বাংলাদেশের বিখ্যাত মরমী কবি ও আত্মতাত্ত্বিক সাধক মহাত্মা লালন সাঁইজিকে নিয়ে ঝড় তোলা হয়েছে; তোলপাড় আরম্ভ করা হয়েছে; বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে আরম্ভ করা হয়েছে প্রবন্ধবাজি। কখনো তাঁর জাত-জন্ম নিয়ে, আবার কখনো তাঁর বাউল বা ফকির হওয়া নিয়ে। উপমহাদেশের বাঘা-বাঘা গবেষক আদাজল খেয়ে নেমে পড়েছেন; কেউ প্রবন্ধ লিখে প্রমাণ করতে চাইছেন; সাঁইজি জন্মগত হিন্দু ছিলেন। অন্যদিকে কেউ প্রমাণ করতে চাইছেন; তিনি জন্মগত মুসলমান। আরেক দল গবেষক বলতে চাইছেন; সাঁইজির জাতিতত্ত্ব বা সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আলোচনা করা বড্ড বাড়াবাড়ি। এছাড়া মহাত্মা লালন সাঁইজির কাল্পনিক জীবনকাহিনী প্রস্তুত করে; তা দ্বারা পুতুলনাচ, যাত্রাপালা, নাটক ও সিনেমার তো শেষ নেই। লালন পরিচয়, বাউল পরিচয় ও ফকির পরিচয় এ ৩টি পর্বে আলোচনাটি শেষ করতে বাসনা রাখছি।
বাঙালী মহামানব লালন সাঁইজি
১. শুদ্ধ শব্দের শুদ্ধ পঠন ব্যতীত লালনাদির প্রকৃত ভাব উদ্ধার করা সম্ভব নয়। সেজন্য পবিত্র লালন পঠন অধ্যায়ন মুখস্ত ও গবেষণার জন্য যথাসম্ভব পরিশুদ্ধভাবে সম্পাদিত বা সংকলিত লালন গ্রন্থ সংগ্রহ করা একান্ত প্রয়োজন।
২. কোন লালন অধ্যায়ন বা মুখস্ত করার প্রয়োজন হলে, উক্ত লালনের প্রতিটি শব্দের অর্থ, ভাবার্থ ও আত্মদর্শনের মূলক ভালোভাবে জেনে ও বুঝে লালন অধ্যায়ন বা মুখস্ত করা একান্ত আবশ্যক।
৩. কঠিন ও ব্যাখ্যামূলক লালনাদির ভাব উদ্ধার নিয়ে কোনক্রমেই কূটতর্কে জড়িয়ে পড়া ঠিক নয় বরং নিজেরা না পারলে কোন সুবিজ্ঞ গুরু গোঁসাইয়ের নিকট হতে জেনে নেওয়াই উত্তম।
৪. সঠিক বিজ্ঞানসম্মত ও যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা ব্যতীত লালনাদির মনগড়া ব্যাখ্যা করা নয়।
৫. অর্থ জেনে ও বুঝে লালন অধ্যায়ন করলে, অতিদ্রুত দিব্যজ্ঞান উদয় হয়। পক্ষান্তরে অর্থ না জেনে ও না বুঝে লালন অধ্যায়ন করলে তা কোন উপকারেই আসে না।
৬. লালনাদির কঠিন ও দুষ্প্রবেশ্য তত্ত্ব ও ভাব উদ্ধার করার জন্য অবশ্যই পাকা গুরু ও গোঁসাইয়ের সাহায্য গ্রহণ করা প্রয়োজন। নিজে নিজে মনগড়া ব্যাখ্যা করতে গেলে ভুলব্যাখ্যায় কবলিত হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক।
৭. পাকা গুরু গোঁসাইয়ের সাহায্য ব্যতীত একাকী লালন গবেষণা ও তত্ত্বাদি উদ্ঘাটনের মতো, হেন কাজ করা কারো পক্ষেই কখনো উচিৎ নয়।
৮. পঠন ও অধ্যায়নের পর গ্রন্থটি যত্রতত্র ফেলে না রেখে যতেœর সাথে নিরাপদ স্থানে তুলে রাখা উচিৎ। তা না হলে শিশু বা কুকুর বিড়ালের দ্বারা গ্রন্থটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
৯. পবিত্র লালন গ্রন্থট রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কালোবর্ণের বসন বা কালোবর্ণের চামড়ার মোড়ক দ্বারা আচ্ছাদিত করে রাখা উত্তম। কারণ এ গ্রন্থটি সাধারণ কোন গ্রন্থ নয় বরং এটি বাংলা ভাষাভাষি মরমীবাউল বৈষ্ণব সহজিয়া মানববাদী, মানবতাবাদী, আত্মতত্ত্ববাদী, অধ্যাত্মবাদী ও লালনপন্থিসহ সব পারম্পরিকগণের একমাত্র ও সর্ব প্রথম বাংলা শাস্ত্রীয় গ্রন্থ।
১০. পবিত্র লালন গ্রন্থটি পবিত্র মনে অধ্যয়ন ব্যতীত, কোন উপকারে আসবে না।
