অসম যুদ্ধের বিরুদ্ধে একজন লড়াকু সাঁওতাল কন্যা ডগর টুডু!  

লিটন রাকিব
লিটন রাকিব - সাহিত্য সম্পাদক
4 মিনিটে পড়ুন
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ডগর টুডু। ছবি: সংগৃহীত।

না কোনো পত্রপত্রিকায়, কোনো আলোচনায়, বাগবিতন্ডায় তার নাম উচ্চারিত হতে দেখিনি৷ পশ্চিম বাংলার পুরুলিয়ার মানবাজারের মেয়ে ডগর টুডু। একাধারে অভিনেত্রী, গায়িকা, নৃত্য শিল্পী। ১২তম দাদাসাহেব ফালকে ২০২২ চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছেন সাঁওতালী ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র “আশা”য় অভিনয়ের সূত্রে। এরপরেই তিনি আলোচনায় উঠে আসেন।

সাঁওতালি শিল্পজগতে ডগরমনি টুডু এখন একটা সুপরিচিত নাম। মাত্র ২৪ বছর বয়সে প্রতিভার জোরে লাইমলাইটে উঠে এসেছেন সাঁওতালি এই তারকা। অভিনয় আর গান দিয়ে নিজের কেরিয়ার সাজিয়েছেন এই সাঁওতালি কন্যে। একের পর এক চলচ্চিত্রে অভিনয় করে বিদ্বজনের প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি। সম্প্রতি ডগরের নাম নতুন করে চর্চায় উঠে এসেছে তাঁর একটি চলচ্চিত্রের হাত ধরে। রায়গঞ্জে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটির প্রযোজনা করেছেন রায়গঞ্জের বিধায়ক কৃষ্ণ কল্যানী ও পরিচালক পল্লব রায়। রায়গঞ্জের সেহরাই গ্রামের গ্রাম্য পরিবেশ ও অনাথ আশ্রমের প্রেক্ষাপটে তৈরি কাহিনী নিয়ে সাঁওতালি ছবি ‘আশা’য় অভিনয় করে দাদাসাহেব ফালকে ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ২০২২-এ সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছেন ডগর। তার সেই ছবি কিছুদিন আগে ২৭তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচিত্র উৎসবে আনহাড’ ইন্ডিয়াঃ রেয়ার ল্যাংগুয়েজ ফ্লিম বিভাগেও চলচ্চিত্রটি প্রদর্শিত হয়েছে। সিনেজগতের তাবড় সমালোচক এই ছবিতে ডগরের অভিনয়ের প্রশংসা করেছেন। এছাড়া তিনি সাঁওতালি ভাষায় একাধিক জনপ্রিয় ছবিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন। শুধু তো অভিনয় নয়, তিনি গায়িকা ও নৃত্যশিল্পী। সাঁওতালি ভাষার গানেও তার যথেষ্ট পারদর্শিতা রয়েছে। এছাড়াও তিনি একজন গীতিকার ও সুরকার। অসংখ্য গান লিখেছেন এবং তাতে সুরারোপ করেছেন। অসাধারণ প্রতিভা, সুন্দর গান করে। তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত অনুবাদ করেছেন এবং গেয়েছেন সাঁওতালি ভাষায়। সম্প্রতি একটি সাঁওতাল টিভি চ্যানেলের অন্যতম জনপ্রিয়  মুখ হয়ে উঠেছেন এই গুণীশিল্পী। দিন দিন সোশ্যাল মিডিয়ায় তারই গুণমুগ্ধ ভক্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বাংলাদেশেও ডগর টুডুর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সেখানে গিয়েছিলেন তিনি। এছাড়া ডগর ওড়িশার মিউজিক ভিডিওতেও কাজ করেন। সেই সুবাদে প্রতিবেশী রাজ্যেও তাই তাঁর সুনাম ও সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে।

