অভিভাষণ
পাল সাম্রাজ্যের অধঃপতন
[কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হাউসে প্রদত্ত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র বক্তৃতার সারাংশ]
খৃষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে বাঙ্গালায় ঘোর ‘মাৎস্য ন্যায়’ (অরাজকতা) উপস্থিত হইয়াছিল। তাহাতে পুনঃ পুনঃ উৎপীড়িত হইয়া, বঙ্গীয় প্রজাবৃন্দ অবশেষে গোপাল নামক এক ব্যক্তিকে রাজপদে বরণ করিয়াছিল। সৰ্ব্ব বিদ্যাবিৎ দয়িতবিষ্ণুর পৌত্র, যুদ্ধবিদ্যাবিশারদ বপটের পুত্র, সমরকুশল গোপালদেব যে রাজবংশের প্রথম রাজা, তাহাই ইতিহাস বিখ্যাত পাল-রাজবংশ। প্রজাপুঞ্জের শক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত এই রাজবংশ অচিরে সমগ্র আর্যাবর্তে সাম্রাজ্য বিস্তার করিয়াছিল। গোপালের পুত্র ধর্মপাল ভোজ, মৎস্য, মদ্র, কুরু, যদু, যবন, অবন্তী, গান্ধার, কীর এবং পঞ্চাল দেশের উপর আধিপত্য লাভ করিয়াছিলেন। তৎপুত্র দেবপাল হিমালয় হইতে বিন্ধ্য, এবং পূর্ব ও পশ্চিম সমুদ্রের মধ্যবর্তী সমুদয় ভূভাগ করপ্রদ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।
এই দেবপালদেব উকুল-কুল উৎকিলিত করিয়া, হূণগৰ্ব্ব খবৰ্বীকৃত করিয়া, এবং দ্রবিড়-গুর্জরনাথ-দর্প চূর্ণকৃত করিয়া, দীর্ঘকাল পর্যন্ত সমুদ্র মেখলাভরণা বসুন্ধরা উপভোগ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।
পালরাজবংশের এই বিস্তৃত প্রভাব অধিককাল স্থায়ী না হইলেও, তাঁহারা দীর্ঘকাল আর্যাবর্তের পূর্বভাগের অধীশ্বর ছিলেন। গোপালের অধস্তন দশম পুরুষে রাজা বিগ্রহপাল (৩য়) যখন মহীপাল (২য়), শূরপাল (২য়) ও রামপাল নামক তিন পুত্র রাখিয়া মৃত্যুমুখে পতিত হন, তখন গৌড়, বঙ্গ ও মগধ পাল রাজগণের অধীন ছিল; কিন্তু মহীপাল রাজ্যলাভ করিবার অনতিকাল পরেই অনীতিক আচরণ আরম্ভ করেন এবং তাঁহার দুই ভ্রাতাকে কারাগারে আবদ্ধ করেন। ইহার ফলে বরেন্দ্রভূমির প্রজাগণ বিদ্রোহী হইয়া, মহীপালকে সিংহাসনচ্যুত ও নিহত করে। এই বিদ্রোহের নায়ক কৈবৰ্ত্তজাতীয় দিবেবাক তাঁহার ভ্রাতা রুদোক ও ভ্রাতুস্পুত্র ভীম যথাক্রমে বরেন্দ্রভূমির শাসনভার গ্রহণ করিয়াছিলেন।
সন্ধ্যাকর নন্দী বিরচিত রামচরিত কাব্যে এই বিদ্রোহের বিবরণ পাওয়া যায়। এই বিদ্রোহের কারণ ও প্রকৃতি সম্বন্ধে সন্ধ্যাকর নন্দী স্পষ্টতঃ কিছুই লেখেন নাই; কিন্তু তাঁহার কাব্য হইতে এ বিষয়ে কতকটা আভাষ পাওয়া যাইতে পারে। রামচরিতের টীকায় দেখিতে পাওয়া যায় যে,–কনিষ্ঠ ভ্রাতা রামপাল “সর্বসম্মত,” এবং সম্ভবতঃ গৌড় রাজ্য অধিকার করিবে, এই আশঙ্কায় মহীপাল তাঁহাকে কারারুদ্ধ করিয়াছিলেন। এই “সর্বসম্মত’ কথায় মনে হয় যেন রাজার নির্বাচন সম্বন্ধে তখনও গৌড়ীয় প্রজাবৃন্দের কিছু কিছু অধিকার ছিল। মহীপাল তাঁহাদের এই অধিকার অস্বীকার করিয়া কেবলমাত্র উত্তরাধিকারের দাবীতে সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। পূর্বেই বলা হইয়াছে গোপালদেব প্রজাগণ কর্তৃক নির্বাচিত হইয়া রাজত্ব পদ লাভ করিয়াছিলেন; তারানাথের উক্তি অনুসারে ধর্মপাল দেবও এইরূপ প্রজাপুঞ্জের দ্বারা নির্বাচিত হইয়াছিলেন। কালে এই নির্বাচন-প্রথা ক্রমশঃ বিলুপ্ত হইয়া আসিলেও, রাজার সিংহাসনারোহণ সম্ভবতঃ কতক পরিমাণে প্রজাগণের সম্মতির উপর নির্ভর করিত। মহীপাল এই চিরাচরিত প্রথা পদদলিত করিয়া প্রজাগণের বিরাগভাজন হইয়াছিলেন এবং ইহাই বোধ হয় বিদ্রোহের মূল কারণ। কৈবৰ্ত্ত নায়ক দিবেবাকের অধীনে সংঘটিত হইয়া থাকিলেও, ইহা কৈবর্ত্ত বিদ্রোহ নহে;-বরেন্দ্রের সমস্ত প্রজাপুঞ্জের বিদ্রোহ, সমস্ত সামন্ত-চক্রের বিদ্রোহ। যে প্রজাশক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হইয়া পাল সাম্রাজ্য উন্নতির চরমশীর্ষে আরোহণ করিয়াছিল, সেই প্রজাশক্তির বিরাগই পাল সাম্রাজ্যের অধঃপতনের মূল কারণ। সুতরাং অতঃপর আমরা এই বিদ্রোহের বিস্তৃত বিবরণ ও পরিণাম অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইব।
পূর্বেই বলিয়াছি যে এই বিদ্রোহের সময়ে রামপাল ও শূরপাল কারাগারে আবদ্ধ ছিলেন। কিরূপে তাঁহারা এই কারাগার হইতে পলায়ন করেন, সন্ধ্যাকর নন্দী সে বিষয়ে কিছুই বলেন নাই। কারাগার হইতে পলায়ন করিয়া, রামপাল পিতৃভূমি বরেন্দ্রীর উদ্ধারের জন্য যাহা যাহা করিয়াছিলেন, রামচরিতে তাহার বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। কিন্তু তাঁহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শূরপাল এবিষয়ে কোন চেষ্টা করিয়াছিলেন কিনা, সে বিষয়ে রামচরিতে কোনো আভাস পাওয়া যায় না। মদন পালের মনহলি-লিপিতে দেখিতে পাওয়া যায় যে, শূরপাল মহীপালের পরে রাজা হইয়াছিলেন;–”মহেন্দ্ৰতুল্য মহিমান্বিত, স্কন্দতুল্য প্রতাপশ্ৰীসমন্বিত, সাহস-সারথী নীতিগুণসম্পন্ন শ্রীশূরপাল নামক নরপাল তাঁহার (মহীপালের) এক অনুজ ছিলেন। তিনি সৰ্ব্ববিধ অস্ত্রশস্ত্রের প্রাগলভ্যে শত্রুবর্গের স্বচ্ছন্দ স্বাভাবিক বিভ্রমাতিশয্যধারী মনে শীঘ্রই বিস্ময়-ভয় বিস্তৃত করিয়া দিয়াছিলেন।”৫
বৈদ্যদেবের : কমৌলি-তাম্রশাসনে বিগ্রহপালের পরেই রামপালের নাম উল্লিখিত হইয়াছে। ইহাতে মহীপাল বা শূরপালের নামোল্লেখ নাই। বৈদ্যদেবের তাম্রশাসনে প্রধানতঃ পালরাজগণের মন্ত্রীবংশই বর্ণিত হইয়াছে। মহীপাল এবং শূরপালের অল্পকাল স্থায়ী রাজ্যের সহিত বৈদ্যদেবের বংশের ইতিহাস তেমন ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত নহে। এই কারণেই তাঁহার তাম্রশাসনে ওই দুইটি নাম পরিত্যক্ত হইয়াছে। এইরূপ কারণেই সন্ধ্যাকর নন্দীর কাব্যের সকল অংশে শূরপালের নাম দেখিতে পাওয়া যায় না। শূরপাল পিতৃভূমি উদ্ধারের জন্য কোন চেষ্টা করিয়া থাকিলেও, অনতিকাল মধ্যেই তাঁহার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সে চেষ্টার পরিসমাপ্তি হইয়াছিল। এই পিতৃভূমির উদ্ধার-রূপ মহৎ কার্য প্রধানতঃ রামপাল কর্তৃকই সাধিত হইয়াছিল;– সুতরাং শূরপালের অল্পকাল স্থায়ী রাজ্য ও মৃত্যুর বিষয় রামচরিত কাব্যের পক্ষে প্রয়োজনীয় বলিয়া বিবেচিত নাও হইতে পারে। রামচরিত কাব্যে শূরপালের নামোল্লেখ না থাকায়, এরূপ অনুমান করা সঙ্গত হইবে না যে রামপাল জ্যেষ্ঠভ্রাতা শূরপালকে বধ করিয়াছিলেন এবং সন্ধ্যাকর নন্দী ইচ্ছাপূর্বক এই ঘটনা গোপন করিয়াছেন।
শ্রীযুক্ত বাবু রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহার ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ নামক গ্রন্থে লিখিয়াছেন,–”রামচরিতে’ শূরপালের সিংহাসন লাভের, তাঁহার রাজ্যকালীন ঘটনার এবং তাঁহার মৃত্যুর বিবরণের অভাব দেখিয়া অনুমান হয় যে, রামপাল কোন উপায়ে শূরপালকে সংহার করিয়া পৈতৃক রাজ্যাধিকার প্রাপ্ত হইয়াছিলেন” (২৫২ পৃঃ)। এইরূপ অনুমান যে কেবল অসঙ্গত তাহা নহে, ইহা স্পষ্টতঃ রামচরিতের বর্ণনার বিরোধী। রামচরিত কাব্যের নিম্নলিখিত শ্লোকে রামচন্দ্রের ও রামপালের সহিত ইন্দ্রের তুলনা করা হইয়াছে, যথা :
“অভিদুরকরোক্ষতবলোপ্যমরূত্বান
প্রভূত মোরপি।
যোভূদগোত্রভিদ পাক শাস (নাশ) নোপি
চ সুনাসীরঃ ।”৬
[প্রথম পরিচ্ছেদ, পঞ্চদশ শ্লোক]
এই শ্লোকের টীকায় রামপাল-পক্ষের অর্থে টীকাকার ‘অগোত্রভিদ’ এই পদের “ন গোত্রভিৎ কুলাঘাতী” এইরূপ ব্যাখ্যা করিয়াছেন। রামপাল তাঁহার ভ্রাতাকে হত্যা করিয়া থাকিলে, কদাপি তাঁহার সম্বন্ধে এইরূপ বিশেষণ প্রযুক্ত হইতে পারিত না।
মদনপালের মনহলি লিপি হইতে প্রমাণিত হয় যে, বরেন্দ্রভূমি হইতে বিতাড়িত হইয়াও, শূরপাল রাজউপাধি গ্রহণ করিয়াছিলেন। তাঁহার মৃত্যুর পরে তাঁহার কনিষ্ঠ সহোদর রামপাল রাজ উপাধি গ্রহণ করেন, এবং পিতৃভূমি বরেন্দ্রীর উদ্ধারের জন্য বদ্ধপরিকর হন।
রামচরিতের প্রথম পরিচ্ছেদের ২৩শ শ্লোকের টীকায় “নন্দনৈঃ পুত্রৈঃ রাজ্যপালাদিভিঃ” এই বাক্য হইতে জানা যায় যে, বরেন্দ্রী ত্যাগ করিবার সময় রামপালের অন্ততঃ তিনটি পুত্র ছিল, এবং তাহার মধ্যে জ্যেষ্ঠের নাম ছিল, রাজ্যপাল। পুত্ৰকলত্রাদি লইয়া প্রথমেই রামপালকে কোন সুরক্ষিত স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করিতে হইয়াছিল। এই আশ্রয় স্থান কোথায়, রামচরিতের নিম্নলিখিত শ্লোকে তাহার আভাস পাওয়া যায়।
