মঙ্গলবার সকাল থেকেই কলেজ মাঠে অভিনব তোড়জোড় শুরু হল। সূর্যের সাত রঙের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মাঠকে সাজিয়ে গুছিয়ে তুলতে ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগে কোনো খামতি ছিল না। বার্ষিক অনুষ্ঠান বলে কথা, মনের নির্যাসে সকলে দুলছে। অধ্যাপক, অধ্যাপিকা, ছাত্রছাত্রী সকলের মিলিত প্রয়াসে দুটো দিন কাটবে বেশ। মানসিক ইমেজের গভীরে তলিয়ে নিজেদেরকে রঙিন করে তোলার নতুন উদ্যোগ। কয়েক শ’ টুকরো স্মৃতির রুপোলি পর্দায় শেষ হবে সেই অনুষ্ঠান।
কসরতের সঙ্গে ভাগ্যের চাকা গড়াবে আপন গতিতে। গত বছরের বিজয়ী হয়তো এ বছর হেরে যাবে, নতুন কেউ চ্যাম্পিয়ন হবে। সেই অনিশ্চিত প্রহেলিকার হাতছানি সারা মাঠ জুড়ে। প্রিন্সিপাল দেবেশ রায় ভালো করেই জানেন, তাঁকে অনেক কাঁটার পথ পার হয়ে মূল চেয়ারে বসতে হয়েছে। এ অনুষ্ঠানকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে আরও জনপ্রিয় করে তুলতে বদ্ধপরিকর তিনি। কুঁড়ি থেকে প্রস্ফুটিত ফুল— জীবনের বিকাশপর্ব এমনিই, সূর্যের ধিকিধিকি তেজ বাড়ার মতো।
মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন পরিমল নস্কর। স্থানীয় মানুষ। দর্শনের জনপ্রিয় অধ্যাপক। নিজের পাঠদানে মুন্সিয়ানা দেখানোয় তাঁর জুড়ি মেলা ভার। এলাকার মিশ্র সংস্কৃতি অক্ষুণ্ণ রাখতে তাঁর প্রয়াস মনে রাখার মতো। সব সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। সেই অর্থে পরিমলবাবু খুব আশা করেছিলেন, প্রিন্সিপাল হওয়ার দৌড়ে তাঁর সামনে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী থাকবে না কিন্তু বাস্তবে তা ঘটে নি। শেষ পর্যন্ত সামান্য নম্বরের হেরফেরে তাঁকে পরাজিত হতে হয়েছিল। সেই থেকে মনে মনে গুমরে আছেন। মুখের বলিরেখার আড়ালে তজর্ন গর্জন লুকিয়ে রাখতেন। একটা কঠোর প্রতিজ্ঞা খেলা করত তাঁর ভিতরে। সময় সুযোগ পেলে ঠিকমতো বুঝিয়ে দিতে পারবেন বলেই আশা করেছিলেন কিন্তু টানা দশ এগারো মাসে সেই সুবর্ণ সুযোগ দেখতেই পেলেন না। মনের তলানিতে চাপা দুঃখভার কয়েক কুইন্টাল ভারী পাথরের মতো চেপে বসেছিল।
নতুন প্রিন্সিপাল দেবেশ রায় কলকাতা থেকে আসেন। কলেজ চালাতে গেলে যে স্থানীয় মানুষজন ছাত্রছাত্রীকে কাছে পেতে হবে, তা হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলেন। সেই অর্থে নিজস্ব ইমেজ বাড়াতে বার্ষিক ক্রীড়ানুষ্ঠানকে নিজের প্লাটফর্ম হিসাবেই বেছে নিলেন। আদরের ছাত্রছাত্রীরা যেন ভাবতে পারে যে নতুন প্রিন্সিপালের উদ্যোগেই এ অনুষ্ঠানকে এত বেশি জমকালো করে তোলা সম্ভব হয়েছে। ইতিমধ্যে আশেপাশের কয়েকটা পঞ্চয়েত সমিতির সভাপতি, স্থানীয় বিধায়ক, সাংসদ ও পাশাপাশি দুই ব্লকের দুই বিডিওকে লিখিত আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভিতরের ভাঙাচোরা অবস্থানকে মজবুত করে তুলতে মাঝে মাঝে আড়ম্ভরতার উপর খুব বেশি নির্ভর করতে হয়। দেবেশ রায় তা ভালো মতোই জানতেন। ছন্নছাড়া হতশ্রী পারিপার্ষিকতাকে একান্ত অনুকূল করে তুলতে সর্বতো প্রচেষ্টায় নেমে পড়েছেন তিনি। সাফল্যের মুকুট মাথায় উঠলে এলাকার মানুষ ভাবতে বাধ্য হবে যে পরিমলবাবুকে বাদ দিয়ে তাঁকে গ্রহণ করে এতটুকু ভুল হয় নি।
কলেজের বার্ষিক অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র হাতে পেয়ে সুবিমল রায় চমকে না উঠে পারলেন না। শুধমুাত্র স্থানীয় রাজনীতির বস হিসেবে নয়, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি হিসাবেও নানা সামাজিক উন্নয়নমলূক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন তিনি। জয়কে দেখিয়ে বললেন, তোর হিলুবিলুর কলেজ থেকে নেমতন্ন এসেছেরে।
সত্যি গুরু?
