ঈদ উদযাপনে ঢাকা থেকে রংপুরে যেতে গত ৭ জুলাই রাত ১০টায় বাসে উঠেছিলেন জাহিদুল ইসলাম। এরপর কেটে গেছে দুই রাত। ৩৩ ঘণ্টা যাত্রা শেষে ৯ জুলাই সকাল ৭টায় গন্তব্যে পৌঁছেছেন তিনি।
শুধু তিনি নন, এবছর উত্তরবঙ্গ তথা রংপুর, রাজশাহীসহ ওই অঞ্চলের ১৬ জেলায় ভ্রমণ করা লাখো মানুষের অবস্থা প্রায় একই। সড়কে যানবাহনের বিপর্যয়ের মাশুল তারা গুনেছেন অবর্ণনীয় যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে।
দেশের উত্তরদিকে যখন এই অবস্থা তখন একেবারেই ভিন্ন চিত্র দক্ষিণবঙ্গ তথা বরিশাল ও খুলনাগামী যাত্রীদের। অন্যান্য বছর যেখানে তাদের সড়কে, নৌযানে কাঁটাতে হতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেখানে এক পদ্মা সেতুর কারণে তারা গন্তব্যে পৌঁছেছেন অতি সহজে।
রাজধানী ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গে যাওয়ার অন্যতম রুট সাভারের ঢাকা-আরিচা, নবীনগর-চন্দ্রা, গাজীপুরের ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা ময়মনসিংহ সড়কে। ঈদযাত্রার শুরু থেকেই এসব রুটে ছিল অতিরিক্ত যাত্রী ও যানবাহনের চাপ। বাস না পেয়ে অনেকেই ট্রাক, পিকআপভ্যানে করেই বাড়ির পথে রওনা দেন।
এ কারণে প্রথমদিন থেকেই এসব সড়কে শুরুতে যানবাহনের ধীরগতি আর পরে শুরু হয় যানজট। এসবের দুর্ভোগ যখন শুরু হয়েছে, তখন সড়কের কয়েকটি এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনা ও অন্যান্য কারণে এর আকার তীব্র পর্যায়ে চলে যায়। একপর্যায়ে এসব রুটের যানবাহন চলাচল হয়ে পরে স্থবির।
শুক্রবার দুপুর ১২টায় রাজধানী ঢাকার টঙ্গী থেকে টাঙ্গাইলের কালিহাতির উদ্দেশে বের হয়েছিলেন চিকিৎসক ইয়াসিন ইসলাম। সাধারণত ১৫০-২০০টাকা ভাড়ায় ২ ঘণ্টায় বাড়ি পৌঁছে যান তিনি। তবে গতকালের ভ্রমণের পুরোটাতেই অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে তাকে।
ইয়াসিন ইসলাম বলেন, দুপুরে ঢাকা থেকে সরাসরি কোনো বাস পাইনি। পরে ভেঙে ভেঙে যাওয়া শুরু করি। শুরুতেই জ্যামে পড়ি গাজীপুর বাইপাসে সিগন্যালে। এরপর চৌরাস্তায় জ্যাম। চান্দরায় গিয়ে দেখি ৩০টাকার ভাড়া ৩শ লাগছে। চন্দ্রাতেও গাড়ি নেই। যা আছে সোজা রংপুর তুলছে শুধু। বাধ্য হয়েই ট্রাকে উঠি। রাত ৯টার দিকে বাড়ি পৌঁছাই। ভাড়াও লেগেছে ৩ গুণ। দিনভর রোদে পুড়ে বাড়ি আসতেই অসুস্থ হয়ে পড়েছি।
টাঙ্গাইলের মতোই ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, নওগাঁ, রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ ও রংপুর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাও ও নীলফামারি যেতেও লেগেছে প্রায় ৩ থেকে ৪ গুণ সময়।
রংপুরে যাওয়া জাহিদুল ইসলাম বলেন, ৭ তারিখ রাত ১০টায় বাসে উঠেছিলাম। এরপর থেকেই আসলে জ্যাম শুরু। এয়ারপোর্ট, খিলক্ষেত পার হতেই অনেক সময় লেগেছে। পরেরটুকু যেভাবে পার করেছি এমনটা আমার জীবনে কখনো দেখিনি। ঢাকা পার করে সকাল ৯টা অর্থাৎ ১০ ঘণ্টায় চন্দ্রা এসেছি। এরপর দুপুর ২টায় যমুনা সেতু। সেখানে সেতুর মধ্যেও গাড়ি স্থবির হয়ে ছিল। সেতু পার হওয়ার পর সিরাজগঞ্জ হাটিকুমরুলেও জ্যাম ছিল। বগুড়া বাইপাসেও জ্যাম। দিন এসব এলাকাতেই পার করেছি। গোবিন্দগঞ্জে ৪ ঘণ্টা একেবারেই বসা। সবশেষে রংপুর শহরে ঢুকতেও জ্যাম। সবমিলিয়ে একটা অসহনীয়, অমানবিক ভ্রমণ হয়েছে এটা। ঢাকা-রংপুরে মহাসড়কে গেল ৪ বছর ধরে কাজ চলছে, শেষ হওয়ার নাম নেই। আবার পুরো সড়কে কোথাও পুলিশি তৎপরতাও দেখিনি। যারা ছিল তারা আয়েশি ভঙ্গিতে যেন মানুষের দুর্ভোগ উপভোগ করছিল।
