বাংলাদেশের বিখ্যাত মরমী কবি ও আত্মতাত্ত্বিক সাধক মহাত্মা লালন সাঁইজিকে নিয়ে ঝড় তোলা হয়েছে; তোলপাড় আরম্ভ করা হয়েছে; বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে আরম্ভ করা হয়েছে প্রবন্ধবাজি। কখনো তাঁর জাত-জন্ম নিয়ে, আবার কখনো তাঁর বাউল বা ফকির হওয়া নিয়ে। উপমহাদেশের বাঘা-বাঘা গবেষক আদাজল খেয়ে নেমে পড়েছেন; কেউ প্রবন্ধ লিখে প্রমাণ করতে চাইছেন; সাঁইজি জন্মগত হিন্দু ছিলেন। অন্যদিকে কেউ প্রমাণ করতে চাইছেন; তিনি জন্মগত মুসলমান। আরেক দল গবেষক বলতে চাইছেন; সাঁইজির জাতিতত্ত্ব বা সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আলোচনা করা বড্ড বাড়াবাড়ি। এছাড়া মহাত্মা লালন সাঁইজির কাল্পনিক জীবনকাহিনী প্রস্তুত করে; তা দ্বারা পুতুলনাচ, যাত্রাপালা, নাটক ও সিনেমার তো শেষ নেই। লালন পরিচয়, বাউল পরিচয় ও ফকির পরিচয় এ ৩টি পর্বে আলোচনাটি শেষ করতে বাসনা রাখছি।
আরবি ভাষায় ফকির পরিভাষাটির দুটি বানান দেখা যায়। যথা;
ফকির- (১) ﻔﻜﻴﺭবিণ বিদ্বান, জ্ঞানী, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, ভাবুক, চিন্তাশীল, বিচারক, বিবেচক, বুদ্ধিমান (প্র) সর্বত্যাগী সিদ্ধপুরুষ, সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসী বা সাধুপুরুষ (শ্ববি) জ্ঞান, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা, knowledge, আক্বল (আ.ﻋﻘﻝ), ইলিম (আ.ﻋﻟﻢ) (আদৈ) মুর্শিদ (আ.ﻤﺭﺷﺪ), পির (ফা.ﭙﻴﺭ) (ইদে) master, teacher (দেপ্র)।
এটি; শ্বরবিজ্ঞানের ব্যৈক্তিক-বৈশিষ্ট্য সারণির ‘জ্ঞান’ পরিবারের ‘চারিত্রিক পরিভাষা’ ও শ্বরবিজ্ঞানের একটি প্রতীতি বিশেষ (সংজ্ঞা) চিত্তপটে সঞ্চিত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তথ্যাদিকে জ্ঞান বা রূপকার্থে বিদ্বান বলা হয় (ছনা) মানুষগুরু (চাপ) কোবিদ ও সম্বিত (উপ) আলো (রূপ) গুরু (মূল) জ্ঞান স্ত্রী ফকিরাণী, ফকিন্নী {আ}
ফকিরাণী (রূপ)বিস্ত্রী বিদুষী, জ্ঞানচর্চাকারিণী {আ.ফকির. ﻔﻜﻴﺮ>}
ফকিরি (রূপ)বি বিদ্যাচর্চা, বিজ্ঞানচর্চা, দার্শনচর্চা, বুদ্ধিবত্তা (ভাঅ) সন্ন্যাসবৃত্তি, সাধুদের বৃত্তি বিণ সাধু সংক্রান্ত {আ.ফকির. ﻔﻜﻴﺮ>}।
ফক্বির- (২) ﻔﻗﻴﺮবিণ ভিখারী, ভিক্ষুক, ভিক্ষাজীবী, নিঃস্ব, দরিদ্র, সর্বহারা, ভিক্ষাবৃত্তিতে জীবিকা নির্বাহকারী স্ত্রী ফক্বিন্নী {আ}
ফক্বিন্নী (রূপ)বিস্ত্রী ভিখারিণী, ভিক্ষাপোজীবিনী {আ.ফক্বির. ﻔﻗﻴﺮ+ বাং.নী}
“যেজন রসিক চাষা হয়, সে যোগ বুঝে হাল বয়, লালন ফকির পায় না ফিকির, হাপুরহুপুর ভূঁই বোনে।” (পবিত্র লালন- ১৬২/৪)।
ফকিরবিষয়ক সাঁইজির কিছু বাণী-