এই তো, দ্যাখ না। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, নে ধর।
জয় দুচোখ বিস্ফারিত করে দেখতে দেখতে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল। বুঝল, বড়ো পদে থাকলে এমনি করে সুযোগ কাছে আসে। চেয়ে থাকল নীল আকাশের দিকে। জানালা দিয়ে বেশ দেখা যাচ্ছে। দিগন্তহীন আকাশ যেন কেবলমাত্র সুবিমল রায়ের দখলে। চুটিয়ে রাজনীতি করার সূত্রে জীবনের পলেপলে নানা অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে পেরেছেন বলেই এত বড়ো আকাশের উপর এভাবেই প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছেন।
জয়কে উদ্দেশ্য করে রায়বাবুর চাপা কথা, হ্যাঁরে, চিঠির ভিতর সুচরিতাকে দেখতে পেলি নাকি? অন্য কিছু ভাবিস নে, তোকে নিয়েই অনুষ্ঠানে যাব, চোখের আশ মিটিয়ে দুপলক দেখার সুযোগ পাবি।
কী যে বলেন গুরু।
তোর মনের কথা বুঝি রে।
না মানে গুরু….।
এভাবে আড়ষ্টতায় ভুগিস নে, দ্বিধা দ্বন্দ্বে থাকবি কেন? আমি তো তোর সঙ্গে রয়েছি। শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারবি কিনা, সে প্রসঙ্গ আলাদা কিন্তু চেষ্টা করে দেখতে তো বাধা নেই। কেবল সেজন্যেই তোকে সঙ্গে নিয়ে যাব।
জয়ের মধ্যে নতুন অনুভূতির কলকলানি, অভিনব অভিযাত্রার মুখ খুঁজে পেল সে। বাধা পেয়ে থমকে যাওয়ার ইচ্ছাটা যেন হঠাৎ বেগবতী সমুদ্র হয়ে উঠছে। সুবিমল সম্পর্কে নতুন মূল্যায়ন শুরু হল তার মধ্যে। শুধু শুধু রাজনীতির গহ্বরে পড়ে থাকেন না, তার মনের খবরও রাখেন। সুচরিতার প্রতি তার দুর্বলতা জেনে ফেলেছেন বলেই এভাবে সাহস যোগাতে পারলেন। ঝমঝমিয়ে রঙিন বৃষ্টি শুরু হল জয়ের মেঘমেদুর আকাশে। গুরু যে তার সঙ্গে রয়েছেন, তা বেশ বুঝতে পারল।
মাঝের কটা দিন জয় মনের উড়োজাহাজে চড়ে এত বেশি এদিক ওদিক করল যে নিজেই কেমন যেন দিশেহারা হয়ে গেল। যার জন্যে এত বেশি মানসিক তোড়জোড়, সেই সুচরিতার কাছ থেকে এখনও সে তেমন কোনো সাড়াই পায় নি। গুরু সঙ্গে থাকলে বড়ো জোর একটা চাপ থাকবে মেয়েটার উপর কিন্তু তাতেই যে ভালোলাগা ভালোবাসার ফুল হয়ে উঠবে, সেই বিশ্বাস জয়ের মধ্যে ছিল না। হতাশার মধ্যে ক্ষীণ আশার আলোয় দুলতে থাকল সকালে বিকালে। নিরিবিলি থাকলে সেই দোলাচল ক্রমেই বেড়ে চলেছে। নির্দিষ্ট দিনেই দেখল, সুবিমল রায় তাকে সঙ্গে নিয়ে সকাল দশটার মধ্যে কলেজের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন।
প্রিন্সিপাল দেবেশ রায় সাদর অভ্যর্থনা জানাতে এতটুকু ভুল করলেন না। ভালো করেই জানেন, সুবিমল রায় স্থানীয় রাজনীতির সবচেয়ে দামি হিরেমানিক। আপদে বিপদে তাঁর সাহায্য একান্ত প্রয়োজন। তাছাড়া নরম মনোভাব দেখাতে পারলেই অধ্যাপক পরিমল আরও বেশি চাপে পড়ে যাবেন, জানাতে পারবেন, সুবিমল রায় হাতে রয়েছেন যখন কোনো বিরূপ ভাবনা থাকলেও তা চেপে রাখাই শ্রেয়। তাঁর পক্ষে তা হবে বিরাট প্লাস পয়েন্ট।
একটু পরে খেলা শুরু হল। প্রিন্সিপালের উদ্দেশ্যে সুবিমল রায়ের বাঁকা প্রশ্ন, আর কে কে এসেছেন?