“স বিনাশিত মারীচোপগতেহষ্টতমো ভুজৌদধদ্বিফলৌ।
ধাম নিজং পরিকলয়াং চকার শূন্যং সসূনুরথরামঃ।”
(প্রথম পরিচ্ছেদ ৪০শ শ্লোক)
এই শ্লোকের টীকায় রামপালপক্ষের অর্থে “উপগতা ইষ্টতমা মিত্রাণি মাতৃবন্ধবো যস্য” এই পদসমষ্টি হইতে অনুমিত হয় যে, রামপাল তাঁহার মাতুলালয়ে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন।
সীতাহরণে রাম যেরূপ শোকে মুহ্যমান হইয়া পড়িয়াছিলেন, রাজ্য হইতে বিতাড়িত হইয়া রামপালও সেইরূপ শোকাভিভূত হইয়াছিলেন। কবি সন্ধ্যাকর নন্দী অতি অল্প কথায় দ্ব্যর্থবোধক শ্লোকের দ্বারা যুগপৎ রাম ও রামপালের মনোভাব বর্ণনা করিয়াছেন। শোকের প্রথম মুহূর্তে রামপাল পিতৃরাজ্য উদ্ধারের বিষয়ে একেবারে হতাশ হইয়া পড়িলেন। কিন্তু লক্ষ্মণের সান্ত্বনাবাক্যে কথঞ্চিৎ আশ্বস্ত হইয়া রাম যেমন সীতান্বেষণে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন, পুত্র ও সহচরগণের পরামর্শে রামপালও সেইরূপ ধৈৰ্য্যাবলম্বন করিয়া পিতৃরাজ্য উদ্ধারের উপায় অন্বেষণে প্রবৃত্ত হইলেন। বহু অর্থ ও বিস্তৃত ভূভাগ দান করিয়া তিনি ক্রমে সামন্তরাজগণকে স্বীয় পক্ষে আনিতে সমর্থ হইলেন। ‘ভূমেৰ্বিপুলস্য ধনস্য চ দানতস্তাগাৎ অনুকূলিতঃ”–(১৪৫) টীকাকারের এই উক্তি হইতে অনুমিত হয় যে অধীন সামন্তরাজগণ স্বেচ্ছায় কর্তব্যপ্রণোদিত হইয়া রাজা ও প্রভু রামপালের সাহায্য করেন নাই। বালী-বধের পর রাজ্যলাভের বিনিময়ে যেমন সুগ্রীব রামের সাহায্য করিয়াছিলেন, তাঁহারাও সেইরূপ অর্থ ও ভূ-সম্পত্তির বিনিময়ে রামপালের সাহায্য করিতে সম্মত হইয়াছিলেন। সুতরাং অনুমান করা যাইতে পারে যে বরেন্দ্রের বহির্ভাগে গৌড়বঙ্গমগধেও পালরাজগণের পুরাতন প্রভুত্ব শিথিল হইয়া পড়িয়াছিল। রামপাল বরেন্দ্রের পুনরধিকারের যে চেষ্টা করিয়াছিলেন, তাহা সাম্রাজ্যের এক অংশের বিরুদ্ধে অপর অংশের যুদ্ধ (Civil war) নহে–একদল ভাড়াটিয়া (mercenary) সৈন্যের সাহায্যে প্রজাশক্তির বিরূদ্ধে অভিযান মাত্র।
এই অর্থগৃধু কর্তব্যজ্ঞানহীন সামন্তচক্রের মধ্যে কেবলমাত্র রামপালের মাতুল বীরাগ্রগণ্য মথন স্বেচ্ছায় কর্তব্য প্রণোদিত হইয়া সমগ্র শক্তি সহকারে ভাগিনেয়ের পক্ষ সমর্থন করিয়াছিলেন। রামচরিতের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের অষ্টম শ্লোকের টীকায় এই মথনের অনেক বিবরণ পাওয়া যায়। বরেন্দ্রের অনুকরণে পীঠীপতি দেবরক্ষিত মগধে বিদ্রোহের ধবজা উড্ডীন করিয়াছিলেন কিন্তু বীরবর মথন তাঁহাকে পরাভূত করিয়া বিদ্রোহবহ্নি প্রশমিত করেন। বিষ্ণু যেমন বরাহাবতারে সিন্ধুর গর্ভ হইতে বসুন্ধরার উদ্ধার সাধন করিয়াছিলেন সুবিখ্যাত রণকুঞ্জর ‘বিন্ধ্যমাণিক্যের’র উপর আরূঢ় হইয়া অদ্ভুত পরাক্রমের সহিত যুদ্ধ করিয়া বীরবর মথনও সেইরূপ সিন্ধুরাজপঠিপতি দেবরক্ষিতের হস্ত হইতে মগধের উদ্ধার সাধন করেন।
সারনাথের ধবংসমধ্যে প্রাপ্ত কান্যকুজের রাজা গাবিন্দচন্দ্রের পত্নী কুমারদেবীর শিলালিপিতেও রাজমাতুল অঙ্গরাজ মথন কর্তৃক পীঠীপতি দেবরক্ষিতের পরাভব কাহিনী বর্ণিত হইয়াছে। এই শিলালিপি হইতে আরও জানা যায় যে মথনের কন্যা শঙ্করদেবীর সহিত দেবরক্ষিতের বিবাহ হইয়াছিল। এইরূপে রামপালের মাতুল মথনের পরাক্রম ও বিচক্ষণতায় রামপালের একজন প্রধান শত্রু, মিত্ররূপে পরিণত হইয়াছিল। মথন কর্তৃক মগধের বিদ্রোহ দমন না হইলে, রামপালের পক্ষে পিতৃরাজ্য লাভ করা হয়ত অসম্ভব হইত। রামপাল আমরণকাল পর্যন্ত মাতুলের এই মহৎ উপকার কৃতজ্ঞ হৃদয়ে স্মৃতিপটে অঙ্কিত করিয়া রাখিয়াছিলেন।
সে সমুদয় প্রধান প্রধান সামন্ত রাজগণের সাহায্যে রামপাল বরেন্দ্রভূমি পুনরধিকার করিয়াছিলেন, রামচরিতে তাহাদের উল্লেখ করা হইয়াছে। রামচরিতের টীকায় তাঁহাদের সম্বন্ধে আরও অনেক তথ্য জ্ঞাত হওয়া যায়। রামচরিতের টীকার এই অংশ তৎকালীন বঙ্গদেশের ভূগোলের পক্ষে বিশেষ মূল্যবান।
প্রথম সামন্তরাজ রামচরিত কাব্যে বন্দ্য নামে অভিহিত হইয়াছেন। টীকা হইতে জানিতে পারা যায় যে তাঁহার নাম ভীমযশ, তিনি মগধ ও পীঠীর অধিপতি ছিলেন এবং তিনি একসময়ে কান্যকুজের অশ্ববাহিনীকে পরাস্ত করিয়াছিলেন।
দ্বিতীয় সামন্তরাজের নাম বীরগুণ। ইনি কোটার অধিপতি ছিলেন। মগধের পরেই কোটার নামোল্লেখ দেখিয়া মনে হয় কোটা সম্ভবতঃ মগধের দক্ষিণভাগে অবস্থিত ছিল–কাহারও কাহারও মতে আইন-ই-আকবরীতে উল্লিখিত সরকার কটক ও কোটা অভিন্ন।
তৃতীয় সামন্তরাজ দণ্ডভুক্তিপতি জয়সিংহ “উৎকলেশ-কর্ণকেশরী-সরিদ্বল্লভ কুম্ভসম্ভবঃ” (২। ৫) রূপে বর্ণিত হইয়াছেন; অর্থাৎ অগস্ত্য যেমন সিন্ধুকে গ্রাস করিয়াছিলেন, তিনিও তদ্রপ উৎকলদেশের অধিপতি কর্ণকেশরীকে পরাভূত করিয়াছিলেন। ইহা হইতে অনুমিত হয় যে, উৎকলের অধিপতি কর্ণকেশরী স্বাধীনতা অবলম্বন করায়, জয়সিংহ কর্তৃক পরাজিত হইয়াছিলেন।
চতুর্থ সামন্তরাজ বিক্রমরাজ, “দেবগ্রামপ্রতিবদ্ধবসুধাচক্রবাল–বালবলভি তরঙ্গবহল-গলহস্ত-প্রশস্ত-হস্ত-বিক্রমঃ” রূপে বর্ণিত হইয়াছেন। এই বর্ণনা হইতে জানা যায় যে, বিক্রমরাজ দেবগ্রামের রাজা ছিলেন, এবং এই দেবগ্রাম রাজ্য বালবলভীর অপর পারে বর্তমান ছিল। দেবগ্রাম ও বালবলভী এ উভয়ের মধ্যে যে নদী প্রবাহিত ছিল, তাহাতে তাঁহার নৌকার বহর (বহল) সজ্জিত থাকিত; এবং এই নৌসৈন্যের সাহায্যেই তিনি বিপক্ষপক্ষকে গলহস্ত-প্রদান (পরাজিত) করিতে বিশেষ দক্ষ ছিলেন।
পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম সামন্তরাজের নাম যথাক্রমে লক্ষ্মীশূর, শূরপাল, রুদ্রশিখর ও ময়গল সিংহ। রামচরিতের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের পঞ্চম শ্লোকের টীকায় ইহাদের প্রত্যেকের সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ বিবরণ পাওয়া যায়।
নবম সামন্তরাজ প্রতাপসিংহ ঢেকুরীর অধিপতি ছিলেন। রামচরিতের ভূমিকায় এই স্থানকে বর্তমান কাটোয়ার অন্তর্গত বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে।
এতদ্ব্যতীত কযঙ্গলীর মণ্ডলাধিপতি নরসিংহাৰ্জুন, সঙ্কটগ্রামের চণ্ডাৰ্জুন, নিদ্রাবলীর বিজয়রাজ, কৌশাম্বীপতি দ্বোরপবর্ধন, পদুম্বা মণ্ডলের অধিপতি সোম এবং অন্যান্য সামন্তগণ রামপালের সাহায্যার্থে সমাগত হইয়াছিলেন (রামচরিত– ২।৬)। কোন কোন লেখক কৌশাম্বীর সহিত রাজসাহীর অন্তর্গত কুসুম্বার এবং পদুম্বার সহিত পাবনার অভিন্নতা প্রতিপাদন করিতে প্রয়াস পাইয়াছেন। কিন্তু এই সমুদয় লেখকগণ একটি বিষয় লক্ষ্য করেন নাই। উল্লিখিত সামন্ত রাজগণ গঙ্গার অপর পার হইতে বরেন্দ্রভূমি আক্রমণ করিয়াছিলেন; সুতরাং তাঁহাদের মধ্যে কেহই বরেন্দ্রভূমির অন্তর্গত রাজসাহী বা পাবনার লোক হইতে পারেন না।
এই সমুদয় সামন্তগণের সাহায্যে হস্তী, অশ্ব, নৌ, পদাতি এই চতুরঙ্গ সেনার সমাবেশ হইল। এই সেনার পরিচালন কার্যে রামপালের প্রধান সহায় ছিলেন মথন, মথনের পুত্র মহামাগুলিক কাফুরদেব এবং মথনের ভ্রাতা সুবর্ণদেবের পুত্র মহাপ্রতীহার শিবরাজদেব।
উল্লিখিত সামন্তরাজগণের মধ্যে মহামাণ্ডলিক কাফুরবেদ এবং মণ্ডলাধিপতি নরসিংহাৰ্জুনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পুরাকালে ‘মণ্ডল’ শব্দে দ্বাদশজন রাজার রাজ্য-পরিমাণ বুঝাইত। মণ্ডলের অধিপতি এই সমুদয় রাজগণের উপর প্রভূত্ব করিতেন। মহামাণ্ডলিক ঈশ্বর ঘোষের তাম্রশাসনে দেখা যায়, যে রাজাধিরাজগণের ন্যায় তিনিও বহুসংখ্যক সামন্ত রাজগণের উপর আধিপত্য করিতেন। ধর্মপালের তাম্রশাসনে মহাসামন্তাধিপতি এই উপাধিভূষিত রাজ কর্মচারির উল্লেখ দেখিয়া অনুমান হয় যে, সামন্ত রাজগণের মধ্যে একজন সমুদয় সামন্তরাজগণের প্রতিনিধি বলিয়া গণ্য হইতেন, এবং তদনুরূপ সম্মান পাইতেন। সুতরাং এই মহামাগুলিক বা মহাসামন্তাধিপতির স্থান মহারাজাধিরাজার ঠিক নিম্নে বলিয়াই গণ্য হইত।
