সমাজতত্ত্বের আলোচনায় ‛শিল্পকলা’ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শিল্পকলা হল সামাজিক বাস্তবতার প্রতিরূপ বা অর্থবহ অভিব্যক্তি। এগুলি মানুষের সমাজ-চেতনার তাৎপর্যপূর্ণ উপাদান। এই শিল্পকলার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সমাজ ও সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের মানসলোকের প্রামাণ্য পরিচয় পাওয়া যায়। সমাজতত্ত্বের আলোচনায় বা সমাজ ব্যবস্থার পটভূমিতে শিল্পকলার চর্চা আজকের দিনের নয়, অনেক দিনের। এই শিল্পকলা বস্তুত সমাজের বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে থাকে। অর্থাৎ সমাজের বাস্তবতা সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট ধারণা শিল্পকলার মাধ্যমে অভিব্যক্তি লাভ করে। তাই বলা যায়, শিল্পকলা হল সমাজ ব্যবস্থারই একটি উপাদান। এই শিল্পকলারই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল ‛পটশিল্প’। সমাজতত্ত্বের যে শাখায় এই শিল্পকলা নিয়ে অধ্যয়ন করা হয়ে থাকে সেটি হল – ‛শিল্পকলার সমাজতত্ত্ব’ (Sociology of Art)। এই ‘শিল্পকলার সমাজতত্ত্বের’ উপর ভিত্তি করে সমাজতত্ত্বের আলোচনায় পটশিল্পের গুরুত্বকে পর্যালোচনা করা যেতে পারে।
অভিধানে ‛পট’ শব্দটির অর্থ হল চিত্র। সাধারণত কাপড়ের উপর আঠা মিশ্রিত প্রলেপ দেওয়ার পর কোনো কাহিনী বা গল্প অবলম্বন করে যেসব চিত্র অঙ্কন করা হয় তা পটচিত্র নামে পরিচিত। এই পটচিত্র তৈরিতে যে সমস্ত দ্রব্যাদির প্রয়োজন হয় তা হল – ইটের গুঁড়ো, কাজল, লাল সিঁদুর, সাদা খড়ি, আলতা, কাঠ-কয়লা ইত্যাদি। প্রধানত পটচিত্র দুই রকমের হয়ে থাকে। এক- চৌকোপট, এবং দুই- জোড়ানো বা গুটানো পট। এছাড়াও বিষয় বৈচিত্র্য অনুসারে পটকে ছয় ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলি হল- ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, বিষয় নিরপেক্ষ, সামাজিক এবং পরিবেশগত পট। বিভিন্ন কাহিনীকে কেন্দ্র করে পটশিল্পীরা বিভিন্ন ধরনের পট চিত্রাঙ্কন করত। যেমন – যমপট, চকসুদন, সাহেবপট, কালীঘাট পট (পশ্চিমবঙ্গ), গাজীপট (বাংলাদেশ) প্রভৃতি। বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার পটচিত্রকে ‘পাটদার’ এবং বীরভূম ও মেদিনীপুরের পটচিত্র যারা করেন তাদের বলা হয় ‘চিত্রকর’। এবং বাংলাতে একে ‘পটুয়া’ বলা হয়ে থাকে।
যাইহোক, সমাজ ভাবনায় তথা সমাজ সচেতনতায় এই পটশিল্পের ভূমিকা ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এই পটশিল্পীরা মূলত বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক কাহিনীকে কেন্দ্র করে গান রচনা করতেন। তারপর তারা সেই গান পরিবেশনের মাধ্যমে পটশিল্প গুলিকে মানুষের সামনে তুলে ধরতেন। পটশিল্পীরা পটশিল্পের মাধ্যমে সমাজ সম্পর্কিত তথা সমাজ সচেতনমূলক বিভিন্ন বিষয়গুলোকে নিয়ে (যেমন- বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ, পণপ্রথা প্রতিরোধ, যাত্রী সুরক্ষা, পরিবেশ সুরক্ষা, নারী ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন, কোভিড-১৯ সচেতনতা, দারিদ্র, বেকারত্ব প্রভৃতি) স্বরচিত সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে সমাজের মানুষদেরকে সচেতন করতেন এবং তাদের সামাজিকীকরনের ভিতকেও আরও সুদৃঢ় করতেন। সমাজের নানান বাস্তবতা গুলোকে পটশিল্পীরা তাদের পটশিল্পের মাধ্যমে উপস্থাপিত করতেন। তাই বলা যায়, সমাজতত্ত্বের ভাবনায় বা সমাজ ভাবনায় পটশিল্পীদের তথা পটশিল্পের অবদান ছিল খুবই অনস্বীকার্য। সমাজের বিভিন্ন বিষয়কে পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে এই পটশিল্প হয়ে উঠেছে ‛সমাজের এক অন্যতম দলিল’। বিশ্বায়নের প্রভাবে এই পটশিল্প আজ দেশ-বিদেশে সব জায়গায় এক অন্যতম স্থান দখল করে নিয়েছে। যেহেতু সমাজ সম্পর্কিত আলোচনায় পটশিল্পের এক বিশেষ ভূমিকা রয়েছে সেইহেতু বলা যায়, সমাজতত্ত্বের আলোচনায়ও এই পটশিল্পের অবদান খুবই অনস্বীকার্য। বর্তমান সময়ে সমাজতত্ত্বের বহু ছাত্র-ছাত্রীরাও এই পটশিল্পকে নিয়ে গবেষণার কাজে যুক্ত রয়েছেন। তাই পটশিল্প আজ হয়ে উঠেছে গবেষণার এক অন্যতম অভিনব বিষয়। সর্বপরি বলা যায়, সমাজতত্ত্ব যেহেতু সমাজ সম্পর্কিত একটি বিষয় তাই পটশিল্পের সাথে সমাজতত্ত্বেরও এক ঘনিষ্ট যোগসূত্র বর্তমান রয়েছে। তেমনি আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই পটশিল্পের অধ্যয়ন করা অনেকাংশেই যুক্তি যুক্ত বলে আমার মনে হয়।যদিও বিষয়টি এখনো পর্যন্ত সমালোচনামূলক।