বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অস্থিতিশীলতা কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া নতুন নীতিমালায় বাজারে ডলারের প্রবাহ বাড়ালেও সেটি চলমান সংকটের দীর্ঘমেয়াদী সমাধান দেবে কি না সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে রবিবার (১৭ জুলাই) থেকে নীতিগত কিছু পরিবর্তন এনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী রপ্তানিকারকের প্রত্যাবাসন কোটায় (ইআরকিউ) ধারণকৃত ডলারের ৫০ শতাংশ নগদায়ন করতে হবে।
আদায়কৃত রপ্তানি আয় জমা রাখার সীমাও যথাক্রমে ১৫%, ৬০% ও ৭০% থেকে কমিয়ে ৭.৫%, ৩০% ও ৩৫% করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী সংশোধিত এই নিয়ম আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কার্যকর থাকবে।
ইতিমধ্যে, অফশোর এবং অনশোর ব্যাংকিং ইউনিটগুলোর মধ্যে তহবিল স্থানান্তরের সীমাবদ্ধতাগুলিও শিথিল করা হয়েছে।
অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটগুলো সরকারের মূলধনী যন্ত্রপাতি, শিল্প কাঁচামাল ও আমদানির মূল্য পরিশোধের অর্থের মোট মূলধনের ২৫% পর্যন্ত দেশীয় ব্যাংকে ছয় মাসের জন্য জমা রাখতে পারবে।
এই নীতিও আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কার্যকর থাকবে।
আমদানি নিরীক্ষণ কাঠামোর অংশ হিসাবে ব্যাংকগুলোকে অফশোর ব্যাংকিংসহ সকল ধরণের বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের হিসাব কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে হবে।
পাশাপাশি আমদানি তদারকি করতে ৫০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যের বেসরকারি যেকোনো আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার ২৪ ঘণ্টা আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া ৫ মিলিয়ন ডলার বা তার বেশি লেনদেনের জন্য প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে।
বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুন নিয়মে সরকারের আমদানি বাদ দেওয়া হয়েছে।
আগে ব্যাংকগুলো তাদের নিয়ন্ত্রক মূলধনের ২০% এর সমতুল্য বৈদেশিক মুদ্রা সংরক্ষণ করতে পারত। বাংলাদেশ ব্যাংক এই সীমা কমিয়ে ১৫% করেছে।
ব্যাংকারদের মতে, বর্তমানে রপ্তানিকারকের প্রত্যাবাসন কোটায় (ইআরকিউ) অ্যাকাউন্টে ৭২০ মিলিয়ন ডলার রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন পদক্ষেপ তাৎক্ষণিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে অন্তত ৩৬০ মিলিয়ন ডলার অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকের নেট ওপেন পজিশনের (এনওপি) সীমা ২০% থেকে কমিয়ে ১৫% করার সিদ্ধান্তের পরে বাজারে আরও ৫৬৯ মিলিয়ন ডলার যোগ হবে।
এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের আমদানি বিল পরিশোধ করার পর দুই বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসার পর সরকার এসব সিদ্ধান্ত নিল।
এদিকে গত সপ্তাহে ঈদুল আজহার পর আমদানি বিল পরিশোধের চাপ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হয়।
তাৎক্ষনিক সংকট সমাধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে। গত ১৪ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে ১৩৫ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। প্রতি ডলারের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৩.৯৫ টাকা।১৪ জুলাই রিজার্ভ ৩৯.৭০ বিলিয়ন ডলার ছিল।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নরের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও এই নীতি নীতি দীর্ঘমেয়াদে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমস্যার সমাধান করতে পারবে না বলে উদ্বেগ জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হুসেন বলেন, “যে সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়েছে তাতে সমস্যাটি কতটা সমাধান হবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কারণ ইআরকিউ-এর অর্থের একটি বড় অংশ গার্মেন্টস খাত থেকে আসে। এই টাকা থেকে তারা বিদেশে তাদের বিভিন্ন দায়-দেনাও মিটিয়ে নেয়। এখন তা কমানো হলে পরবর্তীতে এসব ঋণ পরিশোধের জন্য বাইরে থেকে ডলার কিনতে হতে পারে। এতে তাদের খরচ বাড়বে। এছাড়া হঠাৎ কোনো ধরনের ধাক্কা এলে তারা বড় সংকটে পড়বে।”
“তাছাড়া, আপনার যদি হঠাৎ অর্থের প্রয়োজন হয়, তবে আপনাকে সেই সমস্ত দায় মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিতে হবে। অন্য কথায়, ব্যবসা করার সহজ উপায় নষ্ট হচ্ছে,” তিনি যোগ করেন।
জাহিদ হুসেন আরও বলেন: “আমি মনে করি না যে এই সিদ্ধান্তগুলি বৈদেশিক মুদ্রার সংকট সমাধানে স্বল্পমেয়াদে বা দীর্ঘমেয়াদে খুব ভাল ফল দেবে।”
অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম মনে করেন, উদ্বেগের কারণ না থাকলেও যত দ্রুত সম্ভব রিজার্ভ আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
“আমদানি কমাতে হবে, বিশেষ করে বিলাসবহুল পণ্য। সরকার উদ্যোগ নিয়ে এলসির মার্জিন বাড়িয়েছে। তবে এটি কতটা কার্যকর হয় তা এখনও দেখার বিষয়। রপ্তানি বাড়াতে হবে এবং রেমিট্যান্স বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।”
“কার্ব মার্কেটে ব্যাংকের তুলনায় ডলারের দাম বেশি। সুতরাং, ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে সমস্ত রেমিট্যান্স আনার ব্যবস্থা করা উচিত,” তিনি যোগ করেন।
জুলাই থেকে মে মাসের মধ্যে ৭৫.৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি বেড়েছে। যা বছরে ৩৯% বেশি, যেখানে একই সময়ে রপ্তানি ৩৩% বেড়ে ৪৪.৫৮ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। ফলে যে আয় হচ্ছে তা দিয়ে ব্যয় মিটছে না। আবার বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফলে সংকট প্রকট হয়েছে।
তবে পুরো অর্থবছরের আমদানির তথ্য এখনও প্রকাশ করা হয়নি।
সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে রপ্তানি সর্বকালের সর্বোচ্চ ৫২.০৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। যা বৈদেশিক মুদ্রার চলমান অস্থিরতার মধ্যে দেশকে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় শ্বাস-প্রশ্বাসের জায়গা দিয়েছে।
এ কারণে এফওয়াই২২- এর ১১ মাসে মোট বাণিজ্য ঘাটতি ৩০.৮১ ডলার ছিল। অপরদিকে ২০২১ অর্থবছরের তুলনায় রেমিট্যান্স প্রবাহ ১৫% কমেছে।
এ কারণে গত তিন মাসে ডলারের দাম আনুষ্ঠানিকভাবে ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ৯৩ টাকা ৯৫ পয়সা হয়েছে। তবে ব্যাংকগুলো এখন প্রবাসী আয় আনছে ১০১-১০২ টাকায়। আর আমদানিকারকদের কাছে ডলার বিক্রি করছে এর চেয়ে বেশি দামে। ফলে চাপে পড়েছেন আমদানিকারকেরা। বেড়ে গেছে সব ধরনের আমদানি পণ্যের দাম।
এদিকে ডলার-সংকট মেটাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে প্রতিনিয়ত ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে রিজার্ভ কমে এখন চার হাজার কোটি ডলারের নিচে নেমে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ কতটা কাজে দেবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।