স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কিছু জেলায় পানি কমতে শুরু করলেও এখনও অনেক এলাকার মানুষ পানিবন্দী। অনেক এলাকায় নদীভাঙনে আরও বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। তাই অন্যান্য বারের ঈদগুলো খুশির থাকলেও এবার সিলেটের ঈদ ‘বিষন্ন’। ঘরে ঘরে নেই খুশির ঢেউ। বানের জলে ভেসে গেছে সব আনন্দ। বন্যার পানি আর সিলেটবাসীর চোখের পানি মিলে-মিশে একাকার।
ত্যাগের মহিমায় আজ রবিবার (১০ জুলাই) সিলেটসহ সারা দেশে পালিত হবে পবিত্র ঈদুল আজহা। ঈদের নামাজ শেষে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি করবেন সামর্থ্যবান মুসলমানরা। কিন্তু সিলেটে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ঈদকে ঘিরে যে আনন্দ-উচ্ছ্বাস থাকার কথা তা ম্লান করে দিয়েছে এবারের ভয়াবহ বন্যা।
গত ১৫ জুন থেকে দ্বিতীয় দফা বন্যার কবলে পড়ে সিলেট জেলা। বিভাগীয় নগরী সিলেট ও জেলার ৯০ ভাগ এলাকা প্লাবিত হয় বন্যায়। ভয়াবহ বন্যায় ভেসে যায় মানুষের গবাদিপশুসহ প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র। তলিয়ে যায় রাস্তাঘাট। অনেকের বাড়ি-ঘর পুরোটাই তলিয়ে যায়। দেখা দেয় বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের তীব্র সংকট। দীর্ঘমেয়াদি বন্যার কবলে সিলেটের এখনও প্রায় ৪০ ভাগ এলাকা প্লাবিত। মানুষ এখনও ফিরতে পারেনি স্বভাবিক জীবনে। ব্যাপক আর্থিক ক্ষতিতে পড়েছেন সর্বস্তরের মানুষ। এ অবস্থায় সিলেটের মানুষের দুয়ারে এসে হাজির পবিত্র ঈদুল আযহা। সরকারি হিসাবে জেলায় শেষবারের বন্যায় ৪০ হাজার ৪১টি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা অন্তত ৩০ লাখ। ভয়াল বন্যা কেড়ে নিয়েছে অনেকের পশু কুরবানি করার সামর্থ্য।
বন্যায় ভিটা বাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছেন কোম্পানীগঞ্জের রণিখাই এলাকার কৃষক আবদুস সবুর ও তার স্ত্রী।
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের রণিখাই এলাকার কৃষক আবদুস সবুর। প্রতিবছর তিনি ঈদুল আযহাকে টার্গেট করে গরু লালন পালন করেন। কোরবানির পশুর হাটে তোলেন ১৫-২০টি গরু। গরু বিক্রির টাকা দিয়েই তার সারাবছর সংসার চলে। এবারও পরিচর্যা করে ২১টি গরু প্রস্তুত করেছিলেন। কিন্তু সর্বনাশা বন্যা আবদুস সবুরকে সর্বহারা করে গেছে। বানের পানিতে মারা গেছে তাঁর ৯টি গরু। বন্যার মধ্যে পানির দামে বিক্রি করেছেন ৬টি। আর বন্যার মধ্যে খবার ও যত্মের অভাবে বাকি ৬টি গরু হাড্ডিসার। তাই গরু বিক্রি করে পরিবার নিয়ে ঈদ উদযাপন আর সারা বছরের সংসার চালানোর স্বপ্ন ভেসে গেছে বন্যার পানিতে।
গোয়াইনঘাটের নন্দিরগাঁওয়ের আবদুল মতিনের ভিটেশূণ্য করে ঘরবাড়ি ভেসে গেছে বন্যার পানির স্রোতে। কয়েকটি টিন জোগাড় করে একচালা তৈরি করে কোনরকম মাথার উপর আকাশ ঢেকে রেখেছেন তিনি। ঈদের দিন কোরবানি দেয়া তো দূরের কথা চুলোয় আগুন জ্বলবে কি-না সেই নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন মতিন।
এমন চিত্র কেবল আবদুস সবুর কিংবা আবদুল মতিনের নয়। সিলেটে বন্যাকবলিত প্রতিটি এলাকায় দেখা দিয়েছে খাবার ও আশ্রয় সংকট। যেসব কৃষক গরু ও ধান বিক্রি করে ঈদ উদযাপন করতেন, তাদের ঘরে এখন আনন্দের পরিবর্তে বিষাদ। বন্যায় তছনছ হয়ে গেছে তাদের জীবন। বসতঘর, গোয়ালঘর, গুদামের ধান, ঘরের আসবাবপত্র সবকিছু ভেসে গেছে বন্যার পানিতে। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ফিরে সর্বহারা মানুষ যেন এখন যেন সঙ্গী করে নিয়েছেন খোলা আকাশকে। কেউ কেউ আশ্রয় নিয়েছেন রাস্তার ধারে, কিছুটা স্বস্তিতে থাকা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে। ফলে এবার ঈদুল আযহা বানভাসী এসব মানুষের ঘরে কোন আনন্দের বার্তা নিয়ে আসতে পারেনি।