এখনও তো কাউকে দেখছি নে।
তাহলে প্রাইজ বিতরণের সময় আসবেন।
প্রিন্সিপাল দেবেশ রায় একটু হাসলেন, বুঝলেন, রাজনীতি করার সূত্রে ফাঁকা মাঠে সুবিমল ভারি সুন্দর গোলে বল ঠেলতে পারলেন। রাজনীতির ঘোড়েলবাজি এমনিই। সুবিমল আবার মন্তব্য করলেন, স্যার, ঠিক সময়ে খেলা শুরু করে ভালোই করলেন। অনেক জায়গায় দেখেছি, শেষ দিনে সন্ধের আগে পর্যন্ত সব ইভেন্ট শেষ করা সম্ভব হয় না।
ঠিক ধরেছেন আপনি। দেবেশ রায় হাত বাড়িয়ে মিষ্টার সুবিমলের সঙ্গে হ্যাণ্ডসেক সেরে নিলেন। বললেন, চলুন আমার সঙ্গে, ঘুরে ঘুরে নিজস্ব তত্ত্বাবধানের চমৎকারিত্বগুলো দেখাই। জানি, বিশেষ অর্থে কলেজ বৃহত্তম সামাজিক প্রতিষ্ঠান। আপনাদের সমর্থন পেলে সেই সামাজিকীকরণের পর্ব আরও উচ্চাঙ্গরূপ লাভ করতে পারে।
তালে তালে মাথা নাড়লেন সুবিমল রায়। সোনালি চেনফ্লাগ দিয়ে মাঠের চারদিক ভরিয়ে তোলা হয়েছে। সবুজ মাঠ সম্পূর্ণ শুনশান। এক টুকরো কাগজ কোথাও পড়ে নেই। ঘাসের ফলফলে ডগাগুলো ঝিলমিল রোদে চকচক করছে। লম্বা সারি সারি ঝাউগাছের ছায়া মৃদুমন্দ হাওয়ায় দোল খেতে খেতে এদিক ওদিক পল্লবিত হচ্ছে সবুজ ঘাসের বুকে। প্রস্তুতির নিপুণতায় সুবিমল রায় মুগ্ধ না হয়ে পারলেন না। নিজের মন্তব্যে বললেন, মাঠ সাজানোর মুন্সিয়ানায় জিতে গিয়েছেন স্যার।
প্রাণখোলা স্বীকৃতি দিচ্ছেন?
