আরও কয়েকদিন পরে সুবিমল জয়কে কাছে ডেকে বললেন, এলাকার মহিলা সংগঠনে শ্রীবৃদ্ধি আনতে হলে সুচরিতার মতো নেতৃত্ব খুব প্রয়োজন।
জয় পরম উৎসাহ নিয়ে বলল, কীভাবে তা সম্ভব, বলে দিলে একটা মরিয়া চেষ্টা নিয়ে দেখতে পারি।
সুবিমলের মুখে মৃদু হাসি, চাপা স্বরে বললেন, হ্যাঁরে জয়, শুধুমাত্র নিজের প্রয়োজনে এতটা উৎসাহ দেখাচ্ছিস না তো?
কী যে বলেন গুরু।
ওরে, এতে সংকোচের কী আছে? তোর সঙ্গেই তো রয়েছি।
জয় তাৎক্ষণিক পুলকে ভাসল। দিন সাতেক পরে রবিবার সন্ধেয় সুচরির প্রসঙ্গ নিয়ে সুবিমল আবার জয়ের সঙ্গে বসলেন। গুরুর প্রতি জয়ের কৃতজ্ঞতা আকাশের মতো অসীম। পিছনে ছিলেন বলেই ব্লক লেবেল কমিটিতে জায়গা করে নিতে পেরেছে সে। চাকরি পাওয়া নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ সম্মতি দিয়েছেন। তাকে শুনিয়ে অনেকবার বলেছেন, সাংগঠনিক শক্তি বাড়লে জীবনের চাহিদা কখনো অধরা থাকতে পারে না। রাজনীতির অঙ্ক এভাবেই এঁকেবেঁকে চলে।
আলোচনার শুরুতে রায়বাবু জয়ের কাঁধে হাত রেখে বললেন, হ্যাঁরে, শুধু গাল হাঁ করে শুনবি, সুচরিতাকে সংগঠনে টেনে আনা নিয়ে কিছু ভেবেছিস?
রূপায়ন কোন্ পথে, তা খুঁজে পাচ্ছি নে।
মেয়েটা নাকি খুব স্মার্ট।
সেকথা আগেই বলেছি। চাকরি পাওয়া নিয়েও খুব সমস্যায় রয়েছে, দুবেলা এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে, প্রদীপও পিছু ছাড়ছে না।
ফিক্ করে হেসে ফেললেন সুবিমল।
হাসির মতো কিছু বলি নি গুরু।
একটা প্রসঙ্গ ভালো করে শুনে নে। তুই যেমন চাকরির দাবি জানাচ্ছিস, গ্রাজুয়েট হওয়ার পরে একই দাবি সুচরিও জানাতে পারে। এতে ত্রুটি দেখছিস কেন? আমার ছায়ায় আছিস বলেই চাকরি পাওয়া নিয়ে তোর মধ্যে যতটা নিশ্চয়তা রয়েছে, সুচরির মধ্যে তার চেয়ে অনেক বেশি অনিশ্চয়তা রয়েছে। কিন্তু তার ভিতরে যে স্বপ্ন রয়েছে, তা হুবহু তোর মতোই। কাল পরশু সময় করে ওর কাছে যা, আমার কথা খুলে বলবি, দেখবি নরম হয়ে পড়তে বাধ্য হবে। চাকরির প্রসঙ্গ তুললেই বলবি, সংগঠন বাড়লে চাকরি পাওয়ার সুযোগও বাড়ে।
জয় খুশি হল গুরুর কথা শুনে। ভিতরে ভিতরে আপ্লুত হলেও তা বাইরে এতটুকু প্রকাশ করল না। একটু পরে এক দঙ্গল লোক এল সুবিমলের সঙ্গে দেখা করতে, তাদের চোখেমুখে আতঙ্কের ছায়া।
কী ব্যাপার, এত বিধ্বস্ত অবস্থায়? সুবিমলের হতচকিত প্রশ্ন।
কালিতলায় বড়ো ধরণের সংঘর্ষে আমাদের কয়েকজন আহত হয়েছে। দু’তিন জনের অবস্থা গুরুতর। তাদেরকে মথুরাপুর হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে।
টেবিলে থাপ্পড় মেরে উঠে দাঁড়ালেন সুবিমল, এত বড়ো স্পর্ধা। কী ভেবেছে ওরা? ঘুঘু দেখেছে ফাঁদ দেখে নি।
দাদা, যা করলে হয় করুন।
রায়বাবু আর এতটুকু দেরি করলেন না। দ্রুত জামাপ্যান্ট পাল্টে সাইকেলে উঠে বসলেন। জয়কে উদ্দেশ্য করে বললেন, আর কথা বলতে পারব না রে।
তারপর শিকারী বাঘের মতো মথুরাপুর থানার দিকে ছুটলেন। বড়বাবুর সঙ্গে কথা বলে প্রতিপক্ষদের এ্যারেস্ট করার ব্যবস্থা না করে ছাড়বেন না।
জয় থ্ হয়ে চেয়ে থাকল সুবিমলের চলে যাওয়া পথের দিকে। একটু হাসল আপন মনে। লোকটা পারেন বটে। একটা সুযোগ হাতে এলেই হল, তাকে কীভাবে রাজনীতির ইস্যুতে পরিণত করতে হয়, তা ভালো করেই জানেন। আসামি তুলে আনার জন্যে সুবিমল ওসির টেবিলে থাপ্পড় মেরে কীভাবে নিজের গুরুমশাইগিরি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন বার বার তা জয়ের নিজের চোখে দেখা। রায়বাবু তখন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ, দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য। দলের প্রতি তাঁর ভালোবাসা সমুদ্রের জোয়ারের মতো গতিশীল। ওসি ভয়ে সিটিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন, সুবিমলের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে দলবল নিয়ে আসামি ধরতে বের হয়ে পড়েছেন।
গত বছর আষাঢ় মাসে এমন আরেকটা চাক্ষুষ ঘটনার সাক্ষী হতে পেরেছিল জয় নিজেই। কালিতলার পাশের গ্রাম পুরন্দরপুর থেকে সন্ধের আগে একটা রাজনৈতিক গণ্ডগোলের খবর এসেছিল। মাত্র বিঘেখানেক জমি নিয়ে দুপক্ষের বিবাদ। সুবিমলের লোকজনরা মারাত্মকভাবে জখম হয়েছে। সেদিনও সুবিমলবাবু এতটুকু সময় নষ্ট না করে ছুটে গিয়েছিলেন থানাতে। জয়ও তার সঙ্গে ছিল। রায়বাবুর অগ্নিমূর্তি দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল সে। যেন একটা আস্ত হিংস্র হায়না। কোনো অনুরোধ নয়, কোনো বিনীত কথা নয়, হুকুমের স্বরে ওসিকে বললেন, এখনই মূল ক্রিমিনালকে থানায় তুলে আনুন। প্রসাশনে থেকে কী করছেন আপনারা? মনে রাখবেন, কোথাও শিথিলতা দেখলে তা রুখে দেওয়ার ক্ষমতা আমার আছে। আপনাদের কাজ এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা, না পারলে বাধ্য হয়ে আমাকেই রাজনৈতিক শক্তি প্রয়োগ করতে হবে।
তম্বি দেখে জয় সেদিন ভীষণ ভয় পেয়েছিল। ওসি সব শুনে কিছু সময় নিজের চোয়ারে ঘাপটি মেরে বসে ছিলেন, তারপর বড়ো দলবল নিয়ে বের হয়ে পড়েছিলেন। জয় দেখেছিল, সন্ধের আগেই ওসি কেমন করে অপকর্মের সবকটা পাণ্ডাকে ধরে নিয়ে থানায় ফিরে এসেছিলেন। সুবিমল তখনও গম্ভীর হয়ে বসেছিলেন থানার ভিতরে। ওসিকে ফিরতে দেখে জয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলেছিলেন, এভাবেই কাজ হাসিল করতে হয় রে।
সেই সুবিমল নতুন করে কাঁপুনি ধরাতে আজ আবার থানায় ছুটেছেন। জয়ের দৃঢ় বিশ্বাস, আজও ওসিকে বাধ্য করাবেন বিরুদ্ধ শক্তিকে দুমড়ে মুচড়ে মাটিতে মিশিয়ে দিতে। লৌকিক স্তরে আজকাল সেও কম সম্মান পায় না। কেউ কেউ সরাসরি সুবিমলের কাছে না গিয়ে প্রথমে তার কাছে আসে। খুচখাচ এটা ওটা জেনে নেয়, মন পেতে চেষ্টা করে, তারপর সুযোগ বুঝে রায়বাবুর কাছে পৌঁছে যায়। জয় নিজস্ব ক্যারিশমার অন্য ভাবমূর্তি লাভ করতে পেরেছে, নিজেকে ‘ছোটকুলে’, নেতা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেই পারে না। অবশ্য কেউ কেউ আড়ালে আবডালে তাকে চামচে বলে ঠাট্টা করে। তা নিয়ে জয়ের কোনো মাথাব্যথা নেই বরং প্রচ্ছন্ন গর্ব রয়েছে। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসার যে যোগ্যতা, তা যেন তার অধিগত হয়ে গেছে। রাজার অসাক্ষাতে অনেকে অনেক কিছু বলতে পারে, তার জন্যে রাজার কিছু এসে যায় না। নিজের শরীরটাকে নতুন করে বার দুই ঝাঁকিয়ে নিয়ে ভিতরে অভিনব দোল অনুভব করতে থাকল।
সন্ধে সাতটা। জয় চোখ বুজিয়ে গুরু সুবিমলকে অনসুরণ করে নিজেকে আরও উপরে তুলে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্নে ডুবে ছিল। যে সংগঠনের জোরে সুবিমল ওসির মতো পদস্ত প্রশাসককে কাবু করে দিতে পারেন, তিনিই বলেছেন, দলীয় শক্তিকে আরও জোরদার করে তুলতে হবে। সুচরিতাকে সংগঠনে টেনে এনে মহিলা মোর্চাকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে চান। গুরুর সেসব কথা জয়ের মনে ছবি হয়ে ভেসে উঠছে। মনের ভিতরে নতুন টান অনুভব করল, একবার ভাবল,থানায় গিয়ে সুবিমলদার খোঁজখবর নেওয়া প্রয়োজন কিন্তু সমস্যা হল, সন্ধের পরে রায়বাবুকে খুঁজে পাওয়া মস্ত বড়ো সমস্যার। যেখানে সেখানে এত লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে থাকেন যে ঠিক কোথায় বসে আছেন, তা খুঁজে বের করা কঠিন। বরং গুরুকে খুশি করা সম্ভব যদি সংগঠনে যোগ দেওয়ার জন্যে সুচরির সম্মতি নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসা যায়। সাইকেলে বের হয়ে পড়ল জয়। প্যাডেলে চাপ দিয়ে সামনে এগিয়ে চলল। গঙ্গাধরপুরের পাশের গ্রাম মধুপুর। সুচরির বাড়ি সেখানেই। পূর্ণিমা রাত, সন্ধের শুরু থেকে আকাশে চাঁদ ছিল। সাইকেল নিয়ে সামনে ছুটে চলেছে জয়। মিনিট কুড়ি পরে থমকে দাঁড়ালো একটা ছোটো বাড়ির সামনে। এদিক ওদিক বার দুই তাকিয়ে নিল। একজনকে সামনে পেয়ে জিজ্ঞেস করল, এটাই কী সুচরিতার বাড়ি?