১ “আপনি ফানা আপনি ফকির, আপনি করেন আপন জিকির, বুঝবি কি আলেক ফিকির, সব বেদ পড়ে।” (পবিত্র লালন- ৫৩৪/৩)।
২ “আপনি সাঁই ফকির, আপনি ফিকির, সে লীলার ছলে, আপনার আপনি- ভুলে রাব্বানি, আপনি ভাসে আপন প্রেমজলে।” (পবিত্র লালন- ১১৯/৭৪৭/৩)।
৩ “আমির ফকির হয়ে এক ঠাঁই, সবার পাওনা পাবে সবাই, আশরাফ বলে রেহাই, ভবে কেউ না পাবে।” (পবিত্র লালন- ২৮৮/৩)।
৪ “একা পুত্র তুইরে নিমাই, অভাগিনীর আর কেউ নাই, কী দোষে আমায়- একা ছেড়ে নিমাই, ফকির হলি এ বয়সেরে।” (পবিত্র লালন- ৩২৭/২)।
৫ “এক মেয়ের নাম কলাবতী, নয় মাসে হয় গর্ভবতী, এগার মাসে সন্তান তিনটি, মেজটা ফকির হয়।” (পবিত্র লালন- ৯৫৫/৩)।
৬ “কেউ ফকির কেউ হলো যোগী, কেউ মোহন্ত কেউ বৈরাগী, এবার কার কথায় মন, দিই গিরে।” (পবিত্র লালন- ৩১৭/২)।
৭ “ক্ষীর সর ননি খেতে, বাঁশীটি সদায় বাজাতে, কিবা সুখ পেয়ে তাতে, ফকির হ’লি ভাই।” (পবিত্র লালন- ২৭৯/২)।
৮ “ছয়মাসের এককন্যা ছিল, নয়মাসে তার বিয়ে হলো, এগার মাসে তিন সন্তান হলো, কোনটা করবে ফকিরি।” (পবিত্র লালন- ৪৪০/২)।
৯ “না জেনে ফকিরি আঁটা, শিরেতে পরলে জটা, সার হলো ভাঙ ধুতরা গোঁটা, ভজনহীন সব চুলাতে।” (পবিত্র লালন- ৬৬৫/৩)।
১০ “ফকির ও বৈষ্ণবের পরে, ভক্তিকে ভর্ৎসনা করে, তারা কি বুঝে বসন পরে, বুঝলে কিছু শুনতে চাই।” (পবিত্র লালন- ৯৪/৩)।
১১ “ফকির হলিরে নিমাই কিসের দুঃখে, খাবিদাবি নাচবি গাইবি দেখব চক্ষে।” (পবিত্র লালন- ৬৬১/১)।
১২ “ফকিরি ফিকিরি করা, হতে হয় জ্যান্তমরা, লালন ফকির লেংটি এড়া, মন বসে না কোন মতে।” (পবিত্র লালন- ৬৬৫/৪)।
১৩ “ফের পড়ল মন তোর ফিকিরেতে, যে ঘাটে মরে সারা ফকির ফাকার, ডুবে মরলি সে ঘাটেতে।” (পবিত্র লালন- ৬৬৫/১)।
১৪ “মন যদি আজ হওরে ফকির, লও জেনে সে ফানার ফিকির, ধরো অধরা, ফানার ফিকির না জানলে, ভস্ম মাখা হয় মশক্বরা।” (পবিত্র লালন- ৯৩৩/২)।
১৫ “মাওলাকে জানো যেমন, ফকিরকেও জেনো তেমন, আলিম দর্শন যখন তখন, ফকির দর্শন হাল বেহালে।” (পবিত্র লালন- ৭০৬/৪)।
১৬ “মানসুর হাল্লাজ ফকির সেতো, বলেছিল আমি সত্য, সহি হলো সাঁইয়ের আইন মত, সবাই কি জানতে পায়।” (পবিত্র লালন- ১৪৫/৩)।
১৭ “যে জানে ফানার ফিকির, সে ফকির, ফকির হয় কী শুধু নামের করলে জিকির।” (পবিত্র লালন- ৮৪২/১)।
১৮ “সদা সোহাগিনী সাধে, ফকির কেউ কি হয়, তবে কেন কেউ কেউ, বিদাত-সিদাত কয়।” (পবিত্র লালন- ৯১০/১)।
১৯ “সিরের নিচে কয় মদিনা, কোন্ মুক্বামে তাঁর বারামখানা, নয়লাখ ফকির আনাগোনা, বেচাকেনা করতেছে।” (পবিত্র লালন- ১৭৪/৩)।
২০ “হরদমে যে করে জিকির, তাকে কেবল জেনো ফকির, সদা খোদা ক্বালবে হাজির, ফকির লালন তাই বলে।” (পবিত্র লালন- ৭০৬/৫)।
