রসঙ্গ শুনলে তার শরীর রি রি করে, বিলম্বের কারণ হিসেবে তাঁর নামটা বলে দিল সুচরিতা। ট্রেন এলেই উঠে বসল দুজনে। মথুরাপর থেকে জয়নগর— মাত্র একটাই স্টেশন, সময় লাগে মিনিট পাঁচেক। ট্রেন থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে বাণী সিনেমা পার হয়ে পিপলস্ ব্যাঙ্কের সামনে ফাঁকা মাঠে সবুজ ঘাসের উপর বসল। ফুর ফুরে মিষ্টি হাওয়া বয়ে চলেছে। মানসিক কাব্যে ডুবে থাকার উপযুক্ত জায়গা। সুচরিতা প্রথম নীরবতা ভাঙল প্রশ্ন করে, মেজাজটা আজ তিরিক্ষি বলে মনে হচ্ছে।
তোমার জন্যেই।
সুচরিতা হাসল, এক পলক ভাবল। —আমি আবার কী করলুম?
প্রদীপ আরও কঠোর হল, কটমট চোখে সুচরিতার মুখের দিকে তাকালো, গম্ভীর হয়ে বলল, এভাবেই সুবিমলের কাছে বিক্রি হয়ে গেলে?
তেমন কিছু দেখেছ কী?
দেখার পরেই বলছি।
একটা দৃষ্টান্ত দিতে পারবে?
জয়নগর কর্মীসভায় যাবার সংবাদ আমাকে জানাতে পারলে না কেন?
ওটা আলাদা প্রসঙ্গ।
কী রকম?
সাংগঠনিক প্রসঙ্গ নিয়ে জানতে চাইবে কেন? ওটা আমার কেরিয়ার গড়ার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। তুমি নামতে চাইলে সুবিমলদাকে বলে দেখতে পারি।
ওসব ভালো লাগে না।
তাহলে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছ কেন?
এ নিয়ে তোমার উপর কোনো জোর খাটাতে পারি না?
জুড়ে থাকলে জোর খাটাতে পারবে, না থাকলে পারবে না।
আমি অন্য কথা বলতে চাচ্ছি।
সেটাই বলে ফেলো।
সুবিমলের সঙ্গে তোমার মেলামেশা আমি পছন্দ করি না।
‘মেলামেশা’শব্দের মানে জানা আছে তো?
জানা আছে বলেই প্রতিবাদ করছি।
শালীনতাহীন শব্দ প্রয়োগ আমি পছন্দ করি না।
কী রকম?
সুবিমল রায় আমার রাজনীতির বস। সংগঠনে থাকতে গেলে এ সূত্র মেনে নিতেই হবে। তার মানে কী আমি সুবিমলবাবুর সঙ্গে…
প্রদীপ উত্তেজিত হয়ে বলল, ঠিক তাই।
মুখ সামলে কথা বললে খুশি হই।
বাস্তবে যা দেখেছি, তাই বললাম, এতে মুখ সামলানোর কী আছে?
যা খুশি তাই বলতে পারো না তুমি।
তুমি কী যা খুশি তাই করতে পারো?
সংগঠন করছি আমার নিজস্ব প্রয়োজনে।
আমার কথা ভেবে এসব করা উচিত।
জীবনে মিল গরমিলের সূত্র আলাদা, শেয়ার করলেই তবে তা বোঝা যায়। দেখছি, তোমার মধ্যে Dont care মনোভাব অনেক বড়ো হয়ে উঠেছে।
সুচরিতা রাগে দুঃখে চরম অপমানে চুপ করে থাকল। প্রদীপও আর কথা বাড়ালো না। একটা কঠিন সত্য বুঝতে পারল, সুচরিতা যেভাবে সুবিমলের ট্রাপে পড়ে গেছে, তা থেকে সহজে বের হওয়া সম্ভব নয়। প্রতিবাদ করে যে তেমন কাজ হবে, সেই আশাও ত্যাগ করল। কিছু বললে সুচরিতার গোঁ আরও বেড়ে যেতে পারে ভাবল। সিনেমা দেখার ইচ্ছা থাকলেও তা আর সুচরিতাকে বলতে পারল না। উঠে দাঁড়ালো প্রদীপ, নিজের মতো হাঁটতে শুরু করল।
সুচরিতা একদৃষ্টে চেয়ে থাকল তার দিকে, অকারণে এত জেদ দেখানোর জন্যে মনে মনে ভীষণ দুঃখ পেল। গরিব ঘর থেকে উঠে এসেছে বলেই জীবনের মূল চাহিদা মেটানোর জন্যে তাকে চেষ্টা করতেই হচ্ছে। সেটাই বুঝতে চাচ্ছে না প্রদীপ। একবার ভাবল, পিছন থেকে ডেকে আরও বুঝিয়ে বলা খুব প্রয়োজন কিন্তু তা পারল না ব্যক্তিত্বের বাধা বড়ো হয়ে ওঠার কারণে। ভীষণ নিঃসঙ্গ লাগছে। যার ডাকে সে এত দূর এল, সেই তাকে ছেড়ে চলে গেল? পশ্চাৎভূমি অতিশয় তুচ্ছ, মেনে নিলে কোনো সমস্যাই থাকত না কিন্তু তা সম্ভব হল না বলেই দুজনের মানসিক বিরোধ সমতলভূমি ছাড়িয়ে আকাশ ছুঁয়ে দিল। মনের বিরোধ বড়ো হলে তা যে কাঁচের মতো ভঙ্গুর হয়ে উঠতে পারে, সেই হিসেব জানা ছিল না প্রদীপের। কেবলমাত্র সুবিমলদার কথা ভেবে কেন যে এত বড়ো ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করল, তা মাথায় এল না সুচরিতার। কাঁটা বিদ্ধ শারীরিক যন্ত্রণার মতো মানসিক টানাপোড়েনে বার বার ক্ষতবিক্ষত হতে থাকল। যাকে সে এতদিন হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করে এসেছে সেই তাকে এত হেলাফেলা ভাবতে পারল?