শুধু স্বীকৃতি হিসেবে ভাবছেন কেন, এটাকে কঠোর বাস্তব মন্তব্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন। গত বছর বার্ষিক অনুষ্ঠানের সময় বিশেষ দরকারে মাঠের পাশ দিয়ে গিয়েছি, এত জৌলুস দেখি নি। তাছাড়া এতগুলো ভি. আই. পি-কে আমন্ত্রণ জানিয়ে নতুন রেকর্ড করে ফেলেছেন, জনসংযোগ বাড়াতে এসব খুব প্রয়োজন।
দেবেশ রায়ের মুখে মৃদু হাসির বিচ্ছুরণ, প্রিন্সিপাল হিসেবে বিশেষ গর্বিত। এও ভাবলেন যে রাজনীতির হিরেমানিকরা একটা ছোটো কৃতিত্বকে এভাবেই কাব্য করে বলতে পারেন, রাজনীতির আসরে দাপট থাকলে তা সহজেই সম্ভব।
সুবিমল রায়ের দুচোখ হঠাৎ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল মাঠের বিপরীত দিকে শর্ট প্যান্ট পরা সুচরিতাকে দেখে। দুই উরু সোনালি রোদে চিকমিক করছে। পিছনে দাঁড়িয়ে জয়শংকর। শারীরিক উত্তাপে কাঁপছে বলেই মনে হল। একটু হাসলেন আনমনে। প্রিন্সিপাল বুঝতে পারলেন না, কেন সুবিমল রায় এভাবে থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন, কেন খেলার ট্রাকের পিছনে এভাবে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন? অন্য খাতে তাঁর চিন্তা চক্কর মারছিল। কোনো বিশেষ ত্রুটি ধরা পড়ল না তো? দেবেশ রায়ের বিনীত প্রশ্ন, সুবিমলবাবু, কোনো বিচ্যুতি দেখতে পেলেন কী?
না, তেমন কিছু নয়, চোখ ঘুরিয়ে নিলেন রায়বাবু।
প্রিয় ছাত্র প্রদীপ এসে দাঁড়ালো প্রিন্সিপালের সামনে, স্যার, কিছু বাকি থাকলে বলতে পারেন, হাতে হাতে সেরে ফেলতে পারি।
মঞ্চটাকে আরেকটু ভালো করে সাজিয়ে দাও। সন্ধের পরে প্রাইজ বিতরণ রয়েছে। ওই মঞ্চেই নাটকও মঞ্চস্থ হবে।
তাহলে আসছি স্যার। প্রদীপ দলবল নিয়ে এগিয়ে চলল মঞ্চের দিকে। মঞ্চ সাজানোর ক্ষেত্রে ছেলেটার জুড়ি মেলা ভার। খুব ছোটোবেলা থেকেই সে এসবে অসাধারণ বোধগম্যতার অধিকারী। কলেজে নাটক মঞ্চস্থ করার প্রসঙ্গ এলেই বাংলা বিভাগের প্রধান মেহেবুব হোসেন মঞ্চ সাজানোর দায়িত্ব প্রদীপের উপর বার বার ছেড়ে দিয়েছেন। সফলও হয়েছেন। প্রিন্সিপালের মধ্যেও সেই বিশ্বাস গড়ে উঠেছিল। ছেলেটা পড়াশোনায় যত না ভালো, তার চেয়ে অনেক বেশি পটু সংহতি ও পরিবেশ রক্ষায়।
ডেকরেটরের লোকজন উপস্থিত ছিল, প্রদীপের নির্দেশে তারা মঞ্চ সাজাতে শুরু করল। প্রায় ঘন্টাখানেক ডুবে থাকল সেই কাজে। প্রদীপ বর্মণ এরকমই। আত্মিক চেতনার নির্যাস নিয়ে যে কোনো দায়িত্বে আত্মনিয়োগ করতে ভালোবাসে। প্রিন্সিপাল দেবেশ রায় মঞ্চের সামনে এসে দাঁড়ালেন, মুখে একরাশ হাসি। প্রদীপের প্রশ্ন, স্যার, ঠিকমতো সাজাতে পেরেছি তো?
এ ব্যাপারে তুমিই সেরা, তা নিয়ে আবার প্রশ্ন কেন?