সামন্তরাজগণের বর্ণনা হইতে স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, রামপাল পিতৃরাজ্য উদ্ধারের জন্য বিপুল আয়োজন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। এই আয়োজনের বিপুলতা হইতেই বরেন্দ্রভূমির বিদ্রোহের গুরুত্ব অনুভব করা যায়। এইরূপ প্রভূত বলশালী হইয়াও রামপাল সহসা বরেন্দ্রভূমি আক্রমণ করিতে সাহসী হন নাই। মদন পালের মনহলি লিপিতে বর্ণিত হইয়াছে যে, দৈত্যকর্তৃক স্বর্গচ্যুত ইন্দ্রের ন্যায় রামপাল অসীম ধৈৰ্য্য ও সাবধানতা সহকারে ধীরে ধীরে স্বীয় কাৰ্য্য সিদ্ধির পথে অগ্রসর হইয়াছিলেন। বরেন্দ্রভূমির বিদ্রোহ যদি কেবলমাত্র ব্যক্তি বা জাতিবিশেষের বিদ্রোহ হইত, তাহা হইলে এরূপ প্রভূত বল বা সতর্কতার আবশ্যক হইত না। কিন্তু পূর্বেই বলা হইয়াছে যে বরেন্দ্রের বিদ্রোহ সমগ্র প্রজাশক্তির বিদ্রোহ। রাজার নির্বাচনে প্রজাগণের যে অধিকার ছিল মহীপাল তাহা প্রত্যাখ্যান করিয়া সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। তাঁহার এই অনীতিক আচরণই বরেন্দ্রের বিদ্রোহের মূল কারণ। রামপাল এই বিদ্রোহের প্রকৃতি ও গুরুত্ব বিশেষরূপে জ্ঞাত ছিলেন বলিয়াই অপরিমিত অর্থব্যয়ে বিপুল সৈন্য সংগ্রহ করিয়া সাবধানে এই বিদ্রোহ দমন করিতে অগ্রসর হইয়াছিলেন। তাঁহার ভাড়া করা সৈন্যের সাহায্যে তিনি প্রজাশক্তি উন্মুলিত করিয়া পুনরায় পিতৃ সিংহাসন অধিকার করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন সত্য; কিন্তু তিনি যাহা হারাইয়াছিলেন তাহা আর ফিরাইয়া পাইলেন না। যে প্রজাশক্তির উপর পাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হইয়াছিল, যে প্রজাশক্তি পাল-সাম্রাজ্যের সঞ্জীবনী শক্তির আধার ছিল, অর্থবলে ক্রীত বিপুল সৈন্যের শাণিত তরবারির আঘাতে চিরদিনের নিমিত্ত তাহার মূলচ্ছেদ হইয়া গেল। যে প্রজাশক্তির সাহায্যে আসমুদ্র হিমালয় পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তৃত হইয়াছিল, তাহার প্রাণহীণ রক্তাক্ত দেহের উপর দিয়া শকট চালাইয়া রামপাল পিতৃরাজ্যে ফিরিয়া আসিলেন। কিন্তু সে রাজ্যের শ্রী তখন চিরকালের জন্য অন্তর্হিত হইয়া গিয়াছে কেবল প্রাচীন গৌরবের স্মৃতি বহন করিবার জন্যই তাহার কঙ্কালমূর্তি বরেন্দ্রের বিরাট শ্মশানে তখনও দণ্ডায়মান ছিল। গৌড়রাজমালায় (৫২ পৃঃ) ইহা কাব্যের ন্যায় বর্ণিত হইয়াছে। যথা,–
বরেন্দ্রভূমির বিদ্রোহানল নির্বাণ করিয়া, এবং কামরূপ ও কলিঙ্গে আধিপত্য বিস্তার করিয়া রামপাল যে গৌড়রাষ্ট্র পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন সেই অভিনব গৌড়রাষ্ট্রের অনেক প্রভেদ ছিল। প্রজাসাধারণের নির্বাচিত গৌড়াধিপ গোপালের গৌড়রাষ্ট্র, প্রজার প্রীতির এবং প্রজাশক্তির সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু হতভাগ্য দ্বিতীয় মহীপালের ‘অনীতিকারম্ভের ফলে এবং দিবেবাক নিয়ন্ত্রিত বিদ্রোহানলে, সেই ভিত্তি ভস্মীভূত হইয়া গিয়াছিল। রামপালের পক্ষে, গৌড়রাজ্যের বিচ্ছিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পুনরায় একত্রিত করিয়া, উহার পুনর্গঠন সম্ভব হইলেও, সেই দেহে প্রাণপ্রতিষ্ঠা–সেই ভগ্ন অট্টালিকার বহিরঙ্গের সংস্কার সম্ভব হইলেও, উহার নষ্টভিত্তি পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করা–অসম্ভব হইয়াছিল।”
সম্মিলিত সৈন্যসামন্ত লইয়া স্বয়ং অগ্রসর হইবার পূর্বে, রামপাল বরেন্দ্রভূমির অবস্থা বিশেষ ভাবে পর্যবেক্ষণ করিবার নিমিত্ত হস্তী-অশ্ব-সমন্বিত সেনাসমভিব্যাহারে মহাপ্রতীহার শিবরাজকে প্রেরণ করিয়াছিলেন। বরেন্দ্রভূমির পর্যবেক্ষণ ব্যতীত এই কার্যে হয়ত আরও একটি সুবিধা ঘটাইবার সম্ভাবনা উপস্থিত হইয়াছিল। শিবরাজ যে পথে অগ্রসর হইয়াছিলেন, রামপালের সমুদয় সৈন্য হয়ত সেই পথেই বরেন্দ্র আক্রমণ করিবে, ইহা মনে করিয়া, শত্রুপক্ষ হয়ত সেই দিকেই সমগ্র বল একত্র করিয়াছিল। সুতরাং শিবরাজকে প্রেরণ করিয়া রামপাল রণকুশলতার পরিচয় দিয়াছিলেন বলিয়াই বোধ হয়।
রাম চরিতের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের ৪৬৫৭ শ্লোকে এই ‘রাষ্ট্রকূট মাণিক্য’ শিবরাজের পরিচয় পাওয়া যায়। শিবরাজ কোন পথে বরেন্দ্রভূমির দিকে অগ্রসর হইয়াছিলেন, ‘রামচরিত’ কাব্যে তাহার উল্লেখ নাই। কিন্তু তিনি হস্তীযোগে অগ্রসর হইয়াছিলেন বলিয়া মনে হয় যে, যেখানে হাঁটিয়া নদীপার হওয়া যায় এমন কোনও স্থলেই তিনি নদী উত্তীর্ণ হইয়া থাকিবেন। হনুমান যেমন অশোকবনে সীতাকে অভয় প্রদান করিয়া, রাক্ষস রক্ষিগণকে পরাভূত করিয়া এবং লঙ্কার ধবংসসাধন করিয়া, সীতার সংবাদ সহ রামের নিকট প্রত্যাবর্তন করিয়াছিলেন, শিবরাজও সেইরূপ বরেন্দ্রভূমিতে উপস্থিত হইয়া, দেবতা ও ব্রাহ্মণের সম্পত্তির কোনরূপ অনিষ্ট হইবে না এইরূপ আশ্বাস দিয়াছিলেন; এবং শত্রুপক্ষের সৈন্য পরাজিত ও শত্রুরাজ্য বিধবস্ত করিয়া রামপালের নিকট ফিরিয়া আসিয়া সমুদয় সংবাদ নিবেদন করিয়াছিলেন। তাঁহার প্রমুখাৎ সমুদয় অবগত হইয়া রামপাল বরেন্দ্রভূমি আক্রমণের যথাবিহিত উদ্যোগ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন।
শিবরাজের অভিযান সম্বন্ধে শ্রীযুক্ত বাবু রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহার ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ নামক গ্রন্থে অন্যরূপ লিখিয়াছেন, যথা–’শিবরাজ বরেন্দ্রী হইতে ভীম কর্তৃক নিযুক্ত রক্ষকগণকে দূর করিয়া দিয়াছিলেন এবং রাজসমীপেপ্রত্যাগমন করিয়া রামপালকে জানাইয়াছিলেন যে, তাঁহার পিতৃভূমি শত্রুমুক্ত হইয়াছে। শিবরাজকর্তৃক বরেন্দ্রী অধিকার বোধ হয় দীর্ঘকাল স্থায়ী হয় নাই….” (২৫৫ পৃঃ) কিন্তু হনুমানের কার্যের সহিত শিবরাজের কার্যের তুলনা করিতে দেখিয়া মনে হয়, শিবরাজ কর্তৃক ভীমের পরাজয় বা বরেন্দ্রী অধিকার বর্ণনা করা কবির অভিপ্রেত ছিল না। সুতরাং শিবরাজের অভিযানকে ‘বরেন্দ্রী অধিকার’ বলিয়া বর্ণনা করা যায় না।
অতঃপর সামন্তচক্র পরিবেষ্টিত হইয়া রামপাল বরেন্দ্র অভিমুখে অগ্রসর হইলেন। চতুরঙ্গ সেনাশোভিত রামপালের বিপুল বাহিনীর পক্ষে বরেন্দ্রভূমিতে উপস্থিত হওয়া একটি বিশেষ দুরূহ ব্যাপার হইয়াছিল সন্দেহ নাই, কারণ বরেন্দ্রভূমির উত্তরে হিমালয় পর্বত, এবং অপর সকল দিক নদীস্রোতে সুরক্ষিত। নদীপার হইতে না পারিলে রামপালের পক্ষে বরেন্দ্রভূমিতে উপনীত হইবার সম্ভাবনা ছিল না। কোন স্থানে রামপালের সৈন্য নদী পার হইয়াছিল, রামচরিতে তাহার স্পষ্ট উল্লেখ নাই। কিন্তু আনুসঙ্গিক বর্ণনা হইতে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে, এই স্থানটি বর্তমান রাজসাহী জেলায় অবস্থিত বরেন্দ্রীর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ। গঙ্গা ও মহানন্দার সংযোগস্থলে অবস্থিত থাকায় বরেন্দ্রভূমির এই প্রদেশটি অপেক্ষাকৃত সুরক্ষিত বলিয়াই চিরকাল পরিগণিত হইয়া আসিতেছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে পুনঃ পুনঃ বর্গীর আক্রমণে বিধবস্ত হইবার সময় বাঙ্গালার নবাব আলিবর্দী খাঁ নিরাপদ বিবেচনায় এই প্রদেশেই কেল্লা বারুইপাড়া নামক অধুনা বিলুপ্ত দুর্গমধ্যে তাঁহার পরিবারবর্গের আবাসস্থান নির্দিষ্ট করিয়াছিলেন। এইরূপ স্বভাব-সুরক্ষিত বলিয়া রামপালের আক্রমণ সময়ে এই প্রদেশ রক্ষার্থে হয়ত অতি অল্পসংখ্যক সৈন্যই এইস্থানে অবস্থিত ছিল। রামপাল তাঁহার বিপুল বাহিনী লইয়া অন্য কোনও দিক দিয়া অগ্রসর হইলে, তাঁহার গতিবিধি সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করিত, এবং তাঁহার পক্ষে নদী পার হওয়া বিশেষ কষ্টকর হইত। রামপাল এইস্থান হইতে কিছু দূরে গঙ্গাতীরে বিপুল নৌবাহিনী সংগ্রহ করিয়া সমুদয় সৈন্যসহ যাত্রা করিয়াছিলেন এবং শত্রুপক্ষ সংবাদ পাইয়া বিশেষ বাধা দিবার পূর্বেই সম্ভবতঃ গঙ্গাপার হইয়া এইস্থানে পৌঁছিয়াছিলেন।
শাস্ত্রী মহাশয়ের রামচরিতের ভূমিকায় এই ঘটনা অন্যরূপে বিবৃত হইয়াছে। তাহাতে উক্ত হইয়াছে যে, রামপাল নৌসেতুর সাহায্যে গঙ্গা উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন। (The allied army threw a bridge of boats on the Ganges) oftcor দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের দশম শ্লোকের টীকায় “নৌকামেলকেন” কথাটি আছে, সম্ভবতঃ তাহার জন্যই এরূপ সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ হইয়া থাকিবে। মূল শ্লোকটি এই :
“তস্য ম(মা)হা বাহিন্যাং গুপ্তায়াং তরণিসম্ভবেনাভূৎ
দ্বিষমভিষেণয়তো মুখরিত দিক্কোলাহলঃ সমুত্তারঃ।”
এই শ্লোকের রামপালপক্ষের টীকা এইরূপ–’’মহাবাহিন্যাং গঙ্গায়াং তরণিসম্ভবেন নৌকামেলকেন গুপ্তায়াংচ্ছন্না (যাং) সমুত্তারঃ সম্যগুত্তরণং মুখরিত দিকোলাহলো১০ যস্মিন।”