ঘরে ফেরা ছাড়া সুচরিতার সামনে কোনো পথ খোলা ছিল না। পায়ে পায়ে বাণী সিনেমার সামনে এসে দাঁড়ালো। অচেনা লোকের দেদার ভিড়ভাট্টা, যে যার মতো ব্যস্ত— দাঁড়িয়ে কেউ কফি খাচ্ছে, কেউ কেউ নিজেদের গল্পে মজে রয়েছে। সুচরিতাও সেভাবেই প্রদীপের সঙ্গে সময় কাটাতে চেয়েছিল কিন্তু সম্ভব হল কই? সময়ের কাছে হার মেনে তাকেই ফিরে আসতে হচ্ছে ভিতরের দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে। ভারাক্রান্ত মনে সুচরিতা আবার হাঁটতে শুরু করল জয়নগর স্টেশনের উদ্দেশ্যে। প্রদীপের রোষাণ্বিত চোখমুখ সুচরিতার দুচোখের সামনে একবার ভেসে উঠে নিভে গেল। একটাই আক্ষেপ, টানা তিন বছর কলেজ জীবনের বন্ধু প্রদীপ তাকে ঠিকমতো চিনতেই পারল না। বুঝতে চাইল না, এলাকাতে এমন কেউ নেই যাকে ধরে সে সহজে সাকার হতে পারে।
স্টেশনে ট্রেন ঢুকল মিনিট দশেক দেরিতে। এ দৃষ্টান্ত আজকাল হামেশাই ঘটে থাকে, সুচরিতার মধ্যে তা নিয়ে কোনো বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিল না বরং ভাবল, চলতি সময়ের টানে একান্তভাবে স্বাভাবিক ঘটনা। স্টেশনে ট্রেন ঢুকলেই লেডিস কম্পার্টমেন্টে উঠে বসল। এতক্ষণ মনের গভীরে প্রদীপের জন্যে যে হাহাকার ছিল, ট্রেনের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তা প্রচণ্ড প্রদীপ বিরোধী হয়ে উঠল। বঞ্চিত মনের ধর্মে সুচরিতা না দুলে পারল না। বিশেষ করে ‘মেলামেশা’শব্দের গুরুভার তার ভিতরের একাগ্রতাকে সত্যি সত্যি এলোমেলো করে দিচ্ছিল। প্রদীপের প্রতি এতদিনের দুর্বলতার গভীর থেকে একটা বন্য ক্রোধ জন্ম নিল সুচরিতার মধ্যে। পক্ষে থেকে দাম না পেলে অনেক সময় মানুষ প্রতিপক্ষ হয়ে নিজের মূল্য খুঁজে নিতে চায়। সুচরিতা নতুন অবস্থানের চাপে সেই গণ্ডির ভিতরে ঢুকে পড়তে বাধ্য হল। সুচরিতা যেন রূপান্তরিত নতুন ব্যক্তিত্বের প্রতীক ছাড়া কিছুই নয়। সুবিমল রায় এত দুদর্ণ্ডপ্রতাপ হয়েও তার প্রতি যে দুর্বলতা পোষণ করেন, প্রদীপ তার কণামাত্র দিতে পারল না কেন? বোবা নির্বোধ তাৎক্ষণিক হৃদয়বৃত্তি বার বার জানান দিতে থাকল, প্রদীপের প্রসঙ্গ জানলেই সুবিমলবাবু তার প্রতি আরও বেশি দুর্বলতা না দেখিয়ে পারবেন না। বাজারে পটলার চায়ের দোকানের সামনে গিয়ে দেখল, সুবিমলবাবু কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে মজিয়ে গল্প করছেন ভিতরে বসে। লাভের সূক্ষ্ম হিসেব মিলে গেলে সুবিমলের মতো ভালো মানুষ আর হয় না, না মিললে সুবিমল এক দুর্দান্ত ভয়ানক মানুষ।
সুচরিতাকে দেখেই সুবিমল নিজেই বললেন, এতক্ষণ তোমাকে নিয়ে অনেক কথা হল এইসব ভাইদের সঙ্গে। তুমি যে মানসিকতায় কত বেশি দৃঢ়, তাও বোঝালাম সকলকে। কলেজ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দৃষ্টান্তও তুলে ধরলাম। মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করতেই হবে, তারপর কথা বলছি।
হ্যা প্রণব, তোমার সমস্যাটা সংক্ষেপে বলো।
আমাদের গ্রামে আরেকটা টিউবওয়েল খুব প্রয়োজন।
এভাবে ভাবছ কেন?