আরক্তিম মুখে প্রদীপ দাঁড়িয়ে থাকল, মনের গভীরে স্বীকৃতি পাওয়ার উষ্ণতা।
দেবেশবাবু বললেন, এখন যেতে পারো, বন্ধুদের নিয়ে খেলা উপভোগ করো, প্রয়োজন হলে আবার ডেকে নেব। মঞ্চ সাজানোর জন্যে বিশেষ পুরষ্কার এবছর তুমিই পাবে। বিতরণ সভায় অবশ্যই উপস্থিত থাকবে। ডোন্ট মিস দ্য টাইম।
মাইকে ঘোষণা হল, প্রথম ইভেন্ট শুরু হতে চলেছে, ছাত্রীদের একশো মিটার দৌড়। সুচরিতা গত বছর অল্পের জন্যে প্রথম হতে পারেনি। এ বছরও সে অন্যতম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। মালবিকা জিতে গিয়েছিল। দুজনকে নিয়ে ইতিমধ্যে কানাকানি শুরু হয়েছে। আকর্ষণের অভিনব কেন্দ্রবিন্দু। কেউ ভাবছে, সুচরিতা জিতবে, কেউ ভাবছে মালবিকাকে নিয়ে। ফিনিসিং পয়েন্টে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে ঘোষকদের বিশেষ অনুরোধ, জাজমেন্টে যেন ভুল না হয়।
সুচরিতা কম্পিত মনে ট্রাকে দাঁড়িয়ে। বাম পাশে মালবিকা। আরও ছ’জন। আগে হিট হয়ে গিয়েছিল। মূল পর্বে মোট আটজন প্রতিদ্বন্দ্বী। সুচরিতার মন গতবছরের পরাজয়ের ভাবনায় দুলছে। সে কী পারবে নতুন করে জয়ে ফিরতে? অচেনা নিবিড় টানাপোড়েনে ভেসে যেতে লাগল। রেফারির বাঁশি বেজে উঠতেই চারদিকে চড়চড় হাততালি পড়ল। দু’একটা শিস ভেসে এল কানে। দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা গর্জে উঠল মালবিকার পক্ষে। টানটান উত্তেজনা। তৃতীয় বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীরাও পিছিয়ে থাকল না, তারা গলা ফাটালো সুচরিতার জন্যে।
ফিনিসিং পয়েন্টের একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন সুবিমল রায়। ইভেন্ট শেষ হতেই এগিয়ে এসে সুচরিতার হাতে লাল গোলাপ তুলে দিয়ে বললেন, থ্যাঙ্কস, আমার এলাকার মুখ উজ্জ্বল করতে পেরেছ তুমি। পঞ্চায়েত সমিতির অনুষ্ঠানে তোমাকে সম্বর্ধনা দেব।
সুচরিতা মুখ উঁচু করে একবার সুবিমল রায়কে দেখে নিল। চাপা স্বরে বলল, উৎসাহ দেওয়ার জন্যে আপনাকে থ্যাঙ্কস। আড়চোখে সামনে তাকিয়ে দেখল, প্রদীপ লাল গোলাপ হাতে হন্হন্ পায়ে এগিয়ে আসছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে রায়বাবুর সোজা সাপটা প্রশ্ন, তোমার হাতে আবার লাল গোলাপ কেন?
না মানে….?
এভাবে মানে মানে করছ কেন? আমিই সুচরির হাতে লাল গোলাপ তুলে দিয়েছি। ও আমার এলাকার মেয়ে। আমি ওকে নিয়ে যে ভাবে ভাবতে পারি, তা কী তোমার পক্ষে সম্ভব? এই সৌজন্যটুকু বুঝতে পারলে নে কেন? তুমি কী থার্ড ইয়ারের ছাত্র?
প্রদীপ মুখ ভার করে কিছু সময় থমকে দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর হেঁটে চলল মাঠের বিপরীত দিকে। সুচরিতা পলকহীন চোখে চেয়ে থাকল তার দিকে। মনের কোণে আলতো প্রশ্ন, সুবিমলবাবু কী এভাবে প্রদীপকে শাসন করতে পারেন?
পিছনে চলতে চলতে জয়কে সামনে পেয়ে সুবিমলের মন্তব্য, একটা দুধে ছেলের কাণ্ড দ্যাখ, আমাকে টপকে বাছাধন সুচরির হাতে লাল গোলাপ গুঁজে দিতে চাচ্ছে রে। দিয়েছি আচ্ছা করে। এই গুঁতোটুকু সামলানোর ক্ষমতা ওই বাছাধনের নেই।
জয় মুখ টিপে হাসল। এভাবেই সরাতে পারলে সে সুযোগ পাবে সুচরির মনের সমুদ্রে স্বাচ্ছন্দে ভাসতে।
রায়বাবু দেখলেন, জয়ের ডান হাতের মুঠোয় আরেকটা লাল গোলাপ।
ফিক করে হেসে ফেললেন।
হাসছেন যে?