ইহা হইতে দেখা যায় যে, রামপাল যখন শত্রু-সেনাভিমুখে ‘অভিষেণন” করিতে করিতে ‘ নৌকামেলকে’ গঙ্গাবক্ষ আচ্ছন্ন করিয়া সৈন্যসামন্তসহ অপর পারে উত্তীর্ণ হইলেন, তখন তাঁহার সৈন্যসামন্তের জয়োল্লাসে চতুর্দিক পরিপূরিত হইয়াছিল;–তাহাদের সেই ‘সমুত্তার”-ব্যাপার এমন কোলাহলময় হইয়াছিল যে তাহাতে দিক সমূহ যেন মুখরিত হইয়া উঠিয়াছিল।
এই বর্ণনার সহিত রামপালের নৌসেতুর সাহায্যে গঙ্গা উত্তীর্ণ হইবার কোনরূপ অর্থসঙ্গতি পরিলক্ষিত হয় না। ইহাতে দেখিতে পাওয়া যায়–রামপালের নৌবাহিনী গঙ্গাব আচ্ছন্ন করিয়াছিল। এইরূপ বর্ণনা নৌসেতুর প্রতি প্রযুক্ত হইতে পারে না, কারণ, নৌসেতু গঙ্গাবক্ষ আচ্ছন্ন করিতে অসমর্থ; বরং বাধা সৃষ্টি করিয়া গঙ্গাবক্ষ তরঙ্গায়িত করিয়া তাহাকে অধিক অনাচ্ছন্ন করিত। টীকাকারও “নৌসেতু” না লিখিয়া “নৌকামেলক” লিখিয়াছেন। নৌসেতু স্থাপনা করিতে হইলে গঙ্গার অপর পারে বরেন্দ্রভূমির কিয়দংশের সহিত সেতুকে সংলগ্ন করিতে হইত। তাহা করিবার উদ্যোগ অবশ্যই বাধাপ্রাপ্ত হইত; আর গঙ্গার ন্যায় খরস্রোতার উপর নৌসেতু নির্মাণ করাও সহজ ব্যাপার হইত না। সুতরাং রামপাল যে বহুসংখ্যক নৌকায় গঙ্গাবক্ষ আচ্ছন্ন করিয়া, উজান হইতে ভাটির দিকে অগ্রসর হইয়া সহসা বরেন্দ্রতটে উপনীত হইয়াছিলেন তাহাই কবির বর্ণনীয় বিষয় বলিয়া গ্রহণ করা যুক্তিসঙ্গত।
রামচরিতের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের একাদশ শ্লোক হইতে দেখা যায় যে, গঙ্গা উত্তীর্ণ হইয়া, রামপালের সৈন্যগণ শত্রুপক্ষের ‘আবার’ বা সুরক্ষিত সুদৃঢ় স্থান পর্যন্ত অগ্রসর হইয়াছিল। এই “আবার” এখন রাজসাহী জেলার “ভীমের ডাইঙ্গ” নামে পরিচিত।
পরবর্তী নয়টি শ্লোকে কবি সন্ধ্যাকর নন্দী একপক্ষে রামপাল কর্তৃক সমুদ্রের উপর সেতুবন্ধন এবং অপর পক্ষে রামপাল কর্তৃক বরেন্দ্রভূমির অধিপতি ভীমের বন্দীকরণ, বর্ণনা করিয়াছেন। রামপালের সৈন্যের সহিত ভীমের সৈন্যের ভীষণ সমরকাহিনী কবি অতি অল্পকথায় সুন্দররূপে বর্ণনা করিয়াছেন। ভীষণ যুদ্ধের পর অবশেষে ভীম পরাজিত হইয়া বন্দী হইলে, তাঁহার রণকুরঙ্গগণ চতুর্দিকে পলায়ন করিতে লাগিল, এবং তাঁহার শিবিরস্থ যাবতীয় ধনসম্পত্তি শত্রুপক্ষের করগত হইল। যুদ্ধ শেষ হইয়াছে মনে করিয়া রামপাল বিজয়ী সৈন্যগণকে যথাযোগ্য পুরস্কার প্রদানে প্রবৃত্ত হইলেন। কিন্তু রামপালের পৈতৃক রাজ্যের অবস্থা এতদূর পরিবর্তিত হইয়াছিল যে, এই যুদ্ধজয়ের পরও বরেন্দ্রের অধিবাসিগণ তাঁহাকে রাজা বলিয়া স্বীকার করিল না; পরন্তু ভীমের সুহৃদ হরি ভীমের ছত্রভঙ্গ সৈন্যগণের মধ্যে পুনরায় সুশৃঙ্খলা সম্পাদন করিয়া, রামপালের সহিত যুদ্ধ করিতে অগ্রসর হইলেন।
রামচরিত কাব্যের যে অংশে ইহার পরবর্তী ঘটনা সমূহ বিবৃত হইয়াছে, তাহার টীকা পাওয়া যায় নাই। সুতরাং এই অংশের ব্যাখ্যা করিবার পূর্বে, মুদ্রিত গ্রন্থের ভ্রম প্রমাদের সংশোধন করিয়া লওয়া আবশ্যক। ৪২শ শ্লোকের শেষে যে ‘ইতি’ পদটি মুদ্রিত হইয়াছে, উহা শ্লোকের কোনও অংশ নহে; “শরকলাপম” এইখানেই শ্লোকের শেষ হইয়াছে। তৎপরে “ইতি কুলকং” এইরূপ পাঠ করিতে হইবে। ৪৪শ শ্লোকের শেষ পদটি “নিবেশয়াস” নহে, “নিবেশয়ামাস;” এবং এই শ্লোকের ‘অসজত’ স্থলে ‘অসজৎ’ পাঠ করিতে হইবে। ৪৬শ শ্লোকের “ জেতা স পরাক্রমেণ হরেঃ” ইহার স্থলে (মূল পুঁথি অনুসারে) “ জেতায়ং পরাক্রমেণ হরেঃ” এইরূপ পাঠ করিতে হইবে।
এই সমুদয় শ্লোকে প্রধানতঃ ভীম বন্দী হইবার পরবর্তী নিম্নলিখিত তিনটি ঘটনা বিবৃত হইয়াছে। (১) বন্ধনের পর ভীমের পলায়ন (২) ভীম বন্দী হইবার পর হরির সহিত রামপালের যুদ্ধ (৩) হরির পরাজয়ের পর বন্ধনমুক্ত ভীমের সহিত রামপালের পুনরায় যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধে ভীমের পরাজয় ও মৃত্যু।– পরাজয়ের পর হরির অবস্থা কি হইয়াছিল, রামচরিতে তাহার কোনও আভাস প্রাপ্ত হওয়া যায় না।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের ৩৬শ শ্লোকে ভীমের সহিত অঙ্গদের এবং রাবণের সহিত ‘বিত্তপালস্য সূনোঃ’র তুলনা করা হইয়াছে। অঙ্গদ যেরূপ রাবণের নিকট প্রেরিত হইয়াছিলেন, পরাজয়ের পর ভীমও সেইরূপ রামপাল কর্তৃক “বিত্তপালস্য সুনোঃ”র নিকট প্রেরিত হইয়াছিলেন।
এক্ষণে প্রশ্ন এই যে, ভীমের এই রক্ষক কে? শাস্ত্রী মহাশয় তাঁহাকে কেবল ‘বিত্তপাল’ নামে অভিহিত করিয়াছেন; ‘সূনু’ এই পদের তিনি কোনও ব্যাখ্যা করেন নাই। শ্রীযুক্ত বাবু রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় লিখিয়াছেন যে, ভীম রামপালের কোনও কর্মচারীর রক্ষণাধীনে ছিলেন। কিন্তু যদি ‘বিত্তপাল’ শব্দে কর্মচারী বুঝিতে হয়, তাহা হইলে বলিতে হইবে যে, ভীমের রক্ষক কোনও কর্মচারী নহে, কর্মচারীর সূনু’ অর্থাৎ ভ্রাতা বা পুত্র, অথবা সেই কর্মচারী কেবল কর্মচারী নহে,রামপালের ভ্রাতা বা পুত্র। তৎকালে রামপালের আর কোনও ভ্রাতা জীবিত ছিলেন না, তাঁহার পুত্রগণ জীবিত ছিলেন।
পূর্বে বলা হইয়াছে যে, রামচরিতের একটি শ্লোকের টীকা হইতে জানা যায়, রামপালের অন্ততঃ তিনটি পুত্র ছিলেন; এবং তাঁহাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠের নাম ছিল–’রাজ্যপাল’। মদনপালের মনহলি-লিপি হইতে কুমারপাল ও মদনপাল নামে রামপালের দুই পুত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। রামচরিতোক্ত রাজ্যপাল এবং তাম্রলিপির কুমারপাল যে অভিন্ন, তাহা পরে প্রদর্শিত হইবে। সুতরাং বিত্তপাল রামপালের অবশিষ্ট তৃতীয় পুত্রের নাম হইলেও হইতে পারে, এবং ‘বিত্তপালস্য সূননাঃ’ এই শব্দে রামপালের পুত্র বিত্তপাল সূচিত হইয়া থাকিতে পারেন। তিববতীয় ঐতিহাসিক তারানাথ যক্ষপাল নামে রামপালের এক উত্তরাধিকারীর উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। যক্ষপাল ও বিত্তপাল একই অর্থ সূচক। সুতরাং বরেন্দ্রভূমি আক্রমণের সময় রামপাল মগধ ও অঙ্গ প্রভৃতি শাসনের জন্য বিত্তপাল নামক তাঁহার এক পুত্রকে নিযুক্ত করিয়াছিলেন বলিয়া মনে করা যাইতে পারে। হয়ত এই ঘটনা হইতেই তারানাথ যক্ষপালকে (বিপালকে) রামপালের উত্তরাধিকারী বলিয়া নির্দেশ করিয়া গিয়াছেন। বন্দীকৃত ভীম বরেন্দ্রের জনসাধারণের প্রিয়পাত্র;–সুতরাং তাঁহাকে নিহত করিলে বিষম অসন্তোষের সৃষ্টি হইতে পারিত,–আবার তাঁহাকে বরেন্দ্রভূমিতে রাখিলেও বিপদের সম্ভাবনা থাকিত। হয়ত এই সমুদয় বিবেচনা করিয়াই রাজনীতি কুশল রামপাল ভীমকে রাজ্যের সুদূরবর্তী কোনও প্রদেশে বন্দী করিয়া রাখিবার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করিয়াছিলেন, ভীমের পলায়ন ব্যাপার হইতে এইরূপ এই সম্ভাবনার আভাস প্রাপ্ত হওয়া যায়।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের ৩৭শ শ্লোক হইতে জানা যায় যে, অঙ্গদ যেমন রাবণের স্বল্পসংখ্যক রক্ষিগণকে পরাভূত করিয়া, পুনরায় রামের নিকট প্রত্যাগমন করিয়া তাঁহার আনন্দ-বৰ্ধন করিয়াছিলেন, ভীমও সেইরূপ তাঁহার রক্ষকের সৌজন্যে শৃঙ্খলমুক্ত হওয়ায় সুযোগক্রমে পলায়ন করিয়া, পুনরায় যুদ্ধে বহুসংখ্যক লোককে নিহত করতঃ যমরাজের আনন্দ-বৰ্দ্ধন করিয়াছিলেন।
এদিকে হরির সহিত রামপালের ভীষণ যুদ্ধ হয়। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের ৩৮শ হইতে ৪২শ শ্লোকে কবি এই যুদ্ধের বর্ণনা করিয়াছেন। এই কয় শ্লোকে প্রথমে হরির সহিত রামের এবং পরে রামপালের সহিত রামের তুলনা হইয়াছে। কুম্ভকর্ণের মৃত্যুতে রামচন্দ্রের যেরূপ হর্ষ উপস্থিত হইয়াছিল, হরিকে যুদ্ধে পরাভূত করিয়া রামপালও সেইরূপ উল্লসিত হইয়াছিলেন। (৪৩শ শ্লোক)। হরিকে পরাভূত করার পরে রামপাল বরেন্দ্রমণ্ডলে প্রভাব বিস্তৃত করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। নিম্নলিখিত শ্লোকটিতে কবি ইহার উল্লেখ করিয়াছেন :
শক্তির্জগদ্বিজয়িনী (বৃষজয়িনী) বৃষজয়িনস্তস্য সূনুমপ্যসজৎ।
মূৰ্ছিতোয়মনয়া ধাম ধরায়াং নিবেশয়ামাস। (২৪৪)