পূবপাড়ার লোকেদের ধারণা, যা কিছু হয়েছে, সবই পশ্চিমপাড়াতে। সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচন, প্রতিপক্ষ থেকে মজিদ সেই সুযোগ নিতে পারে। সুযোগ পেলে একমাত্র ওই পারে অপপ্রচার করে একটা ডাহা মিথ্যেকে সত্যে পরিণত করতে। সেজন্যে পূবপাড়ার লোকগুলোর মুখ বন্ধ করতে একটা নতুন টিউবওয়েল দেওয়ার ব্যবস্থা করুন।
পঞ্চায়েত সমিতিতে আবেদন জমা দাও, তারপর দেখছি। নতুন টিউবওয়েলের লট আসছে, সহজে হয়ে যেতে পারে।
আসছি দাদা।
মাসখানেক পরে খোঁজ নিও, ইতিমধ্যে সুযোগ তৈরি হলে জয়কে দিয়ে খবর পাঠিয়ে দেব।
সেই প্রত্যাশা নিয়েই ফিরছি।
সুবিমলের মুখে এক চিলতে হাসি, ঘুরে বসে সমবেত লোকগুলোকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা দল বেঁধে এসেছ কেন বলো?
সমস্যা আরও পাকিয়ে উঠেছে দাদা।
এত কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার পরেও? প্রতিপক্ষের লোকজন কী এখনও আগের মতো সতেজ রয়েছে?
তা নেই তবু থেমেও নেই। হামিদ আর তমাল মিলে ওদের নেতৃত্ব দিচ্ছে।
হ্যাঁরে, দুজনকে ডাকাতি কেসে ঢুকিয়ে দেব? অবশ্য এজন্যে যথেষ্ট হ্যাপাও সামলাতে হবে, হাজত থেকে ফিরলে তোদেরকে টার্গেট হিসেবে ভেবে নেবে। তমাল ছেলেটা ভালো নয়, পুলিশের নজর এড়িয়ে অনেক কিছু করে দিতে পারে।
ওই পথে গিয়ে লাভ নেই সুবিমলদা বরং ওদেরকে কীভাবে আরও নিস্তেজ করে ফেলা যায়, সেই ব্যবস্থা করুন। দেখবেন থানায় এসে যেন আমাদের বিরুদ্ধে কিছু করতে না পারে।
ওসির ঘাড়ে কটা মাথা আছে যে আমাকে টপকে এসব করতে যাবেন? সকলের মুখে বিজয়ের হাসি, বিস্ময় চোখে চেয়ে থাকল সুবিমলের দিকে। লোকটা পারেন বটে, থানার ওসিকে পর্যন্ত তটস্থ করে রাখতে শিখেছেন।
সুবিমলের সহাস্য বিদায় সম্ভাষণ, সাবধানে যাস, হারামিদের দিয়ে কিছু বিশ্বাস নেই।
লোকগুলো বেদবাক্যের মতো কথাগুলো গিলতে গিলতে দল বেঁধে ফিরে চলল। সুবিমল বললেন, ভিতরে এস সুচরিতা, কী মনে করে দেখা করতে এসেছ বলো?
আজ প্রদীপের সঙ্গে ভীষণ বিতণ্ডা হয়ে গেল।
এভাবে বিরোধ করতে গেলে কেন?
একটা বিশেষ কারণে বিরোধে যেতেই হল।
সুবিমলের ফর্সা মুখ লাল হয়ে উঠল।
এই সুযোগটুকুই খুঁজছিলেন। পঞ্চাশ উর্দ্ধ হলে কী হবে, গায়ের ফর্সা রঙে আর কলপ দেওয়া কালো চুলে লোকটাকে মানায় বেশ। এমনিতেই রাশভারী, সময় সুযোগ পেলে নিজেকে ভীষণ Angryman হিসাবে তুলে ধরতে পারেন। মুখ তুলে বললেন, ছেলেটা আমার সংগঠনের নতুন নেত্রীর সঙ্গে এভাবে ঝগড়া করতে সাহস দেখালো? কী হয়েছে একটু খুলে বলবে?