এদিকে দুর্ভোগ ছিল ট্রেন যাত্রায়ও। মই বয়ে ট্রেনের ছাদে উঠে, গেটের হাতলে ঝুলে কোনোমতে ট্রেনে ঠাঁই করে নিতে দেখা গেছে ঘরমুখো মানুষকে।
জামালপুরে যাওয়ার জন্য ঢাকার বিমানবন্দর স্টেশন থেকে রেলগাড়ির গেটের হাতলে ঝুলে টঙ্গি পর্যন্ত এসেছেন মানিক মিয়া। কাঁধে দুটি ব্যাগ। টঙ্গী নেমে ছাদে ওঠার চেষ্টা ব্যর্থ হলে ফের ঝুলেই চলে যান জয়দেবপুর জংশন পর্যন্ত। সেখান থেকে অবশেষে ছাদে উঠতে সক্ষম হন।
ঢাকা ট্রিবিউনকে এই ঈদযাত্রী জানান, তার মতো অসংখ্য মানুষ ছাদে চড়েছেন। অনেক যাত্রী কোনোভাবেই উঠতে না পেরে অসহায়ের মতো স্টেশনেই রয়ে গেছেন।
এছাড়া অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে চাকার স্প্রিং ভেঙে টাঙ্গাইলের বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব রেলস্টেশনে প্রায় ৭ ঘণ্টা বন্ধ ছিল পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেন। ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলায় তিস্তা এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা বন্ধ ছিল রেল যোগাযোগ।
একদিকে উত্তরবঙ্গের মানুষেরা যখন অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাচ্ছিলেন, তখন পদ্মা সেতুর কারণে সহজ ও নির্বিঘ্ন ঈদযাত্রা উপভোগ করছিলেন দক্ষিণবঙ্গের মানুষ। অল্প সময়ে আরামদায়ক যাত্রা করছেন দক্ষিণের জেলাগুলোতে ভ্রমণকারীরা।
সেতুর কারণে শিমুলিয়া-পাটুরিয়া ঘাটগুলোতে ভিড় ছিল না বললেই চলে। লঞ্চেও যাত্রী খুঁজে পাচ্ছিলেন না স্টাফরা। যাত্রী কম থাকায় লঞ্চে ভাড়া তেমন বাড়েনি। ফলে যারা লঞ্চে করে ঈদযাত্রায় বাড়ি ফিরেছেন তারা স্বস্তিতে যেতে পেরেছেন।
এ ছাড়া প্রথম দুই দিন যাত্রী ও যানবাহনের চাপ কম থাকায় পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌ রুটের ফেরিগুলো অলস সময় পার করেছে। পণ্যবোঝাই ট্রাকও পার হয়েছে সহজেই।
ঢাকা থেকে মাদারীপুরে গিয়েছেন আরাফাত উদ্দিন। তিনি বলেন, এবারে খুব দ্রুত বাড়ি পৌঁছে গিয়েছি। বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌরুটে ভিড় ছিল না। ঝুঁকি নিয়ে গাদাগাদি করে উত্তাল পদ্মা পার করতে হয়নি। গাড়িও কম থাকায় জ্যাম পোহাতে হয়নি। এজন্যে চিন্তামুক্ত যাত্রা করতে পেরেছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষেরা।
ঈদ করতে ঢাকা থেকে বরিশাল গিয়েছেন চাকরিজীবী সোহেল আবদিন নাদিম। তিনি বলেন, অন্যান্য বছর লঞ্চে আসতাম। গাদাগাদি করে আসতে হতো। লঞ্চগুলো অতিরিক্ত যাত্রী আনতো বলে ঝুকিতে থাকতাম। কিন্তু পদ্মা সেতু সেই অবস্থা পুরো বদলে দিয়েছে। এবার মাত্র ৪ ঘণ্টায় বরিশাল পৌঁছেছি। কোনো আতঙ্ক নেই। মাওয়াতে একটা বড় সময় নষ্ট হতো, সেটাও নেই এবার। কোনো জ্যামও ছিল না। সবমিলিয়ে স্বস্তির এক ঈদযাত্রা হয়েছে।