কবি এই শ্লোকদ্বারা রামপক্ষে, বৃষজয়ীর অর্থাৎ ইন্দ্রজিতের জগদ্বিজয়ী শক্তি দ্বারা লক্ষ্মণের সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ভূমিতলে পতন; এবং রামপালপক্ষে বৃষজয়ীর পুত্রের জগদ্বিজয়ী শক্তি দ্বারা বরেন্দ্রভূমিতে স্বীয় প্রভাবের (ধাম) বিস্তার বর্ণনা করিয়াছেন। রামচরিতের চতুর্থ পরিচ্ছেদের অষ্টম শ্লোকে রামপালের মাতুল মথনদেবকে “বৃষজিৎ” বলা হইয়াছে। সুতরাং আলোচ্য শ্লোকের ‘বৃষজয়ী’ শব্দও সম্ভবতঃ তাঁহাকে সূচিত করিবার জন্যই ব্যবহৃত হইয়াছে। এই সিদ্ধান্ত বিচারসহ হইলে বলিতে হইবে,–মথনদেবের পুত্রই হরিকে যুদ্ধে পরাজিত করিয়া (ধরায়াং) বরেন্দ্রভূমিতে (ধাম) প্রভাব (নিবেশয়ামাস) বিস্তৃত করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। হরির পরাজয়ের পর ভীম পুনরায় তাঁহার অধীনস্থ সামন্তরাজগণ লইয়া যুদ্ধে অগ্রসর হইয়াছিলেন। নিম্নলিখিত দুইটি শ্লোকে অতি কৌশলে কবি ইহার উল্লেখ করিয়াছেন। যথা :
“উরূতর তরসোপক্রম্যোৎপাট্যাকৃষ্ট বিপুল ভূমিতৃতা।
তদনু জগৎপ্রাণভুবা সম্পাদিত পরমহৌষধীকেন।
তেন প্রতিহতমোহেন লক্ষ্মণেনারিরাকলিমায়ঃ।
নিন্যে মৃত্যুস্থানং জেতায়ং পরাক্রমেণ হরেঃ।” (২। ৪৫,৪৬)।
এই শ্লোকদ্বয়ে কবি বর্ণনা করিয়াছেন যে,–জগৎ-প্রাণ-(পবন) পুত্র হনুমান। কর্তৃক আনীত গন্ধমাদন পর্বতস্থিত মহৌষধি দ্বারা লক্ষ্মণের চৈতন্য সম্পাদিত হইলে, যেমন হরির জেতা ইন্দ্রজিৎ (মৃত্যুস্থানং নিন্যে) যমালয়ে নীত অর্থাৎ নিহত হইয়াছিলেন, তোপ ভীমও সামন্তরাজ-সমভিব্যাহারে হরির পরাজয়ে উল্লসিত রাম পালের সৈন্যগণকে আক্রমণ করিয়া, হরির জেতাকে (মথনের পুত্রকে) শমন সদনে প্রেরণ করিয়াছিলেন। এখানে “জগৎ প্রাণভুবা” শব্দেঃ শ্লেষানুরোধে পবনের পুত্র বলিয়া ভীমকেই সূচিত করা হইয়াছে; কারণ মহাভারতোক্ত মধ্যম পাণ্ডব ভীমও পবনের পুত্র ছিলেন। শ্লিষ্টকাব্যের (জগৎপ্রাণভুব) “পবনপুত্র” শব্দ এক অর্থে হনুমানকে অন্য অর্থে ভীমকে বুঝাইতে পারে।
সম্ভবতঃ এই শ্লোকের অন্যরূপ ব্যাখ্যা করিতে গিয়াই মহামহোপাধ্যায় শাস্ত্রী মহাশয় রামচরিতের ভূমিকায় লিখিয়াছেন যে,–’হরি বধ্যভূমিতে নীত হইয়াছিলেন।’ (Hari was taken to the place of execution) কিন্তু “নিন্যে মৃত্যু স্থানং জেতায়ং পরাক্রমে হরেঃ” এই শ্লোকার্ধ হইতে সেরূপ অর্থ প্রতিভাত হয় না; ইহাতে স্পষ্টই উল্লিখিত রহিয়াছে যে, যাঁহার মৃত্যু হইয়াছিল, অর্থাৎ যাঁহাকে (মৃত্যুস্থানে) যমালয়ে লওয়া হইয়াছিল, তিনি হরি নহেন,–হরির জেতা। — হরির পরাজয়ের কথা রামচরিতে উল্লিখিত হইলেও, পরাজয়ের পর হরির পরিণাম কি হইয়াছিল, সে সম্বন্ধে সন্ধ্যাকর নন্দী কিছুই বলেন নাই।
ভীম পুনরায় যুদ্ধে অগ্রসর হইয়া, রামপালের সম্মুখীন হইলে, সেই দ্বন্দ্বযুদ্ধে রামপাল তাঁহাকে তীক্ষ্ণ তরবারির আঘাতে নিহত করেন। কবি লিখিয়াছেন :
“নিহত কুটুম্বস্য পুরো দারুণমাস্কন্দনং কিমপি দধতঃ।
ধৃতচন্দ্রহাসধাশ্লালঙ্কারাজঃ কৃতোস্য বধঃ। (২৪৯)।
কবি এই শ্লোকে একপক্ষে রাম কর্তৃক লঙ্কারাজের বধ এবং অপর পক্ষে রামপালের হস্তে ‘কারাজ’ অর্থাৎ ভণ্ডরাজা ভীমের নিধন বর্ণনা করিয়াছেন।
এইরূপে দিবেবাক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রাজ্যের ধবংস হইল। কবির বর্ণনা হইতে স্পষ্ট অনুমিত হয় যে, প্রজাশক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত এই রাজ্য সহজে রামপালের করায়ত্ত হয় নাই। প্রাচ্যদেশে সাধারণতঃ রাজা বা সেনাপতির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই যুদ্ধের অবসান হইত। কিন্তু আমরা দেখিয়াছি,–ভীমের মৃত্যুর পরও রামপাল বরেন্দ্র অধিকার করিতে পারেন নাই। ভীমের সুহৃদ হরির নেতৃত্বাধীনে, বরেন্দ্রের প্রজাগণ প্রজাশক্তির প্রতিষ্ঠা অক্ষুণ্ণ রাখিবার জন্য পুনরায় যুদ্ধার্থে সমবেত হইয়াছিল। হরির পরাজয়েও এই যুদ্ধে শেষ মীমাংসা হয় নাই। ভীম পুনরায় ধবংসাবশিষ্ট সৈন্যদল লইয়া রামপালের বিপুল বাহিনীর বিরুদ্ধে অগ্রসর হইয়াছিলেন। বরেন্দ্রের প্রজাগণ যতদূর সাধ্য প্রাণপাত করিয়া যুদ্ধ করিয়াছিল, –একে একে ভীমের সুহৃদবর্গ নিহত হইয়াছিল, কিন্তু এত ত্যাগস্বীকার করিয়াও অঙ্গ মগধাদি ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশের সমবেত শক্তির বিরুদ্ধে বরেন্দ্রের ক্ষুদ্র শক্তি জয়লাভ করিতে পারে নাই;–রামপাল বিজয়-বাহিনী লইয়া বাহুবলের আতিশয্যে বরেন্দ্র অধিকার করিয়াছিলেন, এবং কৈবৰ্ত্ত-নায়ক প্রতিষ্ঠিত রাজধানী ‘ডমর’ (উপপুর) ভূমিসাৎ করিয়াছিলেন।
রামপালের বিপুল বাহিনী কর্তৃক ভীম ও হরির পরাজয় কেবল মাত্র ব্যক্তি বিশেষের জয় পরাজয় নহে। ইহা একটি মহাব্রতের অবসান-কাহিনী। দিবেবাক কর্তৃক এই মহাব্রত আরব্ধ হইয়াছিল, সে ব্রত উদযাপিত হইবার পূর্বেই রামপালের ক্রীতদাস–সামন্তরাজগণ–তাহার ধবংসসাধন করিলেন। এইবার পালরাজগণের ইতিহাসে একটি নূতন অধ্যায়ের আরম্ভ হইল। প্রজাশক্তির পরিবর্তে, অর্থবলে ক্রীত সামন্তরাজগণের বাহুবলের উপর নবগঠিত পাল রাজ্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হইল। কিন্তু রাজশক্তির এই বিজয়বার্তা, প্রজাশক্তির পরাভব কাহিনীর রূপান্তর মাত্র এবং এইরূপ রাজ্যের প্রতিষ্ঠাই পালরাজ্যের অধঃপতনের প্রথম সোপান।
ভীম নিহত হইবার পর, রামপাল তাঁহার জনকভূমি বরেন্দ্রী অধিকার করিয়া, সামন্ত-চক্র সমভিব্যাহারে রাজধানী রামাবতী নগরে প্রবেশ করিয়াছিলেন। কবি সন্ধাকর নন্দী, এই ঘটনার সহিত রাবণ বধান্তে সীতা সহ রামের অযোধ্যা প্রবেশের তুলনা করিয়াছেন; এবং দ্ব্যর্থ শ্লোকের দ্বারা এক সঙ্গেই এই দুই ঘটনার বর্ণনা করিয়াছেন। এই বর্ণনায় যে সীতার সহিত বরেন্দ্রীর এবং অযোধ্যার সহিত রামাবতীর তুলনা করা হইয়াছে, তাহা নিম্নলিখিত শ্লোক হইতেই স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়। যথা :
“ইতি রাজরাজভোগ্যামলকামিব বিবিধশেবধিভরসমৃদ্ধাং
রামাবতীং গৃহীত্বমূমযোধ্যামসৌ পুরীং তামগমৎ”৷৷” (৩৷ ৪৮।।)
রাম পক্ষে ইহার অর্থ এই যে, –‘রামচন্দ্র এইরূপে সীতাকে (অমূম) গ্রহণ করিয়া, কুবের ভবন অলকার ন্যায় সমৃদ্ধিশালী, স্বীয় বাসস্থান (রামাবতী) অযোধ্যা নগরীতে গমন করিয়াছিলেন।”
রামপাল পক্ষে ইহার অর্থ,-–”রামপাল এইরূপে বরেন্দ্রী (অমূম) করতলগত করিয়া, অপরাজেয় (অযযাধ্যাং) এবং কুবের-ভবনের ন্যায় শোভা সমৃদ্ধিশালী রামাবতী নগরে গমন করিয়াছিলেন।”
সীতার সহিত বরেন্দ্রীর তুলনা উপলক্ষে কবি সন্ধ্যাকর নন্দী স্বীয় জন্মভূমি বর্ণনার উৎকৃষ্ট অবসর পাইয়া, চতুর্থ পরিচ্ছেদের প্রথম সাতাইশটি শ্লোকে অতুলনীয় বাক্য-বিন্যাস ও অফুরন্ত কল্পনার সাহায্যে বরেন্দ্রভূমির যে মনোমোহিনী ছবি অঙ্কিত করিয়া গিয়াছেন, তাহা সহস্র বৎসর পরেও তাঁহার স্বদেশপ্রীতির কথা পাঠকগণকে স্মরণ করাইয়া দেয়!
রামায়ণে বর্ণিত আছে যে, অগ্নিপরীক্ষা দ্বারা সীতার শুচিভাব প্রমাণিত হইবার পর, রামচন্দ্র তাঁহাকে গ্রহণ করিয়াছিলেন। এই উপলক্ষে কবি সন্ধ্যাকর নন্দী কয়েকটি বিশেষণ দ্বারা সীতার ও বরেন্দ্রভূমির উভয়েরই পবিত্রতা বর্ণনা করিয়াছেন। বিশেষণ কয়েকটি এই;
১ সম্ভাবিতাকলুষভাবাং ২ উপপাদিতব্রতোকর্ষাং ৩ অপরিমিত-পুণ্যভূমিং ৪ সত্যাচারৈক-কেতনং ৫ ব্রহ্মকুলোদ্ভবাং ৬ গঙ্গাকরতোয়ানর্ঘপ্রবাহপুণ্যতমাং ৭ অপুনর্ভবায়মহাতীর্থবিকলুযযাজ্জ্বলাং।
এই কয়টি বিশেষণ দ্বারা কবি সূচিত করিতেছেন যে, বরেন্দ্রভূমির অধিবাসিগণ নানাবিধ সদগুণের আধার ছিলেন; এইস্থান বহুসংখ্যক ব্রাহ্মণের উদ্ভবস্থান ছিল; এবং ইহার দুই পার্শ্বে গঙ্গা ও করতোয়া এবং মধ্যে অপুনর্ভবা নদী প্রবাহিত থাকায়, ইহা পুণ্যতম বলিয়া গণ্য হইত। এই প্রসঙ্গে কবি বরেন্দ্রভূমির আরও কিছু পরিচয় দিয়াছেন। এই বরেন্দ্রভূমিতে জগদ্দল মহাবিহার, লোকেশ্বর ও মহত্তর দেবের মূর্তি এবং স্কন্দনগর শোণিতপুর প্রভৃতি তীর্থস্থান ছিল।
বরেন্দ্রভূমির এই বর্ণনা কবির অতিশয়োক্তি বলিয়া মনে হইতে পারে। কিন্তু পালরাজগণের মন্ত্রী ভট্টগুরবের গুরুড়-স্তম্ভলিপি, “বৈদ্যদেবের কমৌলি-তাম্র শাসন এবং শিলিমপুর-প্রশস্তিতেও বরেন্দ্রভূমির মাহাত্ম্যের অনেক বিবরণ পাওয়া যায়। সুতরাং কবির উক্তি একেবারে কাল্পনিক বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া চলে না।