আমি নাকি, বাক্যটা শেষ করতে পারল না সুচরিতা।
আরে, এভাবে কেটে রাখলে কেন? মনে রেখো, নেতৃত্বের কাছে এসে সব সময় ঝেড়ে কাশতে হয়। মানুষকে নিয়েই রাজনীতির কারবার। তাদের ভিতরের খুচখাচ জানতে না পারলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেব কী করে?
আমি নাকি আপনার সঙ্গে…
সুবিমলের মুখ আরও লাল হয়ে উঠল, অস্ফুটে বললেন, এভাবেই ছেলেটা হেঁতাল গাছ হয়ে উঠেছে?
খুব অপমান বোধ করেছি সুবিমলদা।
হুমকির সুর বজায় রেখে উত্তেজিত সুবিমল উঠে দাঁড়ালেন। চলতে চলতে বললেন, কিস্সু ভেব না সুচরিতা, উপযুক্ত ব্যবস্থাই করছি। শরীরে প্রবল উত্তেজনা দেখা দিলে সুবিমল ‘কিচ্ছু’শব্দটাকে ‘কিস্সু’বলে ফানুস করে দিতে ভলোবাসেন। দোকান থেকে বের হয়ে সাইকেলে উঠে বসলেন।
আরও কিছু কথা ছিল সুবিমলদা।
ওসব পরে শুনব, আগে হেঁতাল গাছটাকে মাটিতে শোয়াতে হবে, তারপর অন্য কথা। প্যাডেলে চাপ দিয়ে হনহনিয়ে এগিয়ে চললেন।
সুচরিতা বুঝল, আবেগের বশে প্রদীপের বিরুদ্ধে এভাবে অভিযোগ করা ঠিক হয়নি। উন্মুখ হয়ে চেয়ে থাকল সুবিমলের চলে যাওয়া পথের দিকে। মনে মনে কেমন যেন ভয় পেল। সুবিমল ভীষণ দুর্দন্ড প্রকৃতির মানুষ, প্রদীপকে কোনোরকম ক্ষতি করে দেবে নাতো? হেঁতাল গাছ, মাটিতে শুইয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গ সুচরিতাকে ভয়ানক ত্রস্ত করে তুলল। সুবিমল ততক্ষণে বাজার ছাড়িয়ে পাশের গ্রামে ঢুকে পড়েছেন। একটা ভাঙ্গাচোরা বাড়ির সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। এখানে মাঝে মাঝে রাত কাটানো নিয়ে তাঁর যথেষ্ট বদনাম রয়েছে কিন্তু গ্রামীণ উন্নয়নের কথা ভেবে এ নিয়ে কেউ মুখে রা কাটে না। নিজের ক্যারিশমায় সুবিমল নিজস্ব অবৈধ সম্পর্ককে মানুষের গা সোয়া করে তুলতে পেরেছেন। সংসারের হতচ্ছাড়িটা চলে যাবার পর থেকেই শরীরের যন্ত্রণা লাঘব করতে এভাবেই একটু আধটু সময় ব্যয় করতেই হয়। গ্রামীণ মানুষ প্রসঙ্গটাকে সুবিমলের নানা উন্নয়ন যজ্ঞের একটা অংশ হিসাবে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে।
সাইকেলের বেল বাজানোর শব্দ শুনে পঞ্চাশ উর্দ্ধ এক বিধবা বের হয়ে এসে বলল, কোথায় বসতে দিই বলুন তো?
এসব নিয়ে ভাবছ কেন? মেয়ে কোথায় বলো? একটা ভালো প্লট পেয়েছি, মনে হচ্ছে সুরাহা করে দিতে পারব।
মেয়েকে নিয়ে বড়ো চিন্তায় আছি রায়বাবু, কদিন পরে এসব তো জানাজানি হবেই, সমাজে মুখ দেখাবো কী করে?
সুবিমলের রাগ দেখানো কথা, ওসব বাজে কথা রাখো, যা বলছি মন দিয়ে শোনো। পরশু রবিবার মেয়ের ব্যাপার নিয়ে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে সালিশি ডাকার ব্যবস্থা করো।
সাধারণ ডেকো দিয়ে ডাকব তো?
না হলে গ্রামের লোকজন আসবে কেন? মালতি কোথায়? ওর সঙ্গে একটু কথা বলতে হবে।
এই তো এখানে ছিল, ডাকতে শুরু করল, ও মালতি, গেলি কোথায় রে, রায়বাবু একটু ডাকছেন।
সুবিমল নিজেই মালতির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, সবকিছু বুঝিয়ে বললেন। শেষ প্রশ্ন, কী, রাজি তো?