১১. নির্দিষ্ট বৈঠক ব্যতীত সর্ব বৈঠকে সর্ব সময় লালন অধ্যয়ন ও পাঠদানের উপযোগী নয়। কারণ এর ভাব ও ভাষা অনেক উচ্চস্তরে অধিষ্ঠিত।
১২. পরম্পরা জ্ঞানধারিদের বৈঠক ভিন্ন, শাস্ত্রীয় মতানুসারিদের বৈঠকে লালন পাঠদান সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।
ঐশিবাণী লালনাদি
বাঙালী মরমীসাধক মহাত্মা লালন সাঁইজির ওপর অবতীর্ণ সব লালনই ঐশিবাণী। কারণ যে সাধক জ্ঞানস্তরের ১.অন্ধকার ২.ধন্ধকার ও ৩.কুয়াকার- এ তৃতীয়স্তর অতিক্রম করে, জ্ঞানের নৈরাকার স্তরে পদার্পণ করেন, তখন তিনি আর লোককুলে থাকেন না বরং তিনি ঈশ্বরকুল বা প্রতীতিকুলে উন্নীত হন। ফলে তিনি যে কোন একটি দৈবিকাকে ছদ্মনামরূপে গ্রহণ করে, বিশ্বের সর্ব জীবের মধ্যে বিরাজ করেন। প্রতীতিকুল বা ঈশ্বরকুলে উন্নীত হলে, সাধকের বৈক্তিক-সত্তাটি দৈবিকা বা প্রতীতিতে রূপান্তরিত হয়।
উল্লেখ্য লোককুল হতে প্রতীতিকুলে বা ঈশ্বরকুলে উন্নীত না হয়ে বা পদার্পণ না করে, কোন সাধক দৈবিকারূপ ছদ্মনাম গ্রহণ করতে পারেন না। দৈবিকারূপ ছদ্মনাম গ্রহণ করার পর সাধকগণ বিশ্ববাসীর কল্যাণের জন্য, রূপকার্থে যেসব অমীয় ও অমূলবাণী প্রকাশ করেন, তা সবই দৈববাণী বা ঐশিবাণী। দৈববাণী বা ঐশিবাণীকে আকাশবাণীও বলা হয়। আরবি ভাষায় দৈববাণী বা ঐশিবাণীকে অহি (ﻭﺤﻰ) বা ইলহাম (ﺍﻟﻬﺎﻢ) বলে।
ওহি ﻭﺤﻰবি ইঙ্গিত, ছাপ, চিহ্ন, সংকেত, প্রত্যাদেশ, ঐশিবাণী, শব্দ অনুভব, লিখিত সংবাদ, গোপন প্রদত্তবাণী (প্র) কুরানী মনীষীদের রূপকবর্ণনা মতে মহামান্য ঐশিমহামানবগণের নিকট দৈবদূত কর্তৃক প্রেরিত ঈশ্বরের ঐশিবাণী বিশেষ (পরি) মনের মধ্যে উদিত সুভাব, মুখ দ্বারা প্রকাশ করা বা লেখনির সাহায্যে লেখা সুভাব (উপ)বিণ সুবোল (ছনা)বি অবতার (রূ)বি প্রত্যাদেশ (দেত)বি ইঙ্গিত {আ}
ইলহাম ﺍﻟﻬﺎﻢবি ইঙ্গিত, চিহ্ন, ছাপ, সংকেত প্রত্যাদেশ, ঐশি প্রেরণা, স্বর্গ হতে প্রেরিতবাণী (প্র) কুরানী মনীষীদের রূপকবর্ণনা মতে বিশিষ্ট মহামানবগণ যে ঐশিবাণী বা স্বর্গীয়বাণী বিধাতা হতে লাভ করে থাকেন (উপ)বিণ সুবোল (ছনা)বি অবতার (রূ)বি প্রত্যাদেশ (দেত)বি ইঙ্গিত {আ}
বাঙালী মরমীকবি লালন সাঁইজি কর্তৃক প্রকাশিত জীবন্ত লালনাদির মধ্যে, যে মহামূল্যবান আত্মতত্ত্ব, কামতত্ত্ব ও পরমতত্ত্বের শিক্ষার সন্ধান পাওয়া যায়, তা কখনই সাধারণ মানুষ রচিত কাব্য ও গীতিকাব্যের মধ্যে পাওয়া যায় না। সাধারণ মানব রচিত কোন বাণী, সাধারণত দু’চার বছরের অধিককাল জীবন্ত থাকে না কিন্তু ঐশ্বরিকবাণী কিংবা দৈববাণীগুলো অনন্তকাল পর্যন্ত জীবন্ত থাকে। সাঁইজির প্রয়াণের পর হতে এ যাবৎ, একটির পর একটি লালন ক্রমান্বয়ে জীবন্ত হয়ে উঠতে আরম্ভ করেছে। সাঁইজির অমূল্যবাণীগুলোর মধ্যে এযাবৎ প্রায় শতাধিক লালন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পদার্পণ করতে সক্ষম হয়েছে। সেদিন হয়ত অধিক ব্যবধানে নয়, যখন সব লালনাদির সূর ও স্বরলিপি হবে। সুর ও স্বরলিপি হলেই লালনাদি অনন্তজীবন প্রাপ্ত হবে বলে আমরা আশা করি। প্রশ্ন হতে পারে- “গীতি কিভাবে ঐশিবাণী হতে পারে? গীতি তো মানুষকে অশ্লীল পথে নিয়ে যায়।” আমরা বলব- বিশ্বের সব ঐশিবাণী বা দৈববাণীগুলোই প্রাথমিক পর্যায়ে গীতিকাব্যরূপেই অবতীর্ণ হয়। পরবর্তিতে সংকলকগণ বা বিভাগকর্তাগণ গদ্যরীতিতে বা সারি সারি আকারে গ্রন্থে সংস্থাপন করেন। উপমাস্বরূপ বলা যায় বেদ, রামায়ণ, মহাভারত, ত্রিপিটক, জেন্দাবেস্তা, তৌরাত, যাবুর, ইঞ্জিল, কুরান ও লালন মহাগ্রন্থাদি প্রথমে পদ্যরীতিতে বা ছন্দবদ্ধভাবে বা গীতি ছন্দাকারে অবতীর্ণ হয়েছিল। যেমন-