জকিগঞ্জ উপজেলার বিপক গ্রামের মজনু মিয়া জানান, এখনো তার বাড়িতে পানি। পরিবার নিয়ে খেয়ে না খেয়ে আছেন। কেউ ত্রাণ দিয়ে গেলে দুমুঠো ভাত কিংবা শুকনো খাবারের সংস্থান হয়। আর না মিললে উপোস করতে হয় পরিবার নিয়ে। গেল বছর ঈদেও তিনি অন্যদের সাথে ভাগে কোরবানী দিয়েছিলেন। কিন্তু এবার কোরবানী তো দূরের কথা ঈদের দিন ভাতের ব্যবস্থা করতে পারবেন কি-না এ নিয়ে শঙ্কা আছেন মজনু মিয়া।
মৌলভীবাজারের হাওর অঞ্চলের পানিবন্দি মানুষ দফায় দফায় ত্রিমুখী ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। যার কারণে আসন্ন ঈদুল আজহার আমেজ নেই বানভাসি মানুষের মধ্যে। বন্যার পানিতে ভেসে যাচ্ছে তাদের ঈদ আনন্দ।
গত বোরো মৌসুমে দীর্ঘমেয়াদি খরায় জেলার হাওরগুলোতে কৃষকের রোপণকৃত ব্রি-২৮ জাতের ধানে চিটা ধরায় লোকসানে পড়েছিলেন প্রান্তিক কৃষক ও বর্গা চাষিরা। এবার বোরো উত্তোলনের সময় টানা বৃষ্টির কারণে ধান ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে না পেরে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন তারা। সেই সঙ্গে দীর্ঘ দিনের বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন জেলার কুলাউড়া, জুড়ি, বড়লেখা এবং রাজনগর উপজেলার প্রায় ৩ লাখ মানুষ। বন্যায় তাদের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, হাওর অঞ্চলের ৭০-৮০ শতাংশ ঘরে এখনো পানি। অনেকেই আশ্রয় কেন্দ্রে আবার কেউ কেউ ঘরে পানির মধ্যে দিনতিপাত করছেন। কিছু পরিবার উজান এলাকায় আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। যাতায়াতের প্রতিটি রাস্তা, হাটবাজার এখনো পানির নিচে। স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা, ঈদগাহ ও মন্দির তলিয়ে গেছে। মানুষের চলাচলের কোনো জায়গা নেই।
এছাড়াও বানভাসি মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে পানিবাহিত ডায়রিয়া, চর্ম, জ্বর, চোখের ভাইরাসসহ বিভিন্ন রোগ। বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাওড় পারের মৌসুমি খামারিরা। এমন পরিস্থিতিতে তাদের মধ্যে ঈদ আনন্দের চেয়ে দুশ্চিন্তায় পরিণত হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অভাবের কারণে এবারের ঈদে মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকেই কুরবানি দিতে পারছেন না। আবার কারো কাছে হাত পাততে পারছেন না। অন্যদিকে পানিবন্দি এলাকায় কাজ না থাকায় চরম বিপাকে পড়েছেন দিনমজুররা। সব মিলিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন জেলার নিম্নাঞ্চলের বানভাসি মানুষ।
কুলাউড়া উপজেলার জাব্দা গ্রামের বাসিন্দা মো. রিয়াজুর রহমানসহ অনেকেই বলেন, দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কারণে আমাদের মাঝে কোনো ঈদ আনন্দ নেই। নতুন কাপড় কেনা তো দূরের কথা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস জোগানো সম্ভব হচ্ছে না।
হাওর পারের প্রান্তিক ও বর্গাচাষিদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, আমাদের মাঝে এ বছর ঈদের কোনো আনন্দ নেই। আমরা এ বছর ত্রিমুখী ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি। আমাদের একমাত্র সম্বল বোরো ধান। এ বছর বৃষ্টি থাকার কারণে ধান শুকাতে না পারায় কাঁচা ধান পানির দামে বিক্রি করতে হয়েছে।