পৌরাণিক রূপক পরিভাষা’ চয়ন একই। আরও উল্লেখ্য যে; ভারতীয় শ্বরবিজ্ঞান, গ্রিক শ্বরবিজ্ঞান, রোমান শ্বরবিজ্ঞান, পারসিক শ্বরবিজ্ঞান ও আরব্য শ্বরবিজ্ঞান ইত্যাদির মহাকাব্যের ভাব, সূত্রাবলী, উৎপত্তিমূল এবং উপমা নির্মাণশৈলী একই। শুধু রূপকার্থে চয়িত পরিভাষাগুলোই ভিন্ন। শ্বরবিজ্ঞান, পুরাণ, সাম্প্রদায়িক ও পারম্পরিক পুস্তক-পুস্তিকা নির্মাণের ক্ষেত্রে বিশ্বকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। যেমন; ১. ভারতীয় শ্বরবিজ্ঞান, পুরাণ, সাম্প্রদায়িক ও পারম্পরিক পুস্তক-পুস্তিকা ২. গ্রিক শ্বরবিজ্ঞান, পুরাণ, সাম্প্রদায়িক ও পারম্পরিক পুস্তক-পুস্তিকা ও ৩. আরবীয় শ্বরবিজ্ঞান, পুরাণ, সাম্প্রদায়িক ও পারম্পরিক পুস্তক-পুস্তিকা। ভারতীয় শ্বরবিজ্ঞান হলো; বেদ, পুরাণ হলো রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণাদি এবং সাম্প্রদায়িক গ্রন্থ হলো; শ্রীমদ্ভগবতগীতা। গ্রিক শ্বরবিজ্ঞান হলো; বাইবেল (তোরাহ ও ইঞ্জিল), পুরাণ হলো; ইলিয়াড, ওডিসি ও ঈনিদ। অন্যদিকে; পারসিক শ্বরবিজ্ঞান হলো; আবেস্তা। আর পুরাণ হলো; কারবালা। আরবীয় শ্বরবিজ্ঞান হলো কুরান। আর পুরাণ হলো আরব্য রজনীর গল্প, খোলাফায়ে রাসেদা (রূপক ইতিহাস), কাসাসুল আম্বিয়া, কাসাসুল কুরান, কাসাসুল আওলিয়া ও হাদিস। সাম্প্রদায়িক গ্রন্থ হলো; ফেকা এবং পারম্পরিক গ্রন্থ হলো; ত্বরিকত্বের পুস্তক-পুস্তিকা।
এভাবে একই সূত্রাবলী ও উপমা নির্মাণশৈলীর দ্বারা নির্মাণ করা হয় শ্বরবিজ্ঞান। উদাহরণস্বরূপ-
(গেহেনা) হতে আরবি ‘جهنم’ (জাহান্নাম) হয়েছে (প্র) গ্রিক পুরাণে বর্ণিত একটি স্থানের নাম Gehenna. নগরের সব ময়লা আবর্জনাসহ মৃতলাশ সেখানে ফেলে পরে জ্বালিয়ে দেয়া হতো। অপরাধীদেরকেও সেখানে নিয়ে শাস্তি দিয়ে পুড়িয়ে মারা হতো। তাই; ভয়ে ও ঘৃণায় ঐ নোংরা স্থানে স্বেচ্ছায় কেউ যেতে চাইতো না। অসৎ কাজ করলে লোকে এই বলে তাকে শাসাতো যে; “তুমি কি গেহেন্না যেতে চাও?” ইত্যাদি। গবেষকগণের ধারণা উক্ত Gehenna পরিভাষাটি কালক্রমে ভাষান্তরিত হয়ে গেহেন্নাম বা জেহেন্নাম (ইংরেজি এ এর জ উচ্চারণ অনুসারে) রূপান্তরিত হয়েছে এবং পরবর্তীকালে আরবী ভাষায় ‘جهنم’ (জাহান্নাম) হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আরও উল্লেখযোগ্য যে; প্রাচীন গ্রিক ও হিব্রু জাতির অনেক পৌরাণিক কাহিনী ও ‘গ্রিক পৌরাণিক রূপক পরিভাষা’ ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থেও স্থান পেয়েছে; যা এর পরবর্তী ২টি সিমেটিক সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক গ্রন্থেও উল্লেখিত হয়েছে।
১০. গ্রিক পরিভাষা Eden (ইডেন) হতে আরবি ‘عدن’ (আদনা) হয়েছে। ইসলামী পুরাণের বর্ণনা অনুসারে; এটিই আদিমানব ও আদিমানবী সৃষ্টি ও বসবাসের সে আদি স্বর্গ।
১১. গ্রিক পরিভাষা Adam (অ্যাডাম) হতে আরবি ‘أدم’ (আদম) হয়েছে। ইসলামী পুরাণের বর্ণনা অনুসারে; এনিই আল্লাহর নিজ তত্ত্বাবধানে সৃষ্টি আদিমানব ছিলেন। Adam [অ্যাডাম] n কণ্ঠমণি, বিশেষত পুরুষ মানুষরে গলার সম্মুখভাগের উন্নত অংশ (হলকুম) {ই}
১২. গ্রিক পরিভাষা Mary (মেরি) হতে আরবি ‘مريم’ (মারিয়াম) হয়েছে। ইসলামী পুরাণের বর্ণনা অনুসারে; এনিই হযরত ইসার মাতা ছিলেন। অনুরূপ = ‘পৌরাণিক রূপক পরিভাষা’ চয়নের ভিন্নতার দ্বারা ভারতীয়, মিশরীয়, গ্রিক, পারসিক ও আরবীয় ইত্যাদি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। অতঃপর; এসব বলয়ের শ্বরবিজ্ঞানগুলো ক্রমে ক্রমে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রচার ও প্রসারলাভ করতে থাকে। ভারতীয় ও গ্রিক শ্বরবিজ্ঞান প্রায় তিন হাজার (৩০০০) বছর পূর্বে আরবীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করেছিল। আরবীয় সুবিজ্ঞ মনীষীগণ ভারতীয় ও গ্রিক ‘পৌরাণিক রূপক পরিভাষা’কে স্ব স্ব মাতৃভাষায় যথাসাধ্য অনুবাদ করেই গ্রহণ করেছিলেন। স্বীকার করা একান্ত প্রয়োজন যে; আরবীয়রা এখন পর্যন্ত অনেক গ্রিক পরিভাষার সার্থক অনুবাদ করতে পারে নি। আরবীয় অনুবাদকরা বাইবেল অনুবাদের সময় Adam, Archangel, Earth, Eden, Essa, Gabriel, Gehenna, Goliath, Manna, Mary, Michael, Paradise, Seraphim ইত্যাদি পরিভাষা অবিকল রেখে দিয়েছে। অন্যদিকে; বাঙালী অনুবাদকরা কুরান ও হাদিস অনুবাদের সময় ‘أدم’ (আদম), ‘أرض’ (আরদ), ‘اسرافيل’ (ইস্রারাফিল), ‘الْمَنَّ’ (আলমান্না), ‘جالوت’ (জালুত), ‘ﺠﺑﺮﺍﺌﻴﻞ’ (জিব্রাইল), ‘جهنم’ (জাহান্নাম), ‘عزرائيل’ (আজরাইল), ‘عدن’ (আদনা), عيس (ইসা), ‘فردوس’ (ফেরদাউস), ‘مريم’ (মারিয়াম) ও ‘ميكائيل’ (মিকাইল) ইত্যাদি পরিভাষা অবিকল রেখে দিয়েছে।
১. গ্রিক পরিভাষা Gabriel (গ্যাবরিয়েল) হতে আরবি পরিভাষা ‘جبريل’ (জিবরীল) ও পরে ‘ﺠﺑﺮﺍﺌﻴﻞ’ (জিব্রাইল) হয়েছে।
২. গ্রিক পরিভাষা Michael (মাইখেল) হতে আরবি পরিভাষা ‘مِيكَالَ’ (মিকাল)/ ‘مايكل’ (মিকালা), ‘ميكائيل’ (মিকাইল) ও পরে ‘ميخائيل’ (মিখাইল) হয়েছে।
৩. গ্রিক পরিভাষা Seraphim (সের্যাফিম) হতে আরবি পরিভাষা ‘اسرافيل’ (ইস্রারাফিল) হয়েছে। উল্লেখ্য; এ পরিভাষাটি কুরানে উল্লেখ নেই। Seraphim [সের্যাফিম] n উঁচু শ্রেণির দেবতা, সর্বোচ্চ সারির দেবদূত ‘اسرافيل’ (ইস্রারাফিল) {ই}
৪. গ্রিক পরিভাষা Archangel (আখেঞ্জেল) হতে আরবি পরিভাষা ‘عزرائيل’ (আজরাইল) হয়েছে। উল্লেখ্য যে; এ পরিভাষাটি কুরানে উল্লেখ নেই। Archangel [আখেঞ্জেল] n সর্বশ্রেষ্ঠ শ্রেণির দেবতা বা স্বর্গীয় দূত, উঁচু শ্রেণির দেবতা {ই}
৫. গ্রিক পরিভাষা Earth (আর্থ) হতে আরবি ‘أرض’ (আরদ) হয়েছে।
৬. গ্রিক পরিভাষা Paradise (প্যারাডাইজ) হতে আরবি ‘فردوس’ (ফেরদাউস) হয়েছে।
৭. গ্রিক পরিভাষা Goliath (গলেথ) হতে আরবি ‘جالوت’ (জালুত) হয়েছে।
৮. গ্রিক পরিভাষা Manna (মান্না) হতে আরবি ‘الْمَنَّ’ (আলমান্না) হয়েছে। Manna [মান্না] n অমির, পীযূষ, সুধা, স্বর্গীয় জল (প্র) ১ প্রত্যাশিতভাবে প্রাপ্ত মানসিক তৃপ্তিদায়ক পানীয় ২ (বাইবেলে বর্ণিত) ইসরাইলিদের ৪০ বছর মরুপ্রান্তরে কাটানোর সময় প্রভু প্রদত্ত পানীয় বিশেষ ৩ কুরানী মনীষীদের রূপক-বর্ণনা মতে; কুরানোক্ত এক প্রকার স্বর্গীয় পানীয় বিশেষ {ই}
৯. গ্রিক পরিভাষা Gehenna عيس = Essa.
আজ হতে মাত্র ছয়শত (৬০০) বছর পূর্বে সে আরবীয় শ্বরবিজ্ঞান পুনরায় ভারতবর্ষে প্রবেশ করতে আরম্ভ করে। কিন্তু আজও এ উপমহাদেশের অনুবাদকরা আরবীয় পুরাণের ‘পৌরাণিক রূপক পরিভাষা’গুলোর সার্থক অনুবাদ করতে সক্ষম হয় নি। অনুবাদকরা অনুবাদ করার সময়ে আল্লাহ, রাসুল, আদম, হাওয়া, ইসা, মুসা ও সুলাইমান ইত্যাদি ‘পৌরাণিক রূপক পরিভাষা’র সফল কোনো অনুবাদ না করে নামপদ বা বিশেষ্যপদ বলে তা হুবহু রেখে দিয়েছে। ফলে; সাধারণ জনগণের নিকট এটা নতুন বা ভিন্ন কোনো অভিনববিদ্যা বলে প্রতীয়মান হয়ে আসছে। উল্লেখ্য যে; গত অর্ধ শতাব্দী পূর্ব হতে এ পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশের নব্য অনুবাদকরা; আরবীয় শ্বরবিজ্ঞান নির্ভর অনেক পুস্তক-পুস্তিকা বাংলাভাষায় অনুবাদ করেছে। কিন্তু আরবীয় পুরাণে ব্যবহৃত পৌরাণিক রূপক পরিভাষাগুলোকে নামপদ বা বিশেষ্যপদ বলে; কোনো অনুবাদ বা প্রতিশব্দ প্রণয়ন না করে হুবহু রেখে দিয়েছে। এমনকি; কোনো অনুবাদক বা অভিধানবিদ পৌরাণিক রূপক পরিভাষাগুলোর কোনো অর্থও প্রদান করে নি। ব্যাপারটি সম্পূর্ণ উল্টো। কারণ; সাধারণ সাহিত্যে নামপদের কোনো অনুবাদ হয় না বটে কিন্তু পুরাণে চয়িত নামপদগুলোর কয়েক শত পর্যন্ত প্রতিশব্দও হয়।
প্রায় হাজার বছর পূর্ব হতে আরবীয় মনীষীদের ভারতবর্ষে আগমনের মাধ্যমে আল্লাহ, রাসুল, আদম, হাওয়া, ইসা, মুসা, সুলাইমান, জিব্রাইল, মিকাইল, জান্নাত ও জাহান্নাম ইত্যাদি আরবীয় পুরাণের ‘পৌরাণিক রূপক পরিভাষা’ বাংভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করতে থাকে। অতঃপর; প্রায় ৬০০ বছর পূর্বে মোঘল সম্রাটদের আধিপত্যের ছত্রছায়ায় আরবীয় সাম্প্রদায়িক মনীষীদের দ্বারা আরবীয় শ্বরবিজ্ঞান হতে সংস্কারিত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সংস্কারগুলো সাম্প্রদায়িক নীতিমালা নামে ভারতবর্ষে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠালাভ করে। তখন হতেই সাম্প্রদায়িক নীতিমালা আশ্রয়ীদের নিকট হতে পূর্বপুরুষদের বহু কষ্টার্জিত বাংভারতীয় শ্বরবিজ্ঞান বা প্রকৃত আত্মদর্শন (real introspection) বা real theosophy ক্রমে ক্রমে পদদলিত, অবহেলিত, উপেক্ষিত ও বিলুপ্ত হতে থাকে। অর্থ্যাৎ; প্রকৃত আত্মদর্শন (real introspection) মারা যায় এবং প্রতীকী আত্মদর্শন (symbolic introspection) সমাজে প্রতিষ্ঠালাভ করে। সমাজের প্রায় সর্বত্রই (realism) এর পরিবর্তে (symbolism) প্রতিষ্ঠা হতে আরম্ভ করে। ফলে; বাস্তব আত্মদর্শনের প্রতি সৃষ্টি হতে থাকে বিদ্বেষ ও বিরোধিতার বিষোদগারপূর্ণ মনোভাব। অতঃপর; আরবীয় পুরাণ হতে সংস্কারকৃত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নীতিমালগুলোর ধ্বজাধারী পরগাছা নব্য মনীষীরা ভারতীয় আদি শ্বরবিজ্ঞানকে মন্দ, পরিত্যাজ্য ও বিপথগামী বলে কটুক্তিপূর্ণ ধৃষ্টতা প্রদর্শন করতে আরম্ভ করে।
অন্যদিকে; কালের আবর্তন ও বিবর্তনের ফলে প্রায় চার হাজার বছরের ব্যবধানে ভারতীয় মনীষীরাও পুরাণে ব্যবহৃত ব্রহ্মা, বিষ্ণু, গোবিন্দ, শিব, কালী, রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা ইত্যাদি ‘পৌরাণিক রূপক পরিভাষা’র উৎপত্তিমূল হারিয়ে প্রায় দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ে। ফলে; আল্লাহ, রাসুল, আদম, হাওয়া, হারুৎ, মারুৎ, জান্নাত, জাহান্নাম এবং ব্রহ্মা, বিষ্ণু, গোবিন্দ, কানাই, বলাই, স্বর্গ ও নরক ইত্যাদি ‘পৌরাণিক রূপক পরিভাষা’র দ্বারা উভয় পুরাণে প্রকৃতভাবে কী বুঝায় বা কাকে বুঝায়। এর মর্মভেদইবা কী ও এর উপকারিতাইবা কী ইত্যাদির প্রতি সাম্প্রদায়িক মনীষীরা কেউই লক্ষ্য করে নি। অন্যদিকে; তারা সাধারণ মানুষের নিকট; বিশ্বের বিভিন্ন পৌরাণিক উপমা, জনরব, গুজব, রটনা, লোকশ্রুতি, কিংবদন্তি, রূপকথা, লোককথা, জনপ্রবাদ ও লোকপ্রবাদ ইত্যাদি বর্ণনা করে পুরাণকে অন্তঃসারশূন্য পৌরাণিক কাহিনীসর্বস্ব সাহিত্যে পরিণত করেছে। এজন্য; শ্বরবিজ্ঞানের অমর ও অমূল্য রূপক কাহিনীগুলো তার মূলশিক্ষা ও স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেছে। ফলে; শিল্প নির্মাতারা শ্বরবিজ্ঞান ও পুরাণের উপমার ওপর ভিত্তি করে সারি, জারি, নাটক, যাত্রাপালা ও চলচ্চিত্র নির্মাণ করতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি।
শ্বরবিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী নির্মিত ও উপস্থাপিত মনোরম ছোট ছোট পৌরাণিক কাহিনীগুলো ক্রমে ক্রমে নাটক-নাটিকা, ছায়াচিত্র, পুস্তক-পুস্তিকা ও লোকসাহিত্যে পরিণত হতে বাধ্য হয়। অতঃপর; এসব পৃথিবীর সর্বত্র প্রায় সর্বভাষায় সর্বসাধারণের নিকট মর্মগ্রাহী ও হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠতে থাকে। ভারতবর্ষ ও গ্রিক পুরাণের দেবতাগণের আত্মজ্ঞান ভিত্তিক পৌরাণিক কাহিনী আরবীয়দের নিকট কারামত ও আরব্যদের নিকট মু’জেযা নামে পরিচিতি লাভ করে। এমনকি; পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষণীয় ও উপদেশমূলক গল্প আকারে পাঠদানেরও সূচনা হয়। মহাভারতে রূপকার্থে বর্ণিত কুরুক্ষেত্রের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হয় চির অমর মহাকাব্য ‘শ্রীমদ্ভগবদ গীতা’। রামায়ণে রাম-রাবণের এক ভয়াবহ কল্পিত যুদ্ধ বর্ণনা করা হয়। বিশ্ববিখ্যাত মহাগ্রন্থ রামায়ণের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হয় মহাকাব্য ‘মেঘনাথ বধ’। অন্যদিকে; মহাগ্রন্থ বেদের ওপর ভিত্তি করে সাম্প্রদায়িক নীতিমালা রূপে নির্মিত হয় ‘উপনিষদগুলো’ ইত্যাদি। আরও পরে পৌরাণিক কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হতে থাকে অসংখ্য উপন্যাস, মহাকাব্য ও মহাগ্রন্থ। পারসিকদের সুবিখ্যাত কাববালা উপন্যাসের ফুরাত নদীর তীরবর্তী হোসেন বধ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয় অমরগ্রন্থ ‘বিষাদসিন্ধু’ ও মহাকাব্য ‘মহাশ্মশান’। উপন্যাসের মধ্যে পারসিক উপন্যাসগুলো উল্লেখযোগ্য। অতঃপর; আরব্য উপকূলে কুরানের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তীকালে নির্মিত হতে থাকে সাম্প্রদায়িক নীতিমালা বিষয়ক ব্যক্তি মতামতভিত্তিক হানাফি, শাফিয়ি, মালিকি ও হাম্বলি ইত্যাদি ফিক্বা গ্রন্থ। মানবজাতির চির কল্যাণের জন্য থরে বিথরে নির্মিত হয়েছে হাদিস গ্রন্থাদি। এগুলো কুরানের রূপক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণভিত্তিক পুরাণের চিরন্তন বাণী এবং আত্মজ্ঞান ও সাধনতত্ত্ব বিষয়ক মহামূল্যবান গ্রন্থ।
বস্তুত দুটি কারণে মানুষ ক্রমে ক্রমে শ্বরবিজ্ঞান পরিহার করে সাম্প্রদায়িক নীতিমালার প্রতি ঝুঁকে পড়তে আরম্ভ করে। তা হলো ১ বেদ, ত্রিপিটিক, আবেস্তা, তোরাহ, যাবুর, ইঞ্জিল ও কুরানের মতো শ্বরবিজ্ঞান কয়েক শত বছর ব্যবধানে সৃষ্টি হওয়া ২ রূপকার্থে নির্মিত রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, উপনিষদ, হাদিস এবং সাম্প্রদায়িক নীতিমালা বিষয়ক ফিক্বা গ্রন্থ নির্মিত হওয়া। যারফলে; শ্বরবিজ্ঞানের অমূল্য শিক্ষাও ক্রমে ক্রমে অবলুপ্ত হতে থাকে। উল্লেখ্য যে; সাম্প্রদায়িক দর্শন ও প্রকৃত সাম্প্রদায়িক দর্শন এক নয়। তারপরও; সাধারণ মানুষ সাম্প্রদায়িক ও পারম্পরিক দর্শনকে প্রকৃত দর্শন মনে করে ক্রমে ক্রমে সাম্প্রদায়িক ও পারম্পরিক দর্শননির্ভর হয়ে পড়তে আরম্ভ করে।
অবলুপ্ত শ্বরবিজ্ঞানকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য যুগে যুগে বড় বড় সাধু সন্ন্যাসীগণ অবর্ণনীয় প্রচেষ্টা ও প্রয়াস করে গেছেন। যারফলে; বিভিন্ন প্রকার সাম্প্রদায়িক নীতিমালা বর্তমান থাকা সত্ত্বেও হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও মুসলমান সাম্প্রদায়িক মতবাদের মধ্যে প্রায় লক্ষাধিক পরম্পরা মতবাদের আবিষ্কার হয়েছে। মূল আধ্যাত্মিক শিক্ষা হতে বিচ্যুতি হওয়ার ফলে দিশেহারা মানুষ ক্রমে ক্রমে দল-উপদল ও শাখা-প্রশাখায় বা একাধিক দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। উল্লেখ্য; শ্বরবিজ্ঞান সর্বকালে সর্বযুগে সারাবিশ্বে একই। এর কোনো শাখা-প্রশাখার উৎপত্তি হয় নি আজও; কোনো দিন হবেও না। কারণ; আধ্যাত্মিক বিশ্ববিদ্যালয় মাত্র একটি; তা হলো ‘মানবদেহ’। সৃষ্টিজগতে মানবের ঊর্ধ্বে আর কিছু নেই। যারফলে; একমাত্র মানবদেহ খোঁজ করলেই পরম সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তার সন্ধান পাওয়া যায়। বাঙালী গোঁসাইরা; বাঙালী হওয়ার পরও বাংলা সাম্প্রদায়িক ও পারম্পরিক পরিভাষার জ্ঞানার্জন করে না। তাই; তারা তাদের শিষ্যদের সংস্কৃত পরিভাষায় সাম্প্রদায়িক ও পারম্পরিক শিক্ষা দিয়ে থাকে। অন্যদিকে; বাঙালী পিরেরা; বাঙালী হওয়ার পরও বাংলা সাম্প্রদায়িক ও পারম্পরিক পরিভাষার জ্ঞানার্জন করে না। তাই; তারা তাদের শিষ্যদের আরবি পরিভাষায় সাম্প্রদায়িক ও পারম্পরিক শিক্ষা দিয়ে থাকে।
ফলে; মূল বিষয় দাঁড়ায় এমন যে, গোঁসাই ও পিরেরা নিজেও কিছু বুঝে না এবং শিষ্যদেরও কিছুই বুঝাতে সক্ষম হয় না। যেমন; তারা নিজেরাও বিপথগামী; তেমনই; তাদের শিষ্যরাও চরম বিপথগামী। বুদ্ধিমান গোঁসাই, পির, শিষ্য ও পাঠকদের উচিত সর্বপ্রথমে যার যার মাতৃভাষায় সাম্প্রদায়িক ও পারম্পরিক পরিভাষাগুলো ভালোভাবে জেনে ও বুঝে নেওয়া। অতঃপর; ভজন-সাধন কিংবা সাম্প্রদায়িক ও পারম্পরিক মতবাদ প্রচার প্রসারে আত্মনিয়োগ করা। নিজের মাতৃভাষায় কোনকিছু ভালোভাবে বুঝে না নিলে; তা কোনো দিন তার কোনো উপকারে আসবে না। নিজের মাতৃভাষায় কোনকিছু একবার বুঝা; অন্য ভাষায় হাজারবার পড়ার চেয়েও উত্তম।
পৌরাণিক রূপক পরিভাষা’ চয়ন একই। আরও উল্লেখ্য যে; ভারতীয় শ্বরবিজ্ঞান, গ্রিক শ্বরবিজ্ঞান, রোমান শ্বরবিজ্ঞান, পারসিক শ্বরবিজ্ঞান ও আরব্য শ্বরবিজ্ঞান ইত্যাদির মহাকাব্যের ভাব, সূত্রাবলী, উৎপত্তিমূল এবং উপমা নির্মাণশৈলী একই। শুধু রূপকার্থে চয়িত পরিভাষাগুলোই ভিন্ন। শ্বরবিজ্ঞান, পুরাণ, সাম্প্রদায়িক ও পারম্পরিক পুস্তক-পুস্তিকা নির্মাণের ক্ষেত্রে বিশ্বকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। যেমন; ১. ভারতীয় শ্বরবিজ্ঞান, পুরাণ, সাম্প্রদায়িক ও পারম্পরিক পুস্তক-পুস্তিকা ২. গ্রিক শ্বরবিজ্ঞান, পুরাণ, সাম্প্রদায়িক ও পারম্পরিক পুস্তক-পুস্তিকা ও ৩. আরবীয় শ্বরবিজ্ঞান, পুরাণ, সাম্প্রদায়িক ও পারম্পরিক পুস্তক-পুস্তিকা। ভারতীয় শ্বরবিজ্ঞান হলো; বেদ, পুরাণ হলো রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণাদি এবং সাম্প্রদায়িক গ্রন্থ হলো; শ্রীমদ্ভগবতগীতা। গ্রিক শ্বরবিজ্ঞান হলো; বাইবেল (তোরাহ ও ইঞ্জিল), পুরাণ হলো; ইলিয়াড, ওডিসি ও ঈনিদ। অন্যদিকে; পারসিক শ্বরবিজ্ঞান হলো; আবেস্তা। আর পুরাণ হলো; কারবালা। আরবীয় শ্বরবিজ্ঞান হলো কুরান। আর পুরাণ হলো আরব্য রজনীর গল্প, খোলাফায়ে রাসেদা (রূপক ইতিহাস), কাসাসুল আম্বিয়া, কাসাসুল কুরান, কাসাসুল আওলিয়া ও হাদিস। সাম্প্রদায়িক গ্রন্থ হলো; ফেকা এবং পারম্পরিক গ্রন্থ হলো; ত্বরিকত্বের পুস্তক-পুস্তিকা।
এভাবে একই সূত্রাবলী ও উপমা নির্মাণশৈলীর দ্বারা নির্মাণ করা হয় শ্বরবিজ্ঞান। উদাহরণস্বরূপ-
(গেহেনা) হতে আরবি ‘جهنم’ (জাহান্নাম) হয়েছে (প্র) গ্রিক পুরাণে বর্ণিত একটি স্থানের নাম Gehenna. নগরের সব ময়লা আবর্জনাসহ মৃতলাশ সেখানে ফেলে পরে জ্বালিয়ে দেয়া হতো। অপরাধীদেরকেও সেখানে নিয়ে শাস্তি দিয়ে পুড়িয়ে মারা হতো। তাই; ভয়ে ও ঘৃণায় ঐ নোংরা স্থানে স্বেচ্ছায় কেউ যেতে চাইতো না। অসৎ কাজ করলে লোকে এই বলে তাকে শাসাতো যে; “তুমি কি গেহেন্না যেতে চাও?” ইত্যাদি। গবেষকগণের ধারণা উক্ত Gehenna পরিভাষাটি কালক্রমে ভাষান্তরিত হয়ে গেহেন্নাম বা জেহেন্নাম (ইংরেজি এ এর জ উচ্চারণ অনুসারে) রূপান্তরিত হয়েছে এবং পরবর্তীকালে আরবী ভাষায় ‘جهنم’ (জাহান্নাম) হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আরও উল্লেখযোগ্য যে; প্রাচীন গ্রিক ও হিব্রু জাতির অনেক পৌরাণিক কাহিনী ও ‘গ্রিক পৌরাণিক রূপক পরিভাষা’ ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থেও স্থান পেয়েছে; যা এর পরবর্তী ২টি সিমেটিক সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক গ্রন্থেও উল্লেখিত হয়েছে।
১০. গ্রিক পরিভাষা Eden (ইডেন) হতে আরবি ‘عدن’ (আদনা) হয়েছে। ইসলামী পুরাণের বর্ণনা অনুসারে; এটিই আদিমানব ও আদিমানবী সৃষ্টি ও বসবাসের সে আদি স্বর্গ।
১১. গ্রিক পরিভাষা Adam (অ্যাডাম) হতে আরবি ‘أدم’ (আদম) হয়েছে। ইসলামী পুরাণের বর্ণনা অনুসারে; এনিই আল্লাহর নিজ তত্ত্বাবধানে সৃষ্টি আদিমানব ছিলেন। Adam [অ্যাডাম] n কণ্ঠমণি, বিশেষত পুরুষ মানুষরে গলার সম্মুখভাগের উন্নত অংশ (হলকুম) {ই}
১২. গ্রিক পরিভাষা Mary (মেরি) হতে আরবি ‘مريم’ (মারিয়াম) হয়েছে। ইসলামী পুরাণের বর্ণনা অনুসারে; এনিই হযরত ইসার মাতা ছিলেন। অনুরূপ = ‘পৌরাণিক রূপক পরিভাষা’ চয়নের ভিন্নতার দ্বারা ভারতীয়, মিশরীয়, গ্রিক, পারসিক ও আরবীয় ইত্যাদি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। অতঃপর; এসব বলয়ের শ্বরবিজ্ঞানগুলো ক্রমে ক্রমে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রচার ও প্রসারলাভ করতে থাকে। ভারতীয় ও গ্রিক শ্বরবিজ্ঞান প্রায় তিন হাজার (৩০০০) বছর পূর্বে আরবীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করেছিল। আরবীয় সুবিজ্ঞ মনীষীগণ ভারতীয় ও গ্রিক ‘পৌরাণিক রূপক পরিভাষা’কে স্ব স্ব মাতৃভাষায় যথাসাধ্য অনুবাদ করেই গ্রহণ করেছিলেন। স্বীকার করা একান্ত প্রয়োজন যে; আরবীয়রা এখন পর্যন্ত অনেক গ্রিক পরিভাষার সার্থক অনুবাদ করতে পারে নি। আরবীয় অনুবাদকরা বাইবেল অনুবাদের সময় Adam, Archangel, Earth, Eden, Essa, Gabriel, Gehenna, Goliath, Manna, Mary, Michael, Paradise, Seraphim ইত্যাদি পরিভাষা অবিকল রেখে দিয়েছে। অন্যদিকে; বাঙালী অনুবাদকরা কুরান ও হাদিস অনুবাদের সময় ‘أدم’ (আদম), ‘أرض’ (আরদ), ‘اسرافيل’ (ইস্রারাফিল), ‘الْمَنَّ’ (আলমান্না), ‘جالوت’ (জালুত), ‘ﺠﺑﺮﺍﺌﻴﻞ’ (জিব্রাইল), ‘جهنم’ (জাহান্নাম), ‘عزرائيل’ (আজরাইল), ‘عدن’ (আদনা), عيس (ইসা), ‘فردوس’ (ফেরদাউস), ‘مريم’ (মারিয়াম) ও ‘ميكائيل’ (মিকাইল) ইত্যাদি পরিভাষা অবিকল রেখে দিয়েছে।
১. গ্রিক পরিভাষা Gabriel (গ্যাবরিয়েল) হতে আরবি পরিভাষা ‘جبريل’ (জিবরীল) ও পরে ‘ﺠﺑﺮﺍﺌﻴﻞ’ (জিব্রাইল) হয়েছে।
২. গ্রিক পরিভাষা Michael (মাইখেল) হতে আরবি পরিভাষা ‘مِيكَالَ’ (মিকাল)/ ‘مايكل’ (মিকালা), ‘ميكائيل’ (মিকাইল) ও পরে ‘ميخائيل’ (মিখাইল) হয়েছে।
৩. গ্রিক পরিভাষা Seraphim (সের্যাফিম) হতে আরবি পরিভাষা ‘اسرافيل’ (ইস্রারাফিল) হয়েছে। উল্লেখ্য; এ পরিভাষাটি কুরানে উল্লেখ নেই। Seraphim [সের্যাফিম] n উঁচু শ্রেণির দেবতা, সর্বোচ্চ সারির দেবদূত ‘اسرافيل’ (ইস্রারাফিল) {ই}
৪. গ্রিক পরিভাষা Archangel (আখেঞ্জেল) হতে আরবি পরিভাষা ‘عزرائيل’ (আজরাইল) হয়েছে। উল্লেখ্য যে; এ পরিভাষাটি কুরানে উল্লেখ নেই। Archangel [আখেঞ্জেল] n সর্বশ্রেষ্ঠ শ্রেণির দেবতা বা স্বর্গীয় দূত, উঁচু শ্রেণির দেবতা {ই}
৫. গ্রিক পরিভাষা Earth (আর্থ) হতে আরবি ‘أرض’ (আরদ) হয়েছে।
৬. গ্রিক পরিভাষা Paradise (প্যারাডাইজ) হতে আরবি ‘فردوس’ (ফেরদাউস) হয়েছে।
৭. গ্রিক পরিভাষা Goliath (গলেথ) হতে আরবি ‘جالوت’ (জালুত) হয়েছে।
৮. গ্রিক পরিভাষা Manna (মান্না) হতে আরবি ‘الْمَنَّ’ (আলমান্না) হয়েছে। Manna [মান্না] n অমির, পীযূষ, সুধা, স্বর্গীয় জল (প্র) ১ প্রত্যাশিতভাবে প্রাপ্ত মানসিক তৃপ্তিদায়ক পানীয় ২ (বাইবেলে বর্ণিত) ইসরাইলিদের ৪০ বছর মরুপ্রান্তরে কাটানোর সময় প্রভু প্রদত্ত পানীয় বিশেষ ৩ কুরানী মনীষীদের রূপক-বর্ণনা মতে; কুরানোক্ত এক প্রকার স্বর্গীয় পানীয় বিশেষ {ই}
৯. গ্রিক পরিভাষা Gehenna عيس = Essa.
আজ হতে মাত্র ছয়শত (৬০০) বছর পূর্বে সে আরবীয় শ্বরবিজ্ঞান পুনরায় ভারতবর্ষে প্রবেশ করতে আরম্ভ করে। কিন্তু আজও এ উপমহাদেশের অনুবাদকরা আরবীয় পুরাণের ‘পৌরাণিক রূপক পরিভাষা’গুলোর সার্থক অনুবাদ করতে সক্ষম হয় নি। অনুবাদকরা অনুবাদ করার সময়ে আল্লাহ, রাসুল, আদম, হাওয়া, ইসা, মুসা ও সুলাইমান ইত্যাদি ‘পৌরাণিক রূপক পরিভাষা’র সফল কোনো অনুবাদ না করে নামপদ বা বিশেষ্যপদ বলে তা হুবহু রেখে দিয়েছে। ফলে; সাধারণ জনগণের নিকট এটা নতুন বা ভিন্ন কোনো অভিনববিদ্যা বলে প্রতীয়মান হয়ে আসছে। উল্লেখ্য যে; গত অর্ধ শতাব্দী পূর্ব হতে এ পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশের নব্য অনুবাদকরা; আরবীয় শ্বরবিজ্ঞান নির্ভর অনেক পুস্তক-পুস্তিকা বাংলাভাষায় অনুবাদ করেছে। কিন্তু আরবীয় পুরাণে ব্যবহৃত পৌরাণিক রূপক পরিভাষাগুলোকে নামপদ বা বিশেষ্যপদ বলে; কোনো অনুবাদ বা প্রতিশব্দ প্রণয়ন না করে হুবহু রেখে দিয়েছে। এমনকি; কোনো অনুবাদক বা অভিধানবিদ পৌরাণিক রূপক পরিভাষাগুলোর কোনো অর্থও প্রদান করে নি। ব্যাপারটি সম্পূর্ণ উল্টো। কারণ; সাধারণ সাহিত্যে নামপদের কোনো অনুবাদ হয় না বটে কিন্তু পুরাণে চয়িত নামপদগুলোর কয়েক শত পর্যন্ত প্রতিশব্দও হয়।