বেদ
“দ্বাদশ প্রধয়শ্চক্রমেকং ত্রীণি নভ্যানি ক উ তচ্চিকেত
তম্মিন্তসাকং ত্রিশতা ন শংকবোহর্পিতাঃ ষষ্টির্ন চলাচলাসঃ”
(ঋবেসপ্রখপ্রম সূ-১৬৪, ঋ-৪৮)।
ত্রিপিটক
“এতমত্থবসং ঞত্বা পণ্ডিতো সীল সংবুতো
নিব্বান গমনং মগ্গং খিপ্পমেব বিসোধয়ে” (ধম্মপদ-গাথা- ২৮৯)।
যাবুর
“ভদ্র সে লোক, যে দুষ্টদের পরামর্শ মত চলে না
পাপীদের পথে থাকে না, ঠাট্টা বিদ্রূপকারীদের আড্ডায় বসে না” (যাবুর- ১/১)।
কুরান
“إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ
فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ
إِنَّ شَانِئَكَ هُوَ الْأَبْتَرُ”
ইন্না আ’ত্বাইনাকাল কাউসার
ফা সল্লি লিরব্বিকা ওয়ানহার
ইন্না শানিয়াকা হুয়াল আবতার। (কুরান- ১০৯, সুরাঃ- কাউসার)।
লালন (গীতিছন্দ)
“চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে,
আমরা ভেবে করব কী,
ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম,
তাকে তোমরা বলো কী।
ছয়মাসের এককন্যা ছিল,
নয়মাসে তার গর্ভ হলো,
এগার মাসে তিন সন্তান হলো,
কোনটা করবে ফকিরি।
ঘর আছে দুয়ার নাই,
মানুষ আছে তার কথা নাই,
কেবা তার আহার জোগায়,
কে দেয় সন্ধ্যাবাতি।
লালন সাঁইজি ভেবে বলে,
মাকে ছুঁলে মরে ছেলে,
এ তিন কথার অর্থ নইলে,
তার হয় না ফকিরি” (পবিত্র লালন- ৪৪০)।
কিন্তু পরবর্তিকালে সংকলকগণ সারি সারি আকারে বা গদ্যাকারে সম্পাদন করেছেন। যেমন-
বেদ- “দ্বাদশ প্রধয়শ্চক্রমেকং ত্রীণি নভ্যানি ক উ তচ্চিকেত, তম্মিন্তসাকং ত্রিশতা ন শংকবোহর্পিতাঃ ষষ্টির্ন চলাচলাসঃ” (ঋবেসপ্রখপ্রম সূ-১৬৪, ঋ-৪৮)।
ত্রিপিটক “এতমত্থবসং ঞত্বা প-িতো সীল সংবুতো, নিব্বান গমনং মগ্গং খিপ্পমেব বিসোধয়ে” (ধম্মপদ-গাথা- ২৮৯)।
যাবুর “ভদ্র সে লোক, যে দুষ্টদের পরামর্শ মত চলে না, পাপীদের পথে থাকে না, ঠাট্টা বিদ্রƒপকারীদের আড্ডায় বসে না” (যাবুর- ১/১)।
কুরান- (“إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ إِنَّ شَانِئَكَ هُوَ الْأَبْتَرُ) “ইন্না আ’ত্বাইনাকাল কাউসার, ফা সল্লি লিরব্বিকা ওয়ানহার, ইন্না শানিয়াকা হুয়াল আবতার” (কুরান- ১০৯, সুরা- কাউসার)।
লালন- “১চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে, আমরা ভেবে করব কী, ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম, তাকে তোমরা বলো কী। ২ছয়মাসের এককন্যা ছিল, নয়মাসে তার বিয়ে হলো, এগার মাসে তিন সন্তান হলো, কোন্টা করবে ফকিরি। ৩ঘর আছে দুয়ার নাই, মানুষ আছে তার কথা নাই, কেবা তার আহার জোগায়, কে দেয় সন্ধ্যাবাতি। ৪লালন সাঁইজি ভেবে বলে, মাকে ছুঁলে মরে ছেলে, এ তিন কথার অর্থ নইলে, তার হয় না ফকিরি- লালন।”
ঐশিবাণীর গুণ
বিশ্বের সব ঐশিবাণী বা দৈববাণীর চারটি গুণ লক্ষ্য করা যায়। যেমন-
১. ঐশিবাণী অবশ্যই রূপকভাবে নির্মিত হয়।
২. ঐশিবাণী অবশ্যই আত্মতত্ত্বভিত্তিক হতে হয়।