জগদ্দল মহাবিহার এককালে খুব বিখ্যাত ছিল। তিববৎদেশীয় কোন কোন লেখক ইহা বরেন্দ্রভূমিতে অবস্থিত ছিল বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। জগদ্দল নামে পরিচিত কয়েকটি স্থান এখনও বরেন্দ্রভূমিতে দেখিতে পাওয়া যায়। ডাক্তার বুকানন হ্যাঁমিল্টন, বামনগোলা থানার অন্তর্গত এইরূপ একটি স্থানে অনেক প্রাচীন কীর্তির ধবংসাবশেষ ও ধম্মসাগর (ধর্মসাগর) নামক একটি দীঘির কথার উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। সম্প্রতি বরেন্দ্র-অনুসন্ধান-সমিতি দিনাজপুর জেলায়, চীরি নদীর পুরাতন খাতের ধারে জগদ্দল নামে আর একটি স্থানের সন্ধান পাইয়াছেন। ইহাতেও অনেক প্রাচীন কালের স্মৃতিচিহ্ন দেখিতে পাওয়া গিয়াছে। স্থানীয় জনপ্রবাদ অনুসারে ইহাই জগদ্দল মহাবিহারের ধবংসাবশেষ। এই স্থানে কয়েকটি বড় বড় মাটির ঢিবি বর্তমান আছে। একটি ঢিবির মধ্যে একটি প্রস্তর স্তম্ভ, এবং অপর কয়েকটি ঢিবির মধ্যে মন্দিরের ভিত্তি প্রভৃতির ধবংসাবশেষ এখনও দেখিতে পাওয়া যায়।
জগদ্দল মহাবিহার কেবল বরেন্দ্রভূমির নহে, সমগ্র বঙ্গদেশের গৌরবের বস্তু ছিল। তজ্জন্য কবি বরেন্দ্রভূমিকে “মন্দ্রাণাং স্থিতিমুঢ়াং জাগদ্দল-মহাবিহার চিতরাগাং দধতীং” (জগদ্দল মহাবিহারে অবিরত শাস্ত্র-পাঠজনিত মন্দ্ৰধবনির আবাসভূমি) বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন।
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রামচরিতের ভূমিকায় লিখিয়াছেন যে– জগদ্দল মহাবিহার রামপাল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। শ্ৰীযুক্ত রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ও তাঁহার ‘বাঙ্গালার ইতিহাসে’ এই মত গ্রহণ করিয়াছেন। কিন্তু সন্ধ্যাকর নন্দীর কাব্যে এমন কোনো কথা নাই যাহাতে এই সিদ্ধান্তটি সমর্থন করা যাইতে পারে।
পূর্বে উল্লিখিত হইয়াছে যে, জগদ্দল মহাবিহার ব্যতীত বরেন্দ্রভূমিতে স্কন্দনগর ও শোণিতপুর নামক দুইটি তীর্থস্থান ছিল। বগুড়া জেলার অন্তর্গত মহাস্থানই প্রাচীন স্কন্দনগর বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে। স্থানীয় লোকে এখনও স্কন্দদেবের মন্দিরের অবস্থিতিস্থান নির্দেশ করিয়া থাকে; এবং করতোয়া নদীতে স্নান করিবার নিমিত্ত এখনও নারায়ণী যোগের সময়, তথায় বহুসংখ্যক তীর্থযাত্রীর সমাগম হইয়া থাকে। দিনাজপুর জেলায় গঙ্গারামপুর থানার অন্তর্গত বাণগড় নামক স্থানে পুনর্ভবা নদীতীরে প্রাচীন শোণিতপুরের ধবংসাবশেষ বিদ্যমান আছে। দিনাজপুর সহর হইতে ১৬ মাইল দূরে বরেন্দ্র-অনুসন্ধান-সমিতি পুনর্ভবা নদীতীরে একটি প্রাচীন ঘাটের ধবংসাবশেষ আবিষ্কার করিয়াছেন। এই ঘাটের কতকগুলি ইষ্টক এখনও দেখিতে পাওয়া যায়; –তাহা ২৪ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যে ও ১৬ ইঞ্চি পাশে। বাংলা দেশের আর কোনও স্থানে এত বড় ইট দেখিতে পাওয়া যায় নাই।
কবি সন্ধ্যাকর নন্দী বরেন্দ্রভূমির মাহাত্ম্যর ও ইহার অন্তর্গত বিশিষ্ট স্থানগুলির বর্ণনা করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই। স্বদেশের সৌন্দর্য তিনি কিরূপ চক্ষে দেখিয়াছিলেন এবং কিরূপ কবিত্বপূর্ণ ভাষায় তিনি হৃদয়োচ্ছ্বসিত ভাব ব্যক্ত করিয়াছিলেন, তাহা নিম্নলিখিত শ্লোক হইতে বুঝা যাইবে।
“দদলিত-কনক-কেতক কান্তিমপ্যশেষ কুসুমহিতাম।
অরবিন্দেীবরময় সলিল-সুরভি-শীতল-শ্বসনাং।” (৩। ২২)
তৃতীয় পরিচ্ছেদের ২৮শ হইতে ৩২শ শ্লোকে কবি রামপাল কর্তৃক রামাবতী প্রতিষ্ঠার উল্লেখ করিয়াছেন; এবং ৩৩শ হইতে ৪০শ শ্লোকে এই নব প্রতিষ্ঠিত নগরীর বর্ণনা করিয়াছেন। তৎপরবর্তী তিনটি শ্লোকে এই নগরীতে দীর্ঘিকা খনন, দেবমূর্তি প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি বিষয় আলোচিত হইয়াছে।
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সম্পাদিত রামচরিতের ভূমিকার উপর নির্ভর করিয়া শ্ৰীযুক্ত রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় নিম্নলিখিত কয়েকটি সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। (Memoirs of the Asiatic Society-The Palas of Bengal)
১ রামাবতী নগর গঙ্গা ও করতোয়ার সঙ্গমস্থলে অবস্থিত ছিল।
২ রামাবতী নগরের স্থান-নিরূপণ বিষয়ে রামপাল শ্ৰীহেতুরাজ চণ্ডেশ্বর ও ক্ষেমেশ্বরের পরামর্শ গ্রহণ করিয়াছিলেন।
৩ রামাবতী নগরে অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্ত্বের মূর্তি ছিল।
৪ এই নগরীর নিকটে অপুনর্ভবা নামক একটি তীর্থস্থান ছিল।
এই সিদ্ধান্তগুলির মধ্যে প্রথম, তৃতীয় ও চতুর্থটির সমর্থক কোন প্রমাণই রামচরিত কাব্যে নাই। দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটিও একটি শ্লোকের বিকৃত ব্যাখ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত।
শ্লোকটি এই :
“কুৰ্ব্বদ্ভিঃ শংদেবেন শ্ৰীহেত্বীশ্বরেণ দেবেন।
চণ্ডেশ্বরাভিধানেন কিল ক্ষেমেশ্বরেণ চ সনাথৈঃ।” (৩।২)
ইহার পূর্বের শ্লোকেই বলা হইয়াছে যে, সীতার রাক্ষসগৃহে অবস্থানহেতু রাম তাঁহাকে অগ্নিপরীক্ষা করিয়া গ্রহণ করিয়াছিলেন। রামায়ণে বর্ণিত আছে যে, এই অগ্নিপরীক্ষা কালে ব্রহ্মাদি দেবতা উপস্থিত ছিলেন। হেত্বীশ্বর, ব্রহ্মার একটি সুপরিচিত নাম। সুতরাং এখানে হেত্বীশ্বর ক্ষেমেশ্বর প্রভৃতিকে ব্রহ্মাদি-দেবগণের নামরূপে গ্রহণ করাই সঙ্গত। রাম যেমন এই সমুদয় দেবগণের সমাগমে সীতার বিশুদ্ধতা জ্ঞাত হইয়াছিলেন, এই সমুদয় দেবমূর্তির অবস্থিতির জন্য, বরেন্দ্রভূমিও সেইরূপ পরিত্র বলিয়া সুবিজ্ঞাত ছিল। উক্ত শ্লোকের এইরূপ ব্যাক্যাই সমীচীন।
রামপাল রাজধানীতে প্রবেশ করিয়া, রাজ্য সংরক্ষণে মনোনিবেশ করেন। নিম্নলিখিত শ্লোক হইতে জানা যায় যে যুদ্ধ বিগ্রহে প্রজাগণ সর্বস্বান্ত হইয়াছিল, এই নিমিত্ত তিনি তাহাদের রাজস্ব কমাইয়া দিয়াছিলেন :
“ক্র রকরাপীড়িতাসাবিতি ভর্তুদুকরগ্রহাৎ কৃপয়া
কৃষ্টোপচিতাং সপদি স্খলিত প্রতিপক্ষমার দহন শুচম।” ৩। ২৭
রামচরিতে পাল সাম্রাজ্যের পুনর্গঠনের যে বিবরণ পাওয়া যায়, তাহার মধ্যে চারিটি শ্লোকে কয়েকটি মূল্যবান ঐতিহাসিক তথ্য নিহিত আছে।
১ ‘স্বপরিত্রাণনিমিত্তং পত্যা যঃ প্রাদশীয়েন।
বরবারণেন চ নিজস্যন্দনদানেন বস্মণরাধে৷৷ ১১ (৩। ৪৪)
রামায়ণে বর্ণিত আছে যে, ইন্দ্র নিজের রথ ও বৰ্ম্ম রামচন্দ্রকে প্রদান করিয়াছিলেন। উক্ত শ্লোকে রামপক্ষে এই সুপরিচিত ঘটনাই সূচিত হইয়াছে। রামপাল পক্ষে ইহার অর্থ এই যে, পূৰ্ব্বদিগ্বিভাগের বর্মবংশীয় রাজা পুনরায় রামপালের অধীনতা স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়া তাঁহাকে গজ ও রথ প্রদান করিয়াছিলেন। নবাবিষ্কৃত বেলাবো-তাম্রশাসনে এই বৰ্ম্মরাজবংশের কতক কতক বিবরণ পাওয়া যায়।
২ ‘‘ভবভূষণসন্ততিভুব মনুজগ্রাহ জিতমুকলত্রং যঃ।
জগদবতিস্ম সমন্তং কলিংগত স্তান নিশাচরান নিঘুন। “ (৩।৪৫)
রামচন্দ্র অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তনের পথে কিয়ৎকাল কিষ্কিন্ধ্যায় অপেক্ষা করিয়াছিলেন। উক্ত শ্লোক রাম পক্ষে তাহাই সূচিত করিতেছে। রামপাল পক্ষে এই শ্লোকের অর্থ এই যে, –রামপাল উৎকল দেশের চন্দ্রবংশীয় (ভবভূষণ-সন্ততি) রাজার প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করিয়াছিলেন, এবং কলিঙ্গ হইতে আরম্ভ করিয়া সমুদয় দেশ দস্যুহস্ত হইতে রক্ষা করিয়াছিলেন। এক্ষণে প্রশ্ন এই যে চন্দ্রবংশীয় এই উৎকল-অধিপতি কে? এই দস্যু শব্দেই বা কাহাকে সূচিত করা হইয়াছে?
রামচরিতের টীকা হইতে জানা যায় যে,–উৎকলের অধিপতি কর্ণকেশরী রামপালের সমসাময়িক ছিলেন। (মানসী ও মর্মবাণী, ফাল্গুন ১৩২২, ৮১ পৃঃ)। ব্রহ্মেশ্বর নামক মন্দির-লিপিতে উদ্যোতকেশরীর জননী কর্তৃক মন্দির নির্মাণের বৃত্তান্ত হইতে জানা যায় যে, উৎকলের কেশরীরাজগণ চন্দ্রবংশীয় ছিলেন।
এই কেশরীবংশ সম্ভবতঃ অনন্তবর্মা চোড়গঙ্গ কর্তৃক বিতাড়িত হইয়াছিল। কলিঙ্গনগর হইতে প্রদত্ত একখানি তাম্রশাসনের নিম্নলিখিত শ্লোক হইতে জানা যায় যে, অনন্তবৰ্ম্ম চোড়গঙ্গ ৯৯৯ শকে অথবা ১০৭৮ খৃষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন।
“শকাব্দে নন্দরন্ধ্র-গ্রহগণ-গণিতে কুম্ভসংস্থে দিনেশে
শুক্লেপক্ষে তৃতীয়া ষ্ণজি রবিদিনে রেবতীভে নৃষ্ণগ্নে।
লগ্নে গঙ্গাম্বয়াম্বুজবন ক্র-দিনকৃৎ বিশ্ব বিশ্বম্ভরায়া-শ্চক্ৰং সংরক্ষিতুং সৎগুণনিধির ধিপশ্চোড়গঙ্গোভিষিক্তঃ।
(Ind. Ant. XVIIIpp. 161-165.)