কোথা থেকে আসছেন?
জয়ের সদর্প জিজ্ঞাসা, আমাকে চেনেন না? আমি সুবিমলের লোক, জয়।
ও, ও, সরি সরি।
জয় গলা চড়িয়ে ডাকল, কেউ বাড়িতে আছেন?
সুচরির মা বাইরে এসে বলল, কে বাবা তুমি?
আমি জয়, সুবিমলবাবুর এ্যাসিসট্যান্ট।
তাহলে ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? ভিতরে এস বাবা, রায়বাবু কী কিছু বলে পাঠিয়েছেন?
সুচরিতাকে দেখা করতে বলেছেন।
সুচরির মা নতুন আগ্রহে ভাসল। আগেভাগে মেয়ের কাছে শুনেছিল, রায়বাবু খুব প্রভাবশালী মানুষ। ইচ্ছা করলেই সুচরিতাকে একটা চাকরিবাকরি করে দিতে পারেন। উচ্ছ্বাসে গদগদ হয়ে বলল, বলো না বাবা, রায়বাবু কেন ডেকেছেন?
সুচরিতা নাকি পড়াশোনায় খুব ভালো, ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে দিয়েছে। রায়দার হাতে কিছু সুযোগ এসেছে, তাই সুচরিতার সঙ্গে কথা বলতে চান।
আরও কম্পিত হল সুচরিতার মা, চাপা স্বরে বলল, তাহলে মেয়ে কখন দেখা করতে যাবে?
নির্দিষ্ট সময় বলে দিলে তা রায়দাকে জানিয়ে দেব।
সুচরিতার মা আরও নরম হল, ডাকল, ও সুচরি, ঘরের ভিতরে কী করছিস? এখানে আয়, সুবিমলবাবু লোক পাঠিয়েছেন তোর সঙ্গে কথা বলতে, ঠিক করে সময়টা বলে দে।
সুচরিতা একবার ভাবল, প্রদীপের জন্যে দাবি জানালে কেমন হয় কিন্তু সে কথা বলতেই পারল না। চা নিয়ে এল সুচরিতার মা, জয়কে বলল, খেয়ে নাও বাবা। সুচরিতাকে বলল, কখন যাবি, জয়বাবার কাছে ঠিক করে বলে দে। অনেক কষ্ট করে তোকে পড়াশোনা করিয়েছি রে, একটা চাকরি বাকরি পেলে কিছুটা সুখের মুখ দেখতে পারি। বিপদে আপদে পড়লে আমরা শুধু ভগবানকে ডাকি, এখন দেখছি, মানুষও ভগবানের রুপ নিতে পারে।
সুচরিতা কোনো উত্তর দিল না, জয় চা খেতে শুরু করল, সুচরিতার মা সুবিমলের মুল্যায়নে ব্যস্ত হয়ে উঠল। লোকটা এলাকায় কী কী কাজ করেছেন, তাঁর কল্যাণে গ্রামের ভাঙা-চোরা রাস্তা কীভাবে কংক্রিটের হয়ে গেছে— এমনি নানা ফিরিস্তি। মানুষ হিসেবে সুবিমল কেমন, তাও একবার ভেবে নিল। যে কেউ দাবিদাওয়া নিয়ে গেলে শ্রীরায় কীভাবে মন দিয়ে শোনেন, পরে কীভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, সেই মূল্যায়নও ধরা পড়ল সুচরির মায়ের চিন্তায়। এলাকায় সুবিমলের জনপ্রিয়তার পিছনে যে সুবিপুল কীর্তি রয়েছে, তাও একবার ভেবে নিল। সুচরিতার জন্য তার শেষ মূল্যায়ন, রায়বাবু মুখ তুলে চেয়েছেন যখন, মেয়েটার ভাগ্য খুলে যেতে পারে। ব্যাকুলতা দেখিয়ে বলল, এভাবে চুপ করে থাকলি কেন, জয়বাবার কাছে দিনক্ষণ বলে দে।
সামনের সপ্তাহে যে কোনো দিন।
কী ছিরির কথা বলছিস তুই?
কেন মা?
গুরুত্বপূর্ণ বলেই সুবিমলবাবু লোক পাঠিয়েছেন, আর তুই দিন গুণছিস? এভাবে কথা বলা ঠিক নয় রে। এত পড়াশোনা করেছিস, বিষয়ের গুরুত্ব বুঝবি নে? নিজের প্রয়োজনের দিকটা নিয়েও তো ভাবতে হয়। কাল পরশু কখন যাবি, ঠিক করে বলে দে।
জয়কে উদ্দেশ্য করে সুচরির মায়ের মিনতি, ওর কথা শুনে কিছু মনে করো না বাবা। ছেলেমানুষ, কোন কথায় কী গুরুত্ব, তা ঠিক বুঝতে শেখে নি। শুনে নাও জয়বাবা, কাল বিকেলে মেয়ে যাবে সুবিমলবাবুর সঙ্গে দেখা করতে। পাঁচটার সময় উনি তো পটলার চায়ের দোকানে বসেন। সুচরিতা ওখানেই যাবে। সঙ্গে থেকো বাবা, তোমাকে দেখে কেমন যেন ভরসা পাচ্ছি।
সুচরিতাকে উদ্দেশ্য করে আবার বলতে শুরু করল, মনে রাখিস, আমি কথা দিয়েছি, তোকে সময় মতো যেতেই হবে। মনে হচ্ছে, সুবিমলবাবুর হাত ধরে তোর বাপের স্বপ্নটা এবার বাস্তব হতে চলেছে। অতীতকে ভুলতে নেই রে, মনে রাখলে বর্তমানকে আরও সুন্দর করে গড়ে তোলা যায়, ভবিষ্যতও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে! তোর বাপ সব সময় বলতো, গ্রামের হতশ্রী দশা দূর করতে টাকার চলাচল বাড়াতে হবে। না হলে গ্রাম থেকে যারা শহরে উঠে গেছে, তারা আর ফিরতে পারবে না। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিস তো, অধের্ক লোককে সারা বছর কলকাতায় থাকতে হয় কেবল পেটের দায় মেটাতে। এখানে কাজ থাকলে ওরা কোনোদিন কলকাতায় যেত না। ছেলেমেয়ে পরিবার পরিজন ফেলে রেখে কেউ দূরে থাকতে চায় না। তোর বাপ অনেকবার পই পই করে বলেছে, চাকরি পাওয়ার পরে তুই যেন গ্রামে থাকিস। নিজের গ্রামকে গড়ে তোলার পিছনে নাকি ভীষণ আনন্দ রয়েছে।
জয় খুশি হল সুচরির মায়ের কথা শুনে। প্যাডেলে চাপ দিয়ে সাইকেলে ফিরতে শুরু করল। মনে মনে ভেবে নিল, সুচরিতা কিছুতেই তার মায়ের কথা ফেলতে পারবে না। ঠিক সময় বাজারে এসে গুরুর সঙ্গে দেখা করে যাবে। একটু হাসল আপন খেয়ালে, মানসিক দুঃখমথিত কষ্টের হাসি। গুরুর সঙ্গে চলতে চলতে এত সাফল্য, এত সুনাম সত্ত্বেও সুচরিকে সে ঠিক মতো চিনতেই পারল না।
বারান্দায় বসে সুচরি এতক্ষণ অন্য চিন্তায় ডুবে ছিল। আড়চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে ফিক্ করে হেসে ফেলল। সুচরিতার মা অবাক না হয়ে পারল না, সচকিত হয়ে প্রশ্ন করল, এভাবে হাসলি যে? মরা বাপকে উপহাস করছিস? আমার কথা ভালো লাগল না তোর?
