কালজয়ী সাহিত্যে সৃষ্টি নিয়ে বাঙালির প্রাণের কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শতবর্ষ উদযাপন চলছে। গবেষণালব্ধ সৃজনশীলতায় সমৃদ্ধ প্রবন্ধ, কবিতা, সংগীত, গল্প, নাটক, শিশুসাহিত্য ও উপন্যাস রচনায় কাজী নজরুল ইসলাম অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। বাংলা সাহিত্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণের বাণীবাহক কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬ খ্রি.) ছিলেন বিদ্রোহী চেতনার ধারক বাহক এবং রূপকার। তাঁর সংগ্রামশীল বর্ণাঢ্য জীবনে রচিত কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য ও সংগীতশাস্ত্রসহ সৃষ্টিশীল মৌলিক প্রতিভার রূপস্বরূপ সাধনার অনুশীলন এবং চর্চা আবহমান বাংলার বাঙালি সমাজে আজও বিরাজমান। এ নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা ও অনুসন্ধানী গবেষণার ধারা শতাব্দী পেরিয়ে এখনো সমানভাবে গুরুত্ব বহন করছে। যা সাহিত্যক্ষেত্রে এমন সাফল্য, স্বাতন্ত্র্য, সাযুজ্য পাঠক ও সমালোচকের নিকট বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত পরাধীনতা, শোষণ-বঞ্চনা, সামাজিক ও ধর্মীয় গোঁড়ামী এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও প্রতিবাদী প্রত্যয় ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে তিনি আজও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। অধুনা নজরুল প্রতিভার স্বরূপ সন্ধান, অনুধাবন এবং তাঁর সাহিত্যের নবমূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন সৃষ্টিশীল সমাজের লেখকগণ। যা নজরুল চর্চা ও অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে এক মূল্যবান ও অপরিহার্য সংযোজনা। যা আজও আমাদের মুগ্ধ করে।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম যুগ প্রবর্তক ও মৌলিক প্রতিভার অধিকারী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য নিয়ে বিশ্লেষণী আলোচনার প্রবণতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বড়ো প্রতিভার অন্যতম বিস্ময় হলো বারংবার তাঁর মূল্যায়ন চিন্তার গুরুত্ব পুনর্বিচার করা। নজরুলের সাহিত্য ও শিল্পকর্ম নিয়ে পাঠকের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির পিপাসা অপূরণীয়। তাই নতুন করে তাঁকে জানতে চাওয়ার বাসনা অমূলক নয়। এমন দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমান প্রেক্ষিতে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষ্যে চলমান রয়েছে বিভিন্ন সেমিনার, আলোচনা-পর্যালোচনা এবং কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণামূলক গ্রন্থের প্রকাশ। তাঁর সাহিত্যকীর্তি ও মাঙ্গলিক চিন্তাধারার বিদ্রোহী ভাবাবেদন সার্বিক পরিচয়ে বিভিন্ন গ্রন্থের ফ্রেমে তুলে ধরার একটি প্রচেষ্টা দুই বাংলা জুড়ে অব্যাহত রয়েছে। চৈতন্যের উপলব্ধি থেকেই প্রাবন্ধিকগণ কাজী নজরুল ইসলামকে মূল্যায়নের নিজস্ব প্রয়াস গ্রহণ করেছেন। বিশেষ করে উল্লেখ করতেই হয় ‘বিস্তীর্ণ আকাশ জুড়ে কাজী নজরুল ইসলাম’ সম্পাদিত প্রবন্ধ সংকলন আঙ্গিকগত সমীক্ষায় কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ সংকলনটির অভিনব ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচ্য।
বাঙালির জাগরণ এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর কবিতা ও গান ছিল প্রেরণার প্রধান উৎস। তাঁর সৃষ্টিকর্মে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালিসুলভ ভক্তির প্রাবল্য, আবেগের আতিশয্য ও প্রাণপ্রাচুর্যে বিদ্যমান থাকতো বিচিত্র মনোনিবেশ। যেখানে ব্যক্তিগত ভালোলাগা বা মন্দলাগার মতো কোনো বিষয় মুখ্য হিসেবে কখনোই দেখা দিতো না। বাঙালির জাতীয় জীবনে মুক্তির অবগাহনই ছিল তাঁর সৃষ্টিশীল প্রেরণার অন্যতম উপাদান। ধনবাদী যুগের শোষণযন্ত্রের কবলে পড়ে মানুষ যে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হারিয়ে ফেলে, কবি কাজী নজরুল ইসলাম তা তীব্রভাবে উপলব্ধি করে বিপ্লবের প্রেরণায় বাঙালি জাতিকে বরাবরই উদ্বুদ্ধ করেছেন। প্রতিবাদ ও প্রতিকারের আশায় লেখনির মাধ্যমে তাঁর এমন সংগ্রাম ছিল ক্লান্তিহীন।