তিনি মনে করেন, আধুনিক যুগেও সমাজের বিভিন্ন স্তরের আদিবাসী ছেলেমেয়েরা আজও পিছিয়ে রয়েছে। তাই পেশাগত জীবনের পাশাপাশি তিনি সমাজসেবামূলক করে চলেছেন নিয়মিত। দরিদ্র, দুস্থ মানুষের সেবা করা, তাদের যথাসাধ্য সাহায্য করাও ডগরের অন্যতম কাজ। তিনি বলেন, ‘প্রথমে আমাদের সমাজ এবং তার নিয়মনীতি সম্পর্কে জানতে হবে। আদিবাসী সমাজের অনেকগুলো ভাগের মধ্যে একটি আমাদের সাঁওতাল সমাজ এবং বাকিদের থেকে আমাদের সবকিছুই অনেক আলাদা। প্রযোজকরা নিজেদের শখের জন্য সিনেমা বানাচ্ছেন কিন্তু সেই সিনেমা দেখার জন্য একটি সিনেমা প্রেক্ষাগৃহ পর্যন্ত নেই। এইসব সমস্যাগুলি দেখানো হলে ভবিষ্যতে আমরা আরও অনেক ভালো সিনেমা বানাতে পারব।‘

১৮ মে, ১৯৯৮ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার মানবাজারে জন্মগ্রহণ করেন ডাগর টুডু। তিনি রানীবাঁধ গার্লস হাই স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। বাবা অনিলবরন টুডু ‘সংগীত ও সাহিত্য চচা’ করতেন। ডগরমনি নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় বাবাকে হারিয়েছেন।মা ঝরনা টুডু একসময় যাত্রাশিল্পী ছিলেন। একদম ছোটবেলা থেকেই মা বাবা, আত্মীয় পরিজনদের যাত্রাপালায় অভিনয়ের সুবাদে অভিনয়ের জগতকে চিনতে শেখা। স্কুলে পড়াকালীন এক শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় অভিনয় শুরু করেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই তিনি পাশ্চাত্য সঙ্গীত, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিয়েছেন। সাঁওতালি ভাষার ঐতিহ্যবাহী গানে অভিনয় করছেন নিয়মিত।

সাঁওতালি ভাষার বিনোদন জগতে তিনি যথেষ্ট পরিচিত হলেও বাংলাভাষী বিনোদন জগত, সংবাদমাধ্যম কেউই অবশ্য তার খবর রাখত না। এই পুরস্কারের কয়েক সপ্তাহ পরেও যে মূলধারার সংবাদমাধ্যম খুব হৈ চৈ করেছে বা জায়গা দিয়েছে তেমনটি নয়। ডগর টুডুদের লড়াইটা চিরকালই খাড়া পাহাড়ে ওঠার মত। এক্ষেত্রেই বা ব্যতিক্রম হবেই বা কেন? আমাদের অগোচরে ডগরের মতো কত মনি মাণিক্য বাংলার মাঠে ঘাটে ছড়িয়ে আছে- তাদের খবর কেই বা রাখে!  

- বিজ্ঞাপন -

ডগরমনি টুডু হাজার প্রতিকূল পথ পাড়ি দিয়ে জীবনের সব ভালাবাসার রং ফুটিয়ে তুলেছে সাদা ক্যানভাসে৷ অথচ এই গুণীশিল্পী একরকম সমাজের চোখে মূল্যহীন ও উপেক্ষিত। সাঁওতালি এই তারকা গান আর অভিনয়ের মাধ্যমে সামাজিক চেতনার বিকাশ ঘটাতে চান তিনি। বাবা-মায়ের স্বপ্নকে সফল এবং পিছিয়ে পড়া মানুষকে আলোর পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে তার এই লড়াই।

ডগরের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হোক, মানবাধিকার আদায়ের লড়াইয়ে সফল হোক। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ডগর টুডুকে জানাই শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
সাহিত্য সম্পাদক
লিটন রাকিব মূলত কবি। সহজ সরল ভাষা ও গভীর জীবনবোধ থেকে উৎসারিত তাঁর সৃষ্টি। ভালোবাসেন অরন্যের মত নির্জনতা। প্রথম কবিতা গ্রন্থ 'ঋতুর দান', ছড়া গ্রন্থ 'ছড়া দিলেম ছড়িয়ে' এবং সম্পাদিত গ্রন্থ 'গ্রামনগর ' এছাড়াও দীর্ঘদিন সম্পাদনা করে আসছেন 'তরঙ্গ ' পত্রিকা। প্রতিষ্ঠা করেছেন ভিন্নধর্মী সংগঠন 'আলোপথ'। তিনি নিয়মিত একাধিক দৈনিক সংবাদ পত্র সহ অনান্য পত্রিকায় লিখে চলেছেন। দেশে বিদেশে একাধিক সম্মানে সম্মানিত তরুন এই কবি ও গবেষক। এছাড়াও তিনি সাময়িকী'র সাবেক সাহিত্য সম্পাদক।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!