মানিয়ে নিতে পারব কী?
আমি সঙ্গে রয়েছি।
তাহলে আর ভয় কী। মালতি একটু হেসে উঠে বলল, আপনি সঙ্গে ছিলেন বলেই তো আমার মতো হাতভাগিনীকে এত বড়ো সালিশির মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
এখন বাজে ফাজলামির সময় নেই রে। যা বললুম, মনে রাখবি। ঠিক ঠিক বলতে পারলে তোর কপালে ফুল ফুটবে।
মালতি মাথা নাড়ল, সুবিমল আর দেরি করলেন না, সাইকেলে উঠে বসলেন, এগিয়ে চলতে চলতে বিড়বিড় করে বললেন, বুঝুক বাছাধন, সাপের লেজে পা দিলে কীভাবে ছোবল খেতে হয়।
থানার সামনে পৌঁছাতে মিনিট দশেক গেল। পাশে চেয়ে দেখলেন, রঘু বড়ো নিমগাছে শরীর ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সুবিমলের সচকিত প্রশ্ন, এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস যে?
বড়বাবু ডেকে পাঠিয়েছেন।
আমাকে না জানিয়ে এলি কেন?
আসার পথে আপনার বাড়িতে গিয়েছিলুম, দেখতে না পেয়ে ভয়ে এখানে চলে এলুম যদি বড়বাবু রেগেমেগে খারাপ কিছু করে বসেন।
জেনে রাখিস, আমি সঙ্গে থাকলে তোকে ছোঁয়ার ক্ষমতা ওই ওসি সাবের নেই। কত দেখলুম, এ ব্যাটা তো নতুন এসেছেন।
থানায় ঢুকলে সুবিমল সত্যি সত্যি অন্য মানুষে পরিণত হয়ে যান। শুধু সিরিয়াস নয়, নিজস্ব হুমকি বজায় রেখে তালে তালে কথা বলেন, ভিতরে রাজনীতির সূক্ষ্ম সূত্র লুকিয়ে থাকে যা ওসির পক্ষে টপকে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। মর্মে মর্মে বুঝতে পারেন, সুবিমলের সঙ্গে বিপুল জনসমর্থন রয়েছে, বিরুদ্ধে গেলে যে কোনো সময় বিপদ আসতে পারে, এমন কী সরকারি দলের বড়ো কোনো কর্মকর্তার হুমকি ফোন এলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকে না।
ওসির ঘরে ঢুকে সেই সুবিমল চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, বড়বাবু রঘুকে ডেকেছেন কেন?
ওর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।
কে অভিযোগ করল?
জয়ন্ত দেবনাথ।
সুবিমল যেন মস্ত বড়ো সুযোগ পেয়ে গেলেন। নতুন ওসি থানায় এসেছেন মাত্র ছ’মাস, সব কিছু বুঝে উঠতে পারেন নি। সুবিমল বলতে শুরু করলেন, নিশ্চয় এসেই জেনে ফেলেছেন, রঘু জয়ন্ত দেবনাথের ছায়ায় চলে, আজও তাই চলছে। এখন এমন কী ঘটল যে রঘুর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে দেবনাথবাবুকে থানা পর্যন্ত আসতে হল। নালিশটা জানতে পারি কী?
দেবনাথবাবুর গুরুতর আহত হওয়ার পিছনে রঘুর হাত রয়েছে। বেশ কয়েকটা বাড়িও পুড়িয়ে দিয়েছে।
রঘু হাতজোড় করে বলল, কিছুই জানি নে স্যার, আমাকে শুধু শুধু ফাসানো হচ্ছে।
জানি না বললেই মুক্ত হওয়া যায় না রঘু। থানার রেকর্ডে তোমার নামে নানা ধরণের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। বাজারে তোলাবাজি থেকে শুরু করে ডাকাতি, রাহাজানি, মানুষ খুন, সম্প্রতি তোমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, তা আরও গুরুতর অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। প্রকাশ্য দিবালোকে বাজার থেকে একটা মেয়েকে তুলে নিয়ে গেছ। তার পরেও কিছু করি নি, কিছু জানি না বললে তো বিশ্বাস করা যায় না।
সুবিমল একটু হেসে উঠে বললেন, স্যার, একটা গুরুতর প্রসঙ্গকে এভাবে বাদ দিলেন কেন? এতদিন রঘু যা যা করেছে, সবই জয়ন্ত দেবনাথের নেতৃত্বে। কান ধরে টানলেই তো মাথা চলে আসতে পারে। সেই ব্যবস্থা করছেন না কেন? রঘুকে কিছু বলার আগে জয়ন্ত দেবনাথকে এ্যারেস্ট করতে পারবেন? তা না করে রঘুকে দুর্বল ভেবে তার উপর তড়পাতে শুরু করেছেন। আপনি রঘুর বিরুদ্ধে মেয়ে তুলে আনা নিয়ে যে অভিযোগ করেছেন, তা প্রমাণ করতে পারবেন? শুনে রাখুন, রঘু বাজারে যে তোলা তুলেছে, তার বারো আনা গ্রহণ করেছেন দেবনাথবাবু। পারবেন তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে? এ নিয়ে এক্ষুণি জয়ন্ত দেবনাথের নামে লিখিত complain করতে পারি, জানি আপনার তা ভালো লাগবে না, পিছনে কী রহস্য আছে, জানি না। রঘু জয়ন্ত দেবনাথের লোক, তার বাড়িতে ভাঙচুর করতে যাবে কেন? আপনি আসার পরেই তো তা জেনে ফেলেছিলেন, এখন নতুন প্রসঙ্গ টেনে এনে রঘুকে বিপদে ফেলতে চাচ্ছেন কেন?
