দেশে একের পর এক ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কথিত অভিযোগে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ব্যক্তির উপর, বসতবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা, অগ্নিসংযোগ এবং লুটতরাজের ঘটনা ঘটেই চলেছে! ঘটনাগুলির পর সরকার, প্রশাসন, ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায় এবং সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে যে বক্তব্যগুলি আমরা শুনি, সেগুলি নিতান্তই গৎবাঁধা! সরকারের স্বরাষ্ট্র দফতরের তরফ থেকে বলা হয়, যারা দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্টের চেষ্টা করছে, তাদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না! পুলিশ প্রশাসনের বক্তব্য হল এ রকম, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল না, এখন সব কিছু স্বাভাবিক, অপরাধীদের এতজনকে আসামী করে মামলা করা হয়েছে, এতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, বাকীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে! আক্রান্ত সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পুলিশ পাহারা বসানো হয়েছে! জেলা প্রশাসনের বক্তব্য হল এ রকম, জেলা প্রশাসন পুলিশকে সার্বিক সহযোগিতা করে যাচ্ছে! আক্রান্ত পরিবারেগুলির বাড়িঘর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নির্মাণ মেরামত/ পুণঃনির্মাণ করে দেওয়া হবে! আক্রান্ত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতাদের বক্তব্য হল, দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে বিবেচিত হয়! মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি আওয়ামলীগ সরকারের আমলেই যদি এ রকম ঘটনা ঘটে তাহলে অন্য আমলে কি হয় এবং কি হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়! সবশেষে তারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন! আক্রমণকারী ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নেতারা বলেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম! এই ধরনের কাজ যারা করেছে, তারা প্রকৃত মুসলমান নয়! সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাদের বক্তব্য হল, সমাজের রন্ধ্রে, রন্ধ্রে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বিস্তার লাভ করেছে! মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি আজ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে! সরকারের উচিত কঠোর হাতে এগুলিকে দমন করা! হামলার পর, হামলার ঘটনা ঘটে আর এই গৎবাঁধা বুলি শুনতে শুনতে আমরা ক্লান্ত, আমরা হতাশ, আমরা হতাশ! আমরা মানে সমাজের, দেশের মোট জনসংখ্যার একাংশ! কারণ দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা তো বটেই, এই সমাজের অধিকাংশ মানুষ যদি সমভাবে ক্ষুব্ধ হতেন, তাহলে বছরের পর বছর স্বাধীন বাংলাদেশে এই ঘটনার সাময়িক বিরতিতিতে পুনরাবৃত্তি চলতে পারে না! আর এখন তো এটা নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে! তাহলে কি এই কথিত অনুভূতিতে আঘাতের যে অপরাজনীতি সেটা থেকে আমাদের মুক্তি নেই? মুক্তি চাইলেই মুক্তি সম্ভব, এটা আমি এবং আমার মত অনেকেই বিশ্বাস করেন! এখন প্রশ্ন হল সেটা কিভাবে সম্ভব? কিভাবে সম্ভব তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হতে পারে! কারণ মুক্তি মানে আমি একটু গভীরভাবে বুঝতে চাই এবং বুঝাতে চাই! মুক্তি মানেই, মুক্তি যাতে কখনো, কোনো পরিস্থিতিতে কোনো মানুষের উপর এই ইস্যুতে হামলা করবে না, বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা করবে না! সেই সমাজ বিনির্মাণ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার! কিন্তু হামলার ঘটনা আর ঘটবে না বা কেউ চেষ্টা করলে সেটা সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করা হবে এমন একটা পরিবেশ নিশ্চিত করা বোধ করি খুব কঠিন কাজ হবে না! সেক্ষেত্রে সবাইকেই দায়িত্ব নিতে হবে, তবে সবার আগে দায়িত্ব হল, আমি যাদের গতানুগতিক বক্তব্য শুরতেই উপস্থাপন করেছি!
প্রথমত, প্রাথমিক দায়িত্ব হিসাবে সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটা বিবৃতি দিয়ে আক্রান্ত পরিবারগুলির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে, তাঁদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারার জন্য! কারণ মানুষের জীবন এবং নিরাপত্তার অধিকার হল মৌলিক মানবাধিকার! পুলিশের ভূমিকা কি ছিল, সেটা জবাদিহিতার আওতায় আনতে হবে তাৎক্ষণিকভাবেই, প্রয়োজনে পিবিআইকে দিয়ে তদন্ত হতে পারে, প্রশাসনের ভুমিকা কি ছিল, সেটা নিয়ও তদন্ত হতে হবে! ভুমিকা সন্তোসজনক না হলে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে! এই প্রক্রিয়া চলমান থাকা অবস্থায়ই স্বরাস্ট্রমন্ত্রীকে আক্রান্ত এলাকা পরিদর্শন করতে হবে! সেখানে নিজ দলসহ, অন্যান্য রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে মতবিনিময় করে আসল ঘটনা জানতে হবে! যেখানে দলের প্রভাবে শত শত কেন্দ্রে অন্য দলের লোকেরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দীতা করতে সাহস পায় না, এখানে তারাই নাকি একটা পাড়াকে আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন না, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য কথা? যদিও এখানে অন্য কথা প্রচলিত আছে, যে দল নয়, প্রশাসনই নাকি জয়-পরাজয়ের নিয়ামক শক্তি হিসাবে কাজ করে! তাহলে? সেই আলোচনা প্রশাসনের অংশে করব! স্বরাস্ট্রমন্ত্রীর সফর একটা অন্য বারতা দেয় যে রাষ্ট্র বিষয়টাকে কিভাবে নিচ্ছে! দলের লোক যুক্ত থাকলে তাদেরকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করতে হবে এবং তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে অন্য দলের লোকেরাও বার্তা পেয়ে যায়! অন্য দলের মতামত শুনতে হবে এবং তাদের সাথে পরামর্শক্রমে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে!