বিয়ে হলেই সুচরিতাকে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে। সেখানেই নতুন ঘরসংসার, খাওয়া, পরা, থাকা, শোয়া, নতুন সখ্যতা গড়ে তোলা, পরিবারের মধ্যে থেকে সকলের কাছে নিজেকে আপন করে তুলতেই হবে, চারদিকের নতুন সমাজ পরিকাঠামোতে মিশে যাওয়া— সবই সারতে হবে নতুন বাঙালিবাবুর অধীনে। পুরুষশাষিত বাঙালি সমাজে আজও এমন স্বাধীনতা তৈরি হয় নি যাতে একজন স্ত্রী স্বামীর কথা না শুনে যেমন খুশি তেমন চলতে পারে। আবহমানকাল ধরে এ চিত্র চলে আসছে। ব্যতিক্রম থাকলেও তা চোখে পড়ার মতো নয়। বরং গতানুগতিকভাবে পুরুষ শাসনের পদ্ধতি চলছে তো চলছেই। একসময় তার মাও এসেছিল এ সংসারকে আপন করে নিতে, এ গ্রামকে ভালোবাসতে। একদিন তাকেও বাপের গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে সংসার যাত্রার মূল্য দিতে ঠিক মায়ের মতো।
চলতে চলতে জয়ের মনে হল, একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ না জানিয়ে ফিরে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না। শুনলে গুরু রাগ করতে পারেন। বাধ্য হয়ে আবার ফিরতে হল জয়কে। সুচরিতাদের বাড়িতে ঢুকে বলল, একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি মাসিমা।
বলো বাবা শুনি।
সুবিমলদা এ্যাডমিট মার্কসিটের জেরক্স সঙ্গে নিয়ে যেতে বলেছেন।
হেসে সুচরিতার মন্তব্য, ভালো প্রসঙ্গ মনে করিয়ে দিলে জয়দা।
একবার আড়চোখে সুচরিকে দেখে নিল জয়, বলল, মাসিমা, সুচরিকে বের হবার সময় মনে করিয়ে দেবেন। আবার ফিরে চলল খুশি মনে। সুবিমলদা কেন যে তাকে এক নম্বর সাকরেদ হিসেবে গ্রহণ করেছেন, সেই উপলব্ধি জয়কে বার বার ছ্যাকা দিতে লাগল। কোনো জটিল প্রসঙ্গ সামনে এলে গুরু তার উপর নির্ভর না করে পারেন না। আম-সমর্থকদের অনেকেই তা জেনে গেছে। গুরু যে তাকে সবচেয়ে কাছের মানুষ হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তা যেন সবার কাছে দিনের আলোর মতো সুস্পষ্ট। শুধু একটা দুরাশা এখনও সে পূরণ করতে পারে নি। অনেকবার ভেবেছে, সংগঠনে টেনে আনা সম্ভব হলে সুচরিতার সঙ্গ পাওয়া নিয়ে তাকে আর ভাবতে হবে না। দুবেলা দেখা হবে, সংগঠনের টানে ওকে আসতেই হবে, তার মনও সচল থাকবে। প্রতিদিনের জীবনে অনুভব করতে পারবে আনন্দের নতুন নতুন পরশমণি, শীতের সকালে গা’সোয়া রোদের মতোই।
সাইকেলের গতি বাড়িয়ে একবার ভাবল, খবরটা গুরুকে না জানিয়ে বাড়িতে ফিরে যাওয়া ঠিক হবে না। নিশ্চয় বাজারের মধ্যে কোথাও বসে রয়েছেন কিন্তু ঠিক কোথায় থাকতে পারেন, তা অনুমান করতে পারল না। ব্যস্ত মানুষ, এর ওর দরকার নিয়ে নানা জায়গায় বসতে হয় তাঁকে, অবশ্য মূল ঠেক পটলার দোকানেই। যত রাত হোক, সেখানে একবার ঢুঁ না মেরে বাড়িতে ফেরেন না। চা খাবেন,পটলার কাছ থেকে কাঁধের ব্যাগ নেবেন, তারপর সাইকেলে বাড়িতে ফিরবেন। বেশি রাত হলে অনেক সময় সাইকেলে ফেরা সম্ভব হয় না। বাইকে কেউ না কেউ বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যায়।
ক্রিং ক্রিং শব্দ করে জয় চা দোকানের সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। পটলাকে উদ্দেশ্য করে বলল, হ্যাঁরে, দাদা কী ভিতরে?
সন্ধের সময় এসেই বের হয়েছেন। চা খাবার সময়টুকু পান নি। ব্যাগ রেখে যাবার সময় শুধু বললেন, একটু রাত হতে পারে রে পটলা।
কোথায় গেছে জানিস?
পটলা মিষ্টি করে হাসল।
অমন হাসলি যে?
বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়ো, প্রবাদ বাক্যটা মনে পড়ল পটলার, বুঝল, বড়ো রায়ের চেয়ে ছোটো রায়ের কথার ঝাঁঝ অনেক বেশি কিন্তু সে কথা প্রকাশ করল না। কিন্তু কিন্তু করে বলল, মাঝে মাঝে এমনি হাসি পায়।
এ হাসি ভালো নয় রে। গম্ভীর মুখে জয় সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিল। লোকটা কোথায় থাকতে পারেন, আবার ভেবে নিল। স্লো মোশানে বাজারের উত্তর প্রান্তে গিয়ে দেখল, বড়ো মুদি দোকানের পাশে লোকজন ভর্তি আসরে বসে আছেন। জনা কুড়ি লোক ঘিরে রেখেছে তাঁকে। যে যার মতো মতামত দিচ্ছে ফিস ফিস শব্দে, সুবিমলবাবু শুনছেন মনোযোগ দিয়ে, মাঝে মাঝে মাথা নাড়ছেন, কখনো মুখটা গম্ভীর করে তুলছেন, কখনো আলতো হেসে নিজের সমর্থন জানিয়ে দিচ্ছেন। রায়বাবুর হাসি সব সময় রহস্যময়, হাজার অর্থ তার ভিতরে। সাংগঠনিক মুনাফা তোলার সুযোগ তৈরি হলে শ্রীরায় এমনিই বুঁদ হয়ে থাকেন যে তাঁকে দেখে শিকারী বাঘ বলেই মনে হয়। এলাকায় কোথাও রাজনৈতিক সংঘর্ষ হলে সুবিমল সম্পূর্ণ অন্য মানুষে রুপান্তরিত হয়ে যান। নাওয়া খাওয়া ভুলে কার সঙ্গে কেন বিরোধ, পিছনের প্রেক্ষাপট কী, কে কে জড়িত, তাদের মূল উদ্দেশ্য কী,রাজনৈতিক ওজনে তাদের অবস্থান কতটা গুরুত্বপূর্ণ, উদ্ভুত ঘটনা সম্পর্কে আম-মানুষ কী ভাবছে— তন্ন তন্ন করে সব কিছু জেনে নেবার চেষ্টা করেন। যতক্ষণ না নিজের রাজনৈতিক গ্রাফ সম্পূর্ণ হচ্ছে, ততক্ষণ পযর্বেক্ষণে ব্যস্ত থাকেন। তারপর বাড়িতে বসে নিজের মতো করে প্লটটা তৈরি করে ফেলেন, অবশ্য জয়ের কাছ থেকে খুচখাচ মন্তব্য জেনে নিতে ভুল করেন না।
কঠোর বাস্তবে নিজের লড়াই শুরু হলে আর কারুর সঙ্গে পরামর্শে যান না। শুধু হুমকি আর হুকুমের যাদুমন্ত্রে নিজের রাজনীতির মাঠে লোক ভরাতে থাকেন। এত বেপরোয়া হয়ে ওঠেন যে কেউ সামনে এসে মাথা তুলে দাঁড়াতে সাহস পায় না। এমন কী থানার ওসিকেও তটস্ত হয়ে থাকতে হয় রায়বাবুর নতুন নতুন পদক্ষেপ নিয়ে। সন্ধের পরে থানায় ঢুকে ওসির টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে এমন ভাব দেখান যেন তাঁর তৈরি প্লটের উপর কিছু ঘটলে সেই দায় বড়বাবুকেই নিতে হবে। প্রয়োজন হলে মন্ত্রীমহলে ফোন করে ওসির উপর চাপ তৈরি করতে কুণ্ঠা করেন না। ওসিসাব সিঁটিয়ে যেতে বাধ্য হন।
জয় ঘরে ঢুকে বলল, সুবিমলদা, কাজ সেরে ফেলেছি।
দেখা হয়েছে তোর সঙ্গে?
মাথা নাড়ল জয়।
পজিটিভ তো?
আপনার পরামর্শ বেশ কাজে এসেছে।
সব ক্রেডিট তোর।
আপনার পরিকল্পনা, আমার চেষ্টা।
তুই লঙ্কা জয় করে ফিরতে পেরেছিস রে।
জয় চুপ করে থাকল। সুবিমলের মুখে এ ধরণের মূল্যায়ন সে অনেকবার শুনেছে।
সুবিমল হাত উঁচু করে বললেন, লোকগুলোকে ছেড়ে দিয়ে তোর সঙ্গে কথা বলছি। হ্যাঁরে, আমার কথা কিছু জিজ্ঞেস করল?
জয় ভালো করেই জানে, সুবিমল প্রয়োজনের বাইরে একটাও বেফাঁস কথা বলেন না। কিন্তু এক্ষেত্রে এ প্রশ্ন করার পিছনে কী কারণ থাকতে পারে, তা মাথায় ঢুকল না।
সুবিমল রায় সমবেত লোকগুলোকে পর পর ছাড়তে শুরু করলেন। —তাহলে তপন, ওই কথা থাকল। দুতিনদিন পরে এসে ঘটনার অগ্রগতি জানিয়ে যাবি। ভেবে দেখব নতুন কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
আপনি রয়েছেন যখন—।
এতটাই নির্ভরতা?
প্রথম থেকেই তো।
বেশ বললি রে। প্রবীর কই? আরেকটু সামনে সরে এসে বসো। যা বলছি মন দিয়ে শোনো। গ্রামে ফিরে গিয়ে সাঙ্গপাঙ্গদের সঙ্গে বসো, তাদের মতামত নাও। সকলের একমত হওয়া খুব প্রয়োজন, আমি সব সময় জনবলে বিশ্বাস করি। সহমত হলেই সেই শক্তি লাভ করা সম্ভব।
স্বপন কই? গ্রামের রাস্তাটুকু কংক্রিটের করার কথা বলেছিলি তো? সব ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছি। অপেক্ষা করার দিন শেষ। সামনের সপ্তাহে ওয়ার্কঅর্ডার হাতে পাব। কাল পরশু প্রধানকে একবার স্মরণ করিয়ে দিয়ে এলেই হল। খুব কাজের লোক, অনেকগুলো স্কিমের কাজ ওকে সারতে হবে। বলছি কী, কটা দিন প্রধানের সঙ্গে লেগে থাকলেই কাজটা দ্রুত শুরু করা সম্ভব হবে।
ভালো খবর দিলেন, আসছি দাদা।
সাবধানে যাস, পথে কোনো বিপদ আপদের ভয় নেই তো? থাকলে আমাকে বলতে পারিস, পুলিশ প্রোটেকশনের ব্যবস্থা করে দেব। প্রতিপক্ষের কয়েকজন ভয়ানক ক্ষেপে আছে।
ওসব জানি কিন্তু মাথায় রাখি না। যেমন চলছি, তেমন চলব, বিপদ আসলে আসবে।
রাজনীতি করতে গেলে আত্মবিশ্বাস খুব কাজে লাগে। আমিও সেই বিশ্বাস নিয়ে চলাফেরা করি, প্রতিপক্ষরা রেগে আছে মানে সংগঠনের প্রতি আমার দায়বদ্ধতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। সেলিম সামনে এসো, তোমার কেসটা বেশ জটিল বলে মনে হয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছি, ওসির সঙ্গেও আরেক বার কথা বলব। আশা করছি, স্বসম্মানে উতরে যেতে পারব।
তাহলে সম্পূর্ণ ভরসা রাখতে পারছি তো?