ওটা সযত্নে রেখে দে। কাল তো সুচরির বাড়িতে যাবি, এক ঢিলে এই দুই পাখি মারতে পারবি। জীবনে সুবর্ণ সুযোগ এভাবেই আসে।
জয় চুপ করে থাকল, ভিতরে ভিতরে উৎফুল্ল না হয়ে পারল না। গুরুও তার মনের খবর রাখেন। ভাবল, মনের যুদ্ধে জিতে যাওয়ার জন্য একটা পথ পেয়ে গেছে সে। মানসিক এ্যাডভেঞ্চার মেটাতে কোনো বিপদ এলে গুরু তার পাশেই থাকবেন। নেতৃত্বের দায়বদ্ধতার ধূসর ছায়া দেখতে পেল। জয় সেদিন প্রথম নিজের ইচ্ছা পূরণের সঙ্গে একটু আধটু রাজনীতিকে মিশিয়ে ফেলতে পারল। সুন্দরবনের রাজনীতি এভাবেই ব্যক্তিস্বার্থের গহ্বরে যখন তখন ঢুকে পড়ে।
সুচরিতার আর কোনো ইভেন্ট ছিল না। সুবিল রায় সারাক্ষণ মঞ্চের উপর মুখ ভার করে বসে থাকলেন। এদিক ওদিক বার বার তাকিয়ে একবারও মেয়েটাকে দেখতে পেলেন না। খুব করে ভেবেছিলেন, স্রেফ কৃতজ্ঞতা বশে সুচরিতা তাকে অন্তত একবার থ্যাঙ্কস জানাতে আসবে কিন্তু সেই আশা পূরণ হল না। একটা দুর্বল সন্দেহ মনের কোণে জোনাকি আলোর মতো উঁকিঝুঁকি মারছে বার বার। তাহলে কী প্রদীপ পিছনে ফেবিকুইকের মতো লেগে আছে বলেই আসতে পারল না? হতেই পারে।
মাঠের মধ্যে অন্যান্য ইভেন্টগুলো পরপর শেষ হচ্ছে। দিনের শেষ খেলা সমাপ্ত হল বিকেল পাঁচটায়। আগেই ঘোষণা করা হয়েছিল, প্রথম দিনের প্রাইজ খেলার পরে বিজয়ী প্রতিযোগীদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। সেই সূত্র ধরে প্রাইজগুলো মঞ্চে আনা হয়েছে। সন্ধের আলো জ্বলে উঠেছে। সমগ্র পরিবেশে গভীর স্নিগ্ধতার কোমল স্পর্শ। স্থানীয় বিধায়ক এসেছেন, সাংসদ একটু পরে আসবেন, আরও বেশ কয়েকজন গেষ্ট। বিডিও সকালে খেলা শুরুর সময়ে এসেছেন, শেষ না করে যাবেন না। এস.ডি.ও. ফোন করে বলেছেন, সন্ধে সাতটার সময় আসবেন। প্রিন্সিপালের কানের কাছে মুখ নিয়ে সুবিমল বললেন, সুচরিতা তার এলাকার মেয়ে, প্রাইজটা যদি তাঁর হাত দিয়েই তুলে দেওয়া সম্ভব হত।
সেটাই স্বাভাবিক নিয়ম। আপনার ইমেজ নষ্ট করতে যাব কেন? একমাত্র আপনিই সকালে এসে আমাকে সঙ্গ দিতে শুরু করেছেন, এ বদান্যতা ভোলা যায় না। একটু পরে প্রিন্সিপাল নিজেই ঘোষণা করলেন, প্রাইজ ডিসট্রিবিউশন পর্ব শুরু হচ্ছে। যারা ইভেন্টে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয়েছ, তাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছি মঞ্চের বামপাশে চলে আসতে।
মঞ্চ থেকে ঠিকরে পড়া আলোয় ঝাউগাছের পাতায় নতুন রোমাঞ্চের সুর।
প্রিন্সিপাল খুব মিষ্টি করে বললেন, ছাত্রীদের একশো-মিটার দৌড়ে প্রথম হয়েছে তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী সুচরিতা নস্কর, মথুরাপুর পঞ্চায়েত সমিতির এলাকার মেয়ে। সমিতির সভাপতি শ্রীযুক্ত সুবিমল রায় এখানে উপস্থিত আছেন। তাঁকে অনুরোধ করছি সুচরিতার হাতে পুরস্কারটি তুলে দিতে।