দ্বিতীয়ত, পুলিশ এবং স্থানীয় প্রশাসনকে সব সময় এটা বিবেচনায় রাখতে হবে যে ফ্যানাটিক মব নয় আমলে নিতে একজন মানুষ হলেও তার নিরাপত্তা এবং প্রাধান্য দিতে হবে আইনকে! স্থানীয় পুলিশ এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষে সম্ভব না হলে জেলার, বিভাগের সহায়তা নিন! সংশ্লিস্টহ দফতর এবং মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করে একজন মানুসকে অন্যায়ভাবে নিগ্রহের হাত থেকে বাঁচাতে হাজারো মানুষকে যদি আহত করতে হয়, একবার করে দেখুন, তারা পরবর্তীতে একই কাজ করবার আগে দ্বিতীয়বার ভাববেন! যেখানে ঘটনা ঘটে গেছে সেখানে প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি নিশ্চিত করুন! আপনারা তদন্ত কাজ শেষ করবার আগেই আসামিরা জামিনে বের হয়ে আসে! আক্রান্তরা নিরাহীনতায় ভোগেন! কিভাবে ন্যায় বিচার নিশ্চিত হবে? আপনাদের পক্ষে যে এগুলি সম্ভব সেটা তো আমরা নিরবাচনের সময় দেখি! তাহলে আমরা ধরে নিব, একটা বিশেস দল ক্ষমতায় এলে আপনারা লাভবান হবেন, বলেই ঝুকি নিতে রাজী থাকেন! আর আপনাদের উপর দায়িত্ব বরতানোর পরও এই ক্ষেত্রে আপনাদের ভুমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, কিন্তু আপনারা থোড়াই কেয়ার করেন! কারণ, এখানে আপনাদের লাভ-ক্ষতির প্রশ্ন নাই! বরং ফ্যানাটিক হলেও আপনারা কথিত সংখ্যাগরিস্টহের বিপক্ষে যেতে চান না, তাদের কথিত সেন্টিমেন্টের বিপরীতে যেতে চান না! একবার স্রোতের বিপরীতে, আইনের পক্ষে, মানবতার পক্ষে দাঁড়িয়ে দেখুন আপনাদের পক্ষেই সম্ভব! জনগণকে সম্পৃক্ত করে পরিস্থিতি মোকাবেলা করুন!
আক্রান্ত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতাদের এই আওয়ামী তোষণ নীতি বন্ধ করতে হবে! চাইতে হবে জবাব! সংসদে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যারা নেতা আছেন, তাদেরকেই এই বিষয়ে কথা বলতে হবে! আপনাদের তো অনেক হিসাব-কিতাব থাকে! কথা বললে, যদি পরবর্তী নির্বাচনে টিকেট না পান! হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতাদের শুধু বিবৃতি আর মানব বন্ধনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না! আইনি সহযোগিতা নিশ্চিত, তদন্তকাজ ফলোআপহ একটা প্ল্যানিং থাকতে হবে যাতে ঘটনাগুলির ন্যায় বিচার নিশ্চিত হয়! মুসলমান সম্প্রদায়ের যেসন নেতারা বলেন, যারা এই ধরনের কাজ করেছে, তারা প্রকৃত মুসলমান নয়! তাহলে আপনারা এদেরকে সামাজিকভাবে বয়কট করুন! নাকি ওদের সুমতি ফেরানোর দায়িত্ব আপনারা সৃষ্টিকর্তার উপরই দিয়ে রাখাছেন? করে দেখুন না, ফ্যানাটিক মব কোনঠাসা হবেই! আপনারা বলেন, ওরা প্রকৃত মুসলমান না, তাদের সাথে দাঁড়িয়ে এক কাতারে নামায পড়া বন্ধ করুন, বুকে বুক না মিলিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে শিখুন, তাহলে এই ধরনের ঘটনাও ঘটবে না, নিজেদের মধ্যে প্রকৃত, অপ্রকৃত বিভাজনও করার প্রয়োজন হবে না!
সবশেষে সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সামাজিক সংগঠনের দায় অশেষ! মানুষের মনন গঠনের দায় তাদের উপরই বর্তায়! আমরা এমনও গ্রাম আছে যেখানকার একজন মানুষও সারাজীবনে একটা মঞ্চ এমনকি পথ নাটকও দেখেননি! বছরে একদিনও হয়ত লালন শোনেননি! তারা মানুষ বুঝবেন কিভাবে? মানবতা বুঝবেন কিভাবে? তাদের ধর্মীয় অনুভূতিকে চাঙ্গা করা খুব সহজ কাজ! আপনাদের কাজ আপাতত প্রতিরোধ, সেটা তো এদেশে হয়েছে! আজ কেন আপনারা শুধু বিক্ষোভ সমাবেশ করে দায় সারছেন?
আমি এতক্ষণ যে কথাগুলি বললাম, আপনাদের এর শতভাগ বিপরীত মত থাকতে পারে! আপনারাও সেই যুক্তি তুলে ধরুন! আমি চাই, আমরা চাই কথিত অনুভূতিতে আঘাতের এই অপরাজনীতি বন্ধ হোক আজ থেকেই! আলাপ না হলে, আওয়াজ না তুললে সেটা আশা করা দুরাশা মাত্র! আসুন আলাপ করি, দ্বিমত হই কিন্তু আওয়াজটা তুলি একসাথে!