২১ “হেন ছেলে ফকির হয় যার, ধন্য জনম সে মায়ের, কেমনে রয়েছে ছেড়ে ঘর, হেন সোনার গৌরমণি।” (পবিত্র লালন- ৩০২/২)।
উপোরোক্ত উদ্ধৃতিগুলোর প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায়- সাঁইজির বাণীর সর্বক্ষেত্রে ফকির (ﻔﻜﻴﺭ) পরিভাষাটি ব্যবহার করা হয়েছে। তা ব্যবহার করা হয়েছে বিজ্ঞানী বা দার্শনিক অর্থে। অথবা কোথাও কোথাও বিদ্বান, জ্ঞানী, ভাবুক, চিন্তাশীল, বিচারক, বিবেচক ও বুদ্ধিমান অর্থে। দার্শনিক বলি, বিজ্ঞানী বলি আর বিদ্বান বলি; এসব পরিভাষা বাউলদের যে বায়ুর সাধনা ও বাউলদের যে আত্মজ্ঞান সাধনা তার ধারেকাছেও যায় না। তাই লালন সাঁইজিকে ফকির১ (ﻔﻜﻴﺭ) বলার চেয়ে বাউল বলা অধিক যুক্তিযুক্ত।
পূর্বকাল হতে বঙ্গদেশে খাঁ, গাজি, পাঠান, মল্লিক, ভূইয়া, মৃধা, শেখ ও সরকার প্রভৃতি উপাধি প্রচলিত আছে। আরবি গাজি (ﻏﺎﺯﯼ) পরিভাষাটির অর্থ বিজয়ী, বীর ও বিখ্যাত ইত্যাদি। আর ঐ বংশের একজন লোকের নাম কাঞ্চন। এবার উদাহরণত; বলতে হয় যে; গাজি বংশের- কাঞ্চন যদি চোর হয়; তবুও তার নাম হবে চোর কাঞ্চন গাজি। কাঞ্চন যদি কবি হয়; তবুও তার নাম হবে কবি কাঞ্চন গাজি। কাঞ্চন যদি চেয়ারম্যান হয়; তবুও তার নাম হবে চেয়ারম্যান কাঞ্চন গাজি। কাঞ্চন যদি বাউল হয়; তবুও তার নাম হবে বাউল কাঞ্চন গাজি। অতঃপর কাঞ্চন যদি ফকির হয়; তবুও তার নাম হবে ফকির কাঞ্চন গাজি।
এখানে কাঞ্চনের চোর, কবি, চেয়ারম্যান, বাউল ও ফকির হওয়ার জন্য বিজয়ী ও বিখ্যাত গুণের কোন প্রয়োজন নেই। কারণ; গাজি বা বিজয়ী কাঞ্চনের নিজস্ব কোন গুণ নয় বরং এটি হলো তার পদবি।
অন্যদিকে কাঞ্চন চোর, কবি, চেয়ারম্যান, বাউল ও ফকির গুণের অধিকারী হওয়ার পর তার নামের পূর্বে চোর কাঞ্চন গাজি, কবি কাঞ্চন গাজি, চেয়ারম্যান কাঞ্চন গাজি, বাউল কাঞ্চন গাজি ও ফকির কাঞ্চন গাজি ইত্যাদি পরিভাষা ব্যবহার করতে পারে। আবার ইচ্ছে করলে না-ও পারে। অর্থাৎ কেবল কাঞ্চন গাজি লেখতে পারে।
এ সূত্র হতে বলা যায়; লালন সাঁইজি ফকির পরিভাষাটি কেবল পদবি বা উপাধি রূপে ব্যবহার করেছেন। তিনি গুণের বিচারে উপাধি ব্যবহার করেননি। সাঁইজির অর্জিত গুণ হলো- কবি, বাউল, আত্মতাত্ত্বিক, মরমী, আত্মজ্ঞানী, দার্শনিক ও বিজ্ঞানী ইত্যাদি। গুণের বিচারে উপাধি গ্রহণ করলে তিনি লেখতেন- কবি লালন, বাউল লালন, আত্মতাত্ত্বিক লালন, মরমী লালন, আত্মজ্ঞানী লালন, দার্শনিক লালন ও বিজ্ঞানী লালন ইত্যাদি। অতঃপর এর সাথে তাঁর পদবি যুক্ত করলে হতো- কবি লালন ফকির, বাউল লালন ফকির, আত্মতাত্ত্বিক লালন ফকির, মরমী লালন ফকির, আত্মজ্ঞানী লালন ফকির, দার্শনিক লালন ফকির ও বিজ্ঞানী লালন ফকির ইত্যাদি।