সুচরিতা মঞ্চে এসে দাঁড়ালো। সুবিমল রায়ের হাতে ফার্স্ট প্রাইজ। উঠে দাঁড়ালেন, সামনে একটু সরে এসে হাত বাড়িয়ে বললেন, এটা নাও। সুচরিতার মুখে মৃদু হাসি।। হঠাৎ বিদ্যুৎ সংযোগ ছিন্ন হল। জেনারেটর চালক মেসিনে স্টার্ট দিতে ব্যস্ত কিন্তু কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। ঘুট ঘুটে অন্ধকারে রায়বাবুর ডানহাতের পাঁচ আঙুল সুচরিতার বাম হাতের উপর চেপে বসল। বেশ লাগছে। সরিয়ে নিতে মন চাচ্ছে না। শরীরের কম্পনে নতুন সুর অনুভব করতে লাগলেন। সুচরিতা যে কিছু মনে করতে পারে, সেই ভাবনা সুবিমলের মাথা থেকে সম্পূর্ণ উবে গেছে। শুধুমাত্র অনুভূতির তীব্রতায় ভাসছেন। মিনিট পাঁচেক পরে অনেক চেষ্টায় জেনারেটরে স্টার্ট দেওয়া সম্ভব হল। আলো জ্বলে উঠতেই রায়বাবু চটপট সুচরিতার হাতে প্রাইজটা তুলে দিয়ে চেয়ারে বসে পড়লেন। ভিতরে ভিতরে কেমন যেন উদ্বেলিত, দুটো ভয় উঁকি মেরে থাকল মনের গভীরে। জয় মঞ্চের শেষ ধাপে এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। দেখে ফেলে নি তো? সুচরিতা কী অসন্তুষ্ট হয়ে এ ঘটনা কারুর কাছে বলে দিতে পারে? দুটোই ভারী হতে হতে জগদ্দল পাথরের মতো সুবিমলের বুকের উপর চেপে বসল। মনের চেয়ে বড়ো বন পৃথিবীর কোথাও নেই। সেই নিবিড় জঙ্গলে ঢুকে পড়লেন সুবিমল, বুকের গভীরে ধুকপুকুনির শিহরণ, তা ক্রমে দ্রুততর হয়ে উঠছে।
রাত আটটায় পুরষ্কার বিতরণ পর্ব শেষ হল। প্রিন্সিপাল দেবেশ রায় ভিতরে ভিতরে খুব গর্বিত, সুবিমলবাবুর সামনে এসে বললেন, মিষ্টি মুখ না করে যাবেন না।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে নেতার চেয়ে সাকরেদদের গুরুত্ব স্থান কাল পাত্রে অনেক বেশি। ঘোড়েল সুবিমল তা ভালো করে জানেন বলেই জয়শংকরকে সঙ্গে নিয়ে মিষ্টিমুখ-চা চক্রে ঢুকলেন। প্রিন্সিপাল দেবেশ রায়ও জেনে ফেলেছেন, মূল সাকরেদ হাতে থাকলে কত সহজে নেতার কাছে পৌঁছানো যায়। জয়ের সামনে এসে বললেন, তোমার ফোন নম্বরটা দাও। সুবিমলবাবুকে সব সময় কাছে পাব না বলেই তোমাকে বাড়তি গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। কলেজে কিছু ঘটলে আগেভাগেই তোমাকে জানাবো, তারপর সব দায়িত্ব তোমার।
জয় সেদিন প্রথম বুঝতে পারল, রাজনীতি করলে এভাবেই গুরুত্ব পাওয়া যায়। গুরু অনেক বেশি গুরুত্ব পেলেও তার ভাগ্যে নেহাৎ কম জটুছে না। সুবিমল রায় কেন এভাবে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছেন, তা মাথার ভিতরে একবার চক্কর মারল। তবুও তো এলাকার সকলে জানে, সুবিমলের পরেই তার স্থান, গর্বে জয়ের বুক ভরে উঠল।
মিষ্টিমুখ আর চা-চক্রের পর্ব সেরে সুবিমল রায় দুহাত জোড় করে বললেন, আসছি দেবেশবাবু।
আগামিকাল শেষ দিন, আসতে ভুলবেন না। সুচরি আপনার এলাকার মেয়ে, আরও দুটো ইভেন্টে নাম দিয়েছে। জিতলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে যেতে পারে। আপনার আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে সুচরিতা সেই স্বপ্নকে বাস্তব করে তুলতে পারলে আপনিই সবচেয়ে বেশি গর্বিত হতে পারবেন।
তখনও ব্লাক আউটের সময় সাময়িক বিভ্রাট নিয়ে সুবিমল মনে মনে কেমন যেন বিব্রত। কলেজ মাঠ পার হয়ে জয়কে সঙ্গে নিয়ে রাস্তায় নামলেন। সামনে বারাসত রেল স্টেশন। বুকের গভীরে ছ্যাক ছ্যাক শব্দ দোল, থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, হ্যাঁরে জয়, ব্লাক-আউটের সময় ছিলিস কোথায়?