এত সহজে রঘুকে বিশ্বাস করা যায় না সুবিমলবাবু।
এতদিন ধরে যে ছেলেটা জয়ন্ত দেবনাথের তলপিবাহক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করল, সেই বাস্তবতাকে আপনি অবিশ্বাস করতে চাচ্ছেন? ওর তাৎক্ষণিক সাইকোলজি নিয়ে এতটুকু ভাববেন না? সদ্য বিয়ে করেছে, ঘরে সুন্দরী বউ, তাকে সময় না দিয়ে রাত জেগে ক্রিমিনাল ফাংশনে জড়াতে যাবে কেন?
জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়াকে আপনি বিয়ে বলছেন?
ভুল শুনেছেন আপনি।
অনেক লোকের সামনে এ ঘটনা ঘটেছে।
ভালোবাসার লোককে হাত ধরে হাঁটলেই বুঝি জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়?
তাহলে রঘু মেয়েটাকে বাজার থেকে তুলে নিয়ে যায় নি?
সেটাই আপনাকে প্রমাণ করতে হবে। রঘুর বউ এ অভিযোগ অস্বীকার করলে আপনার মুখরক্ষা হবে তো?
থমকে যেতে বাধ্য হলেন ওসি। ভালো করেই জানেন, সুবিমল নেতৃত্ব দিয়ে খুব সহজে সাতকে সত্তর করে দিতে পারেন। ভয়ানক কূটকৌশলী। রঘুর বউকে দিয়ে রঘুর পক্ষে বিবৃতি দেওয়াতে পারলেই সব অভিযোগ ফানুস হয়ে উবে যাবে।
সুবিমল দম্ভভরে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আসছি বড়বাবু। দয়া করে কিছু মনে হলে একান্ত আপন ভেবে আমার সঙ্গে পরামর্শ করবেন। ভুলে যাবেন না, আপনাকে যথাযথ মর্যাদা দিতে সব সময় স্যার সম্বোধন করি। বাংলা অর্থ ‘মহাশয়’ অথচ আমাকে না জানিয়ে রঘুকে থানায় ডেকে পাঠালেন? শেষ পর্যন্ত জয়ন্ত দেবনাথকে ফেবার করতে গিয়ে আমাকে অপরাধী হিসেবে ভাবতে শুরু করলেন। কেন ভুলে যাচ্ছেন, অকারণে রঘু হয়রানি হলে আমি আপনি ওর বউএর চোখে বাস্তবে অপরাধী হয়ে যেতে পারি। দয়া করে এ ভুল করবেন না।
ওসি গুম মুখে বসে থাকলেন, সিলিং-এর দিকে দুচোখ রেখে নতুন পরিস্থিতির মূল্যায়ন বুঝে নিতে চাচ্ছেন। গত বর্ষায় প্রবল বর্ষণে ছাদে জল জমার ফলে সিলিং এর কিছু অংশ বসে গিয়েছিল, তাতেই ছোপ ছোপ দাগ পড়েছে।
রঘুকে সঙ্গে নিয়ে সুবিমল থানার বাইরে চলে এলেন, পরম পরিতৃপ্তি রঘুর মুখে। কত কী বলতে চাইলেও তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারল না। ক্রিমিনালদের হাত চলে বেশি, মুখ চলে কম, রঘু তা বেশ আয়ত্ত করে ফেলেছিল। সুবিমলের সহাস্য মন্তব্য, কেমন দিলাম রে?
