ঘাগরা গাছ যত্রতত্র জন্মে। এর সাথে গ্রামবাংলার শৈশব কৈশোরের কিছু স্মৃতি জড়িয়ে আছে অনেকেরই। কিশোরীদের জন্য এই গাছ এক আতঙ্ক, কিশোরদের জন্য কৌতূক আর গ্রাম্যবধূর জন্য সৌখিন মৌসুমী শাক। জলের ধারে, রেল সড়কের পাশে, পতিত জমি, মাঠান জমি সব জায়গাতেই এর বিস্তার। ম্যাপেল-এর মতো পাতা আর সজারুর মতো ফলসহ এই গাছ কখনও চিনতে ভুল হয় না আমাদের।
বংশবিস্তারের জন্য এর বীজ বিসরণ প্রক্রিয়া বেশ মজার। এর ফলের কাঁটায়, সহজে চোখে পড়ে না এমন ধরনের বাঁকানো আঁকশি থাকে যা অনেকটা জুতা কিংবা ভ্যানিটি ব্যাগ আটকানো সুইস ভেলক্রো (Velcro) হুক-এর মতো। অনুমিত হয়, পরবর্তীকালে ঘাগরা ফলের অনুকরণেই উদ্ভব হয়েছে বহুল ব্যবহৃত ভেলক্রো। শুধু কাপড়ে আর রোমশ পশুর গায়ে লেগে যায় এই কাঁটাফল তা নয়, বিভিন্ন কৃষিযন্ত্র, লাঙ্গল জোয়াল মইতেও লেগে থাকতে পারে এরা। এর শুকনো বীজ জলে ভেসে যায় দূর দূরান্তরে। আর এভাবে এক জমি থেকে আরেক জমি, এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলে যায় ঘাগরার বীজ।
অনায়াসেে ঘাগরায় লেগে যায় বলে হয়তো এমন নাম হয়েছে অথবা হয়তো এর ফলের অবয়বে ঘাগরার রূপ কল্পনা করেছে শিল্প-মানস। এর আরেকটি স্বল্প প্রচলিত নাম ছোটো-গোক্ষুর। গোক্ষুর একটি পরিচিত সাপের নাম, কারণ এর ফণায় গোরুর ক্ষুরের ন্যায় চিহ্ন দেখা যায়। পুষ্ট ঘাগরা বীজের মুখটা দেখতে চেরা, দ্বিখণ্ডিত ক্ষুরের মতো মনে হয়, সেই হেতু এই নাম। ইংরাজিতে একে বলা হয় ককল্বার (Cocklebar)।
গাছটির আদিবাস উত্তর আমেরিকা কিন্তু সারা দুনিয়ায় এখন আগাছা হিসাবে এর অধিক পরিচিতি। বেশ কিছু দেশে এর পাতা আর কচি ডাঁটা খায় মানুষ। আমাদের দেশেও কখনও মাছের ঝোলের সঙ্গে রান্না করা হয় এবং স্বাদটাও বেশ। কিন্তু এই খাওয়াটা হয় সন্তর্পণে, কারণ এর যে বিষক্রিয়া হতে পারে তা মানুষ জানে কবিরাজদের মাধ্যমে। আয়ুর্বেদ এই গাছকে ভেষজ হিসাবে ব্যবহার করে আসছে বহুকাল যাবৎ কিন্তু প্রবন্ধে তার উল্লেখ করা হচ্ছে না কারণ পশ্চাৎপটে রয়েছে সিলেটের এক দুঃখজনক ঘটনা।
সেবার সিলেটে অসময়ে বন্যা হয়েছে, ২০০৭ এর অক্টোবর-নবেম্বরের দিকে। সীমান্ত এলাকার কিছু দরিদ্র মানুষ পাথর কুড়িয়ে, খননকাজ করে কোনো রকমে দিনাতিপাত করে। বন্যার কারণে তারা শহর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বেশ দূরে। খাবার শেষ হয়ে গেছে কিন্তু রিলিফ আসছে না। আর রিলিফ মানে, ধরতে গেলে শুধু চাল, কিন্তু সে চাল খাবে কী দিয়ে! নিকটবর্তী ডাঙা থেকে এলাকাবাসীরা শাকপাতা কচুঘেঁচু সংগ্রহ করে খেতে লাগল কিন্তু তাও শেষ হয়ে গেল দ্রুত। এবার তারা ঘাগরা শাক খেতে শুরু করল প্রায় একযোগে। এই ঘাগরা তারা আগে থেকেও খেতো, কিন্তু বীজ হবার আগে। তারা জানত ফুল থেকে বীজ হতে হতে গাছে বিষ হয়, পাতাও বিস্বাদ হয়ে পড়ে। আমরুল, হেলেঞ্চা মালঞ্চও একই রকম, ফল ধরলেই বেড়ে যায় অকজ্যালিক। কিন্তু মনকে প্রবোধ দিল তারা, কী আর হবে এমন, প্রাণে তো বেঁচে থাকা চাই। কিন্তু এর ফল হলো, ২০ জন মারা গেল সুচিকিৎসার আগেই এবং ৮০ জন ভর্তি হলো হাসপাতালে।
এই ঘটনা থেকে অনুমিত হয়, ঘাগরা শাকের পাতা এলিলোরসায়ন-এ বিষাক্ত হয়ে পড়েছিল। আফ্রিকার কুডু প্রাণীরাও বেঘোরে মারা পড়েছিল এভাবে। একবার খরার কারণে বাবলা গাছের পাতা এমনভাবে মুড়ে খেলো তারা যে বাবলার জীবন-সংশয় দেখা দিল আর ঠিক তখনই তারা বিষাক্ত করে ফেলল তাদের পাতা, এলিলোকেমিকেল নিঃসরণ করে। এক বাবলা গাছ বিষ তৈরি করে আরেক গাছকে জানাল, বাতাসের গতিপথে ইথিলিন গ্যাস ছড়িয়ে। কুডুরা সেটা বুঝতে পারার আগেই ঝাড়ে বংশে মরা শুরু করল। কিন্তু জিরাফ মরল না।
জিরাফরা এই বিষের অস্তিত্ব টের পেয়ে গেল সহজাত কারণে। তারা বিষাক্ত গাছ পেরিয়ে দূরে গিয়ে পাতা খেতে শুরু করল কারণ তখনও বাতাসের উল্টো দিকে কেমিকেল রিলিজের ইঙ্গিত পৌছাতে পারেনি। কিন্তু মানুষ তো আর জিরাফ নয়, বুঝতে পারেনি ঘাগরাতে বিষের আধিক্য জমেছে। সাদামাটা কুডুর মতো না বুঝে প্রাণ হারাল অনেক অবুঝ মানুষ।
ঘাগরা- Cocklebur
বৈজ্ঞানিক নাম- Xanthium strumarium L. , synonym Xanthium indicum (family : Asteraceae)