ব্যস্ততা আর একঘেয়েমির যৌথ বেত্রাঘাতে মন যখন পালাই পালাই, বন্ধুর টেলিফোনে বসে না মন- চলুন যাই তখন উড়িষ্যার বালেশ্বরে জেলার বৈচিত্রে ভরপুর বিচিত্রপুর ম্যানগ্রোভ অরণ্যে।
বিচিত্রপুর ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গের দীঘা থেকে মাত্র ১৮ কি.মি.দূরে বিচিত্রপুর হচ্ছে একটি বেলাভুমি। সমগ্র বেলাভূমে অজস্র ঠেসমূল। একদিন দীঘা থেকে তালসারি হয়ে চন্দনেশ্বর মন্দিরকে পেছনে রেখে ফাইবার বোটে করে পৌঁছেছিলাম বিচিত্রপুরে। তখন ঘড়ির কাঁটা মিলেছে সকাল দশটায়।
মনে হচ্ছিল যেন সত্যি পা রেখেছি কোনো এক অচিনপুরে। নরম বেলাভুমি, সুন্দরী,গরান, গেওয়ার সবুজ বাতাস,আর চিত্র- বিচিত্র কাঁকরার দল নীরবে ডাকছে যেন ভ্রমণকারীদের। মাথার উপর স্নিগ্ধ স্বচ্ছ নীল আকাশপট, পায়ের নীচে ভেজা বেলামাটিতে পা নম্রতায় আশ্রয় পায়, অথচ ডুবে যায় না। বিচিত্র এক অনুভব। চায়ের খালি ভাঁড় কিংবা পরিত্যক্ত ঠোঙাদের অস্তিত্ব নেই এখানে। কমলা রং এর উপর সাদা কালো ছিট- অদ্ভুত দর্শন ছোট ছোট কাঁকড়া আগে কখনও দেখি নি। এদের পা একটু বড়। মানুষজনের পায়ের শব্দ শোনা মাত্র লাজুক রমণীর মত ছোট গর্তে সেঁধিয়ে যাচ্ছে নিমেষে চারদিকে কেবল ছাইরঙা সমুদ্রমাটি। খড়িবিল জেটি থেকেস্পীড বোটে করে যেতেহয় বিচিত্রপুর ভূ খন্ডে। ফাইবার বোট চলে দিনে দুটি। ছয়জনের সীটে খরচ হাজার টাকা। খড়িবিল বনদপ্তরের অফিস থেকে পারমিশন নিয়ে আমরা যাত্রা করেছিলাম মাটি রঙা জলরাশির মধ্য দিয়ে।
ছোট ছোট ঢেউ ভেঙে অফুরান জলরাশি চলেছে যেন কোন নিরুদ্দেশে। বোটে করে যেতে মন হয় উদাসী পাখি। মৃদুমন্দ বাতাস মধুর পরশ দিয়ে যায় গাছেরা সব দাঁড়িয়ে ঠেসমূলে ভর দিয়ে।স্বাধীনচেতা সৈনিকের মত সাদা বক একটি দুটি উড়ে যাচ্ছে একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। দুর থেকে দেখা গেল বিচিত্রপুর। বাঁশ আর কাঠের বাঁধানো ছোট্ট সেতু দিয়ে আমরা পা রাখলাম বিচিত্রপুর। নির্জন,নিস্তব্ধ বিস্তীর্ণ বেলাভূমি। চারদিকে নিস্তব্ধতা, কোলাহল নেই, হৈ চৈ নেই। সূর্যিমামার নরম তেজকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলেছি।বেন্চপাতা বসার জায়গা। করোনা কালে আর যাই নি।এখন বিচিত্রপুর অন্য সাজে সেজে উঠতেও পারে।
রোজকার ছুটে চলা জীবন, পরিবেশ দূষণের দাপট- এ সব থেকে মুক্তি পেতে বিচিত্রপুর অসাধারন। প্রকৃতির উদার আঙিনায় বসে পড়লাম। দুরে দু তিনটি বড় গাছ। নিস্পত্র, নিরালম্ব, একা। আমাদের গাইড জানালেন, নোনামাটি শ্বাসমূলকে ঢেকে দেয় অনেকসময়, তখন গাছ শ্বাস নিতে পারে না। গাছ মরে যায়। তেমনি দু তিনটে গাছ দেখতে পেলাম। যতদূর দৃষ্টি যায়, কেবল শ্বাসমূল আর শ্বাসমূল।
ওখানে দিনভর কাঁকরা ও মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে এমন কয়েকজন স্থানীয় নারীর সঙ্গে আলাপ হলো। তাদের কাছে দেখতে পেলাম এক ধরণের মাছ- নাম গাঙ্গুমাছ। বিচিত্রপুরের নাম আমরা আগে কখনো শুনিনি। ২০১৩ সালে বিচিত্রপুরের উৎপত্তি। তবে এখন একটু একটু করে পর্যটকদের সমাগম বাড়ছে। খড়িবিল জেটিতে খাবারের দোকান আছে। সেখান থেকে খাবার নিয়ে এ বেলাভূমিতে বসেই ভোজনপান করা যায়। সারাদিন নরম বেলেমাটিতে পা রেখে আনন্দ করে সময়কে নিয়ে খেলা যায়। তারপর আবার বোট নিয়ে ফিরে যাওয়া।
কত যে নাম না জানা পাখিরা স্বচ্ছন্দ ঘুরে বেড়াচ্ছে। সুবর্ণরেখা আর বঙ্গোপসাগরের মিলনস্হলের দিকে বোট চলে এগিয়ে আর মনে হয় অবিশ্রান্ত জলধারার দেশে এসে পড়েছি। দীঘা, পুরী তো অনেকবার গেছি। কিন্তু বিচিত্রপুরের আহ্বান অন্যরকম। ম্যানগ্রোভ অরণ্যের পাতাদের রং গাঢ় সবুজ নয়- কচিকলাপাতা আর সবুজের মিশেল।
কালিয়াচোয়া, বনী, খড়সী, এমন কত গাছ। যেন এসে পড়েছি সুন্দরবন। কিন্তু সবুজে হারিয়ে যাওয়া নয়। উন্মুক্ত আকাশ আর তরুরাজির মেলবন্ধনে বিচিত্রপুর মনে বৈচিত্র আনে বৈকি।
এখানে আসতে হলে খড়িবিল ম্যানগ্রোভ অভয়ারণ্য বনদপ্তরের অফিস থেকে বোটে করে যাবার পারমিশন নিতে হবে। দীঘা, শঙ্করপুর, জুনপুট তো আমরা যাই ই। কিন্তু এ নতুন জায়গা বিচিত্রপুর- এর আবেদন অন্যরকম। প্রকৃতির স্বচ্ছ ছায়ায়, জলধারার সঙ্গসুধায় বিচিত্রপুরে মন হয়ে যায় সুখপাখি।