গুরু, এ কেবল আপনার পক্ষেই সম্ভব।
ওরে, কড়া ডোজ দিলেই তবে ওসির মুখ বন্ধ করা সম্ভব।
রঘু আবেগে গদগদ হয়ে গেল। সুবিমল বললেন, এখন জয়ন্ত দেবনাথকে ঠিকমতো চিনতে পারছিস তো? পাক্কা হারামি। এতদিন তোর কাঁধে ভর দিয়ে যে লোকটা হাটে বাজারে তম্বি দেখিয়ে এলেন, তাঁর ভিতরে এতটুকু কৃতজ্ঞতা থাকবে না? চুপ করে থাকলেই তো ল্যাটা চুকে যেত, তা না করে তোর বিরুদ্ধে গান গাইতে থানা পর্যন্ত চলে এলেন? ওঁর মধ্যে বোধভাষ্যি বলে কিছু নেই রে, রাজনীতিকে দালালির পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছেন মাত্র।
রঘু মন্ত্রশিষ্যের মতো কথাগুলো গিলছিল। সুবিমল সাবধান করে দিয়ে বললেন, খুব সন্তর্পনে বাড়িতে ফিরে যা। একা একা চলবি নে, দেবনাথকে এতটুকু বিশ্বাস করা যায় না। আমাকে একটু বাজারে যেতে হবে, জয় আসবে পটলার দোকানে, সারাদিনের খোঁজখবর নিতে হবে ওর কাছ থেকে। আরেকটা কথা তোকে শুনিয়ে রাখি, হঠাৎ বিপদ আপদ এলে আমাকে না পেলে জয়কে ডেকে নিবি। ওর ক্যারিশমা অসাধারণ।
সাইকেলে চেপে বসলেন সুবিমল, মাথার ভিতরে চিন্তার জট। রঘুকে ধরে রাখতে পারলে খটিরবাজার এলাকায় নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি যে বাড়িয়ে নেওয়া সম্ভব, তা বেশ বুঝতে পারছেন। বাজারে ঢুকে চা দোকানের সামনে গিয়ে দেখলেন, জয় তাঁর জন্যে অপেক্ষায় রয়েছে।
হ্যাঁরে, কতক্ষণ আগে এসেছিস?
একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর আছে গুরু।
এত রাতে আবার খবর কী?
জয় সুবিমলের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, আপনি ছিলেন না, ঢোলা লক্ষ্মীনারায়ণপুর থেকে প্রতাপ এসেছিল আপনার সঙ্গে দেখা করতে, বাধ্য হয়ে আমাকে সবকিছু বলে গেছে।
কখন শুরু হবে তা কী কিছু বলল?
কাল সকাল না হতেই শুরু হবে।
খুব রিস্কের, পারবে প্রতাপরা?
আজ থেকে বাইরের লোকজন এসে জড়ো হচ্ছে এখানে ওখানে।
সাবধানে করতে বলেছিস তো?
যা বলার সব বলে দিয়েছি।
নিজের তৈরি করা প্লট, আর খুলে বলতে হল না। জয়কে বললেন, এখনিই একবার রামজীবনপুরে গেলে ভালো হয়।
জয় সুবিমলের দিকে চেয়ে থাকল।
বুঝতে পারলিনে? লক্ষ্মীনারায়ণপুরে মফিজুলের জামাইয়ের বাড়ি। ওকে পাঠিয়ে দিলে দর্শক হিসেবে সব কিছু দেখে ফিরতে পারবে। সম্ভব হলে মফিজুলের সঙ্গে আরেকজনকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
জয়ের উদাসীন উত্তর, তাহলে তাই করুন।
মনে হচ্ছে, ভয় পেয়েছিস?
ঠিক ধরেছেন।
বিভাজন আর এ্যাকশন ছাড়া সুন্দরবনে সংগঠন টিকিয়ে রাখার বিকল্প রাস্তা নেইরে। অন্য পথে হেঁটে দেখেছি, তাতে তেমন কাজ হয় নি। লোকজনকে চাপে রাখলেই তবে ঝুলে থাকবে, মানসিক প্রেসারে থাকতে থাকতে এভাবেই সকলে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছে।
জয়ের আনমনা উত্তর, তাহলে এখন রামজীবনপুরে যাচ্ছেন?
আমার সঙ্গে যাবি?
