জাপানের কুমামোতোর জিকাই ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে পরিত্যক্ত নবজাতকদের জন্য একটি “হ্যাচ” আছে। গত ১৫ বছর ধরে এটি পরিত্যক্ত শিশুদের জন্য একমাত্র “নিরাপদ আশ্রয়স্থল”। এখানে গর্ভবতীদের ২৪ ঘণ্টা সহায়তার ব্যবস্থা আছে, পাশাপাশি আছে হটলাইনের সুবিধা। কোনো নারী গোপনে সন্তান জন্ম দিতে চাইলে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিতে সর্বক্ষণ প্রস্তুত এই ক্লিনিক।
গোপনে প্রসব এবং পরিত্যক্ত সন্তানদের নিরাপদ আশ্রয়ের কারণে ক্লিনিকটি সমালোচনার মুখেও পড়েছে।
কিন্তু হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসক তাকেশি হাসুদা বললেন, ‘‘অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের কারণে অনেক নারী লজ্জায় তা প্রকাশ করতে চান না এবং এটাকে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা মনে করেন। এ ধরনের নারীরা এখানে এসে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।”
হাসপাতালের কর্মী সাওরি তামিনাগা জানান, রাজি থাকলে কখনো কখনো তারা মায়েদের কাছে তাদের শিশুদের এখানে জন্ম দেওয়ার বা রেখে যাওয়ার কারণ জানতে চান। তারা মায়েদের উৎসাহ দেন, যাতে তারা কিছু তথ্য লিখে রেখে যান, যাতে শিশুরা পরবর্তীতে তাদের শেকড় সম্পর্কে জানতে পারে।
জার্মান মডেল অনুসারে ২০০৭ সালে ক্যাথলিক এই হাসপাতালে প্রথম পরিত্যক্ত শিশুদের জন্য “বেবি হ্যাচ” চালু হয়। শত শত বছর ধরে এ ধরনের “বেবি হ্যাচ” কর্মসূচি চলে আসছে।
বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়া, পাকিস্তান এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কিছু দেশে এই মডেল চালু আছে। তবে ব্রিটেনসহ কয়েকটি দেশে এই মডেল নিষিদ্ধ।
প্রত্যেকটি শিশুর তার জন্ম এবং বাবা-মা’র তথ্য জানার অধিকার আছে এবং এই ব্যবস্থায় শিশু অধিকার লঙ্ঘন হয় বলে অভিযোগ করেছে জাতিসংঘ।
জিকাই হাসপাতাল মনে করে “বেবি হ্যাচ” মডেল মূলতঃ জাপানে শিশুদের হয়রানি এবং মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে।
পুলিশ রেকর্ড অনুযায়ী, ২০২০ সালে দেশটিতে ২৭টি শিশু পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায় এবং ২০১৯ সালে হয়রানির শিকার হয়ে ৫৭ শিশুর মৃত্যু হয়।
হাসুদা জানান, পরিত্যক্ত শিশুদের মায়েদের মধ্যে যৌনকর্মী এবং ধর্ষণের শিকার নারী আছেন, আছেন এমন নারী যাদের থাকার কোনো জায়গা নেই।
তিনি বলেন, “বেবি হ্যাচ ব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হলো, সমাজের পরিত্যক্ত মায়েদের জন্য শেষ অবলম্বন এটি।”
এখন পর্যন্ত ১৬১টি শিশু এই হাসপাতালে রেখে গেছেন মায়েরা।
জাপানের প্রথা অনুযায়ী, যারা সন্তানের জন্ম দেবেন, তারাই তাকে লালন-পালন করতে বাধ্য। কিন্তু “বেবি হ্যাচ” ব্যবস্থা এই প্রথার বিরোধী হওয়ায় এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে হাসপাতালটিকে।
যদিও দেশটির সরকার হাসপাতালটিকে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। বরং বৈধ নিবন্ধন আছে এই ব্যবস্থার। দেশটিতে জন্ম, মৃত্যু এবং বিয়ের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। যেসব শিশু পরিত্যক্ত এবং নিবন্ধনে যাদের পরিবারের পরিচয় থাকে না, তাদের “কলঙ্কিত” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
হাসপাতালের নিষেধ সত্ত্বেও অনেক সময় জাপানের শিশু কল্যাণ কর্তৃপক্ষ পরিত্যক্ত শিশুদের পরিবার খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। এর ফলে ৮০% শিশু পরবর্তীতে তাদের পরিবারের ব্যাপারে জানতে পেরেছে এবং ২০% তাদের বাবা-মা বা আত্মীয়ের কাছে ফিরে গেছে।
প্রতি বছর এই হাসপাতালের হটলাইনে লাখো নারীর ফোন আসে। এদের সবাই গোপনে সন্তান প্রসব করতে চান। বেবি হ্যাচে যে নারীরা তাদের সন্তানকে রেখে যান তাদের প্রশ্ন করা হয় কেনো তারা গর্ভপাত করাননি।
হাসুদা জানান, নারীদের সঙ্গে যেকোনো নেতিবাচক ঘটনা ঘটুক না কেনো সমাজ তাদের সাহায্য না করে নারীকেই দায়ী করে। ১৯৪৮ সালে জাপানে গর্ভপাত বৈধ করা হয়। ২২ সপ্তাহ পর্যন্ত গর্ভপাত করা যাবে, তবে এজন্য পুরুষ সঙ্গীর অনুমতি লাগবে। সঙ্গী মৃত, নিখোঁজ হলে বা নারী ধর্ষণের শিকার হলে সেক্ষেত্রে সরাসরি অনুমতি দেওয়া হয়।