এক নাগাড়ে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। ঝড়ো হাওয়া। রোদ্দুরের মাস আশ্বিন এখন বর্ষার অকালবোধনে জল-ঝড়ের মাস। সরমার মা আজ সারাদিন কিছু মুখে তোলেনি। ছেলের বউ ময়না খুব মারধোর করেছে। মাঝেমধ্যে এরকম হয়। বলা নেই কওয়া নেই, হাতের কাছে যা পায়, কোনোটাই বাদ যায় না। আজ ঝাঁটা দিয়ে মেরেছে। অকথ্য গালিগালাজ করেছে। রতন বউকে কিছু বলতে পারে না। রাগ করলে একটু নেশা করে। মাদুর পেতে দাওয়ায় শুয়ে পড়ে।
ময়নার সারাদিন ফোন আসে। কত ঠাট্টা-তামাশা। সবসময় ছেলেদের সঙ্গে কথা বলে। উপুড় হয়ে ফোনে কথা বলতে বলতে বিছানায় পা দোলায়। কোনো কোনোদিন সেজেগুজে ময়না দুপুরের পর বেরিয়ে পড়ে। সন্ধ্যার পর বাড়ি ফেরে।গতকাল ফিরতে রাতদুপুর হয়ে গেছে। ব্যাগ ভর্তি জামাকাপড় এনেছে। ঘরে ঢুকতে গোটা ঘর কেমন যেন গন্ধ গন্ধ লাগে। বড়োলোকেদের মেয়েদের গায়ে এমন গন্ধ থাকে।
রতনের ক্ষমতা নেই। কিন্তু ময়নার জানাশোনা লোকজন সব দেয়। সংসার চালায়।
সরমার মা বলেছিল, “না খেতে পাই মরে যাব, তাই বলে ঘর পুরুষ ছেড়ে পর পুরুষ। ছিঃছিঃ!
তারপর উত্তম-মধ্যম ঝাঁটা দিয়ে মার। রতন ভয়ে কাঁপছিল। কাঁদছিল। বাঘিনীর হাত থেকে কে বাঁচাবে!
সারাদিন আলোর মুখ দেখা যায়নি। সকাল থেকেই কেমন অন্ধকার ! তবে রতনের সংসার আজ তারচেয়েও যেন বেশি অন্ধকার। মাতৃ আরাধনার মাস এই আশ্বিন-কার্তিক। সংসারে মা ও ছেলের কোনো জায়গা নেই। এটা ময়নার একার সংসার।
বিকেল হতে না হতেই মনে হচ্ছে সন্ধ্যে হয়ে গেল।এখনও সরমার মা মুখে কিছু তোলে নি। সকাল থেকে ধুলোতে শুয়ে আছে। একনাগাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। বাড়ির বাইরে রাস্তা থেকে ছাতা মাথায় মনোরমার মা রতনের নাম ধরে ডাকছে।
“বাড়িতে রতন আছিস?” ” হতভম্ব রতন বলে, ” হ্যাঁ কাকিমা আছি। বলো। “
“আমাদের লালুটার দেখেছিস? কোন্ সকালে বেরিয়েছে, কোথায় যে যায়, কে জানে! সারাদিন খেতে এলো না। তোদের এদিকে এসেছে কিনা দেখছি। দেখতে পাচ্ছি না। তুই কি দেখেছিস, লালুকে ? “
“এদিকে আসেনি তো। এদিকে এলে আমাদের বাড়ির দাওয়ায় এসে শুয়ে থাকে। লেজ নাড়ায়। দেওয়ালে টিকটিকি দেখলে ঘেউ ঘেউ করে ডাকে।”
‘দেখলে আমাদের বাড়ির দিকে তাড়িয়ে দিস তো। একমুঠো না খেলে হয়, বেলা বয়ে গেল।’
‘ঠিক আছে, দেখলে ডেকে ডেকে তোমাদের বাড়িতে দিয়ে আসব।’
‘যাসস, বাবা, তাই যাস। যাই রে। বৃষ্টি তো থামবে না, দেখছি,মরণের বৃষ্টি লেগেছে।’
দু-এক কথা বলতে বলতে মনোরমার মা পাড়ার দিকে চলে যায়।
কিছু একটা ভেবে, রতন এবার হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে।’
‘হা ভগবান। ওদের বাড়ির কুকুর সারাদিন খায়নি তাই ওরা খুঁজতে বেরিয়েছে। আর আমার মা সারাদিন ঝাঁটা খেয়ে শুয়ে আছে। সারাদিন কেটে গেল। এক ফোঁটা জল পেল না। তার খোঁজ নেবার কেউ নেই। আর এমন হতভাগা আমি যে মায়ের জন্যে কিছু করতে পারি না। মানুষ না হয়ে মা যদি কুকুর হত, মনোরমার মায়ের মতো কেউ না কেউ খুঁজতে বের হত। একমুঠো ভাত দিত, ভালবেসে। না হয় আমি সেই কুকুরের ছানা হতাম। দুঃখ থাকত না।”
রতন অনর্গল বৃষ্টির মতো হাউ হাউ করে কাঁদে। ছেলের কান্না শুনে মা আর ঠিক থাকতে পারে না। কাঁদতে থাকে। বৃষ্টি আরও ঝমঝমিয়ে আসে।