১১১৮-১৯ খৃষ্টাব্দে উত্তীর্ণ একখানি লিপিতে অনন্ত-বর্মা চোড়গঙ্গের উৎকল জয়ের উল্লেখ আছে। যথা :
“পূৰ্ব্বস্যাং দিশি পূৰ্ব্বমুকলপতিং রাজ্যে বিধায়চ্যুতং
পশ্চাৎ পশ্চিমদিকতটে বিগলিতং বেঙ্গীশমপ্যেতয়ো
লক্ষ্মীং বন্দনমালিকামিব জয়শ্রীতেরণ শুম্ভয়ো–
ব্বধাতি স্ম সমৃদ্ধবিত্তবিভবঃ শ্রীগঙ্গচুড়ামণি।”
সুতরাং অনুমান করা যাইতে পারে যে,–রামপাল সম্ভবতঃ অনন্তবর্মা চোড়গঙ্গ কর্তৃক উৎকল জয়ের পূৰ্ব্বে কেশরী রাজগণকে আশ্রয় প্রদান করিয়াছিলেন। শ্ৰীযুক্ত রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রামচরিতের ভুমিকার উপর নির্ভর করিয়া সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে, রামপাল উৎকল জয় করিয়া তাহা নাগবংশীয় রাজগণকে প্রত্যাপর্ণ করিয়াছিলেন–কিন্তু এরূপ মনে করিবার কোনই কারণ নাই।
৩-৪ যো বাজিনামধিভুবা নাগাবলি সংযতোরিতস্কন্ধঃ।
কৃত সাহায়কবিধিনা দেবঃ প্রিয়কারিণা প্রীণি।
তস্য জিত কামরূপাদি বিষয়বিনিবৃত্তঃ মানসম্পাদ্যঃ
মহিমানমায়ন নৃপো যতমানস্য প্রজাভিরক্ষার্থম৷৷ (৩৪৬-৪৭)।
রাম অযোধ্যা প্রতিগমনকালে ভরদ্বাজমুনির ঐশ্বরিক শক্তিবলে সৈন্যের খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহে সমর্থ হইয়াছিলেন; উপরোক্ত শ্লোকদ্বয়ে তাহাই সূচিত হইয়াছে। রামপাল-পক্ষে ইহার অর্থ এই যে, কামরূপ প্রভৃতির বিজয়-ব্যাপারে রামপাল তাঁহার মাতুল মহনদেবের নিকট বিশেষ সাহায্য পাইয়াছিলেন।
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রামচরিতের ভূমিকায় লিখিয়াছেন যে, মায়ন নামে এক রাজা কামরূপাদি জয় করিয়াছিলেন। শ্রীযুক্ত রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই মত গ্রহণ করিয়াছেন। কিন্তু এই মতটি সমীচীন বলিয়া বোধ হয় না। মহিমানমায়নপো’ এই পদটি মহিমান + মায়ন + নৃপো এইরূপ ভাবে ভাগ করা যায় না। কারণ সংস্কৃত ভাষায় কোন রকমেই মহিমান’ পদ সিদ্ধ করা যায় না। মহিমানং + আয়ন এইরূপ পদ বিভাগ করা ব্যতীত উপায় নাই। সুতরাং ‘মায়ন’ নামে কোন নৃপতির অস্তিত্ব এই শ্লোক হইতে অবগত হওয়া যায় না– তাহার দিগ্বিজয় তো দূরের কথা। হয়তো অনবধানতাবশতঃ ক্রিয়াপদ ‘আয়ন’ কামরূপজয়ী মায়ন-নৃপে পরিণত হইয়া, বাঙ্গালার ইতিহাসে স্থান লাভ করিয়াছে।
রাজা রামপাল সুদীর্ঘকাল রাজত্ব করিয়াছিলেন। তিববতীয় ঐতিহাসিক লামা তারানাথের মতে তাঁহার রাজ্যকালের পরিমাণ ৪৬ বৎসর। চণ্ডীমৌ-গ্রামে আবিষ্কৃত মূর্তির পাদপীঠে উৎকীর্ণ লিপি হইতে জানা যায় যে, তৃতীয় বিগ্রহপালের রাজত্বকালেই রামপাল বহুযুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হইয়াছিলেন। সুতরাং অনুমান করা যাইতে পারে যে, ৪২ বৎসর রাজত্ব করিবার পরে, রামপাল বার্ধক্যোচিত অবসর গ্রহণ করিয়াছিলেন। রামচরিত কাব্যের চতুর্থ পরিচ্ছেদের প্রথম শ্লোকের “সূনু সমর্পিত-রাজ্যঃ” এই বিশেষণটি হইতে এইরূপ অনুমান হয়। রাম পক্ষে ইহার অর্থ (সূনুনা ভ্রাতা ভরতেন সমর্পিতং রাজ্যং যস্মৈ) “ভ্রাতা ভরত কর্তৃক সমর্পিত রাজ্য”; রামপাল পক্ষে ইহার অর্থ (“সূনবে পুত্ৰায় সমর্পিতং রাজ্যং যেন”) যিনি পুত্রকে রাজ্য সমৰ্পণ করিয়াছেন। রামপালের এই পুত্রের নাম রাজ্যপাল।
রামচরিত-কাব্যের যে পুঁথি পাওয়া গিয়াছে, তাহাতে লেখক ভ্রমক্রমে কয়েকটি শ্লোক বাদ দেওয়ায়, রাজ্যপাল সম্বন্ধে অধিক কিছু জানিবার উপায় নাই। কেবল “বিগ্রহ-নিজ্জিত-কামরূপভৃৎ” এই বিশেষণটি হইতে জানা যায় যে, তিনি কামরূপ রাজকে যুদ্ধে পরাজিত করিয়াছিলেন। রামপাল কর্তৃক কামরূপ জয়ের কথা পূর্বে লিখিত হইয়াছে; সুতরাং মনে হয়, কামরূপ-রাজ বিদ্রোহী হওয়ায়, রাজ্যপাল পুনরায় তাঁহাকে পরাভূত করিয়াছিলেন। বৈদ্যদেবের কমৌলি-তাম্রশাসনেও এই অনুমানের সমর্থক প্রমাণাবলী দেখিতে পাওয়া যায়।
রামচরিত কাব্য হইতে জানা যায় যে, রামপাল মাতুল মহনদেবের মৃত্যু সংবাদ শুনিয়া, স্বেচ্ছায় নদীগর্ভে তনুত্যাগ করিয়াছিলেন। (৪। ১০) এইরূপ একটি প্রবাদ বহুদিন উত্তরবঙ্গে প্রচলিত ছিল। মালদহের অন্তর্গত পাণ্ডুয়া নামক স্থানে এক মসজিদে রক্ষিত ‘সেখ শুভোদয়া’ নামক হস্তলিখিত গ্রন্থে এই জনপ্রবাদ লিপিবদ্ধ দেখিতে পাওয়া যায়।
সন্ধ্যাকর নন্দী রামপালের পরবর্তী রাজাকে কুমার নামে অভিহিত করিয়াছেন। কিন্তু পিতার জীবদ্দশায়ই রাজ্যপালের মৃত্যু হইয়াছিল, রামচরিত কাব্যে এরূপ কোনও উল্লেখ নাই। ইহা হইতে অনুমান হয় যে, কুমারপাল রাজ্যপালেরই নামান্তর। কমৌলি তাম্রশাসন হইতে জানা যায় যে কুমারপালের রাজত্বকালের তদীয় মন্ত্রী বৈদ্যদেব “অনুত্তরবঙ্গে এক নৌযুদ্ধে জয়লাভ করেন, এবং তিঙ্গ্যদেবকে পরাভূত করিয়া, তাঁহার স্থলে কামরূপের রাজপদে অধিষ্ঠিত হন। শ্রীযুক্ত বাবু রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে অনন্তবর্মা চোড়সঙ্গই উক্ত নৌযুদ্ধে রামপালের প্রতিপক্ষ ছিলেন। কিন্তু ‘অনুত্তরবঙ্গ” এরূপ অনুমানের পক্ষ সমর্থন করে না।
কুমারপালের রাজত্বকালে এই সকল যুদ্ধবিগ্রহ সংঘটিত হইতে দেখিয়া অনুমান হয় যে, রাজা রামপাল নবপ্রতিষ্ঠিত পালরাজ্য সুদৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপন করিয়া যাইতে পারেন নাই; এবং মথনদেবের ও তাঁহার মৃত্যুর পরেই চতুর্দিক হইতে পালরাজের সামন্তগণ আবার বিদ্রোহী হইয়া উঠিয়াছিলেন। পালরাজ্যের এই দুর্দিনে যে সকল নূতন নূতন শত্রদলের আবির্ভাব হইতে আরম্ভ করে, তন্মধ্যে রাঢ়দেশবাসী সেনরাজগণ অন্যতম। পূর্বোল্লিখিত ‘সেখ শুভোদয়া’ নামক গ্রন্থে বর্ণিত হইয়াছে যে, রাজা রামপালের মৃত্যুর পরে কয়েকজন রাজ-অমাত্য মিলিয়া বিজয় সেনকে রাজপদে নির্বাচিত করেন। এই জনপ্রবাদের মূলে কতটুকু সত্য নিহিত আছে, তাহা জানিবার উপায় নাই। কিন্তু রামপালের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই যে পাল ও সেনরাজগণের দ্বন্দ্বযুদ্ধ ঘনীভূত হইয়া উঠে, তদ্বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। রাজসাহী জেলার মান্দা থানার অন্তর্গত নিমদীঘি নামক স্থানে প্রাপ্ত একখানি শিলালিপি আমি “কলিকাতা মিউজিয়মে” উপহার প্রদান করিয়াছি। এই শিলালিপিতে বহু লিপিকর-প্রমাদ বর্তমান থাকিলেও, ইহা হইতে জানা যায় যে, পালরাজ তৃতীয় গোপালদেবের মৃত্যুর পর, তাঁহার অনুচরগণের সহিত পুরসেন নামক কোন ব্যক্তির ভীষণ যুদ্ধ হইয়াছিল। রামচরিত কাব্যে একটি মাত্র শ্লোকে তৃতীয় গোপালদেবের বিবরণ পাওয়া যায়। এই শ্লোকের গূঢ়ার্থ এ পর্যন্ত কেহই লক্ষ্য করেন নাই। শ্লোকটি এই :
“অপি শত্রুঘোপাযাদা (ঙ্গো) পালঃ স্বর্জগাম
তৎসূনুঃ।
হন্তু [:] কুম্ভীনস্যা স্তনয়স্যৈতস্য সাময়িকমেতৎ৷৷ (৪।১২)
রামপক্ষে এই শ্লোকে শত্রুঘ্নের মৃত্যুকাহিনী (রামায়ণ, উত্তরকাণ্ড–৬৯ অধ্যায়) সূচিত করিতেছে। কুন্তীনসী-তনয় লবণের হত্যাকারী রাজা (গো-পাল) শত্রুঘ্নের অকাল মৃত্যু ‘সাময়িক’ অর্থাৎ বিধিনির্দিষ্ট কালেই হইয়াছিল।
অপর পক্ষে এই শ্লোকের অর্থ–শত্ৰুদলের নিধনকারী (শত্রুঘ) গোপালদেব কুন্তীনসীর পুত্রকে হত্যা করিবার পরেই অকালে কালগ্রাসে পতিত হইয়াছিলেন। টীকা না থাকায়, এই শ্লোকোক্ত ‘কুন্তীনসীর পুত্র’ কাহাকে সূচিত করিতেছে, তাহা নির্ণয় করিবার উপায় নাই। পূর্বোল্লিখিত মান্দা-লিপির তৃতীয় ও চতুর্থ পংক্তিতে “স্বেচ্ছয়া ত্যক্তকায়ঃ” এইরূপ পাঠ গ্রহণ করা যাইতে পারে। ইহা হইতেও প্রমাণিত হয় যে, গোপালদেব স্বেচ্ছায় দেহত্যাগ করিয়াছিলেন।
গোপালদেবের মৃত্যুর পর, রামপালের কনিষ্ঠ ভ্রাতা মদনপাল সিংহাসনে আরোহণ করেন। শ্রীযুক্ত রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় অনুমান করেন (Memoirs, p. 102 বাঙ্গালার ইতিহাস পৃঃ ২৮৩) যে মদনপাল অপ্রাপ্তবয়ষ্ক গোপালদেবকে। নিহত করিয়া, সিংহাসনের পথ মুক্ত করিয়াছিলেন। কিন্তু এরূপ অনুমান করিবার কোনই কারণ নাই। সন্ধ্যাকর নন্দী নিম্নলিখিত শ্লোকে মদনপালের সিংহাসন লাভের বিষয় উল্লেখ করিয়াছেন।
কুশলী কুশোকশল্যং রামবিরামবিদ্ভবং নিরাকুৰ্ব্বন।
অন্তোধি মেখলায়া ভুবঃ প্রভুরভূদভিয়া মদনঃ। (৪।১৫)
রামপক্ষে ইহার অন্বয়, ‘‘অমদনঃ কুশলী কুশো রামবিরামবিদ্ভবং অক-শল্যং নিরাকূৰ্ব্বন অন্তোধি-মেখলায়া ভুবঃ প্রভুরভূৎ’–অর্থাৎ “কুশ রাজত্ব পদলাভ করায়, রামের বিয়োগ জনিত দুঃখ দূর হইয়াছিল।”
রামপাল পক্ষে এই শ্লোকের অন্বয়, –”কুশলী মদনঃ রামবিরামবিদ্ভবং কুশোকশল্যং নিরাকুব্বন অন্তোধিমেখলায়া ভুবঃ প্রভুরভূৎ”, অর্থাৎ “মদনপাল রাজত্ব লাভ করাতে রামপালের মৃত্যুজনিত দুঃখ দূরীভূত হইয়াছিল।”
অন্তঃপর ছয়টি “কুলক” শ্লোকে (১৬। ২১ শ্লোক) কবি মদনপালের বিষয় বর্ণনা করিয়াছেন। হস্তলিখিত পুঁথিতে ২১ শ্লোকের শেষে, ‘কু’ এই অক্ষরটি দ্বারা সূচিত করা হইয়াছে যে, এই শ্লোকে একটি “কুলক” শেষ হইয়াছে। কিন্তু এশিয়াটিক সোসাইটির মুদ্রিত পুঁথিতে এই ‘কু’ অক্ষরটি পরিত্যক্ত হওয়ায় অর্থগ্রহণে বিশেষ গোলযোগ ঘটিয়াছে।
শ্লোক কয়েকটি এই
অভিষেক সম্ভার-বিতানৈর্বিশ্বাশা পূরণ পুরা।
দিশত্যর্থমনাথাবনাৎ জনতা জনানন্দং৷৷ ১৬
হেলা বিলুন বলবৎ পদ্মা (ন্দ্রা) বলিবলদ মিত্র চক্রেণ।
রাজাবত [ং] সলক্ষ্মীভারৈকধুরীণতাং দধানেন। ১৭
দোষা স্পর্শাকর্ষিত মমহিমাতিশয়ং প্রকাশমানেন।
দ্বিজপরিকর পরিপালনরূচিনোচ্চৈ-মণ্ডলাধিপতিনা চ৷৷ ১৮
সখ্যা চ শস্ত্রভালক্ষ্ম্যাশাভূতেন চারূবৃত্তেন।
সুহিত পরম শ্রমেণ চ সুবর্ণজাতেন বিধিবদর্ঘ্যেণ। ১৯
সিংহীসুত বিক্রান্তেনাৰ্জ্জুনধাস্লা ভুবঃ প্রদীপেন।