শেষ পর্যন্ত পারি নি এমন দৃষ্টান্ত আমার জীবনে নেই, তবে জটিল হলে একটু সময় নিয়েই ঝাঁপাতে হয়। শঙ্করপুর থেকে আসা লোকজনদের উদ্দেশ্যে বললেন, বলেছিলাম এ্যারেস্ট করিয়ে দেব, সে কথাই রেখেছি। মনে রাখিস, আমার লোকজনের গায়ে হাত দিয়ে কেউ রেহাই পাবে না। অকারণে হনু সাজতে গেলে দুমড়ে মুচড়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেব। অনেক কষ্টে এত বড়ো ফিল্ড গড়ে তুলেছি, কাউকে কিছুতেই তার ভিতরে চক্করবাজি করতে দেব না। ওসিকে বলেছি, যাতে সহজে জামিন পেয়ে যেতে না পারে। ওসি নিজেও মাঝে মাঝে ভয়ে বলেন,আপনার মতো রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারকে ভয় না পেয়ে উপায় কী। ওরে ঠ্যালার নাম বাবাজি, জয়েন করার পর থেকেই কোনোদিন আমার সামনে মাথা সোজা করে দাঁড়াতে পারেন নি।
জয় না হেসে পারল না। লোকগুলো বাড়তি সন্তুষ্ট হয়ে দুড়দাড় উঠে দাঁড়ালো। সুবিমল রায় জয়কে মৃদু ধমকে দিয়ে বললেন, এভাবে হাসছিস যে? আজ কী প্রথম আমার ভোকাল টনিক শুনলি? কথায় কাব্য করতে না পারলে রাজনীতি করবি কী করে? আমার পাশে এসে বোস। এলাকার মহিলা সংগঠনকে শক্তিশালী করে তোলার খবর আনতে পেরেছিস বলেই ধন্যবাদ। তাহলে তোর কথায় রাজি হয়ে গেল? মহিলা সংগঠনটা ঢেলে সাজানোর সুযোগ করে দিল মেয়েটা?
রাজি হলেও কম ঝক্কি নেই গুরু।
সংগঠন করবি, ঝক্কি সামলাবি না, তা হয় নাকি?
এটা ব্যতিক্রম সমস্যা।
কী রকম?
সুচরির চাকরি পাওয়ার জন্যে যে নেশা তার পিছনে ওর মায়েরও মদত রয়েছে।
তা থাকতেই পারে, মেয়ের চাকরির জন্যে মা ভাববে না, এমন হতে পারে না। কখন দেখা করতে আসবে তাই বল?
কাল বিকেলে পাঁচটার দিকে পটলার চায়ের দোকানে। আমাকেও থাকতে বলেছে। আপনি যে রোজ ওই দোকানে বসেন, সুচরির মায়ের কাছে সেই খবরও ছিল।
একটা দারুণ জয়লাভ নিয়ে ফিরতে পারলি রে। এলাকার মহিলা সংগঠন নিয়ে এতদিন অনেক করে ভেবেছি কিন্তু উতরে যেতে পারি নি। তোর উদ্যোগে সেটাই আজ সম্ভব হল।
শরীর দোলাতে লাগল জয়। আগেও অনেকবার সুবিমল কিছু কিছু কাজে বিশেষ সাফল্যের জন্য এভাবে মন খুলে প্রশংসা করেছেন। মনে মনে বুঝল, সেও অসাধ্য সাধন করে সহজে গুরুর নেক নজরে থাকতে পারে। সময়ের পরিবর্তনে প্রয়োজনের সঙ্গে তালমিল করতে কীভাবে নিজেকে রুপান্তরিত করতে হয়, সেটাই শিখে ফেলেছে সে। সুচরিকে বশে আনার জন্যে তার সব কূটকৌশল গুরুর কাছ থেকে শেখা অধিত বিদ্যার তাৎক্ষণিক প্রতিফলন। একবার নিজেকে অনেকখানি সাহসি বলে মনে হল জয়ের। আগামি দিনে সে যে বহু অসাধ্য সাধন করতে পারবে, সেই বিশ্বাস গভীর হয়ে উঠছে হৃদয় সমুদ্রের তলানিতে।
সুবিমল আবার বলতে শুরু করলেন, স্বীকার করছি, আজকাল তুই অনেক বেশি কৌশলী হয়ে উঠেছিস। ভালো লাগছে এই ভেবে যে সুচরিকে সংগঠনে টেনে আনার ফলে তোর মনের দায় কিছুটা মিটতে পারে। সংগঠনে থাকলে সঙ্গ পাওয়া নিয়ে কোনো অসুবিধা থাকে না। আরেকবার চা খাবি নাকি? ইচ্ছা থাকলে বলে আয়, না খেতে চাইলে বাড়িতে ফিরে যাই চল্। রাত অনেক হল, সাইকেল কোথায় রেখেছিস?
এখন আর চা খেতে ভালো লাগছে না।
তাহলে তো ফিরে যেতেহ হয়। তোর জয়লাভের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে এগিয়ে যেতে বেশ লাগবে। হ্যাঁরে, সুচরির সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ নিয়ে তো অনেক কথা বললি,আমাকে নিয়ে ও কী কিছু বলল?
কেবল চাকরি নিয়ে ভাবছে, তার সব কথা নিজেকে নিয়েই।
এতে অস্বাভাবিকতার কিছু নেই। ছোটোবেলায় বাবাকে হারাতে হয়েছে, মাকে নিয়ে দুজনের সংসার। চাকরি পেয়ে সেই মাকে আরেকটু সুখী করার পিছনে কোনো অবাস্তবতা থাকতে পারে না। পেটের দায় এড়িয়ে আমরা কেউ চলতে পারি না। সেই দায় সুচরিতার মধ্যে থাকলে তা কী আমরা অস্বীকার করতে পারি?
তা অবশ্য ঠিক।
বাড়িতে ফিরে সুবিমল কেমন যেন অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন। একটা অদৃশ্য শূন্যতা ক্রমে গ্রাস করছে তাকে। রাতের খাওয়া শেষ করে বিছানার উপর অনেকক্ষণ বসে থাকলেন। সুচরিতা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হলে কতটা লাভ আসতে পারে,সেই চিন্তায় পড়ে থাকলেন বেশ কিছু সময়। মাঝ রাতে দুচোখ জুড়ে ঘুম এল। একটু বেলাতে উঠে চা বিস্কুট খেলেন কিন্তু কিছুতেই মনের দুর্বলতা দূর করতে পারলেন না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল এল। তখনও মনের স্তরে স্তরে অস্বস্থির ধূসর ছায়া রয়ে গেছে। তিনটের দিকে দেখলেন, এক দঙ্গল লোক এসেছে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে।
এসব ব্যাপারে সুবিমলের পটুতা প্রশংসা পাওয়ার মতোই, সর্বোচ্চ স্তরের না হলেও দিব্যি আকাশ ছুঁয়ে যাবার মতো যোগ্যতা রাখেন। সকলকে বারান্দায় বসতে বলে চটজলদি ঘরের ভিতরে ঢুকে সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে আবার বারান্দায় ফিরে এলেন। সুবিমলের বিনীত অনুরোধ, বাপেরা, একটা প্রসঙ্গ মাথায় নিয়ে কথা বলতে হবে। সকলের জন্যে মোট সময় পাঁচটা পর্যন্ত। তার পরেই বিশেষ জরুরি কাজে আমাকে বের হতেই হবে। প্রাকটিক্যালি তোমাদের হাতে ঝাড়া দেড় ঘন্টা সময় তুলে দিলাম। একটু সংক্ষেপে বললে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বলাইকে আগে বলতে বলছি। অনেকদিন পর তোকে দেখলাম, আমাকে ভুলে থাকার অভ্যেস পাকাপোক্ত করে ফেলেছিস নাকি?
মাঝে একদিন এসেছিলাম, দেখতে পাই নি, বাধ্য হয়ে ফিরতে হয়েছিল। গ্রামের একমাত্র প্রাইমারি স্কুলটা ধসে পাশের খালে নামার উপক্রম। এতদিন বলেও কোনো কাজ হয় নি, দু’তিনমাস পরে বর্ষা নামবে, তার আগে একটা ব্যবস্থা করতে না পারলে তো….। সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে বিশেষ চাপ রয়েছে, সেজন্যে দেখা করতে এসেছি।
ভাবছিস কী বিষয়টা আমি ভুলে গিয়েছি? এ্যাই দ্যাখ, গতকাল অফিসে গিয়ে ওয়ার্ক অর্ডার হাতে নিয়ে ফিরেছি। কবে কাজ শুরু হবে, কাল পরশু জানতে পারবি। পঞ্চায়েত সমিতি থেকে ইতিমধ্যে সবকিছু পাস হয়ে গেছে, এখন কন্ট্রাক্টরের ব্যাপার, তাগিদ দিলে তাড়াতাড়ি শুরু হতেই পারে। তবে বর্ষার আগে যে শেষ হবে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়।
পরিমল পিছনে বসে ছিল, সামনে সরে এসে বলল, আপনার নির্দেশ মেনে বর্ধমানে গিয়েছিলাম, দেখাও হয়েছে। সামনের সপ্তাহে আবার যেতে বলেছেন। তখন ফাইনাল করে দেবেন।
ভালো খবর দিলি রে, সফলতার সংবাদে উৎফুল্ল হয়ে উঠল সুবিমলের মুখ।
আপনার কথা শুনে আমার সঙ্গে বেশ নরম ব্যবহার করলেন। চা বিস্কুট খেতে দিয়ে বললেন, আমার বসের কাছ থেকে এসেছ, অবশ্যই যথাসাধ্য চেষ্টা করব। আরও অনেক কিছু প্রশংসা করলেন আপনার নামে। আপনিই নাকি ভদ্রলোককে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন।
সুবিমল শুধু হুঁ বললেন অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে, মুখের বলিরেখায় গৌরবের প্রশ্নচিহ্ন। চোখ তুলে তাকালেন সকলের দিকে, বুঝে নিতে চাইলেন, পরিমলের প্রশংসা কতটা গতিতে আছড়ে পড়ল সকলের উপর। বুঝিয়ে দিতে পারলেন, শুধু আঞ্চলিক স্তরে নয়, তাঁর নেতৃত্ব বহুদূর বিস্তৃত, জেলাপারেও যথেষ্ট প্রভাব প্রতিপত্তি রয়েছে। বিশেষ মুগ্ধতা ও প্রশ্নমিশ্রিত বিস্ময় সকলের চোখে মুখে। সুবিমলের ভাবগম্ভীর জিজ্ঞাসা, রহমত কী আসে নি?