শরীরটা আজ ভালো নেই।
ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছিস তো? সুবিমলের মুখে সেই রহস্যঘন হাসি, সাইকেলে উঠে বসলেন, প্যাডেলে পর পর চাপ দিয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছেন, নিজেকে রাতের বাজপাখি ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারছেন না। সাইকেলের গতির টানে মনে হচ্ছে, বয়স অনেকখানি কমে গেছে।
চা-দোকানদার পটলা চমকে না উঠে পারল না, দুচোখ খাড়া করে চেয়ে থাকল জয়ের দিকে। পটলার শরীরে অভিনব কম্পন, জটিল মুহূর্তে সুবিমল বিষধর কেউটে হয়ে এত বিষ ঢালতে পারেন যে প্রতিপক্ষের প্রাণ ওষ্ঠাগত না হয়ে পারে না।
রাত নটা। বাড়িতে ফিরেও পটলা ভিতরের কাঁপুনি থামাতে পারছে না। দোকানের ঝাঁপ ফেলে পিছনে তাকিয়ে দেখেছিল, একটা পুলিশ ভ্যান ভোঁ করে বেরিয়ে গেল। পটলার বুকের গভীরে কেমন যেন ঝড় বয়ে চলেছে, ঘুম আসছে না দুচোখে। তাহলে কী পুলিশের উপস্থিতিতে ঘটনাটা ঘটবে? ভয়ে আঁৎকে উঠল পটলা। যে গ্রামের দুর্ঘটনা নিয়ে টানা তিন মাস এত তোলপাড়, সেই ঘটনার সঙ্গে পটলার বন্ধুর ছেলে পবিত্র জড়িয়ে। ছেলেটার অকাল মৃত্যু অপেক্ষা করে নেই তো? চরম দুশ্চিন্তার ভাঁজ পটলার কপালে, কিছুতেই ঘুম এল না, জেগে থাকল শোবার ঘরে, বুকের গভীরে এক অদ্ভুত অস্থিরতা। দোকানে এলেই পবিত্র প্রশ্ন করত, কাকু, বেচাকেনা ভালো হচ্ছে তো? একেবারে নিকট আত্মীয়ের মতো।
পরের দিন সকালে দোকান খুলতে মন চাচ্ছে না। পবিত্রর কথা বার বার মনে পড়ছে কিন্তু বেলা বাড়তেই ভিতরের কৌতূহলে পটলাকে দোকানে আসতেই হল। সাইকেল নিয়ে আসার পথে ভাবতে বাধ্য হল, নিশ্চয় এতক্ষণ সেই দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। থানার সামনে এসে দাঁড়ালো, বুকের ভিতরে চাপা উত্তেজনা। একটু পরে দুচোখ বড়ো বড়ো করে দেখল, দুটো মেসিন-ভ্যানে লোড হয়ে লাশগুলো আসছে, ছোপ ছোপ রক্ত চুইয়ে পড়ছে রাস্তায়। পটলার মস্তিষ্কে বিদ্যুতের মতো ঝিলিক খেলে গেল। পিছনে আসা ভ্যানটার একপাশে নিথর দেহে শুয়ে আছে বন্ধুর ছেলে পবিত্র। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল পটলা। আবেগে দুলতে লাগল, একবার ছুঁয়ে দেখতে খুব করে মন চাচ্ছে কিন্তু আইনের ভয়ে সেই মানসিক উচ্ছ্বাসে সাড়া দিতে পারল না। পুলিশের লোকজন এসে লাশগুলো নামাতে শুরু করল ভ্যান থেকে। পবিত্রকে ছুঁয়ে দেখার উদ্বেলতা পটলার মধ্যে দ্বিগুণ হয়ে উঠছে। লাশ রাখা ঘরে বডিগুলো ঢুকে গেলে আর দেখা সম্ভব হবে না। পিছন থেকে পরাশর এসে বলল, তোর বন্ধুর ছেলে না?
কোনো উত্তর দিল না পটলা, ভাঙা সাইকেলে বাড়ির পথে এগিয়ে চলল।
কী সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেল সুবিমলের অঙ্গুলিহেলনে অথচ কেউ তা জানতেই পারল না। সমগ্র সুন্দরবন জুড়ে কূটনীতির খেলা এভাবেই এগিয়ে চলে। আম-মানুষ হানাহানি না চাইলেও নেতৃত্বের ফাঁদ থেকে বের হয়ে আসার কোনো পথ খোলা নেই তাদের সামনে। একই ট্রাডিশন চলছে তো চলছে। বিকেলে দোকান খুলতে গিয়ে পটলা শুনল, সুবিমল রায় কয়েকশো লোক নিয়ে থানা ঘেরাও করতে এসেছেন, বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু হল একটু পরে। মাইকে সুবিমলের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে, প্রশাসন সজাগ থাকলে এত বড়ো ঘটনা কিছুতেহ ঘটত না। সেই গাফিলতির দায়ে ওসিকে পদত্যাগ করতেই হবে। বড়বাবুর উদ্দেশ্যে রায়বাবুর প্রশ্ন, আমরা কী জবাব দেব পবিত্রর বাবাকে? ছেলেটা পটলাকে কাকু বলে ডাকত, অনেকবার দোকানে আসতে দেখেছি, ভেবে পাচ্ছিনে, চায়ের দোকানে ঢুকে কী বলে সান্ত্বনা দেব পটলাকে।
চলবে…