কমলা বিকাশ ভেষজ ভিষজা চন্দ্রেণ বন্ধুনোপেতম। ২০
চণ্ডীচরণ সরোজ প্রসাদ সম্পন্ন বিগ্রহ শ্রীকং।
ন খলু মদনং সাঙ্গেশ মীশ মগাদ জগদ্বিজয়ে লক্ষ্মীঃ। ২১
উল্লিখিত শ্লোকগুলির মধ্যে বিংশ শ্লোকের ‘চন্দ্রেণ’ এই বাক্যটি হইতে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে, মদনপাল, কান্যকুজের গাহড়বাল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রদেবের নিকট হইতে সাহায্য পাইয়াছিলেন। শাস্ত্রী মহাশয়ের অনুকরণে শ্রীযুক্ত রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ও এই মত গ্রহণ করিয়াছেন। কিছুদিন পূর্বে Modern Review পত্রিকায় ইহা লইয়া তাঁহার সহিত আমার তর্কবিতর্ক উপস্থিত হয়; তৎসমুদয়ের পুনরুল্লেখের আবশ্যক নাই। একটু ধীরভাবে আলোচনা করিলেই দেখা যাইবে যে, উল্লিখিত শ্লোকগুলি মদনপালের সহিত গাহড়বালরাজ চন্দ্রদেবের সমসাময়িকত্ব সূচিত করিতে পারে এমন কোনও কথাই নাই।
উল্লিখিত শ্লোকগুলিতে রতিপতি মদন, রাজা মদনপাল ও রামচন্দ্রের পুত্র কুশের রাজ্যাভিষেক বর্ণিত হইয়াছে। এ সকলেরই অভিষেক কালে তাঁহাদের একজন বন্ধু উপস্থিত ছিলেন, এই বন্ধুর নাম চন্দ্র। রতিপতি মদনের বন্ধু ওষধিপতি চন্দ্র, ও কুশের বন্ধু খুল্লতাতপুত্র চন্দ্রকেতু ইহা সহজেই বোধগম্য হয়। প্রশ্ন এই যে রাজা মদনপালের বন্ধু ‘চন্দ্র’ কে? মহামহোপাধ্যায় শাস্ত্রী মহাশয় ও শ্রীযুক্ত রাখাল বাবুর মতে ইনিই গাহড়বাল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা কান্যকুজাধিপতি চন্দ্রদেব, কিন্তু ইহা সম্ভবপর বলিয়া বোধ হয় না। কারণ চন্দ্র মণ্ডলাধিপতি’ ও বন্ধু বলিয়া অভিহিত হইয়াছেন। এখানে মণ্ডলাধিপতি শব্দের অর্থ মদনপালের অধীনস্থ কোনও সামন্ত রাজা। ‘বন্ধু’ এই শব্দটিও ‘জাতি’ বা কুটুম্ব অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে কারণ অন্যত্র ‘সখ্যা’ এই বিশেষণটি থাকায় বন্ধু শব্দের সাধারণ অর্থ গ্রহণ করিলে পুনরুক্তি দোষ ঘটে। গাহড়বালরাজ চন্দ্রদেব কখনই পালরাজগণের সহিত তাঁহার কোন কুটুম্বিতা ছিল এরূপ প্রমাণও অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই। সুতরাং মদনপালের অভিষেক কালে যে মণ্ডলাধিপতি ‘বন্ধু’ চন্দ্রদেব উপস্থিত ছিলেন, তিনি কখনও গাহড়বালরাজ চন্দ্রদেব হইতে পারেন না।
মদনপালের রাজ্যাভিষেক কালে বর্তমান চন্দ্রদেবের সহিত কান্যকুজাধিপতি চন্দ্রদেবের অভিন্নতা প্রতিপাদন করার পক্ষে আরও অন্তরায় আছে। গাহড়বাল রাজ চন্দ্রদেব ১১০৪ খৃঃ অব্দের পূর্বেই মৃত্যুমুখে পতিত হন। কারণ, উক্ত বর্ষে উত্তীর্ণ ‘বশাহি’ লিপিতে তদীয় পৌত্র গোবিন্দচন্দ্র ‘মহারাজপুত্র’ বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছেন। মদনপালকে চন্দ্রদেবের সমসাময়িক বলিয়া ধরিয়া লইলে বলিতে হইবে যে, মদনপাল ১১০৪ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে জীবিত ছিলেন। কিন্তু এই অনুমান সুপ্রতিষ্ঠিত সিদ্ধান্তের বিরোধী। ১০২৬ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ সারনাথ-লিপি হইতে জানা যায় যে ওই সময়ে রাজা মহীপাল জীবিত ছিলেন। মহীপাল ১০২৬ খ্রিস্টাব্দে জীবিত থাকিলে, মদনপাল কখনই ১১০৪ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে সিংহাসন লাভ করিতে পারেন না। এই অসঙ্গতি ব্যাখ্যা করিবার জন্য শ্রীযুক্ত রাখাল বাবু অনুমান করিয়াছেন যে, মহীপালের সারনাথ লিপি তাঁহার মৃত্যুর পরে উৎকীর্ণ হইয়াছিল! বলা বাহুল্য এরূপ অনুমান করিবার কোনই কারণ নাই।
মদনপাল কতদিন রাজত্ব করিয়াছিলেন, তাহার নির্ণয় করিবার উপায় নাই। দেবপাড়া-প্রশস্তি হইতে অবগত হইয়া যায় যে, বিজয় সেন “ গৌড়াধিপতিকে” বিতাড়িত করিয়াছিলেন। ঐতিহাসিকগণ একবাক্যে মদনপালকেই এই “গৌড়াধিপতি” বলিয়া স্থির করিয়াছেন। মদনপালের রাজত্বের ঊনবিংশ (মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে ‘চতুর্দশ’) বর্ষে উৎকীর্ণ লিপি পাওয়া গিয়াছে। সুতরাং বিজয়সেন কর্তৃক পরাজিত হইবার পূর্বে তিনি অন্ততঃ ঊনবিংশ বর্ষকাল রাজত্ব করিয়াছিলেন, এরূপ অনুমান করা যাইতে পারে।
শ্রীযুক্ত বাবু রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় অনুমান করিয়াছেন যে, বিজয় সেন মিথিলা জয় করিবার পূর্বেই বরেন্দ্রভূমি করতলগত করিয়াছিলেন। কিন্তু দেবপাড়া প্রশস্তির নিম্নলিখিত শ্লোক হইতে স্পষ্ট জানিতে পারা যায় যে, মিথিলা জয়ের পরে (পূর্বে নহে) বিজয়সন বরেন্দ্রভূমি অধিকার করিয়াছিলেন।
ত্বং নান্যবীর বিজয়ীতি গিরঃ কবীনাং
ত্বান্যথা মননরূঢ় নিগূঢ়তরাষঃ।
গৌড়েন্দ্র মদ্রবদপাকৃত কামরূপ–
ভূপম কলিঙ্গমপি যস্তরসা জিগায়।
সন্ধ্যাকর নন্দী যখন তাঁহার কাব্য লিখিয়াছিলেন, তখনও পালরাজ্যের এই ধবংসের দিন সমাগত হয় নাই। তখন রাজা মদনপাল অপ্রতিহত প্রভাবে রাজ্যশাসন ও শত্রুদমন করিতেছিলেন। কবি তাঁহাকে বিষ্ণুর সহিত তুলনা করিয়াছেন। কারণ, তিনিও গোবর্ধন উৎপাটিত করিয়াছিলেন, এবং কলিঙ্গরাজরূপী কালীয়কে দমন করিয়াছিলেন। ইহাদ্বারা কবি মদনপালের দিগ্বিজয় সূচিত করিয়াছেন। এই দিগ্বিজয়ী পরাক্রান্ত রাজা সুদীর্ঘকাল রাজ্যসুখ ভোগ করুন (চিরায় রাজ্যং কুরূতাৎ) এই প্রার্থনা বাক্যের সঙ্গে সঙ্গে কবি যখন তাঁহার রামচরিত কাব্য শেষ করিয়াছিলেন, তখনও বিজয় সেনের বিজয়োদ্ধত সেনানীবৃন্দ মার্জিত বর্ষাফলক উন্নত করিয়া সুচির প্রতিষ্ঠিত পালরাজ্যের জীর্ণদ্বার ভগ্ন করিবার মানসে রাঢ়দেশের অরণ্যানী হইতে নিষ্ক্রান্ত হয় নাই। ‘অরবিন্দেীবর’ শোভিত বরেন্দ্রী পরহস্তে বন্দী হইবার পূর্বেই বাঙ্গালার শেষ স্বদেশপ্রেমিক কবি ‘নন্দিকুল-কুমুদ কানন-পূর্ণেন্দু সন্ধ্যাকর নন্দী পালরাজ্যের ইতিহাস বর্ণনাচ্ছলে উচ্ছ্বসিত প্রাণে জননী-জন্মভূমির স্তুতিগান করিয়া ধন্য ও কৃতার্থ হইয়াছিলেন। তিনি যাহা লিখিয়া গিয়াছেন, তাহা কাব্য হিসাবে অতুলনীয় হইলেও, ইতিহাস পদমর্যাদা লাভেরও সম্পূর্ণ উপযুক্ত।
স্তোকৈস্তোষিতলোকৈঃ শ্লোকৈরক্লেশনশ্লেষৈঃ।
ঘটনাপরিস্ফুটরসৈঃ গম্ভীরোদার ভারতীসারৈঃ।
এই এক শ্লোকে কবি নিজেই তাঁহার কাব্যের যথার্থ সমালোচনা করিয়াছেন। বস্তুতঃ কবিত্ব-রসপূর্ণ হইলেও; তাঁহার কাব্য যে ‘ঘটনা পরিস্ফুট-রসে’ও পরিপূর্ণ, তাহাতে কোনই সন্দেহ নাই। তিনি যে সমুদয় ঘটনা লিপিবদ্ধ করিয়াছেন, তাহা একপ্রকার তাঁহার জীবিতকালেই সংঘটিত হইয়াছিল। তিনি পালরাজ্যের সান্ধিবিগ্ৰাহিকের পুত্র ছিলেন; সুতরাং ঐ সমুদয় ঘটনা যথাযথরূপে জানিবার তাহার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। তিনি যে এই সুযোগের সমুচিত সদ্ব্যবহার করিয়াছিলেন, তাহা তাঁহার কাব্যে বর্ণিত কতকগুলি ঘটনা সমসাময়িক উৎকীর্ণ লিপিদ্বারা সমর্থিত হওয়াতেই স্পষ্ট প্রমাণীকৃত হইয়াছে। সুতরাং সন্ধ্যাকর নন্দী বিরচিত এই রামচরিত কাব্য একাধারে কাব্য ও ইতিহাস বলিয়া গৃহীত হইতে পারে।
উপসংহারে বক্তব্য এই যে, মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এই অমূল্য গ্রন্থখানি আবিষ্কার করিয়া, সমগ্র বঙ্গবাসীর কৃতজ্ঞতা অর্জন করিয়াছেন। এক্ষণে এই পুঁথির একটি বিশুদ্ধ সংস্করণ মুদ্রিত করা আবশ্যক। বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি এই কার্যে প্রবৃত্ত হইয়া যে সকল তথ্য সংগ্রহে সমর্থ হইয়াছেন, তাহার সারাংশ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবৃত করিয়াছি।*
মানসী ও মর্মবাণী, ফাল্গুন ১৩২২-জ্যৈষ্ঠ, ১৩২৩
তথ্যসূত্র
১ গৌড়লেখমালা–পৃ. ১৪-খালিমপুর লিপি।
২ গৌড়লেখমালা–পৃ. ৭৮–গরুড়স্তম্ভলিপি।
৩ গরুড়স্তম্ভলিপি–গৌড়লেখমালা পৃ. ৮১
৪ রামচরিত–১/৩৭ টীকা।
৫ গৌড় লেখমালা–১৫৬–১৫৭ পৃ. ।
৬ মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সম্পাদিত এবং এশিয়াটিক সোসাইটি হইতে প্রকাশিত ‘রামচরিত’ গ্রন্থে ‘সুনাশীরঃ” এই পদ দেখিতে পাওয়া যায়। মূল পুঁথিতে ‘সুনাসীর” আছে; তাহা ‘সুনাশীর” রূপে মুদ্রিত হইয়াছে কেন, তাহার কারণ উল্লিখিত হয় নাই। এই শব্দটি দ্বিদন্ত্য, দ্বিতালব্য, তালব্যাদি হইতে পারে, যথা–সুনাসীর, শুনাশীর, শুনাসীর, কিন্তু “সুনাশীর” এইরূপ বর্ণবিন্যাসযুক্ত শব্দ সংস্কৃতভাষায় দেখা যায় না।
৭ মুদ্রিত পুথিতে ‘বিকলৌ’ এইরূপ পাঠ আছে। কিন্তু ইহাতে অর্থসঙ্গতি হয় না। মূলের টীকায় ‘বিফল’ পাঠ আছে– ইহাতে সুসঙ্গত অর্থ হয় বলিয়া ইহাই গ্রহণ করা গেল।
৮ ‘অবনীপতিতাং তনুমপি ন তদা সম্ভাবয়ামাস।” রামপাল পক্ষে অর্থ “অবনী পতিতাং পৃথ্বীপতিতাং তনুং অল্পমপি ন সম্ভাবিতবান’। রামপক্ষে অর্থ “মুচ্ছিতঃ সন অবনীপতিতাং তনুং দেহং ন সম্ভাবিতবান”।
৯ মুদ্রিত গ্রন্থে “অবিসেনয়তো” এইরূপ আছে। ইহাতে কোনও অর্থ হয় না। মূল পুঁথিতে “অভিষেণয়তো” এই পদ দেখিতে পাওয়া যায়। তাহাই গ্রহণ করা গেল।
১০ এটা একটা ছাপার ভুল। মূল পুঁথিতে “দিক্কোলাহলোগ নাই। তাহাতে আছে “মুখরিতদিক কোলাহলো যস্মিন”–সমাস ভাঙ্গিয়া বুঝাইবার জন্য টীকাকার এইরূপই পদচ্ছেদ করিয়াছিলেন, মূলপুঁথিতেও তাহা এই ভাবেই লিখিত আছে, মুদ্রিতগ্রন্থে তাহাই “মুখরিতদিক্কোলাহলো যস্মিন” এইভাবে মুদ্রিত হইয়াছে।
১১ ‘আরাধে’ পদটি ব্যাকরণদুষ্ট। আরাধি বা আরেধে হইতে পারে কি না বিবেচ্য।
* অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র এই বক্তৃতা রমেশচন্দ্র মজুমদার কর্তৃক সংকলিত এবং মানসী ও মর্মবাণী পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়।