ছেলেটা কিছুতেই জেনারেটরে স্টার্ট দিতে পারছিল না, বাধ্য হয়ে মঞ্চ থেকে নেমে ছুটে গিয়ে ওকে একটু হেল্প করলুম। সুবিমলের বুকের গভীর থেকে একটা বড়ো গভীর দীঘশ্বাস বের হয়ে এল। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। তাহলে জয় কিছুই জানতে পারে নি। বলতে বলতে এগিয়ে চললেন, প্রদীপকে আজ খুব টাইট দিয়েছি রে। ছেলেটা কী ভাবে বলতো? খুশি হয়েছিস তো? আই মিন তোর জন্যে ফিল্ডটা একটু ফাঁকা করে দিলাম।
জয় আনমনে একটু হাসল, বুঝল, সুচরিতাকে কাছে পাওয়ার লড়াইয়ে গুরু তার সঙ্গেই রয়েছেন। সুবিমলের প্রশ্ন, সেই লাল গোলাপটা কই?
জামার পকেটে রেখেছি।
বেশ করেছিস। কাল সকালে সুচরির বাড়িতে যা, দেখা করে গোলাপটা দিয়ে আয়, দেখবি, অনেকখানি নরম হয়ে পড়েছে। পারলে আমার কথা বলিস। একটা জমকালো অনুষ্ঠানে ওকে সম্বর্ধনা দেওয়ার ব্যবস্থা করছি।
ট্রেন আসতেই জয়কে সুবিমল বললেন, চল্, ভিতরে গিয়ে বসি। সদর্থক মাথা নাড়ল জয়। মিনিট কুড়ির মধ্যে ট্রেনযাত্রাও শেষ হল। মথুরাপুরে নেমে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে অটোতে বসে জয়কে বললেন, দাঁড়িয়ে থাকলি যে?
একটু পরে যাব।
মৃদু হেসে সুবিমলের বক্রোক্তি, সুচরি এখানে নেই রে।
জয় জবাব দিল না কিন্তু মৃদু হেসে মানসিক আবেগে ডুবে থাকল। সুবিমল বাড়িতে ফিরে গিয়ে ভিতরের টানাপোড়েনে কেমন যেন হাঁপিয়ে উঠতে লাগলেন। কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছেন না, শূন্যতার বানে একা ভেসে চলেছেন। জয়ের মধ্যে একই অবস্থান, বাড়িতে ফিরে গুম হয়ে বসে থাকল। ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে সুচরিতা ভর করে আছে। প্রদীপের সঙ্গে তার কানাকানির কথা মনে পড়ছে। নিজেকে আর স্থির রাখতে পারল না, অস্বস্তির গভীরে ভেসে চলল নিঃশব্দে।
‘ঘোড়েল’ পর্ব – দুই
এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
শিক্ষক জীবনের ৫৫ বছরে এসে সাহিত্যচর্চা শুরু। ইতিমধ্যে পঞ্চাশের বেশি উপন্যাসের মনসবদার। গল্প উপন্যাস
লেখার ক্ষেত্রে দীর্ঘ জীবন পরিক্রমায় কঠোর বিশ্বাসী। এখন বিদগ্ধ পাঠক শুধুমাত্র কাহিনি বা চরিত্র খোঁজেন না বরং তার ভিতরে লেখক এর নিজস্ব গভীর মনন আবিষ্কার করতে চান। ঔপন্যাসিক মুসা আলি দীর্ঘ জীবন পরিক্রমার জাদুতে তার নিজস্ব মনন দিয়ে বাঙালি পাঠককে ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ করে তুলতে বদ্ধপরিকর।
একটি মন্তব্য করুন
একটি মন্তব্য করুন