৩. ঐশিবাণী বিশ্ববাসীর কল্যাণমূলক হতে হয়।
৪. ঐশিবাণী সার্বজনীন ও সার্বকালীন হতে হয়।
ওপরোক্ত চার (৪)টি গুণ বা বৈশিষ্ট্য সম্বলিত সব বাণীকেই ঐশিবাণী বা দৈববাণী বলা হয়। বাঙালী মরমীসাধক লালন সাঁইজি রচিত, প্রতিটি লালনের মধ্যেই ঐশিবাণী হওয়ার চারটি গুণাগুণ পরিপূর্ণরূপেই বিদ্যমান। এ জন্য আমরা অনায়াসে লালনাদিকে ঐশিবাণী স্বর্গীয়বাণী বা দৈববাণী বলতে পারি। যেমন-
“কৈ হলো মোর মাছ ধরা (ও মন),
সারাজনম ধাপ ঠেলে,
হলাম কেবল বল হারা।
বিলে তো ধাপগুলি,
তাতে মোর ঠেলাজালি,
শুধু উঠেরে শামুক চাড়া,
শুভযোগ না পেয়ে মোর,
হলো কেবল জাল ছিঁড়া।
কতজন সে গল্প করে,
মাছ ধরতে যায় প্রেমসাগরে,
চিনে নদীর তিন ধারা,
মরতে এলাম সে নদীতে,
হলো না জাল ধরা।
যেজন ডুবুরী ভালো,
মাছের ঝিম সে চিনিল,
তার শুভ হলো যাত্রা,
সে নদীর মাছ ধরে,
সে খ্যাতি পেল বিশ্বজোড়া।
কানাই বলাই ছিল ভালো,
মাছের ধারা তারা পেল,
মাছ ধরে যায় তারা,
আমি লালন ভাবছি বসে,
সার হলো লালপড়া” (পবিত্র লালন- ৩৪৯)।
“১কৈ হলো মোর মাছ ধরা, সারাজনম ধাপ ঠেলে, হলাম কেবল বল হারা। ২কানাই বলাই ছিল ভালো, মাছের ধারা তারাই পেল, মাছ ধরে যায় তারা, আমি লালন ভাবছি বসে, সার হলো মোর লাল পড়া।”
আলোচ্য অন্তরাটি নির্মাণের মূল উপাদান- “কানাই বলাই মাছ লালন লাল ও ধাপ” এ পরিভাষাদির প্রত্যেকটিই পুরোপুরি রূপক। মূলোকাদি নিম্নরূপ-
পর্যবেক্ষণ
উপমা ন- চবিত্র- নারী- চরিত্র- রূপক- মূলক
১. কালনাগিনী- ধন্বন্তরী- রজকিনী- কানাই- কবন্ধ
২. খুঁটি- বিম্বল- বলাই- শিশ্ন
৩. মাছ – স্বামী – সাঁই- পালনকর্তা
৪. গৌরাঙ্গ- লালন- সাঁই- পালনকর্তা
৫. উল্কা- লাল- কামরস
৬. বেলা- ধাপ- আয়ু
“কানাই বলাই মাছ লালন লাল ও ধাপ”- এ শব্দাদির প্রত্যেকটিই পুরোপুরি রূপক। অতএব আমাদের আলোচ্য লালনের মধ্যে ঐশিবাণীর প্রথম গুণটি পাওয়া গেল। আবার “কানাই বলাই মাছ লালন লাল ও ধাপ” ইত্যাদির প্রত্যেকটিই আত্মতত্ত্বভিত্তিক দৈবিকা।
রূপক- মূলক
১. কানাই- কবন্ধ
২. বলাই- শিশ্ন
৩. মাছ- পালনকর্তা
৪. লালন- পালনকর্তা
৫. লাল- কামরস
৬. ধাপ- আয়ু
অতএব আমাদের আলোচ্য লালনের মধ্যে ঐশিবাণীর দ্বিতীয় গুণটিও পাওয়া গেল। আলোচ্য অন্তবাটির মধ্যে মানবমনের পশুত্বভাব তিরোহিত করে, মনসত্বভাব অর্জন করে, সারাজগতের প্রতিপালক সাঁইয়ের সাথে দেখা করার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। এটা নিশ্চয় বিশ্ববাসীর আধ্যাত্মিককল্যাণমূলক অমূল্যবাণী। অতএব আমাদের আলোচ্য লালনের মধ্যে ঐশিবাণীর তৃতীয় গুণটিও পাওয়া গেল।
“কৈ হলো মোর মাছ ধরা,
সারাজনম ধাপ ঠেলে,
হলাম কেবল বল হারা।
কানাই বলাই ছিল ভালো,
মাছের ধারা তারাই পেল,
মাছ ধরে যায় তারা,
আমি লালন ভাবছি বসে,
সার হলো মোর লাল পড়া।”
আলোচ্য অন্তরাটি স্থান, কাল, পাত্র, জাতি ও বর্ণ কোন কিছুর সাথেই সম্পৃক্ত নয়। এ জন্য নিশ্চয় এটা বিশ্বজনীন বা সর্বজনীন। অতএব আমাদের আলোচ্য লালনের মধ্যে ঐশিবাণীর চতুর্থ গুণটিও পাওয়া গেল। পরিশেষে আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি, মহাত্মা লালন সাঁইজি বিরচিত প্রত্যেকটি লালন ঐশিবাণী বা স্বর্গীয়বাণী। এটা আমাদের বাঙালী জাতির সর্বকালের ও সর্বশ্রেণির মানুষের জন্য স্বর্গীয়বাণী রূপ সাহিত্য সম্পদ। তদ্রূপ প্রতিটি লালন বিশ্বের সর্বশ্রেণির মানুষের জন্য অত্যন্ত পুজনীয় ও অত্যন্ত পবিত্র রূপক সাহিত্য সম্পদ।