দাদা, এই তো আমি এখানে।
সামনে এস, দরখাস্তটা দিতে পেরেছিলে?
পেরেছিলুম।
সব শুনে কী বললেন?
প্রথমে জিজ্ঞেস করলেন, কে পাঠিয়েছেন?
তারপর?
আপনার নাম বললাম।
তারপর?
তাতেই সব কাজ হয়ে গেল। বরফ গলে যাওয়ার মতো ভদ্রলোক শুধু নরম হলেন না, তো তো করে বললেন, রায়বাবু পাঠিয়েছেন যখন এ নিয়ে আর ভাবতে হবে না, যা করার আমিই করব।
নড়েচড়ে বসলেন সুবিমল। সাতে সত্তর করে দেওয়ার ক্ষমতা যে তাঁর রয়েছে, সেই যাদু বার বার স্পর্শ করতে লাগল। এলাকায় এক ঘাটে বাঘে গরুতে জল খাওয়াতে একমাত্র তিনিই পারেন। খুশিতে সিগার ধরালেন, সুড়সুড় টানের সঙ্গে কয়েকবার আ আ শব্দ করলেন, মানসিক আনন্দ প্রকাশের অভিনব স্পন্দন। উপস্থিত সকলের দৃষ্টি সুবিমলের উপর। তারাও অভিভূত রায়বাবুর বীরত্বের হাসি দেখে, অনন্য সাফল্যের পরিচয় পেয়ে।
সুবিমল চটজলদি হাতঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে নিলেন, চারটে ত্রিশ বাজতে চলেছে। বাজার পর্যন্ত সাইকেলে যেতে অন্তত মিনিট দশেক তো লাগবে। সরল অঙ্ক হল, আরও মিনিট কুড়ি দিব্যি কথা বলতে পারব। —করিম ভাই, তোমাদের রোজা শুরু তো পরের মাসের প্রথম সপ্তাহে। প্রসঙ্গটা আমার মাথায় আছে। পরশু ডিলারের কাছে গিয়েছিলাম, সব বলে দিয়েছি। রোজার মাসে সকলকে ঠিক ঠিক চিনি দিতে হবে। কেউ কেউ চাইলে একটু বেশিও পেতে পারে। সরকার থেকে মসজিদের কোঠায় বিশেষ চিনি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। করিমভাই, তোমাকে একটা প্রসঙ্গ মনে করিয়ে দিই, মসজিদে সাধারণ ইফতারের জন্যে চিনি দেওয়ার প্রস্তাব আমিই প্রথম মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়েছিলাম, তা সাদরে গৃহীতও হয়েছে। এ রাজ্যে ত্রিশ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে আমরা বঞ্চিত করতে যাব কেন? তাছাড়া রোজার ত্যাগ ও মাহাত্ম্যে আমার গভীর বিশ্বাস রয়েছে যেজন্যে বছর বছর ইফতার পার্টি করে থাকি। তোমাদের উদ্যোগে নিশ্চয় এবছর ইফতার পার্টির ব্যবস্থা হচ্ছে। অবশ্যই যাব, পিক আওয়ার্সে বলতে দিও ভাই। অনুষ্ঠান সেরে তোমার বাড়ি থেকে এক ঝলক ঘুরেও আসতে পারি।
শুনতে শুনতে রহিম অভিভূত না হয়ে পারল না। এই লোকটা তাদের জন্যে এত করে ভাবেন? পলকহীন চোখে চেয়ে থাকল সুবিমলের দিকে। রাযরাবু সাধারণ মানুষের সঙ্গে চলতে চলতে হৃদয়ের প্রসারতায় সমুদ্র হয়ে উঠতে পেরেছেন। রাজনীতিকের মধ্যে খাঁটি গণজীবন গড়ে উঠলে এমনি করে সার্বিক হয়ে উঠতে পারেন। সুবিমলের মধ্যে সেই ছবি ধরা পড়ছে, তাছাড়া ঘোড়েল রাজনীতিক সুবিমল ভালো করেই জানেন যে ‘সাচার কমিশনে’র রিপোর্ট বের হওয়ার পরে এ রাজ্যের সংখ্যালঘুরা ফুটবলার তৈরি হয়ে গেছে। আগে ফুটবল হিসেবে ছিল বলেই তাদের নিয়ে যেমন খুশি খেলা যেত, এখন সেই সুযোগ নেই, মাঠের যে কোনো কর্ণারে দাঁড়িয়ে নিজেরাই গোলে বল ঠেলার অধিকার পেয়ে গেছে।
রহিমের মুখচ্ছবিতে তুষ্টির উজ্জ্বল ছায়া, সুবিমলেব মুখে বিজয়ের উন্মাদনা। স্থির বিশ্বাস, রহিমের মাধ্যমে তাঁর বলা কথাগুলো গ্রামে পৌঁছে গেলে সকলে গলে জল হয়ে যেতে বাধ্য হবে। সুবিমলের শেষ কথা, সময় এলে আমাকে নিয়ে একটু বেশি ভাবলেই হল।
দাদা, সব সময় সঙ্গে রয়েছি।
বেশ তো, বেশ তো, পাশে মুখ ঘুরিয়ে দেখলেন, কে একজন অপরিচিত লোক এসেছে তার সঙ্গে দেখা করতে। সুবিমলের সচকিত প্রশ্ন, কোথা থেকে আসছেন?
স্যার, খটিরবাজার থেকে।
কোনো জরুরি খবর?
মস্তান রঘু আমার মেয়েকে বাজার থেকে তুলে নিয়ে গেছে, আপনার পায়ে পড়ি, একটা ব্যবস্থা করুন।
সুবিমল রাগে কাঁপতে শুরু করলেন, উঠে দাঁড়িয়ে রাগত স্বরে বললেন, এভাবে কাউকে পাশবিক শক্তি প্রয়োগ করতে দেব না। এমন ব্যবস্থা নেব, যা জীবনে ভুলতে পারবে না। শুধু ফোন নম্বরটা দিয়ে যান, নতুন কোনো খবর থাকলে তৎক্ষণাৎ আমাকে জানাবেন। উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে তাঁর বিনীত নিবেদন, বিষয়টা আর্জেন্ট বলেই চলে যেতে হচ্ছে, সময় করে কাল পরশু আবার তোমাদের নিয়ে বসব। যা পরিস্থিতি, থানা ঘেরাও এর মতো কঠোর সিদ্ধান্তও নেওয়া যেতে পারে। আগেভাগে সকলকে সচেতন করে দিলাম। একট আস্ত ক্রিমিনালকে যে কোনো মূল্যে ঠান্ডা করে দিতে না পারলে তো মানুষ আমার উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে।
সকলে অবাক হয়ে চেয়ে থাকল সুবিমলের মুখের দিকে। একটু আগে যে মানুষটা এত শান্ত গলায় কথা বলছিলেন, তিনিই একটা জবর খবরে এভাবে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতে পারলেন? সাইকেলে উঠে বসে প্রিয় সাকরেদ জয়ের উদ্দেশ্যে তাঁর বিনীত নির্দেশ, সুচরিতাকে একটু বুঝিয়ে বলিস, যা পরিস্থিতি, ফিরতে দেরি হতেই পারে। তারপর প্যাডেলে চাপ দিয়ে উপস্থিত অন্যান্যদের উদ্দেশ্যে বললেন, বাপেরা কিছু মনে করো না। বলতে বলতে তিরের ফলার মতো মাথা ঝুঁকিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। জয়ের স্থির বিশ্বাস, যে গনগনে আগুন নিয়ে ছুটে চলেছেন তার গুরু, তা চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে থানার ভিতরে ঢুকলেই।
প্যাডেলে আরও চাপ দিয়ে গতি বাড়িয়ে দিলেন সুবিমল। একটা দারুণ প্লট পেয়ে গেছেন। কাজে লাগাতেই হবে। ওই জানোয়ারটার জন্যে তাঁর পক্ষে খটিরবাজারে ঠিকমতো পা রাখা সম্ভব হয় নি। নতুন পরিস্থিতি এসেছে, ভালো মতো ট্যাকল করতে পারলেই ওকে কাত করে দেওয়া সম্ভব। সুবিমলের শরীরের ভিতরে গুরগুর করছিল। মিনিট পাঁচেক এভাবে চলার পরেই পাশে চেয়ে দেখলেন, কে একজন বিবর্ণ মুখে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। কোনো বিপদ-আপদ হবে নাতো? বুকের গভীরে ভয়ের রেশ, তবুও অসীম ভরসায় বুক বেঁধে আরেকটু সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন, কে রে তুই?
আমি রঘু।
এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
প্রবীর ঘোষালের মেয়েকে বাজার থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিস?
রঘু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল।
সুবিমলের রাসভ হুঙ্কার, কী ভেবেছিস তুই?
আমাকে বাঁচান দাদা।
এতে বাঁচানোর কী আছে শুনি?
খটিরবাজার এলাকাটা আপনার হাতে তুলে দিতে চাই।
বিপদে পড়ে আমাকে নতুন করে ঠকানোর ছক কসছিস?