মহামানবগণ কখনোই গুণ বিচারিক সম্বোধন বা উপাধি গ্রহণ করেন না। এককথায় গুণ বিচারিক উপাধিতে তুষ্টু হন না। তাই তিনি কবি, বাউল, আত্মতাত্ত্বিক, মরমী, আত্মজ্ঞানী, দার্শনিক ও বিজ্ঞানী ইত্যাদি উপাধি গ্রহণ করেননি। এজন্য তিনি তাঁর নামের পূর্বে বাউল উপাধিটি ব্যবহার করেননি। যেমন কাঞ্চন কবি হওয়ার পর যদি কেবল কাঞ্চন গাজি লেখে; তবুও যেমন তার কবি বা কবিত্ব প্রতিভা বিলুপ্ত হবে না। তেমন লালন সাঁইজি বাউল হওয়ার পরও যদি লালন ফকির লেখে তবে তাঁর বাউল গুণ বা বাউল প্রতিভা বিলুপ্ত হবে না।
বঙ্গদেশের বংশীয় উপাধি ব্যবহার সূত্র মতে; কাঞ্চন স্বেচ্ছায় তার অর্জিত উপাধি বা গুণগত উপাধি পরিত্যাগ করলেও বংশীয় উপাধি পরিত্যাগ করতে পারবে না। কারণ; বংশীয় উপাধি পরিত্যাগ করলে ব্যক্তির বংশ পরিচয়টিই হারিয়ে যায়। তাই মহাত্মা লালন সাঁইজিও তাঁর অর্জিত উপাধি বা গুণগত উপাধি পরিত্যাগ করলেও বংশীয় উপাধি পরিত্যাগ করেননি।
দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়; বাংলাদেশের চট্রগ্রামের মাইজভাণ্ডারের অনুসারীদের পারম্পরিক উপাধি ভাণ্ডারী, বাংলাদেশের বরিশালের চরমোনাই পিরের অনুসারীদের পারম্পরিক উপাধি মুজাহিদ ও বাংলাদেশের ফরিদপুরের আটরশি পিরের অনুসারীদের পারম্পরিক উপাধি জাকের।
অন্যদিকে বাংলাদেশের দেওয়ানবাগী পিরের অনুসারীদের পারম্পরিক উপাধি আশেকে রাসুল। তাই এসব ঘরানার অনুসারীরা তাদের স্বস্ব নামের আগে ও পরে ভাণ্ডারী, মুজাহিদ, জাকের ও আশেকে রাসুল ইত্যাদি উপাধি ব্যবহার করে থাকে। আবার মাস্টার, ডাক্তার, গায়ক, সরকার ইত্যাদি উপাধি নামের আগে ও পরে লেখার প্রচলনও বঙ্গদেশে দীর্ঘদিনের।
এখানে এতটুকু উল্লেখ করা যায় যে; সাঁইজির ফকির উপাধিটি অবশ্যই তাঁর কোনো গুরুজন, গুরুদেব বা গুরুপরম্পরা হতে প্রাপ্ত। এটি নিশ্চয়ই তাঁর পেশাগত পরিচিতি নয় কোনো মতেই। অর্থাৎ তিনি পেশায় ভিক্ষুক ছিলেন না কখনোই। তিনি এ উপাধিটি স্বেচ্ছায় ব্যবহার করেছেন গুরু বা পরম্পরাগত সম্মান রক্ষার্থে।
অন্যদিকে বাউল তাঁর অর্জিত গুণ। তাই তিনি এটি ব্যবহার করে আত্মপ্রচারে গা ভাসাননি।
পরিশেষে বলা যায়; বাউলের কর্ম, বায়ুর সাধন, বায়ুর প্রাণায়াম ও বায়ুর খেলা ইত্যাদি আলোচনা সাঁইজির বাণীর মধ্যে অধিক লক্ষ্য করা যায়। যা আমরা পূর্বের প্রবন্ধে তুলে ধরেছি। অন্যদিকে বিদ্বান, দার্শনিক বা বিজ্ঞানী সম্পর্কে তেমন কোনো আলোচনা সাঁইজির বাণীর মধ্যে দেখা যায় না। তাই বলা যায় মহাত্মা লালন সাঁইজিকে ফকির বলার চেয়ে বাউল বলাই অধিক যুক্তিযুক্ত। তবে উপাস্য লালন বাউল-ফকিরের অনেক উর্ধ্বে; সব উপাধির নাগালের বাইরে।