বুম একাধিক নজরুল গবেষকের সঙ্গে কথা বলেছে তাঁরা এটিকে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা বলে মানতে নারাজ।
সোশাল মিডিয়ায় বালাদেশের অনামী ব্যক্তির লেখা নবী মহম্মদ এর নামে নামে তৈরি ইসলামিক গানের পংক্তিকে কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা বলে চালানো হচ্ছে। ফেসবুকে ওই পংক্তি সহ গ্রাফিক পোস্ট শেয়ার করে শ্যামাসঙ্গীতের রচয়িতা নজরুল ইসলামকে সাম্প্রদায়িক লেখক বলে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। গ্রাফিক পোস্টটিতে লেখা হয়েছে, ”রাসুলের অপমানে যদি কাঁদেনা তোর মন, মুসলিম নয় মোনাফেক তুই, রাসুলের দুশমন”- কাজী নজরুল ইসলাম। গ্রাফিক পোস্টটি শেয়ার করে ক্যাপশন লেখা হয়েছে, “এপার বাংলায় শীত ঘুমে ঘুমিয়ে থাকা বুদ্ধু হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য পড়ানো হয়: #মোরাএকই বৃন্তেদুটি কুসুমহিন্দু মুসলমান। আর ওপার বাংলায় জিহাদি তৈরী করে হিন্দুদের নিঃশেষ করার জন্য পড়ানো হয়: #রাসুলেরঅপমানে যদিকাঁদেনা তোরমন……..
২০১৪ সাল থেকে ছড়ানো অনামী লেখা
বুম এই পংক্তি দুটিকে ইউটিউবে সার্চ করে জানতে পারে, ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের একটি ইসলামীয় সঙ্গীতের শিল্প গোষ্ঠী তাদের লেখা গান বলে দাবি করেছে। যদিও ফ্রান্সের শিক্ষকের শিরচ্ছেদের ঘটনার পর থেকে। এই পংক্তিটি নিয়ে বেনামে অনেকেই “ইসলামের দুশমন” নামে একটি ইসলামীয় সঙ্গীত গেয়ে চেলছেন। ৬ জানুযারি ২০২০ ইউটিউবে ঊর্ধগগন শিল্পগোষ্ঠী ‘রাসূলের দুশমন’ নামে একটি ভিডিও আপলোড করে। ওই ভিডিওতে উল্লেখ করা হয় উমর বিন মুজফ্ফর নামে এক ব্যক্তি গানটির রচয়িতা। ৩১ সেকেন্ড সময়ের পর এই পংক্তি শোনা যায়, ”রাসুলের অপমানে যদি কাঁদেনা তোর মন, মুসলিম নয় মোনাফেক তুই, রাসুলের দুশমন।”
এই একই ইসলামিক সঙ্গীতকে নিজের লেখা বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশের বিতর্কিত ধর্মপ্রচারক মুফতি গিয়াসউদ্দিন তাহেরী। গিয়াসউদ্দিন তাহেরী ওই ভিডিওতে বলেন, ফ্রান্সের ঘটনার পর তিনি নিজে ওই পংক্তি লিখেছেন। বুম অবশ্য দেখে একই পংক্তি অনলাইনে রয়েছে ফ্রান্সের ঘটনার অনেক আগে থেকে। ২ সেকেন্ড সময়ের পরে শোনা যাবে একই পংক্তি।
বুম দেখে সম্প্রতি ২৬ অক্টোবর ২০২০ প্রকাশিত বাংলাদেশের গণমাধ্যম দৈনিক ইত্তেফাক- এর প্রতিবেদনে একই ছত্রের ব্যবহার হতে দেখে। এই ছত্র কোন কবিতা বা গানের অংশ তার উল্লেখ নেই ওই প্রবন্ধে। বুম আরও যাচাই করে দেখে বেনামে এই লেখা ২০১৪ সাল থেকে বিভিন্ন ইসলামীয় ব্লগে খুঁজে পাওয়া যায়। সেই লেখায় এটিকে নজরুল ইসলামের লেখা বলে দাবি করা হয়নি।
