স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের সব চেয়ে বড় ট্রাজেডি হল, এই দেশে যে পেশায় সবচেয়ে বেশি মানুষ যুক্ত, সেই পেশার মানুষদেরই কোনো স্বাধীন এবং শক্তিশালী সংগঠন নাই! কাজেই সমাজ এবং রাষ্ট্রে তাঁদের সেই অর্থে কোনো গুরুত্ব কিংবা মর্যাদাও নাই! ডাক্তারের ছেলে ডাক্তার হতে চান, ইঞ্জিনিয়ারের ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ীর ছেলে ব্যবসায়ী কিন্তু কৃষকের ছেলে কৃষক হতে চান না! এমনকি কৃষকও চান না, তার ছেলে–মেয়ে কৃষক হোক! গ্রামেগঞ্জে একটা কথা প্রচলিত আছে, কৃষিকাজ হল, ভূতের খাটুনি! কিন্তু কৃষক দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর সেই ভূতের খাটুনি খেটে যাচ্ছেন! দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে আমরা যে গর্ব করি, সেই কৃতিত্বের প্রকৃত দাবীদারদেরকে কি আমরা যথাযথ মুল্যায়ন করতে পারি কিনা, সেই প্রশ্নই আজ অবান্তর হয়ে দাঁড়িয়েছে! পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রে কোথাও তাঁরা তাঁদের যোগ্য মূল্যায়ন এবং মর্যাদা পান না! এমনকি এত বিপুল সংখ্যক মানুষ যে পেশায় যুক্ত, সেই পেশার মানুষদের বিষয়ে সঠিক তথ্য-উপাত্তও আমাদের সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলিতে নাই! তার একটা সাম্প্রতিক উদহারণ দেয়, দেশে যখন করোনার টিকা কার্যক্রম শুরু হয়, অগ্রাধিকারের তালিকায় কৃষক এসেছে অনেক পরে! কিন্তু বাংলাদেশে একটা মৌসুমেও কি কোনো চাষযোগ্য জমি অনাবাদী ছিল? সেই প্রসঙ্গে নাইবা গেলাম! অগ্রাধিকারের তালিকায় কৃষকের নাম যুক্ত হবার পর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রশ্ন করা হয়, কে কৃষক সেটা কিভাবে নির্ধারিত হবে? স্বভাবতই উত্তর দেবার দায় বর্তায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপর! কৃষি মন্ত্রণালয়য়ের কাছে তো কোনো তথ্য উপাত্ত নাই, তারা দেবেন কিভাবে! যে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, কত হেক্টর জমিতে কি কি চাষ হয়েছে, কি পরিমাণ ফসল উৎপাদনের প্রত্যাশা করা হয়েছে এবং কি পরিমাণ উৎপাদিত হল, যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এই উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন, তাঁদের কোনো তথ্য কৃষি মন্ত্রণালয়ে নাই! কবিগুরুর কথা ধার করে বলতে হয়, এই মন্ত্রণালয় লইয়া আমরা কি করিব!
আমার বক্তব্যে মনে হতে পারে, আমি কৃষকের জন্য মায়া কান্না করছি! সত্যিই তাই করছি! নইলে জেলা শহরগুলি তো বটেই, খোদ ঢাকার বুকে বসবাস করা মানুষদের একটা বড় অংশের বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বজনেরা গ্রামে সরাসরি কৃষির সাথে যুক্ত! অনেক বাসাতেই গ্রামের বাড়ি থেকে চাল, ডাল, মৌসুমি ফল আসে নিয়মিতই! কই, এই যে ডিজেলের দাম বাড়ল লিটার প্রতি ৩৪ টাকা, কয়েকদিন আগে ইউরিয়া সারের দাম বেড়েছে কেজি প্রতি ৬ টাকা তা নিয়ে তো আমাদের মুখে রা নাই! মানে আমরা যারা কৃষকের সন্তান, তাঁদের কথা বলছি! হয়ত আমরা নিজেদেরকে আর কৃষকের সন্তান হিসাবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না! কিন্তু এই দেশের ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলে! এদেশের নানা আন্দোলন সংগ্রামে কৃষকের ভূমিকা, তাঁদের সন্তানদের ভূমিকা অত্যন্ত গৌরবের! তাহলে কেন আমাদের এই মানসিক দৈন্য শুরু হল? সেটা নিয়ে ব্যাপক পরিসরে আলোচনা হতে পারে! কিন্তু সাদা চোখেও আমরা বলতে পারি, এই দৈন্যতার মুলে আমাদের রাজনীতি! ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর এদেশের যে উল্টোপথে যাত্রা শুরু, সেই যাত্রায়, কথিত দেশ নায়ক, পল্লীবন্ধুরা কৃষকের জন্য যা করেছেন সেটাকে মায়া কান্না হিসাবে মূল্যায়ন না করলেও তাঁরা যে খোদ কৃষকের মনের কথা জানতেন না, তাঁদের পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না, সেটা নিশ্চিত করেই বলা যায়! আমরা যদি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং হুসাইন মুহাম্মদ এরশারদের দলে নেতা রিক্রুট্মেন্ট দেখি তাহলেই বোঝা যায়, উনারা আসলে কাদেরকে নিয়ে সামনে এগোতে চেয়েছিলেন!