স্বর্গীয়াবতার লালন সাঁইজি বাঙালীজাতি, বাংলাভাষাভাষী তথা বিশ্বাবাসীর জন্য, বাঙালী এ ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ যে, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী অবতার ছিলেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমাদের বাংলাভাষায় হেন মহাপুরুষের আগমন না হলে, বাঙালীজাতি বিভিন্ন শাস্ত্রীয় সংস্কারের গভীর অন্ধকারে ঘুরপাক খেতো, আরো কতদিন তা কল্পনাতীত। তিনি সুতীক্ষè আধ্যাত্মিক ও আত্মতত্ত্বভিত্তিক জ্ঞানের মাধ্যমে, লালনাদির দ্বারা রূপক ও মূলকের মধ্যে পার্থক্য বা সনাতন ও সংস্কারের মধ্যে পার্থক্য, চমৎকারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। মূলক ও রূপককে আরবি ভাষায় হাক্বিক্বি (ﺤﻘﻴﻘﻰ) ও মাজাযি (ﻤﺟﺎﺯﻯ) বলে। যেমন তাঁর বাণী-
“কী কালাম পাঠালেন আমার সাঁই দয়াময়,
একেক দেশে একেক বাণী কয় খোদা পাঠায়।
এক যুগে যা পাঠায় কালাম,
অন্যযুগে হয় কেন হারাম,
দেশে দেশে উপমা তামাম,
ভিন্ন দেখা যায়।
যদি এক খোদার হয় বর্ণনা,
তাতে তো ভিন্ন থাকে না,
মনুষের সব রচনা,
তাইত ভিন্ন হয়।
একেক দেশে একেক বাণী,
পাঠান কী সাঁই গুণমনি,
মানুষের রচিত জানি,
লালন ফকির কয়।” (পবিত্র লালন- ৩০৫)।
পুরাণীরা যেরূপ গীতাকে সরাসরি শ্রীকৃষ্ণের মুখ নিঃসৃতবাণী বলে বিশ্বাস করেন, তদ্রূপ কুরানীরা কুরান ও হাদিসে কুদসিকে সরাসরি কাঁইয়ের বাণী বলে বিশ্বাস করেন। পুরাণীরা আরো বলেন- বিশ্বের সব গ্রন্থাদির চেয়ে শ্রীমদ্ভগবত গীতার মান অনেক ঊর্ধ্বে। বিশ্ববাসীর সুখশান্তি ও সুপথ প্রদানের জন্য, গীতার মতো একটি গ্রন্থই যথেষ্ট। তারা নাগরী বর্ণ ও নাগরী ভাষাকে স্বর্গীয়ভাষা বলে বিশ্বাস করে থাকেন। তারা শ্রী গোবিন্দকে আদিপিতা বা আদিমানব এবং শ্রীমতি সরস্বতিকে আদিমাতা বা আদিমানবী বলে বিশ্বাস করে থাকেন।
অপরপক্ষে কুরানীরা পবিত্র কুরান ও হাদিসে কুদসিকে সরাসরি কাঁইয়েই বাণী বলে বিশ্বাস করে থাকেন। তারা আরো বলেন- বিশ্বের অন্যান্য মহাগন্থাদির চেয়ে পবিত্র কুরানের মান অনেক উর্ধ্বে। তারা বিশ্ববাসীর সুখ সাচ্ছন্দ ও সাধন ভজনের জন্য, এ একটি গ্রন্থকেই যথেষ্ট মনে করে থাকেন। তারা আরবি বর্ণ ও আরবি ভাষাকে স্বর্গীয়ভাষা বলে বিশ্বাস করে থাকেন। তারা হযরত আদমকে (ﺍﺩﻢ) আদিমানব বা আদিপিতা ও হযরত হাওয়াকে (ﺤﻮﺍﺀ) আদিমানবী বা আদিমাতা বলে বিশ্বাস করে থাকেন। এরূপে বিশ্বের সর্ব দেশের সর্বভাষার সর্বজাতিই, যার যার শাস্ত্রীয় গ্রন্থ, যার যার ভাষা, যার যার শাস্ত্রীয়সংস্কার ও যার যার শাস্ত্রীয় মহামানব বা ঐশিদূতকে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ বলে বিশ্বাস করে থাকেন।