”নজরুলের লেখা হতে পারে না”- বুম একাধিক নজরুল গবেষকের সঙ্গে কথা বলেছে তাঁরা নজরুলের কোনও কবিতা ও গানে এই বাক্য খুঁজে পাননি। পশ্চিমবঙ্গ থেকে দুই পর্যায়ে নজরুলের রচনাবলী প্রকাশিত হয়েছে। ৭ খন্ডে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমী প্রকাশিত রচনাবলী। তারও আগে আব্দুল আজীজ আল আমান ৮-৯টি খণ্ডে প্রকাশ করেন নজরুলের সমগ্র রচনাবলী। এই দুই প্রধান আকর গ্রন্থে উল্লেখ নেই এই পংক্তিটির। বুম বিশিষ্ট নজরুল গবেষক ও সমগ্র নজরুল সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদক গিয়াসুদ্দিন দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করে। গিয়াসুদ্দিন দালাল নজরুলের জন্মস্থান পশ্চিম বর্ধমানের চুরুলিয়ার এনকে হাই স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক। নজরুল ও তাঁর স্ত্রী প্রমীলা দেবী জীবনের শেষ পর্যায়েও চুরুলিয়ার এই স্কুলে বেশ কিছুটা সময় কাটিয়েছিলেন। গিয়াসুদ্দিন বিখ্যাত গান ‘বাংলা আমার সর্ষে ইলিশ’-এর গীতিকার। দীর্ঘদিন তিনি নজরুলের গান ও রচনাসমগ্রের অনুবাদের কাজ করছেন। প্রকাশ করেছেন একাধিক গ্রন্থ। গিয়াসুদ্দিন দালাল বলেন, “নজরুল তাঁর সাহিত্যের কোথাও হজরত মহম্মদকে ‘রাসুল’ নামে সম্মোধন করেননি।” তিনি নজরুলের একাধিক গান ও কবিতার রেফারেন্স দেন। হজরত মহম্মদকে নিয়ে লেখা গীতিকবিতায় ‘মোহাম্মদ রসুল’, ‘নবিজির রওজায়,’ ‘নবি আহমদ’, ‘রসুল’, ‘মোহাম্মদ মোস্তাফা’, (সূত্র: জুলফিকার, ১৪, ২৬, ৩৭, ৩০, ৪০ নং গীতি কবিতা) প্রভৃতি নামে সম্মোধন করেছেন। ‘রাসুল’ এই বানানের ব্যবহার নেই কোথাও। আবার নজরুল ইসলামের হজরত মহম্মদকে নিয়ে লেখা অসম্পূর্ণ জীবনী কাব্যগ্রন্থ ‘মরুভাষ্কর’-এর বিভিন্ন কবিতায় ‘নবি আল্ আরবি’ (মরুভাস্বর ৪ র্থ সর্গ), ‘মহম্মদ’, ‘মওলা মদিনার’ প্রভৃতি নামে সম্মোধন করেছেন। ”রাসুলের অপমানে যদি কাঁদেনা তোর মন” এই ধরণের বাক্য নজরুলের লেখার সঙ্গে খাপ খায়না। ”যদি কাঁদেনা তোর মন” এই ধরণের ভাষা প্রয়োগ বাংলা ভাষাতে বিরল। এর মধ্যে উর্দু ভাষার আঙ্গিক রয়েছে,” বলেন গিয়াসুদ্দিন দালাল। বুম নজরুল ইসলামের উপর তথ্যচিত্র নির্মাতা মুজিবর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনিও বিষয়টির সঙ্গে সহমত প্রকাশ করেন। এটি নজরুলের লেখা হতে পারে না, এমন সাওয়াল করেছেন মুজিবর। ২০১৭ সালের ১০ সেপ্টেম্বর লন্ডনের লরেন্স হিলের বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে মুজিবর রহমান নির্মিত ‘কাজী নজরুল ইসলাম’ তথ্যচিত্রের প্রদর্শন হয়। বুম স্বাধীনভাবে যাচাই করেনি এই পংক্তির মূল রচয়িতা কে তবে বুম নিশ্চিত হতে পেরেছে এই পংক্তি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা নয়। বুম আগেও সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেনের লেখা বলে চালানো “ভালবাসা” নামে অনামী লেখকের একটি কবিতার তথ্য যাচাই করেছে।