স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জনসংখ্যা গণনা হয় ১৯৭৪ সালে। ওই আদমশুমারির হিসাবে তখন দেশে মোট জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ১৫ লাখ। মাঝে আরও কয়েক দফায় হয় এমন শুমারি। সবশেষ জনসংখ্যা গণনার শুমারি অনুষ্ঠিত হয় ২০১১ সালে। পঞ্চম ওই জনশুমারিতে দেখা যায়, দেশের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ কোটি ৯৮ লাখে। সম্প্রতি দেশে শেষ হলো ষষ্ঠ ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনা। চলতি মাসেই প্রকাশ হবে যার ফলাফল।
দেশের মোট জনসংখ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হতে পারে আরও কয়েক কোটি মানুষ। অর্থাৎ স্বাধীনতার প্রায় পাঁচ দশকে দেশে জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যেখানে জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ কতটা এগোতে পারলো, বৃহৎ এই জনসংখ্যার সুফল কতটা তুলতে পারছে বাংলাদেশ- এমন আলোচনা বরাবরই উঠেছে বিশেষজ্ঞ মহলে।
অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের যা অর্জন তা জনসংখ্যার হাত ধরেই এসেছে। পোশাকখাত ও প্রবাসী আয়ে বাংলাদেশের যে অভাবনীয় অবস্থান, সেটার মূলে জনসংখ্যাই। এছাড়া খাদ্যশস্য উৎপাদনসহ বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশের স্বনির্ভর হয়ে ওঠার পেছনেও মূল অবদান জনসংখ্যারই। যদিও বিপরীত কিছু দিকও রয়েছে, যেমন উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ এখনো তার জনসংখ্যার প্রয়োজনীয় সংখ্যক অংশকে কর্মে নিয়োজিত করতে পারছে না। এখনো এই দেশে বিপুলসংখ্যক বেকার, যার মধ্যে আবার বড় অংশই যুবক।
স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত প্রথম শুমারিতে দেশের জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ১৫ লাখ, যার মধ্যে পুরুষ তিন কোটি ৭১ লাখ এবং নারী তিন কোটি ৪৪ লাখ। এরপর ১৯৮১ সালে জনশুমারি অনুষ্ঠিত হয়। ওই সময় মোট জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ কোটি ৯৯ লাখে। এর মধ্যে নারী ৪ কোটি ৩৬ লাখ এবং পুরুষ ৪ কোটি ৬৩ লাখ। ১৯৯১ সালে দেশে মোট জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১১ কোটি ১৫ লাখে। এর মধ্যে নারী ৫ কোটি ৪২ লাখ এবং পুরুষ ৫ কোটি ৭৩ লাখ।
২০০১ সালে চতুর্থ আদমশুমারি ও গৃহগণনা করা হয়, এই সময় জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ কোটি ৫ লাখ। এর মধ্যে নারী ৬ কোটি ২৮ লাখ এবং পুরুষ ৬ কোটি ৭৭ লাখ। ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম ওই জনশুমারিতে দেখা যায়, দেশের জনসংখ্যা বেড়ে ১৪ কোটি ৯৮ লাখে দাঁড়িয়েছে, এর মধ্যে পুরুষ ৭ কোটি ৫০ লাখ এবং নারী ৭ কোটি ৪৮ লাখ। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনার ফলাফল প্রকাশের অপেক্ষায়।
জনশুমারির বাইরে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বিভিন্ন সময় জনসংখ্যা ও এ সম্পর্কিত নানান প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এসব প্রতিবেদনের তথ্যমতে, দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৭৪ লাখ ৬৯ হাজার। এর মধ্যে পুরুষ ৮ কোটি ৩৭ লাখ ৯২ হাজার, নারী ৮ কোটি ৩৬ লাখ ৭৭ হাজার। মোট জনসংখ্যার ৬৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ অর্থাৎ ১১ কোটি ১৬ লাখ ৭৮ হাজার নারী-পুরুষ কর্মক্ষম।
প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে মোট কর্মপোযোগী মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ৯১ লাখ। এর মধ্যে কর্মে নিয়োজিত ৬ কোটি ৮ লাখ। বাকি ৪ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার কর্মক্ষম, তবে শ্রমশক্তির বাইরে। এর মধ্যে শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত নারী-পুরুষ রয়েছেন।
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধির হার কিছুটা কমে ১ দশমিক ৩০ জন হয়েছে। আগের বছর এ হার ছিল ১ দশমিক ৩২ জন। এই জনসংখ্যার ৫৪ শতাংশ গ্রাম আর ৪৫ শতাংশ শহরে বাস করছে।
১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। দীর্ঘ ১০ বছর পর দেশে জনশুমারির তথ্য প্রকাশ করা হবে এ মাসেই। জনসংখ্যা ইস্যুতে সচেতনতা বাড়ানো এবং এ-সংক্রান্ত পরিবেশ ও উন্নয়নের সম্পর্ক লক্ষ্য রেখে দিবসটি ১৯৯০ সাল থেকে জাতিসংঘ ও সদস্যদেশগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করছে।