লালন ও বলন ব্যতীত কোন ঐশিবাণী এখনো বাংলাভাষায় অবতীর্ণ হয়নি। এমনকি এখন পর্যন্ত আমাদের বাংলা ভাষায় কোন শাস্ত্রীয় নীতিমালা প্রণয়ন করা বা আবিষ্কার করা হয়নি। “যদি একই খোদার হয় বর্ণনা, তাতে তো ভিন্ন থাকে না, মানুষের সকল রচনা, তাইত ভিন্ন হয়।” মহাপুরুষ লালন সাঁইজি উদাত্ত কণ্ঠে বর্ণনা করেছেন- শাস্ত্রীয় মতবাদ ও শাস্ত্রীয় গ্রন্থ, শাস্ত্রীয় সংস্কার এগুুলো একান্ত মানুষের সৃষ্টি, এগুুলো বিধাতার সৃষ্টি নয়। বিশ্ব বিধাতার সৃষ্টি হলে সব শাস্ত্রীয় গ্রন্থাদি ও শাস্ত্রীয় সংস্কারাদি এক ও অভিন্ন হতো। তাতে কোন প্রকার ভিন্নতা থাকত না। তিনি আরো বলেছেন- “একেক দেশে একেক বাণী, পাঠান কী সাঁই গুণমনি, মানুষের রচিত জানি, লালন ফকির কয়।” বিশ্বব্যাপী এ শাস্ত্রীয় মতবাদ ও শাস্ত্রীয় সংস্কারাদি, সব কিছুই মানুষ মানুষের প্রয়োজনে নির্মাণ করেছে। মানুষ মানুষের প্রয়োজনে রূপকার্থে শাস্ত্রীয় সংস্কারাদি সৃষ্টি করেছে। রূপকার্থে নির্মিত এরূপ সাহিত্যকে আরবি ভাষায় মাজাাঝি (ﻤﺟﺎﺯﻯ) বলে। মানুষের নির্মিত শাস্ত্রীয় সংস্কারাদি দ্বারা সংসার সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় কিছুটা হলেও উপকার পাওয়া যায়।
মাজাযি (ﻤﺟﺎﺯﻯ) বা শাস্ত্রীয় রূপকসংস্কারাদি স্থান, কাল ও পাত্রভেদে ভিন্নভিন্ন। যে দেশের যেরূপ জলবায়ু ও পরিবেশ সে দেশে সেরূপেই গড়ে উঠে শাস্ত্রীয়সংস্কার। মানুষ সামাজিকভাবে বসবাসের জন্য, যুগেযুগে শাস্ত্রীয় সংস্কারাদি নির্মাণ করেছে। কিন্তু ব্যক্তিগত সাধন ভজনের জন্য শাস্ত্রীয় সংস্কারাদি বা রূপকসংস্কারাদির পরিবর্তে আত্মদর্শনের কোন বিকল্প নেই। মানুষের ব্যক্তিগত সাধন ভজন ও মানসিক উন্নয়নের জন্য হাক্বিক্বি (ﺤﻘﻴﻘﻰ) বা মিনহাজ (ﻤﻨﻬﺎﺝ) বা সনাতনী সাধন পথ। পবিত্র কুরানে এ ব্যাপারে পবিষ্কার বলা হয়েছে যে, প্রত্যেকের জন্য দু’টি পথ রয়েছে, একটি হলো রূপকসংস্কার এবং অপরটি হলো প্রকৃতপথ বা সনাতনী পথ। যেমন- (لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا) অর্থ- তোমাদের প্রত্যেকের জন্য সংস্কার ও সনাতন পথ রয়েছে (কুরান- মায়িদা- ৪৮)। আরবি ভাষায় একে মাজাাঝি (ﻤﺟﺎﺯﻯ) ও হাক্বিক্বি (ﺤﻘﻴﻘﻰ) বলে। মানবদেহের প্রকৃতমূলক গোপন রেখে রূপকসদস্যের মাধ্যমে শাস্ত্রীয়শিল্প আবিষ্কারের বয়স তিন হাজার (৩,০০০) বছর অতিক্রম করলেও, বর্তমান সময় পর্যন্ত রূপক বা মাজাাঝি (ﻤﺟﺎﺯﻯ) metaphor, allegory এর বর্ণনাই সর্বত্র শুধু শোনানো হচ্ছে। বাস্তব শিক্ষা বা ভেদবিদ্যা বা এরফান (ﻋﺮﻔﺎﻦ) কোথাও শোনানো হয় না। ফলে সাধারণ মানুষের চরিত্রের মধ্যেও, তেমন কোন পরিবর্তন হয় না, এমনকি শাস্ত্রীয় শিক্ষা মানুষের জীবনে, বাস্তবে তেমন কোন উপকারে আসে না। কারণ কোন বিষয়ের মূলভাব ভালোভাবে বুঝতে না পারলে তা মানবীয় চিত্তপটে স্থায়ীত্বলাভ করে না।
শাস্ত্রীয় মহাগ্রন্থাদির মধ্যে নির্মিত রূপকগল্প ও উপাখ্যানাদি দিন দিন যতই প্রচার ও প্রসার হচ্ছে, আতংবাদ ও উগ্রবাদের পরিমাণ ততই বাড়ছে। হেন সংকটময় মুহূর্তে বিশ্বের বিভিন্ন শাস্ত্রীয় গ্রন্থাদির মধ্যে বর্ণিত রূপকউপমাদির আত্মদর্শনের প্রকৃত মূলকাদি উদঘাটন করে তা প্রচার ও প্রসার করতে থাকলে আতংবাদ, উগ্রবাদ ও সাম্প্রাদায়িকতা বহুলাংশে হ্রাস পাবে বলে আমরা মনে করি।