মায়ের দিব্যি করে বলছি, এসব আমার মাথায় নেই।
তোকে বিশ্বাস করা যায় না।
পুরনো রঘুকে ভেবে একথা বলছেন তো?
তুই কী এখন নতুন রঘু হতে চাচ্ছিস?
আপনি পাশে থাকলে সেই চেষ্টা করতেই পারি।
সুবিমল থমকে না গিয়ে পারলেন না। রাজনীতি করতে গেলে সবাইকে মাটির বুক বেয়ে চলতেই হয়। এই সেই রঘু যার কারণে তিনি খটিরবাজার এলাকায় ঠিকমতো পা রাখতে পারেন নি। ভয়ে সবাই এত সিঁটিয়ে থাকত যে তাঁর নিজের হাতে গড়া ফিল্ড বার বার ভ্যানিস হয়ে গেছে। পিছনে যে রঘুর হুমকিজাল ছিল, তা নিয়ে তাঁর মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। ছেলেটা পাকা সুপারি কিলার, অন্যদের ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা ছাড়া উপায় ছিল না, বিরুদ্ধে মন খুলে বলার কেউ ছিল না খটিরবাজারে, আজও নেই। খুচখাচ পিছনের কথা নিয়ে তো রাজনীতি চলে না। সেই অবস্থান অনেকবার ভাঙার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হতে হয়েছে। এমন কী, পাল্টা গ্রুপ তৈরি করেও কিছুতেই রঘুকে বাগে আনা সম্ভব হয় নি। বরং দেখেছেন উল্টো চালচিত্র। রঘু কী ভাবছে, কোনটা পছন্দ করছে, কোনটা অপছন্দ করছে, সেটাই খটিবরাজারের আম-মানুষ খুব বেশি করে খোঁজ রাখত। তাতেই রঘু সহজে বাজিমাত করে দিতে পেরেছে বার বার। খোঁজ রাখাই যে ভয়ের মূল সূত্র, রঘু তা হাড়ে হাড়ে বুঝত বলেই সময় সুযোগ বুঝে অল্প বিস্তর ডোজ দিত নিজের অবস্থান ধরে রাখার জন্যে।
সেই রঘু বিপদে পড়ে তাঁর কাছে আশ্রয় নিতে এসেছে। দুদণ্ড না ভেবে পারলেন না। রঘুকে কী ভাবে ব্যবহার করলে খটিরবাজার এলাকায় নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়ানো সম্ভব, তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন সুবিমল কিন্তু মনের গভীরে এক চিলতে সন্দেহ ওঠানামা করছে। একবার ভাবলেন, এত সহজে রঘুকে বিশ্বাস করা ঠিক হবে না, তাঁকে ধরে অসময় পার করে নিয়ে আবার পুরনো অবস্থানে ফিরে যেতে পারে। এও ভাবলেন, রাজনীতিতে সম্ভাবনার শিল্পকে দুবেলা নতুন করে গড়ে তুলতে হয়, কখনো সফলতা আসে, কখনো আসে না কিন্তু হাত গুটিয়ে বসে থাকাটাই বোকামি, বরং এ প্রক্রিয়াকে নিরন্তর চালিয়ে যাওয়ার মধ্যে সার্থকতার গোপন চাবিকাঠি রয়েছে। মানসিক দোলাচলে দুলতে লাগলেন সুবিমল।
আবার রঘুর মিনতি, বিপরীত কিছু ভাবছেন নাতো? শুধু সামনের বিপদ থেকে রক্ষা করে দিন, দেখবেন, আমি সত্যি সত্যি আপনার হয়ে গিয়েছি। যা বলবেন তাই করব। আপনার নেতৃত্বের বাইরে গিয়ে কিছুই করব না।
সত্যি বলছিস?
এত বড়ো বিপদের সময় আশ্রয়দাতাকে মিথ্যে বলতে যাব কেন?
আমাকে কী করতে হবে বল্?
প্রবীর ঘোষাল নিশ্চয় আপনার কাছে গিয়েছিল।
সেটাই স্বাভাবিক।
তাহলে তো সব শুনে ফেলেছেন, আজকের মতো বাঁচিয়ে দিন দাদা।
একটু খুলে বলবি?
মেয়েটাকে বউ হিসেবে পেতে চাই।
এভাবে জোর করে?
আমাকে কে মেয়ে দেবে বলুন? মাসলম্যানদের দিয়ে সকলে কাজ সেরে নেয় কিন্তু মনে প্রাণে কেউ বিশ্বাস করে না।
এটাও বুঝিস?
ভালো মতোই বুঝি।
তাহলে এপথে আছিস কেন?
আর তো পিছনে সরার উপায় নেই, সরতে চাইলে মৃত্যু অনিবার্য। রঘু আরও নরম হল মনের তলানিতে, কয়েক পা সামনে সরে গিয়ে সুবিমলের দুপা জড়িয়ে ধরল, বিশ্বাস করুন দাদা, মেয়েটাকে আমি অন্তর দিয়ে ভালোবাসি।
তাহলে এভাবে জোর করলি কেন?
বাজারের মধ্যে ওর চলাফেরা দেখে কেমন যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি, অন্যের মাধ্যমে দেবশ্রীকে কাছে পাবার প্রস্তাবও দিয়েছি কিন্তু কিছুতেই রাজি হল না, তাই বাধ্য হয়ে—
আমার কাছে কী সাহায্য চাচ্ছিস বল্?
থানার ব্যাপারটা দেখুন যাতে কোনো বিপদ না আসে।
আর বলতে হবে না, সুবিমল গম্ভীর হয়ে গেলেন।
সন্ধেয় কোথায় দেখা করব বলুন? পটলার দোকানে?
এসব কী বলছিস? একদম নয়, রাত দশটার পর জয়ের বাড়িতে যাবি, আমার উপর আগের সব রাগ ঝেড়ে ফেলতে পেরেছিস তো?
কী যে বলেন দাদা।
ঠিক আছে, এখন যা, বাজার থেকে ঘুরে থানায় যাব।
নিশ্চিন্তে থাকতে পারি তো?
বড্ড বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিস রে।
কী করলে হয় করুন।
ওসিকে আগে সামলানো দরকার।
বেদেয় চেনে সাপের হাঁচি, রঘু এতদিন অন্ধকার পথে থাকতে থাকতে বসের সূক্ষ্ম ইঙ্গিত ধরতে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছিল। আর রা না কেটে দ্রুত সরে পড়ল। ভাবতে ভাবতে গেল, সুবিমলবাবু তার পক্ষে ঘুঁটি সাজাতে শুরু করলে কেউ ছুঁতেই পারবে না।
ঢিমে তালে সাইকেলে এগিয়ে চলেছেন সুবিমল, মাথার ভিতরে লাট খাচ্ছে রঘুর প্রসঙ্গ। ছেলেটার বাহুতে সত্যি বল্ আছে। সরকারি দলের প্রভাব উপেক্ষা করে এতদিন এভাবে চালিয়ে আসার মধ্যে রঘুর যে কৃতিত্ব তা কিছুতেই ছোটো করা চলে না। আগে কেউ এ এলাকায় এত বড়ো ক্যারিশমা দেখাতে পারে নি। থানার পুলিশকেও তটস্ত হয়ে থাকতে হয়েছে ওর জন্যে। রঘুর প্রসঙ্গ উঠলেই ওসির মধ্যে কেমন যেন গড়িমসি শুরু হত, নেতাদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে সময় গুণতেন। সাইকেলটা গেটের সামনে রেখে ওসির ঘরে ঢুকতেই বড়বাবুর বিনীত জিজ্ঞাসা, রঘু নাকি প্রবীর ঘোষালের মেয়েকে…?
সেজন্যে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
আপনার ভাবনা চিন্তা কী?
পথেই শুনলাম, আপনি নাকি রঘুর বিয়েতে নেমতন্ন পাচ্ছেন?
কে বলল আপনাকে?
পথেই শোনা, কোনো ব্যক্তির নাম জড়ানো ঠিক হবে না।
এতদিন আপনি রঘুর বিরুদ্ধেই বলেছেন, আজ নতুন হেঁয়ালি শুনছি। সম্ভাবনার বুক বেয়ে রাজনীতির নতুন শিল্প গড়ে ওঠে স্যার। আয়ারাম গয়ারামদের নিয়ে কূটনীতির সাগরে ভাসতে না পারলে দলের শক্তি বাড়বে কী করে? ভিনরাজ্যের লোক এনে তো রাজনীতি করা সম্ভব নয়। যারা আছে, তাদের মগজ ধোলাই করেই ফিল্ডটা সাজিয়ে তুলতে হবে, অবশ্য সব ক্ষেত্রে আপনি দারুণ হেল্প করেছেন। কখনো সখনো গোপন বিরোধিতা করলেও তা মুখ বুজে মেনে নিয়েছি। খামাখা প্রশাসনকে খেপাতে যাব কেন?
তাহলে কী স্পটে যাব না?
তা বলছি নে, স্পট ভিজিট আপনাকে করতেই হবে, শুধু রঘুকে না ধরলেই হল। সবে তো খেলা শুরু হয়েছে, আমাকে একটু খেলতে দিন, দেখবেন ঘটনাটা ঠিক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেব।
কোনো চাপ আসবে নাতো?