আর বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পর যে বক্তৃতায় সরকারি কর্মচারীদের বলছেন, এদেশের কৃষক, শ্রমিক, মজুরদেরকে ইজ্জত দিয়ে কথা বলবেন! সেই বক্তব্য পাড় আওয়ালীগারদের বেশিরভাগ মানুষই শোনেন নাই, বাকিদের কথা বাদই দিলাম! আসলে এই বক্তব্য হয়ত আমাদেরকে শুনতে দেওয়া হয় নাই পরিকল্পিতভাবেই! তাহলে তো কথিত চেতনাধারীদের এক ধাপ এগিয়ে কৃষককেই স্যার বলতে হয়! তা কিভাবে সম্ভব? নিজদের ইজ্জত কি আর বাঁচে তাহলে? তাই দীর্ঘ সময়, আওয়ামলীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার পরও না হয়েছে কৃষকের জীবন মানের উন্নয়ন, না তারা আসতে পেরেছেন, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় মর্যাদার জায়গায়! কেন্দ্র এবং জেলার কথা বাদই দিলাম, ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড আওয়ামলীগের কৃষকলীগের কমিটি’র পদ-পদবীর জায়গায় প্রকৃত কৃষকের দেখা মেলা ভার!
শুরুতেই যেটা বলছিলাম, কৃষকের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সমাজ এবং রাষ্ট্র এই অনীহা এবং কিছু ক্ষেত্রে ধৃষ্টতা দেখানোর সাহস করতে পারে কারণ, তারা জানেন কৃষকের মেরুদণ্ডটা সোজা নাই, সাংগঠনিক ভিত্তি নাই! কৃষকের মুখে, ভাগচাষীদের মুখে সেই গান নাই, এই লাঙ্গল ধরা কড়া হাতের শপথ ভুলো না, জান কবুল, আর মান কবুল, আর দেব না, আর দেব না রক্তে বোনা ধান মোদের প্রাণ হো…তারা আরো জানেন, যতই কৃষক বলুক, আর করব না ধানের চাষ, দেখি তোরা কি খাস…কৃষক আবারো ধান চাষ করবে! আর আমাদের সরকার কম দামে ধান কিনে, বেশি দামে চাল বিক্রি করবে! এ এক অদ্ভুদ দেশ যেখানে কম দামে তেল কিনে বেশি দামে বিক্রি করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সেই লাভের টাকা ব্যাংকে জমা রাখে, সেই প্রতিষ্ঠান বিশ্ববাজারে তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে রাতারাতি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কথা বিবেচনা না করে, বিশেষ করে কৃষকের কথা বিবেচনা না করে কৃষি উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপাদান ডিজেলের দাম বাড়িয়ে দিল! এইটা কোনো যৌক্তিক কথা হতে পারে না, আর সেটা যে পারে না বলে আমরা যারা দাবী করছি, সেটাও কোনো আবেগী বক্তব্য না! কারণ, সরকার লিটার প্রতি কর এবং মূল্য সংযোজন কর মিলিয়ে নিচ্ছে ২৪ টাকা! এই ২৪ টাকা বাদ দিলেও তো সরকার ডিজেলের দাম দুই অংকের ঘরে রাখতে পারত! এটা কি আর নীতি নির্ধারকরা জানেন না? তারপরও তারা কেন এটা করেছেন? করেছেন, কারণ এই চাষার বাচ্চারা সংখ্যায় বেশি হলেও এদের সাথে এগুলি করে পার পাওয়া যায়! ওদের না আছে শেকড়ে শক্তিশালী সংগঠন, না আছে শহরে ওদের হয়ে কথা বলবার মত লোক!
আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি এবং রাজনীতি, অর্থনীতির প্রয়োজনেই কৃষকদের, কথিত চাষার বাচ্চাদের মূল্যায়ন করতে হবে, সমাজ এবং রাষ্ট্রে তাঁদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার করতে হবে, আমাদের সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনেই করতে হবে! সমাজে এবং রাষ্ট্রে তাঁদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হলে, পরিবারে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই হয়ে যাবে! তাছাড়া এখন পর্যন্ত ঢালাওভাবে বলার সুযোগ নাই যে, পরিবারেও কৃষকের মর্যাদা নাই! পরিবার তো রাষ্ট্রের একটা ছোট ইউনিট! উপরের প্রভাব তার উপর গিয়ে পড়ে, সেটা ইতিবাচকই হোক আর নেতিবাচকই হোক! তবে রাষ্ট্র তো স্বেচ্ছায় করবে না, কারণ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে তো এই চাষার বাচ্চারা নাই! এমনকি তাদের কথা বোঝার মত, অনুভব করার মত মানুষও নাই! দাবী তুলতে হবে, আওয়াজ তুলতে চাষার বাচ্চাদের, কৃষকের সন্তানদের! সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা এই কথা শুধু মুখে বললে হবে না, সাধকের মর্যাদা নিশ্চিত এবং তার প্রতি সমীহ বোধ জাগ্রত করা এখন সময়ের দাবী!