যুগকে ৭.আধুনিকযুগ ৬.মধ্যযুগ ৫.আদিমযুগ ৪.ধাতুরযুগ ৩.প্রস্তরযুগ ২.পদার্থযুগ ১.শক্তিযুগ- এ সাতভাগে ভাগ করা হয়। প্রস্তর যুগকেই মানব সভ্যতার প্রথমযুগ বলা হয়। প্রস্তর ব্যতীত অন্য কোন কিছুর ব্যবহার মানুষ জানত না বলে, তখন সর্ব কাজে একমাত্র পাথর ব্যবহার করত তারা। কারণ তখন ছিল না সহজলভ্য মারণাস্ত্র, ছিল না কারাগার, ছিল না ভাষা, ছিল না দুষ্টদের শাসন ও দমনের কোনে ব্যবস্থা। এছাড়াও অভিযুক্তকে শাস্তিদানকারী বিচারকের জন্য ছিল না দেহরক্ষী ও ছিল না বিচারকদের জন্য পৃথক কোন আবাস নিবাস। তখন অভিযুক্ত, অভিযোগকারী, প্রতিভূ, সাক্ষী এবং বিচারক সবাইকে একত্রে বসবাসসহ, একত্রে চলাফিরা করতে হতো, এমনকি একত্রে আহার বিহার ও নিশিযাপন পর্যন্ত তাদের করতে হতো। এমন সময় যাযাবর দলের দুষ্ট, দুষ্কৃতিকারী, কুচক্রী ও লম্পটদের নিয়ন্ত্রণ করা, দলপতিদের নিকট অত্যন্ত কঠিন ছিল। দুষ্টদের দমন ও শিষ্টদের পালন করার পর, নিজের প্রাণ রক্ষা করাও ছিল তাদের নৈমিত্তিক সমস্যাদির মধ্যে অন্যতম।
এরূপ সংকটাপন্ন মুহূর্তে দুষ্ট দমন ও শিষ্ট পালনের জন্য শাস্ত্রীয় মতবাদ নামক এ অন্ধবিশ্বাস অস্ত্রটি মানুষই মানুষের প্রয়োজনে আবিষ্কার করেন। মানব সভ্যতার প্রথমযুগ বা প্রস্তরযুগেই অন্ধবিশ্বাস অস্ত্রটির উদ্ভাবন হয়েছিল বলে গবেষকগণ মনে করেন। একমাত্র দুর্বলচিত্ত দুষ্টদের শাসন ও দমনের জন্যই এ পদ্ধতিটি উদ্ভাবন করা হয়। “গোত্রীয় প-িত ও দলপ্রধানগণ ১.সৃষ্টিকর্তা ২.পালনকর্তা ৩.সংহারকর্তা ৪.আদিমানব/ আদিমানবী ৫.বর্থ্য ৬.স্বর্গ ও ৭.নরক নামক শাস্ত্রীয়মূল পরিভাষাদি রূপকার্থে নির্মাণ করেন। তারা ব্যাখ্যা দেন যে, স্রষ্টা এ বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন, তিনি প্রয়াণোত্তর কালে পাপ-পুণ্যের বিচার করেন, পাপীদের নরকে নিক্ষেপ করেন, নরক অত্যন্ত যন্ত্রণাময় স্থান এবং পুণ্যবানদের স্বর্গে প্রেরণ করেন, স্বর্গ অত্যন্ত সুখময় স্থান। পালনকর্তা বিশ্বের সবকিছু প্রতিপালন করেন। সংহারকর্তা (যম) বিশ্বের সব জীবের প্রাণনাশ করেন ——– ইত্যাদি ইত্যাদি।” এটিই ছিল অন্ধবিশ্বাসের বীজ। এরূপেই মানবীয় সভ্যতার প্রথমযুগে বা পাথরের যুগে দুষ্ট দমন ও শিষ্ট পালনের জন্য নামক অন্ধবিশ্বাস অস্ত্রটি নির্মিত হয়।
অতঃপর এ অন্ধবিশ্বাস অস্ত্রটি প্রস্তরযুগ ও ধাতুরযুগ পেরিয়ে আদিমযুগে পদার্পণ করলে আদিমযুগের মানুষ এর সর্ব প্রথম আবিষ্কৃত মূলক ঠিক রেখে রূপক পরিভাষার আবিষ্কারের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ ‘রূপক সাহিত্য’ উদ্ভাবন করেন- যা আজো রূপক সাহিত্য নামেই বিশ্ববাসীর নিকট সুপরিচিত। আদিমযুগ হতে এ রূপক সাহিত্যটির কাঁধে পা রেখে না জেনে ও না বুঝে স্বার্থান্বেষী শাস্ত্রীয় মতবাদ ব্যবসায়ীরা একের পর এক শাস্ত্রীয় মতবাদ আবিষ্কার করে সাধারণ মানুষকে শাস্ত্রীয় মতবাদ নামের বিভেদ-বৈষম্যের বেড়াজালে বা আত্মঘাতী মরণপাশে আবদ্ধ করতে আরম্ভ করেন। ফলে সৃষ্টি হতে থাকে অসংখ্য শাস্ত্রীয়দল ও উপদল। গত মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগে দুষ্ট দমন ও শিষ্ট পালনের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে অভিনব স্বয়ংক্রীয় অস্ত্রাদি ও কারাগার এবং আধুনিককালে আরো উন্নত সব মারণাস্ত্র আবিষ্কারের ফলে- সে-ই প্রস্তরযুগে উদ্ভাবিত অন্ধবিশ্বাস অস্ত্রটির চিরপরিসমাপ্তি ঘটেছে। কারণ বর্তমানে দুষ্ট দমন ও শিষ্ট পালনের জন্য নীতিকথা, শাস্ত্রীয়ছড়া, শাস্ত্রীয়কথা, শাস্ত্রীয় গল্পকাহিনী বা সৃজক পালক নাশক স্বর্গ ও নরকের ভয়ভীতি প্রদর্শনের প্রয়োজন হয় না। এখন বাদী বিবাদী প্রতিভূ সাক্ষী ও বিচারক একত্রে বাস করেন না। এ জন্য বিচারক ও সাক্ষীর প্রাণনাশের সম্ভাবনাও নেই। এ জন্য সে প্রস্তর যুগে উদ্ভাবিত শাস্ত্রীয় মতবাদ নামক অন্ধবিশ্বাস অস্ত্রটির ব্যবহার বিলুপ্ত প্রায়।
অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় হলো- আধুনিককালে আবিষ্কৃত অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের সাহায্য নিয়ে, এক শ্রেণির শাস্ত্রীয় মতবাদ ব্যবসায়ী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সে-ই অন্ধশ্বিাস অস্ত্রটিকে ব্যবহার করে মানবঘাতি মহামারী সৃষ্টি করেছে। স্বার্থান্বেষী শাস্ত্রীয় মতবাদ ব্যবসায়িরা অন্ধবিশ্বাস অস্ত্রটি ব্যবহার করে, কোমলমতি কিশোর ও কিশোরীদের প্রয়াণোত্তর রূপকস্বর্গ লাভের লোভ দেখিয়ে, আগে মন হরণ করে, পরে হাতে তুলে দিচ্ছে অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রীয় মারণাস্ত্র। ‘বাঁচলে বীর মরলে স্বর্গ, প্রাণের চেয়ে শাস্ত্রীয় মতবাদ বড়’ ইত্যাদি নাদধ্বনি কিশোর কিশোরীদের শিক্ষা দিচ্ছে তারা। স্বার্থান্বেষী শাস্ত্রীয় মতবাদ ব্যবসায়ীদের অন্ধবিশ্বাস অস্ত্রের মরণপাশে আজ অনেক বিজ্ঞজনকেও আটকে পড়তে দেখা যাচ্ছে। আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে বিজ্ঞাননির্ভর ও প্রমাণনির্ভর হতে না পারলে বা প্রস্তর যুগে উদ্ভাবিত অন্ধবিশ্বাস অস্ত্রের মরণপাশ হতে বের হয়ে আসতে না পারলে এবং শাস্ত্রীয় অন্ধবিশ্বাসীদের মরণকবল হতে বের হয়ে আসতে না পারলে প্রয়াণোত্তর রূপকস্বর্গের লোভে কিশোর কিশোরীদের আত্মঘাতি বোমা বহনের হাত হতে রক্ষা করার কোন পথই আমাদের সম্মুখে উম্মুক্ত নেই।
রূপকস্বর্গের লোভ রূপকনরক ও রূপকস্রষ্টার ভয় প্রদর্শন করে দুষ্টদমন ও শিষ্টপালন- এটা ছিল প্রস্তরযুগের কিংবদন্তিমূলক অদ্ভূতসংস্কার। এটা ছিল সেযুগের সোনালী অধ্যায়। কিন্তু সেটি আজকের জন্য অবশ্যই শাস্ত্রীয় মহামারী। সৃজক, পালক, নাশক, স্বর্গ ও নরক এসব মানুষের সৃষ্টি। বর্তমানে এগুলোকে বলা হয় রূপক সাহিত্য। অথচ এসব রূপক সাহিত্যের খপ্পরে পড়ে আত্মঘাতন বা আত্মহনন কোন বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না। এ মুহূর্তে শাস্ত্রীয় অন্ধবিশ্বাস ও জ্ঞানবিজ্ঞানের তুলনামূলক আলোচনা ও পর্যালোচনা করে কোমলমতি কিশোর-কিশোরী ও যুবক-যুবতীদের রূপকস্বর্গের লোভে আত্মঘাতী বোমা বহনের মতো লোমহর্ষক পথ ও মত হতে সরিয়ে আনা আমাদের প্রতিটি মানুষের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে আমরা মনে করি। হাক্বিক্বি ﺤﻗﻴﻗﻰবিণ মূল, যথার্থ, মর্মার্থ বি মূলক, বাস্তব {আ} মাজাযি ﻤﺟﺎﺯﻯবি রূপক, ছদ্ম, কলা, কৃত্রিম, অপ্রকৃত (ব্য্য) যে অর্থালংকারে উপমান ও উপমেয়ের অভেদ কল্পনা করা হয়। যথা- মুখচন্দ্র। যেসব কাব্য বা নাটকে কোন তত্ত্বকে রূপ দেওয়া হয় (পরি) সত্তার ছদ্মনাম, সত্তার উপমান নাম, বৈক্তিকসদস্যাদির সামাঞ্জস্যপূর্ণ ছদ্মনাম ব্যবহার করে মানব কল্যাণমূলক কল্পিত বর্ণনা (সংজ্ঞা) ১.আত্মদর্শনের উপমিত বিষয় বস্তুকে প্রকৃতির উপমান বিষয় বস্তুর সাথে সার্থক তুলনা করে রচিত গল্পকাহিনীকে রূপক বলে ২.যে অর্।
চলবে…