রোষে অগ্নিশর্মা হয়ে সুবিমল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, এলাকায় কোনো চাঁদুর সেই ক্ষমতা নেই স্যার।
ওসি অবাক হলেন সুবিমলের অন্য মূর্তি দেখে। ভদ্রলোক পারেন বটে, তটস্থ হয়ে বললেন, প্রসঙ্গটা শুধু জেনে নিতে চাইলাম।
থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, আপনি আপনার কম্পন নিয়ে থাকুন, আমাকে আমার পথে চলতে দিন। এতদিন কত করে বলেছি কিন্তু রঘুর বিরুদ্ধে একবারও রুখে দাঁড়াতে পারেন নি। প্রশাসনের মাথায় বসে কেন যে এভাবে সমঝোতা করে চলতে হয়, তা মাথায় ঢোকে না। কেবল আপনার গাফিলতির জন্যেই খটিরবাজার এলাকায় ঠিকমতো প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তার করা সম্ভব হয় নি। আম-মানুষের ধারণা, আপনিই গোপনে রঘুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলছেন বলেই ছেলেটা যেমন খুশি চলতে পারছে। সেই ছেলেটা নতুন করে কার পক্ষে গেল তা নিয়ে এত ওকালতি করার কী আছে? সরকারের টাকায় যে প্রশাসন চলছে, সেখানে বসে আপনি কী এভাবে নির্লিপ্ত থাকতে পারেন? অনেকবার সেই দৃষ্টান্ত দেখেছি। বাধ্য হয়ে সোমবার ব্লক কমিটির মিটিং-এ এজেন্ডা দিতে হয়েছে, সিদ্ধান্তের কপি অবশ্যই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে। পরের দিন এসে আপনাকেও একটা কপি দিয়ে যাব।
না মানে আমি তো আপনার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলিনি।
দূর থেকে তাক্ করে যেভাবে ঢিল ছুঁড়লেন, তা আরও বিপদজনক। তাতে যে আমার মাথা ভাঙতে পারে, সেটাই খেয়াল করেন নি।
এসব কথা বলছেন কেন? আমি আপনাকে….।
রঘুর সঙ্গে আমাকে জুড়ে দিয়ে অপদস্ত করতে চাইছেন তো?
কাইন্ডলি আমার কথা শুনুন।
সুবিমল আর বাক্য ব্যয় না করে ঝড়ের গতিতে ওসির ঘর থেকে বাইরে এসে সাইকেলে হনহনিয়ে বাজারের দিকে এগিয়ে চললেন। সূর্য ডুবতে বসেছে পশ্চিমের আকাশ গাঙে। চায়ের দোকানের সামনে এসে দেখলেন, জয়-সুচরিতা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, জয় কী যেন বলে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে, সুচরিতা তা গিলছে রসগোল্লার মতো। সুবিমল একটু হাসলেন, মনে মনে ভাবলেন, প্রদীপকে সেদিন ফেবিকুইক বলে জয় ঠিক কাজ করেনি। সাইকেল থেকে নেমে জয়কে উদ্দেশ্য করে বললেন, এভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস যে?
চমকে উঠল জয়, তা বুঝতে সুবিমলের কোনো অসুবিধা হল না, বললেন, সুচরির জন্যে চা বলেছিস তো?
সবে তো এল।
দোকানে ঢুকতে ঢুকতে সুবিমলের সাদর সম্ভাষণ, এখানে এস সুচরিতা।
পটলাকে বললেন, তিনটে চা দে, দুটো করে ক্রিম বিস্কুট দিস।
জয়ের বিনীত অনুরোধ, গুরু, আমার জন্যে দুটো এক্সট্রা বিস্কুট বলুন।
সুবিমল বিড় বিড় করে বললেন, সুচরির সঙ্গে কথা বলে বেচারার খিদে বেড়ে গেছে।
চমকে উঠল জয়, সুচরিতা সেই প্রসঙ্গে ঢুকলই না, নরম করে বলল, আমাকে ডেকেছিলেন?
তোমার গ্রজুয়েশন হওয়ার খবর পেয়েছি, চাকরি পাওয়া নিয়ে যে খুব ব্যস্ত, তাও জেনেছি। সংগঠন করলে এসব প্রসঙ্গ খুব সহজ হয়ে ওঠে সুচরিতা। মনে রেখো, আমার সংগঠন কারুর উন্নয়নের পথে কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি, বরং যথাসাধ্য চেষ্টা করি কারুর সাকার হওয়ার প্রসঙ্গ সামনে এলেই। কদিন আগে কলেজের বার্ষিক ক্রীড়াপ্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনায় যথেষ্ট দক্ষ, গতমাসে রবীন্দ্র নজরুল জয়ন্তী একসঙ্গে পালন করে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিতে পেরেছ। আমার স্থির বিশ্বাস, সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হলে অপরিসীম সাফল্য পাবে। অন্যদেরকেও সাহায্য করতে পারবে।
এতদিন যে বিশ্বাস শুধুমাত্র কল্পনায় ভাসত, সুবিমলের কথায় তা কঠোর বাস্তবে নামতে শুরু করল। ভিতরে ভরসায় নতুন গ্রাফ তৈরি হতে থাকল। সুচরিতা ভাবল, কলেজ মাঠে কষ্ট করে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো আরেকটা ব্যাপার। শুধু কসরত লাগবে, সময় ব্যয় করতে হবে, ঐকান্তিকতা থাকলেই হল। সুবিমলের কথায় ভাবতে পারল যে সে সব গুণ তার মধ্যে আছে, ভিতরে ভিতরে গর্বিত হল সুচরিতা, উৎসাহের আবেগে ভাসল, বলল, তাহলে পারব বলছেন?
কেন পারবে না? সুবিমলের সুচালো হুঙ্কার। বাড়িতে ফিরে গিয়ে মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করো, আমার কথা বুঝিয়ে বলো, যে চেষ্টায় কলেজে চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছ, শুধু সেটুকু দিতে পারলেই হল, তাতেই ভিতরের শক্তি বেড়ে যাবে। পরের বৃহস্পতিবার কুল্পি উচ্চ বিদ্যালয়ে মহিলা সংগঠন নিয়ে আলোচনা, যেতে পারবে? ভালো করে বুঝে নিতে না পারলে তো ফিল্ডে নামতে পারবে না। এটুকু বলতে পারি, চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্যে যে কসরত লেগেছিল, তার অধের্ক দিতে পারলে সংগঠনে জায়গা করে নিতে পারবে। আমার এলাকার মেয়ে, সাফল্য পেলে সবচেয়ে বেশি খুশি হব আমি। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর নিশ্চয় আমার আনন্দের বহর জানতে পেরেছিলে। সাফল্যের উচ্ছ্বাস এমনিই হয়। তিলে তিলে শক্তি ব্যয় করে যে চারণভূমি তৈরি করতে পেরেছি, তুমি তার উপযুক্ত ধারক বাহক হয়ে উঠতে পারবে বলেই মনে করি। জয় থাকল, তুমি থাকলে, আমার ঐকান্তিক প্রত্যাশা থাকল, দুজনের যৌথ প্রচেষ্টায় সংগঠন তরতর করে এগিয়ে চলবে। এভাবেই সংগঠনে নতুন নেতৃত্ব গড়ে ওঠে সুচরিতা।
অভিনব মানসিক দ্বন্দ্বে দুলতে লাগল সুচরি। অচেনা স্বপ্নের বিভাবরি তাড়া করছে তাকে। ভিতরের তাগিদে অন্য সুর অনুভব করতে পারছে। চাপা স্বরে বলল, তাহলে আসছি দাদা, কুল্পির সভায় নির্দিষ্ট সময়ে চলে যাব।
জয় কী তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসবে?
এটুকু পথ, একাই যেতে পারব।
মন খুলে বললে তো? মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে সবসময় চিন্তায় থাকতে হয়, সংগঠনের মাথায় থাকলে এ ভাবনা থেকে সরে থাকা যায় না।
চলতে চলতে সুচরিতার স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠল বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার প্রথম দিন সন্ধ্যায় বাম হাতের উপর সুবিমলের পাঁচ আঙুল চেপে বসার দৃশ্য। শরীরটা চিড়বিড করে উঠলেও আশু নেতৃত্ব লাভের কুহকে তা মুহূর্তে উবে গেল, বরং ভাবল, হঠাৎ বিদ্যুৎ বিভ্রাট না হলে এসব ঘটত না। সংসারী মানুষ, এসব করতে যাবেন কেন? মাথার চুলে পাক ধরেছে, শীর্ষ নেতৃত্বে থাকার কারণে অনেক গুরু দায়িত্ব সামলাতে হয়। হাঁটতে হাঁটতে বাজারের শেষ প্রান্তে এসে দেখল, প্রদীপ সাইকেলে বাজারের দিকে চলেছে। সুচরিতাকে দেখেই তার অবাক প্রশ্ন, কোত্থেকে এমন অসময়ে?
সুবিমলদার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম।
তাহলে কী রাজনীতিতে নামবে?
তাই ভাবছি, কলেজে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো চেষ্টা নিলে হবে তো?
এত সহজ ভাবছ?
সুবিমলদা তো তাই বললেন।
তোমাকে রাজনীতিতে টানার জন্যে এসব বলতেই পারেন।
মিথ্যে করে এসব বলতে যাবেন কেন?
একদিনেই মাথা ঘুরে গেল?
নেত্রী হওয়ার স্বপ্ন জেগেছে মনে।
অনেক দুর্গম পথ।
চেষ্টা নিতে দোষ কী?
সরল মনে সুবিমলের টোপ এত সহজে গিলে ফেললে?
দেখছি, খেলার মাঠের স্মৃতি এখনও ভুলতে পারো নি।
প্রদীপ থমকে যেতে বাধ্য হল। এ কোন সুচরিকে দেখছে সে? কী সাংঘাতিক এককাট্টা হয়ে উঠেছে। বুঝিয়ে বললে যে কিছু হবে না, তাও একবার ভাবল, কিন্তু কিন্তু করে বলল, সত্যি সত্যি রাজনীতিতে নামছ?
নেত্রী হতে চাই হে।
বড়ো কঠিন পথে ছুটতে চাচ্ছ।
এ্যাভারেষ্ট জয়ের চেয়েও কঠিন?
প্রদীপ স্তম্ভিত না হয়ে পারল না। এতটাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সুচরি? তবুও আবার অনুরোধ জানিয়ে বলল, এত জটিল পথে চলতে ভালো লাগছে তোমার?
উপরে উঠতে গেলে ঘুরপথে ছুটতেই হবে।
প্রদীপ আর কথা বাড়ালো না, বুঝল, অসুখ মাথায় ধরে গেছে। অনুরোধ করে কোনো লাভ হবে না। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিতে বলল, চলো, তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।
রাজনীতি করতে এ প্রস্তাব দিলে না তো?
কী রকম?
আমাকে দুর্বল করে দিতে চাচ্ছ না তো?
দেখছি, সুবিমলকে গিলে ফেলেছ।
রাজনীতি করতে গেলে একজনকে গুরু হিসেবে লাগবেই। না থাকলে উপরে উঠব কী করে? আরেকটা সুখবর দিই তোমাকে। সামনের পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছি।
এত আগে ঠিক করে ফেললে?
