সাতদিন হল হীরু দোকানে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এমনকি সে বাড়ির বাইরেও বেরোয় না। সবসময় ঘর বন্ধ করে ফোনে বকবক করে, দুঃখের গান শোনে। কেবল দুপুরের আর রাতের খাবারটুকু খায়; না চা-কফি না জলখাবার। মা ছাড়া বাড়ির কারোর সঙ্গে সে কথা বলে না। হীরুর বাবা নিতাই পাল, বিখ্যাত পাল জুয়েলার্সের মালিক। হীরু দোকানে না-যাওয়ায় ভালোই সমস্যায় পড়েছেন তিনি। কিন্তু ছেলের জেদের কাছে মাথা নোয়াবার পাত্র তিনি নন। তার ছেলে হয়ে হীরু কিনা এক জুতো দোকানির মেয়েকে বিয়ে করার কথা বলে। তাছাড়া মেয়েটি যেমন মুখরা তেমন দম্ভী। হীরু তাকে বিয়ে করলে মোটেও সুখী হবে না। হীরু যে কী পেয়েছে ওই মেয়ের মধ্যে তা ভেবেই পান না নিতাই পাল। এই নিয়েই বিবাদ বাপ-ব্যাটায়। হীরু গোঁ ধরে বসে আছে রূপালিকেই সে বিয়ে করবে। দোকানে যাওয়া বন্ধ করে সে বাবাকে বুঝিয়ে দিতে চাচ্ছে, তাকে ছাড়া পাল জুয়েলার্স চালানো কতটা কঠিন। সুতরাং ব্যবসার স্বার্থে অন্তত হীরুর কথা মেনে নেওয়া উচিত। নিতাই পাল পদে পদে হীরুর অভাব অনুভব করছেন, কিন্তু ভিতরে ভিতরে ভাঙলেও বাইরে নিজেকে শক্তই রেখেছেন।
ছেলের এই দুর্মতি দেখে নিতাই পাল মেয়ের ব্যাপারে কোনোরকম ঝুঁকি নিতে চাননি। মেয়ে কমলার গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হতে এখনও বছরখানেক বাকি। মেয়েকে গ্র্যাজুয়েট করার ইচ্ছা থাকলেও এখন তা ছেঁটে ফেলেছেন। শেষে সে আবার কী বায়না ধরে বসবে কে জানে! তড়িঘড়ি করে এক ঘটক ধরে বসেন নিতাই পাল। একটা ভালো ছেলের সন্ধানও পেয়ে যান। কাঁসারি দোকানির একমাত্র ছেলে। পরেরদিনই পাত্রপক্ষকে বাড়িতে আসার কথা বলেন নিতাই পাল। বেলা এগারোটার সময় পাত্র, পাত্রের মা ও বাবাকে নিয়ে ঘটক এসে হাজির হন। এই দেখতে আসার বিষয়টা হীরুর জানতই না। কিন্তু ঘরের ভিতর থেকে কিছু কথাবার্তা শুনেই সে বুঝে নেয়, কমলার দেখাশোনার জন্য লোকজন এসেছে। হঠাৎই সে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। উসকোখুসকো চুল, মুখে কয়েকদিনের না-কামানো দাড়িগোঁফ, পরনে কেবল একটি হাফ প্যান্ট। তাকে দেখে ঘটক ও পাত্রপক্ষ আঁতকে ওঠেন। হীরু হুংকার ছাড়ে, বেরিয়ে যাও সব। যতদিন না আমার বিয়ে হবে ততদিন এ বাড়িতে কারোর বিয়ে হবে না। সামনে দাঁড়ানো নিতাই পালের দিকে সে আঙুল তুলে বলে, এই লোকটা বাপ নয়, একটা শয়তান। তারপর হা হা করে অট্টহাস্য করতে করতে সে নিজের ঘরে ঢুকে দরজায় খিল তুলে দেয়। নিতাই পালের সমস্ত অনুনয় বিনয় ব্যর্থ করে পাত্রপক্ষ জলস্পর্শ না করেই উঠে পড়েন।
নিতান্ত বেকায়দায় পড়া নিতাই পাল ছেলের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শান্ত কণ্ঠে বলেন, হীরু দরজা খোল তুই যা চাস তাই হবে। একই কথার বার কয়েক পুনরাবৃত্তি ও দরজায় পুনঃপুন মৃদু আঘাতের ফল পাওয়া গেল। দরজা খুলে গেল, হীরু হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এল। নিতাই পাল ছেলের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলেন, আর কাঁদিসনি বাপ। জিত তো তোরই হল। হীরু আরও উচ্চৈঃস্বরে কেঁদে ওঠে। তারপর ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে, এখন তো রূপালি বিয়েতে রাজি নয়…
অণুগল্প: না রা জ
এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন