পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ এবং ঈদের সময় মহাসড়কে ৭ দিনের জন্য মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পক্ষে-বিপক্ষে নানা কথাবার্তা সামাজিক যোগাযগ মাধ্যম এবং গণমাধ্যমে আলোচনা হচ্ছে! আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণে দেখলাম যে যার অবস্থান থেকে বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন! আমাদের অনেক বোদ্ধা ব্যক্তিত্ব, যাঁদের বক্তব্য অন্য অনেক ইস্যুতে আমরা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করি, তাঁদের অনেকেই বলছেন মোটরসাইকেল কিভাবে গণপরিবহন হতে পারে? সত্যিই তো, মোটরসাইকেল কিভাবে গণপরিবহন হবে! কিন্তু তাঁরা এই প্রশ্নটা তুলছেন না যে, প্রাইভেট কার গণপরিবহন হতে পারে কিনা? আমাদের কথিত মুল ধারার গণমাধ্যম ২০১৯ সাল থেকে এই পর্যন্ত প্রতিমাসে, প্রত্যেক বছরে কতগুলি মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশন হয়েছে, সেগুলির কত শতাংশ ঢাকাতে, কত শতাংশ ঢাকার বাইরে, আগামী ২০২৭ সাল নাগাদ কত লক্ষ মোটরসাইকেল রাস্তায় নামবে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য আমাদের সামনে হাজির করছেন! কিন্তু এই মহানগরীর রাস্তায়, যেখানে আমাদের গণপরিবহনের সবেধন নীলমণি বাসগুলিকে প্রাইভেটকারের সমুদ্রে দ্বীপের মত দেখায়, সেই প্রাইভেট কার বিষয়ে কোনো বক্তব্য নাই!
যাঁদের মোটরসাইকেলও নাই, প্রাইভেটকারও নাই, তেমন অনেক মানুষেরও গাত্রদাহের কারণ হল মোটরসাইকেল! এই যন্ত্রণাটা যে আমি বুঝি না, তা নয়! কারণ আমি নিজেও ভুক্তভোগী! মুলতঃ এই শ্রেণীর ক্ষোভ হল মোটরসাইকেল চালকদের প্রতি! তারা হুটহাট পথচলতি মানুষের ভেতর দিয়ে সামনে এগোতে চায়, বিনা কারণে হর্ন বাজায়! ফুটপথে বাইক উঠিয়ে দেয়! প্রাইভেট কারও কিন্তু এর ব্যতিক্রম নয়! কিন্তু সেইগুলি হয়ত, আপনার সাথে প্রতিনিয়ত ঘটে না! চোখ, কান খোলা রাখলেই দেখতে পাবেন এবং এটা আপনাকেই দেখতে হবে! কারণ যাঁদের সাথে এটা ঘটে তাঁদের ফেসবুক আইডি নেই! চলতে রাস্তায় দেখতে পাবেন, হঠাতই প্রাইভেট কার দাঁড় করিয়ে ড্রাইভার লাঠিসহ নেমে রিক্সাওয়ালাকে মারতে যাচ্ছে! খানাখন্দে ভর্তি এই নগরীর অলিতে, গলিতে বৃষ্টির পর জমে থাকা পানি দ্রুতগামী প্রাইভেট কারের চাকায় ছলকে গিয়ে পথ চলতি আপনার গায়ে লাগবে জেনেও কি কেউ কারের গতি কমায়? ঢাকা শহরের রাস্তায় কিংবা অলিতে, গলিতে নিয়মিত যারা হাঁটাচলা করেন, তাঁরা এই অভিজ্ঞতা লাভ করেন নাই, এটা বোধহয় বলা যাবে না!
এতক্ষণ যা বললাম, তা মুলতঃ ব্যক্তিক পর্যায়ের বক্তব্য! সামগ্রিক বিবেচনায়, আমরা যদি ভাবি কেন বাইকের সংখ্যা বাড়ছে? তাহলে বলতে হবে আমাদের গণপরিবহণের জীর্ণদশা এবং রাস্তার গতিসীমা! একবার ভাবুন তো অফিস আওয়ারে প্রাইভেট কারের সমুদ্র পেরিয়ে মোহাম্মদপুর থেকে প্রগতি স্মরণি যেতে আপনার কত সময় লাগবে? মিরপুর কিংবা গাবতলী থেকে রওনা হয়ে আপনি যদি সোয়া আটটার মধ্যে কলেজগেট পার না হতে পারেন, সেদিন অফিসে কিংবা কাজের জায়গাতে আপনি সময়মত পৌঁছাতে পারবেন না, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়! প্রাইভেট কারের কথা আমি কেন জোর দিয়ে বলছি, সেটা আপনি বিআরটিসি’র দোতলা বাসের দোতলায় সামনের সিটে বসে একটু সামনে তাকালেই বুঝতে পারবেন! আপনার চোখ যতদুর যায়, সেই সীমানার মধ্যে বাসগুলি গুণে ফেলতে পারবেন! এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতেই নিম্নমধ্যবিত্তের বিকল্প হল, দুই চাকা! নগরীতে বাইকের সংখ্যা বৃদ্ধির মূল কারণগুলির অন্যতম প্রধান কারণ হল এটা! রাইড শেয়ারিং আজকের দিনে যে বাস্তবতা, সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় আছে? কাজেই সেটাও একটা কারণ!
এদেশে বাস মালিকরা যেখানে সরকারকেই জিম্মি করে ফেলে, সেখানে সাধারণ যাত্রীরা তো কোন ছার! অফিস শেষে ঢাকা থেকে রওনা হয়ে একটু অফটাইমে গাবতলী পর্যন্ত গিয়ে যদি দেখে বাসে যথেষ্ট পরিমাণ যাত্রী নাই, তাহলে হঠাতই তাদের বাস নস্ট হয়ে যায়! এটা মিরপুর থেকে কলেজগেট এসেও নষ্ট হয়! আবার রাতের বেলা গাবতলী থেকে বাবুবাজার যাবার প্থে বেড়িবাধ তিন রাস্তার মোড়েও নষ্ট হয়, কিংবা ছুটির দিনে মগবাজারের দিক থেকে গাবতলী কিংবা সাভারগামী বাস ফার্মগেট কিংবা খামারবাড়িতে এসেও নষ্ট হয়! বাস নষ্ট হবে কি হবে না, সেটা নির্ভর করে বাসে কতজন যাত্রী আছে, সেটার উপর! আর ভাড়া নিয়ে, লেডিস সিটে বসা নিয়ে, ছাত্র-ছাত্রীদের ভাড়া নিয়ে বাসের মধ্যে বাহাস থেকে হাতাহাতি তো উপরি পাওনা! এরা কখন লোকাল, আবার কখন গেইটলক হয়ে যায়, সেটা বোঝাও দায়!
এ তো গেল ঢাকা কেন্দ্রিক আংশিক আলোচনা! আপনি, ঢাকা থেকে দুর-পাল্লার বাসে ঈদে বাড়ি যাবার যে যন্ত্রণা, সেটা তো শুরু হয়, টিকেট প্রাপ্তি সময় থেকে, হোক না, সেটা বাস, ট্রেন কিংবা লঞ্চ! টিকিটের দাম দ্বিগুণ কিন্তু সরকারের তরফ থেকে কমন বক্তব্য, আমরা মনিটরিং করছি, মালিকপক্ষের, বিশেষ করে বাস মালিকদের বক্তব্য, আমরা প্রকৃত ভাড়ায় নিচ্ছি! মাঝে মধ্যে কাউন্টার থেকে কেউ কেউ বলেন, ঈদের সময় আমাদের গাড়িগুলি খুব কম যাত্রী নিয়ে ফেরত আসে, তাই সেটা সমন্বয় করার জন্য কিছু বাড়তি টাকা আমাদের নিতে হয়! এই কিছুর কোনো নির্ধারিত পরিমাণ নাই! ট্রেনের টিকিট সে তো সোনার হরিণ! সবার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলছি, আমাদের বাড়ির টান এবং নাড়ির টান কেবল ঈদ আসলেই চাগান দিয়ে ওঠে! তাই বাড়ি না গিয়ে যেহেতু উপায় থাকে না, তাই কোনোমতে বউ-বাচ্চার জন্য বাস কিংবা ট্রেনে টিকেট যোগাড় করে, শেষ মুহূর্তে নিজে রওনা হন মোটর বাইকে, সাথে কলিগ কিংবা কোন কাজিন! তাই মহাসড়কেও গত ঈদে রেকর্ড সংখ্যক মানুষ বাইকে করে বাড়ি ফিরেছে!
যেখানে অন্য যথাযথ ব্যবস্থা এবং ব্যবস্থাপনা নেই, সেখানে মানুষ তো তার মত করে বিকল্প খুঁজে নেবেই! রাষ্ট্রযন্ত্রের উপ মানুষের আস্থা না থাকলে যেটা হয়, সেটা হল নিযন্ত্রণ কোনো বাধ মানে না! বাইক নিয়ন্ত্রণের চেয়ে বাড়ি ফিরবার, নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছাবার ব্যবস্থা করুন! বাইক এবং প্রাইভেট কার দুটোই নিয়ন্ত্রণ করুন, মানসম্মত গণপরিবহণ নিশ্চিত করুন ঢাকাতে এবং দুর-পাল্লায়! মানুষের বাইকের প্রতি ঝোঁক এমনিতেই কমে আসবে! কারণ, যিনি বাইক চালান, তিনি নিজেও জানেন, এটা ঝুঁকিপূর্ণ বাহন!