সুবিমলদা অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন।
কোন্ স্তরে দাঁড়াচ্ছ শুনি?
পঞ্চায়েত সমিতিতে।
আমাকে কর্মী হিসেবে পাশে নিও।
সুবিমলদা থাকলে আর কাউকে লাগবে না।
প্রদীপ বুঝতে বাধ্য হল, সুচরিতা মাত্র একদিনেই সুবিমলের হাতের পুতুল হয়ে উঠেছে।
নিজেকে কেমন যেন নার্ভাস লাগল। গুম মুখে দাঁড়িয়ে থাকল ভাবনার বিকলতা মাথায় নিয়ে। সুচরিতা সরে গিয়ে প্রদীপের দুহাত চেপে ধরল, এত মন খারাপ করার কিছু হয় নি গো। তুমি আমার ছিলে, আজও আছ, ভবিষ্যতেও থাকবে। চলো, হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি পর্যন্ত যাই।
সামনে ঘুটঘুটে অন্ধকার। পাশাপাশি লাগালাগি শরীর নিয়ে এগিয়ে চলল দুজনে। প্রদীপের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে সুখের স্পন্দন। ধীর কদমে চলতে শুরু করল। মাত্র কয়েক মিনিটের রাস্তা, অনুভূতির প্রগাঢ়তায় চলতে চলতে বার বার শিহরিত হচ্ছিল, বাড়ির সামনে এসে সুচরি বলল, ধন্যবাদ তোমাকে।
প্রদীপ তখনও আবেগে ভাসছে। ঘরের ভিতর থেকে সুচরির মায়ের প্রশ্ন, কাকে ধন্যবাদ দিচ্ছিস রে? জয় কী এগিয়ে দিতে এসেছে? ভিতরে ডেকে নিয়ে আয়, চা খেয়ে যাক।
সুচরিতা প্রদীপের গায়ে ঠ্যালা দিয়ে বলল, মা কী ভাবছে দ্যাখো, আমি নাকি জয়ের সঙ্গে একা একা পথ চলব?
আবার মায়ের ডাক ভেসে এল কানে, শুনতে পাচ্ছিল সুচরিতা, জয়কে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলি কেন? ভিতরে নিয়ে এসে বসতে বল্, চা করে আনছি।
সুচরিতা প্রদীপের গায়ে আরও জোরে ঠ্যালা দিয়ে বলল, অমন হ্যাংলার মতো দাঁড়িয়ে থেকো না, মা বাইরে এসে দেখে ফেললে অন্য কিছু ভাবতে পারে।
অগত্যা প্রদীপ পিছনে ফিরে চলল, সুচরিতার মা তখনও বারান্দার উপরে উন্মুখ হয়ে দাঁড়িয়ে। জয় ছেলেটা খুব ভালো। ছোটো ছোটো করে কথা বলে, বেশ আন্তরিক। ছেলেটা ভিতরে এলে ভালো আপ্যায়ন করার কথাও ভেবে নিল। জয় তো মেয়ের জন্যে ভালো খবরটা বাড়িতে এসে প্রথম জানিয়েছিল। কিন্তু একা সুচরিতাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে সুচরির মায়ের হতচকিত প্রশ্ন, জয় কই?
না এলে কী করব?
ঠিকমতো বলেছিস তো?
কী যে বলো মা, হাত ধরে টানার পরেও এল না।
তাহলে হয়তো জরুরি কাজ ছিল।
তাও হতে পারে।
সুবিমলবাবু কী বললেন তোকে?
অনেক ভালো খবর দিলেন।
কী ভালো বলবি তো।
নেত্রী হয়ে যাচ্ছি মা।
মানে?
একেবারেই সিম্পল।
একটু খুলে বলতে পারিস না?
পর পর অনেকগুলো সুযোগ। ভোটে দাঁড়ানোর সুযোগ, নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ, নিজের চাকরি নিজেই করে নেওয়ার সুযোগ, আরও কত কী। অন্যকে সাকার করে তুলতে আমার নাকি লম্বা হাত থাকতে পারে।
সত্যি বলছিস তো?
লোকটা দেবতার মতো, মন উজাড় করে কথা বলতে পারেন।
তাহলে তো সুবিমলবাবু তোকে খুব পছন্দ করেছেন।
জানো মা, খুব বড়ো মনের মানুষ, কারুর সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে শেখেন নি।
এই সম্পর্কটা রগরগে করে রাখ না, নজরে থাকতে পারলে তোর জন্যে আরও অনেক কিছু অপেক্ষা করে আছে।
কিন্তু মা, আমি কী সুবিমলদার মতো নেতৃত্ব দিতে পারব?
এক্ষুণি অত বড়ো স্বপ্ন দেখছিস কেন?
সুবিমলদা তো স্বপ্নগুলো আমার মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন।
রায়বাবু বড়ো মাথায় বড়ো বড়ো স্বপ্নের রূপকার। তেমন হতে সময় লাগবেই।
আমাকে এভাবে খাঁটো করে দেখ না মা। ওই লোকটার উৎসাহে কলেজ স্পোর্টস্-এ চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছি। রাজনীতি করেও চ্যাম্পিয়ন হতে পারব।
কথা শুনে তোর বাপের কথা খুব মনে পড়ছে রে। নিজের উদ্যোগে এমনি করে অনেক স্বপ্ন দেখত।
সেগুলো আমাকেই পূরণ করতে হবে মা।
সুবিমলবাবু পাশে থাকলে তা সহজে সম্ভব।
সেজন্যেই রায়বাবুর নজরে থাকতে চাচ্ছি।
এ সুযোগ ক’জন পায় বল্ তো?
তা বলেছ ঠিক।
রাত নটা। সুচরিতা মায়ের সঙ্গে যে সুবিমলকে নিয়ে তখনও আলোচনায় ব্যস্ত, তিনিই হন্তদন্ত হয়ে জয়ের বাড়িতে ঢুকে দেখলেন, রঘু তাঁর অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে বসে আছে।
কখন এলি রে? সুবিমলের সাদর সম্ভাষণ।
এই তো একটু আগে।
কোনো নতুন খবর?
থানার পুলিশ গ্রামে ঢোকে নি।
ওসিকে কম ঠ্যালা দিই নি রে।
আপনার কৃতিত্ব স্বীকার করে নিচ্ছি দাদা। এখন বুঝতে পেরেছি, জয়ন্ত দেবনাথের পক্ষে এত কঠিন বিষয় সামলানো সম্ভব হত না। দেবনাথদা শুধু পিছন থেকে তাল ঠোকার গুরুমশাই।
এতদিন পরে বুঝলি?
সরি সুবিমলদা।
হ্যালো রায়বাবু, শুনতে পাচ্ছেন? আমি থানা থেকে বলছি।
বলুন স্যার।
একবার থানায় আসতে পারবেন?
খুব জরুরি?
সেজন্যে ফোন করতে হল, একটু আগে জয়ন্ত দেবনাথ থানায় ঢুকেছেন, তাঁর একমাত্র দাবি, এখনিই রঘুকে এ্যারেস্ট করতে হবে।
একটু পরে যাচ্ছি বলে সুবিমলবাবু ফোন কেটে দিলেন।
আমার কী হবে দাদা?
এত ভয় পেলি?
না মানে ওই তো শুনলাম, দেবনাথবাবু দাবি করছেন—
রাখ তো ওই হুতিটার কথা। সুবিমলের রাসভ হুঙ্কার, ও কে শুনি, একটা থাপ্পড় সামলানোর ক্ষমতা নেই।
রঘু চেয়ে থাকল সুবিমলের মুখের দিকে।
আমি পাশে রয়েছি, এভাবে ভয় পাচ্ছিস কেন? কটা দিন বরং আমার বেলেঘাটার বাড়িতে গিয়ে থাকগে যা। ইতিমধ্যে সব সামলে নিতে পারব। খবর পাঠালেই চলে আসবি।
ওকে নিয়েই যাব তো?
প্রাইভেট কার ঠিক করে দিচ্ছি, ঝক্কি ঝামেলা ছাড়াই যেতে পারবি। ওসিকে সন্তুষ্ট করার জন্যে সঙ্গে কিছু এনেছিস?
এনেছি দাদা।
আমাকে দে।
রঘু হাত বাড়িয়ে বাণ্ডিলটা তুলে দিল।
কত আছে বল্?
পাঁচ হাজার।
এত কমে হয়?
আর সংগ্রহ করতে পারি নি দাদা।
লাগবে তো অনেক।
একটা উপায় বের করুন।
ওসির হাতে পঞ্চাশ হাজার তুলে দিতে হবে, সেটাই কমন রেট, এত কম টাকা নিয়ে আমি কী করব? পরিবেশ ঠান্ডা হলে না হয় একটা সুযোগ করে দিতে পারি তোকে।
তাহলেই পেরে যাব।
সুবিমল একদৃষ্টে চেয়ে থাকলেন রঘুর দিকে। —আর কোনো সমস্যা থাকল না তো?
আপাতত ম্যানেজ করে দিন দাদা।
আচ্ছা, সে না হয় হল।
মন্ত্র পাঠ করিয়ে বিয়েটা সেরে ফেলব?
এক চিলতে হাসি সুবিমলের মুখে। ভিতরের তাৎপর্য বুঝতে কোনো অসুবিধা হল না রঘুর। রাযরাবু গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, আর দেরি করা চলে না রে, এখনিই থানায় যেতে হবে।
রঘু থ্ হয়ে চেয়ে থাকল সুবিমলের দিকে।
ভুলে যাস নে, নেতৃত্বের ভার নেওয়া একটা মস্ত বড়ো গুরুদায়িত্ব। মুখের কথা গলার ফাঁস। তোর প্রসঙ্গটা মাথাব্যাথার কারণ হয়ে উঠেছে। দ্রুততার সঙ্গে সাইকেলে উঠে বসলেন, প্যাডেলে চাপ দিয়ে হনহনিয়ে এগিয়ে চললেন থানার দিকে। মিস্টার সুবিমল ভালো করেই জানেন কীভাবে রাতকে দিন করতে হয়।