কাজী নজরুল ইসলাম-এর প্রতিভার যথাসাধ্য বিশ্লেষণ তুলে ধরার প্রয়াস অন্বিষ্ট হয়েছেন বহু গবেষক। যার মধ্য দিয়ে সুনিবিড় মহিমার প্রত্যয়ে বিদ্রোহের বার্তা ও সাম্যবাদের রূপান্তর সূচিত হয়েছে। যেখানে তারুণ্যের উদ্দীপনায় গৌরবময় চিন্তাচেতনা ভিন্নমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। আন্তরিক তৃপ্তি ও কৃতজ্ঞতা চিত্তে কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর যুক্তি নির্ভর স্বাধীন অভিমত ব্যক্ত করেছেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়। তাই বাস্তবতার প্রেক্ষিতে আজ কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে অনুশীলন ও চর্চা করা জরুরি একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়ে। ভারতের অশুভ শক্তি হিসেবে উপস্থিত হয়েছে ফ্যাসিট শক্তি তাদের তুঘলকি কাজকর্মের ফলে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। সংবিধানের মূল কাঠামোর উপর আঘাত হানছেন অশুভ শক্তি। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে রাজশক্তির অমানবিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী আওয়াজ তুলেছিলেন।
আবেগের পরিবর্তে যুক্তির আলোকে ও রস বিচারে কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টিকৃত সাহিত্যে বিশ্লেষণে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে আমাদেরকে। হৃদয়ে যদি নতুন করে জীবনপ্রীতির দর্শনে হৃদয় ও বুদ্ধিমুক্তির তাগিদে কাজী নজরুল ইসলামকে জনমানসে আবিষ্কারের আগ্রহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় তবেই অব্যাহত প্রচেষ্টা প্রয়াস ও সার্থক হবে।
যুগস্রষ্টা কাজী নজরুল ইসলাম সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নবজাগরণের অন্যতম রূপকার হিসেবে পরিচিত। আর এই রূপকের অনন্য সাধারণ ভাবনা ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় যথাযথ আবেদনে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম ছিলেন। মূলত শক্তি ও মুক্তির চেতনায় মানব প্রত্যয় নিয়ে যুগযন্ত্রণায় তিনি যে দ্রোহের ভূমিকা পালন করেন তারই রূপান্তর বিদ্রোহী কবিতার নির্যাস। জাগতিক অন্যায়, অবিচার, শোষণ, দুঃশাসন ও অমানবিকতার বিরুদ্ধে ছিল তাঁর বিদ্রোহ। পরাধীন ভারতবর্ষে যখন মানবতা শৃঙ্খলিত, সমাজকাঠামোয় তমসাচ্ছন্ন, তখন তিনি স্বদেশ ও স্বজাতির মুক্তির কামনায় হয়ে ওঠেন অসনিসংকেত। ব্যক্তিনিরপেক্ষ, মুক্তিকামী ও স্বাধীনচেতা মানুষটি দেশ ও জাতিকে শৃঙ্খলমুক্ত করতে শক্তি ও প্রত্যয় নিয়ে গেয়েছেন জাগরণী গান।
কাব্যগ্রন্থ, ধর্মদর্শন, ইতিহাস, লোকসাহিত্য, সংগীত, নাটক, ছোটোগল্প, সমাজভাবনা ও শিল্পসাহিত্য বিষয়ক বৈচিত্র্যময় বিষয়ে সহজলভ্য উপায়ে কাজী নজরুল ইসলাম-এর কলম প্রথম স্বাধীনতার সুর জাগিয়ে তোলে পরাধীন ভারত জুড়ে। যা আজও সেই ভাব-সৌন্দর্যের অমিয়সুধা উপভোগ করছেন পাঠক বাঙালি ও বাঙালি জাতি। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর লেখায় বরাবরই জাগরণ ও দেশপ্রেমের অনুষঙ্গ ও উদ্দীপনামূলক ভাবাবেদন তুলে এনেছেন। বিশেষ করে পিছিয়ে থাকা বাঙালিদের জীবনাচার ও তাঁদের অতীত, বর্তমান এবং ভূত-ভবিষৎ সম্পর্কিত কর্মপন্থা বিষয়ক লেখায় অধীক যত্নবান থেকেছেন।
ক্রিসমাসের রাত ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে বাইশ বছরের যুবক কাজী নজরুল ইসলাম কলকাতার ৩/৪ সি, তালতলা লেনের বাড়িতে বসে কাঠ পেন্সিলে লিখেন কালজয়ী ‘বিদ্রোহী’ কবিতা । শতবর্ষ পেরিয়ে আজও সমান জনপ্রিয় হয়ে আছে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি। হয়তো অনাগত সময় ধরে এই কবিতার আবেদন বাঙালি জীবন ও সমাজে অটুট থাকবে।#