সরকারের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের সীমিত সম্পদ কাজে লাগিয়ে জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করতে কাজ করছে সরকার। যদিও বেকারত্বসহ নানান প্রশ্নে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্মক্ষম মানুষকে দক্ষ করতে হবে। না হলে জনসংখ্যা বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ জানায়, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ তরুণ প্রজন্ম। এদের শিক্ষা, সুস্বাস্থ্য ও কর্ম উদ্যোগের ওপর নির্ভর করছে দেশের ভবিষ্যৎ সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন। ভবিষ্যতের কারিগর এই তরুণ প্রজন্মকে দক্ষ, সুশিক্ষিত ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হিসেবে গড়ে তোলা আবশ্যক। কিশোরকাল হচ্ছে জীবন গঠনের সঠিক ও উপযুক্ত সময়। মানবসম্পদ উন্নয়নে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে যদি এদেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে সুস্থ, শিক্ষিত, দক্ষ, অভিজ্ঞ করে গড়ে তোলা যায়, তাহলে এ জনসংখ্যা বিশাল মানবসম্পদে পরিণত হতে পারে। অন্যথা অশান্তি, বিশৃঙ্খলা, হত্যা, সন্ত্রাস, ধর্ষণের মতো অপকর্ম কমবে না।
কর্মকর্তারা বলছেন, বিশাল জনগোষ্ঠী থেকে আরও সুফল নিতে সরকার নানা ধরনের উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করা হচ্ছে। দেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ইতোমধ্যে ২০ লাখ মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে। বর্তমানে সাড়ে ৬ লাখ ফ্রিল্যান্সার আউটসোর্সিং পেশায় যুক্ত আছেন। সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিনির্ভর কর্মসংস্থান ৩০ লাখে উন্নীত করার পরিকল্পনা নিয়েছে। মৎস্য ও পশুপালন খাতেও কর্মসংস্থান সৃষ্টির ব্যাপক উদ্যোগ চলমান। ২০২২-২৩ অর্থবছরে উপজেলা পর্যায়ে ১০০টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের নির্মাণকাজ শুরু হবে। এছাড়া আগামী অর্থবছর নিশ্চিত করা হবে ৮ লাখ ১০ হাজার বাংলাদেশি কর্মীর বৈদেশিক কর্মসংস্থান। পাশাপাশি পাঁচ লাখ ২০ হাজার মানুষকে বিভিন্ন ট্রেডে দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পরিচালক (নিবন্ধন) মো. নজরুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী একটা আশীর্বাদ। এ জনগোষ্ঠী থেকে অনেক অর্জন এসেছে। তবে ভালোর কোনো শেষ নেই। জনগোষ্ঠী থেকে আরও সুফল পেতে স্কিল ট্রেনিং করা হচ্ছে। দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ দেয় এমন ৩০৫টি প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধন দিয়েছি। এটার বিরাট একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। বর্তমানে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব চলছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মানেই ডিজিটাল বিপ্লব। আমরা ডিজিটাল নানা ধরনের ট্রেনিং করাচ্ছি। ফ্রিল্যান্সিংসহ নানা বিষয়ে দক্ষ করে গড়ে তুলতে নানা ধরনের উদ্যোগ হাতে নিয়েছি।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির বড় দুটি খাত হচ্ছে রেমিট্যান্স ও পোশাকশিল্প। দুটি অর্জনই কিন্তু এদেশের মানুষের হাত ধরে এসেছে। মোটাদাগে বলা জনসংখ্যা থেকে ভালো অর্জন এসেছে। তবে এটাকে আরও কাজে লাগানো যায়। দেশের এক কোটি মানুষ প্রবাসে নানা ধরনের কাজে জড়িত। ফলে গত অর্থবছর ২২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। এটা বড় আয়ের জায়গা তৈরি করেছে। দ্বিতীয়ত, পোশাকখাতে ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করছে। এদের অধিকাংশই তরুণ। এটাও জনসংখ্যার সুফল।
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দেশের জনগোষ্ঠীকে উৎপাদনমূলক কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাহিদার ওপর ভিত্তি করে দিতে হবে প্রশিক্ষণ। এছাড়া সামনে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আসছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মানেই ডিজিটাল বিপ্লব। এ বিষয়ে কর্মক্ষম মানুষকে দক্ষ করতে হবে, না হলে জনসংখ্যা বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপ দিতে তিনটি মৌলিক বিষয়ে কাজ করার পরামর্শ দিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে প্রথমে। মায়ের পেটে যখন শিশু আসে তখন থেকেই মায়ের ও শিশুর পুষ্টির খেয়াল করতে হবে। জন্মের প্রথম এক হাজার দিন যদি পুষ্টির বিষয়ে খেয়াল না করা হয় তবে শারীরিক ও মানসিকভাবে শিশুটি ভালোভাবে বেড়ে উঠবে না। দ্বিতীয়ত, মৌলিক শিক্ষা। এটা এমনভাবে শেখাতে হবে যেন পড়তে পারে ও গুনতে পারে। এগুলো সবার জানা দরকার। তবে এখানে যথেষ্ট ঘাটতি আছে। অনেক ছাত্র বিবিএ পড়ে, কিন্তু একটা চিঠিও লিখতে পারে না। একটা ভাগ দিলে সঠিকভাবে করতে পারে না। মুখস্তবিদ্যায় সব কিছু হবে না। অনেকে ইংরেজি পড়তে পারে না।
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব চলছে, তবে আমাদের শ্রমশক্তির সমন্বয় নেই। শিল্পায়ন হচ্ছে, কিন্তু দক্ষ শ্রমশক্তি আমদানি করতে হয়। অন্যদিকে অদক্ষ শ্রমিকদের বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ফলে একজন শ্রীলঙ্কান বা ফিলিপাইনের শ্রমিক বিদেশে যে টাকা আয় করছে আমরা তা পারছি না। অন্যদিকে দেশেও দক্ষ শ্রমিক আমদানি করছি। উচ্চশিক্ষায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে মিল রাখতে হবে। শ্রমিক যদি দক্ষ না হয় তবে এই বিশাল জনগোষ্ঠী বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
(সূত্র জাগো নিউজ)