প্রায় হাজার বছর পূর্ব হতে আরবীয় মনীষীদের ভারতবর্ষে আগমনের মাধ্যমে আল্লাহ, রাসুল, আদম, হাওয়া, ইসা, মুসা, সুলাইমান, জিব্রাইল, মিকাইল, জান্নাত ও জাহান্নাম ইত্যাদি আরবীয় পুরাণের ‘পৌরাণিক রূপক পরিভাষা’ বাংভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করতে থাকে। অতঃপর; প্রায় ৬০০ বছর পূর্বে মোঘল সম্রাটদের আধিপত্যের ছত্রছায়ায় আরবীয় সাম্প্রদায়িক মনীষীদের দ্বারা আরবীয় শ্বরবিজ্ঞান হতে সংস্কারিত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সংস্কারগুলো সাম্প্রদায়িক নীতিমালা নামে ভারতবর্ষে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠালাভ করে। তখন হতেই সাম্প্রদায়িক নীতিমালা আশ্রয়ীদের নিকট হতে পূর্বপুরুষদের বহু কষ্টার্জিত বাংভারতীয় শ্বরবিজ্ঞান বা প্রকৃত আত্মদর্শন (real introspection) বা real theosophy ক্রমে ক্রমে পদদলিত, অবহেলিত, উপেক্ষিত ও বিলুপ্ত হতে থাকে। অর্থ্যাৎ; প্রকৃত আত্মদর্শন (real introspection) মারা যায় এবং প্রতীকী আত্মদর্শন (symbolic introspection) সমাজে প্রতিষ্ঠালাভ করে। সমাজের প্রায় সর্বত্রই (realism) এর পরিবর্তে (symbolism) প্রতিষ্ঠা হতে আরম্ভ করে। ফলে; বাস্তব আত্মদর্শনের প্রতি সৃষ্টি হতে থাকে বিদ্বেষ ও বিরোধিতার বিষোদগারপূর্ণ মনোভাব। অতঃপর; আরবীয় পুরাণ হতে সংস্কারকৃত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নীতিমালগুলোর ধ্বজাধারী পরগাছা নব্য মনীষীরা ভারতীয় আদি শ্বরবিজ্ঞানকে মন্দ, পরিত্যাজ্য ও বিপথগামী বলে কটুক্তিপূর্ণ ধৃষ্টতা প্রদর্শন করতে আরম্ভ করে।
অন্যদিকে; কালের আবর্তন ও বিবর্তনের ফলে প্রায় চার হাজার বছরের ব্যবধানে ভারতীয় মনীষীরাও পুরাণে ব্যবহৃত ব্রহ্মা, বিষ্ণু, গোবিন্দ, শিব, কালী, রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা ইত্যাদি ‘পৌরাণিক রূপক পরিভাষা’র উৎপত্তিমূল হারিয়ে প্রায় দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ে। ফলে; আল্লাহ, রাসুল, আদম, হাওয়া, হারুৎ, মারুৎ, জান্নাত, জাহান্নাম এবং ব্রহ্মা, বিষ্ণু, গোবিন্দ, কানাই, বলাই, স্বর্গ ও নরক ইত্যাদি ‘পৌরাণিক রূপক পরিভাষা’র দ্বারা উভয় পুরাণে প্রকৃতভাবে কী বুঝায় বা কাকে বুঝায়। এর মর্মভেদইবা কী ও এর উপকারিতাইবা কী ইত্যাদির প্রতি সাম্প্রদায়িক মনীষীরা কেউই লক্ষ্য করে নি। অন্যদিকে; তারা সাধারণ মানুষের নিকট; বিশ্বের বিভিন্ন পৌরাণিক উপমা, জনরব, গুজব, রটনা, লোকশ্রুতি, কিংবদন্তি, রূপকথা, লোককথা, জনপ্রবাদ ও লোকপ্রবাদ ইত্যাদি বর্ণনা করে পুরাণকে অন্তঃসারশূন্য পৌরাণিক কাহিনীসর্বস্ব সাহিত্যে পরিণত করেছে। এজন্য; শ্বরবিজ্ঞানের অমর ও অমূল্য রূপক কাহিনীগুলো তার মূলশিক্ষা ও স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেছে। ফলে; শিল্প নির্মাতারা শ্বরবিজ্ঞান ও পুরাণের উপমার ওপর ভিত্তি করে সারি, জারি, নাটক, যাত্রাপালা ও চলচ্চিত্র নির্মাণ করতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি।
শ্বরবিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী নির্মিত ও উপস্থাপিত মনোরম ছোট ছোট পৌরাণিক কাহিনীগুলো ক্রমে ক্রমে নাটক-নাটিকা, ছায়াচিত্র, পুস্তক-পুস্তিকা ও লোকসাহিত্যে পরিণত হতে বাধ্য হয়। অতঃপর; এসব পৃথিবীর সর্বত্র প্রায় সর্বভাষায় সর্বসাধারণের নিকট মর্মগ্রাহী ও হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠতে থাকে। ভারতবর্ষ ও গ্রিক পুরাণের দেবতাগণের আত্মজ্ঞান ভিত্তিক পৌরাণিক কাহিনী আরবীয়দের নিকট কারামত ও আরব্যদের নিকট মু’জেযা নামে পরিচিতি লাভ করে। এমনকি; পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষণীয় ও উপদেশমূলক গল্প আকারে পাঠদানেরও সূচনা হয়। মহাভারতে রূপকার্থে বর্ণিত কুরুক্ষেত্রের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হয় চির অমর মহাকাব্য ‘শ্রীমদ্ভগবদ গীতা’। রামায়ণে রাম-রাবণের এক ভয়াবহ কল্পিত যুদ্ধ বর্ণনা করা হয়। বিশ্ববিখ্যাত মহাগ্রন্থ রামায়ণের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হয় মহাকাব্য ‘মেঘনাথ বধ’। অন্যদিকে; মহাগ্রন্থ বেদের ওপর ভিত্তি করে সাম্প্রদায়িক নীতিমালা রূপে নির্মিত হয় ‘উপনিষদগুলো’ ইত্যাদি। আরও পরে পৌরাণিক কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হতে থাকে অসংখ্য উপন্যাস, মহাকাব্য ও মহাগ্রন্থ। পারসিকদের সুবিখ্যাত কাববালা উপন্যাসের ফুরাত নদীর তীরবর্তী হোসেন বধ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয় অমরগ্রন্থ ‘বিষাদসিন্ধু’ ও মহাকাব্য ‘মহাশ্মশান’। উপন্যাসের মধ্যে পারসিক উপন্যাসগুলো উল্লেখযোগ্য। অতঃপর; আরব্য উপকূলে কুরানের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তীকালে নির্মিত হতে থাকে সাম্প্রদায়িক নীতিমালা বিষয়ক ব্যক্তি মতামতভিত্তিক হানাফি, শাফিয়ি, মালিকি ও হাম্বলি ইত্যাদি ফিক্বা গ্রন্থ। মানবজাতির চির কল্যাণের জন্য থরে বিথরে নির্মিত হয়েছে হাদিস গ্রন্থাদি। এগুলো কুরানের রূপক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণভিত্তিক পুরাণের চিরন্তন বাণী এবং আত্মজ্ঞান ও সাধনতত্ত্ব বিষয়ক মহামূল্যবান গ্রন্থ।
বস্তুত দুটি কারণে মানুষ ক্রমে ক্রমে শ্বরবিজ্ঞান পরিহার করে সাম্প্রদায়িক নীতিমালার প্রতি ঝুঁকে পড়তে আরম্ভ করে। তা হলো ১ বেদ, ত্রিপিটিক, আবেস্তা, তোরাহ, যাবুর, ইঞ্জিল ও কুরানের মতো শ্বরবিজ্ঞান কয়েক শত বছর ব্যবধানে সৃষ্টি হওয়া ২ রূপকার্থে নির্মিত রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, উপনিষদ, হাদিস এবং সাম্প্রদায়িক নীতিমালা বিষয়ক ফিক্বা গ্রন্থ নির্মিত হওয়া। যারফলে; শ্বরবিজ্ঞানের অমূল্য শিক্ষাও ক্রমে ক্রমে অবলুপ্ত হতে থাকে। উল্লেখ্য যে; সাম্প্রদায়িক দর্শন ও প্রকৃত সাম্প্রদায়িক দর্শন এক নয়। তারপরও; সাধারণ মানুষ সাম্প্রদায়িক ও পারম্পরিক দর্শনকে প্রকৃত দর্শন মনে করে ক্রমে ক্রমে সাম্প্রদায়িক ও পারম্পরিক দর্শননির্ভর হয়ে পড়তে আরম্ভ করে।
অবলুপ্ত শ্বরবিজ্ঞানকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য যুগে যুগে বড় বড় সাধু সন্ন্যাসীগণ অবর্ণনীয় প্রচেষ্টা ও প্রয়াস করে গেছেন। যারফলে; বিভিন্ন প্রকার সাম্প্রদায়িক নীতিমালা বর্তমান থাকা সত্ত্বেও হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও মুসলমান সাম্প্রদায়িক মতবাদের মধ্যে প্রায় লক্ষাধিক পরম্পরা মতবাদের আবিষ্কার হয়েছে। মূল আধ্যাত্মিক শিক্ষা হতে বিচ্যুতি হওয়ার ফলে দিশেহারা মানুষ ক্রমে ক্রমে দল-উপদল ও শাখা-প্রশাখায় বা একাধিক দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। উল্লেখ্য; শ্বরবিজ্ঞান সর্বকালে সর্বযুগে সারাবিশ্বে একই। এর কোনো শাখা-প্রশাখার উৎপত্তি হয় নি আজও; কোনো দিন হবেও না। কারণ; আধ্যাত্মিক বিশ্ববিদ্যালয় মাত্র একটি; তা হলো ‘মানবদেহ’। সৃষ্টিজগতে মানবের ঊর্ধ্বে আর কিছু নেই। যারফলে; একমাত্র মানবদেহ খোঁজ করলেই পরম সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তার সন্ধান পাওয়া যায়। বাঙালী গোঁসাইরা; বাঙালী হওয়ার পরও বাংলা সাম্প্রদায়িক ও পারম্পরিক পরিভাষার জ্ঞানার্জন করে না। তাই; তারা তাদের শিষ্যদের সংস্কৃত পরিভাষায় সাম্প্রদায়িক ও পারম্পরিক শিক্ষা দিয়ে থাকে। অন্যদিকে; বাঙালী পিরেরা; বাঙালী হওয়ার পরও বাংলা সাম্প্রদায়িক ও পারম্পরিক পরিভাষার জ্ঞানার্জন করে না। তাই; তারা তাদের শিষ্যদের আরবি পরিভাষায় সাম্প্রদায়িক ও পারম্পরিক শিক্ষা দিয়ে থাকে।
ফলে; মূল বিষয় দাঁড়ায় এমন যে, গোঁসাই ও পিরেরা নিজেও কিছু বুঝে না এবং শিষ্যদেরও কিছুই বুঝাতে সক্ষম হয় না। যেমন; তারা নিজেরাও বিপথগামী; তেমনই; তাদের শিষ্যরাও চরম বিপথগামী। বুদ্ধিমান গোঁসাই, পির, শিষ্য ও পাঠকদের উচিত সর্বপ্রথমে যার যার মাতৃভাষায় সাম্প্রদায়িক ও পারম্পরিক পরিভাষাগুলো ভালোভাবে জেনে ও বুঝে নেওয়া। অতঃপর; ভজন-সাধন কিংবা সাম্প্রদায়িক ও পারম্পরিক মতবাদ প্রচার প্রসারে আত্মনিয়োগ করা। নিজের মাতৃভাষায় কোনকিছু ভালোভাবে বুঝে না নিলে; তা কোনো দিন তার কোনো উপকারে আসবে না। নিজের মাতৃভাষায় কোনকিছু একবার বুঝা; অন্য ভাষায় হাজারবার পড়ার চেয়েও উত্তম।