জীবন-কথা ও স্মৃতিচারণ
লালন ফকির
লালন ফকিরের সকল কথা ভাল করিয়া জানি না, যাহা জানি তাহাও কিম্বদন্তীমূলক। লালন নিজে অতি অল্প লোককেই আত্মকাহিনী বলিতেন, তাঁহার শিষ্যেরাও বেশী কিছু সন্ধান বলিতে পারেন না। লালন জাতিতে কায়স্থ, কুষ্টীয়ার নিকটবর্তী চাপড়াগ্রামের ভৌমিকেরা তাঁহার স্বজাতীয়। ১০।১২ বৎসর বয়সে বারুণী গঙ্গাস্নান উপলক্ষে মুর্শিদাবাদে যান, তথায় উকট বসন্তরোগে আক্রান্ত হইয়া মুমূর্য দশায় পিতা-মাতা কর্তৃক গঙ্গাতীরে পরিত্যক্ত হন। লালনের মুখে বসন্তচিহ্ন বৰ্ত্তমান ছিল বলিয়া অনেকে এই কাহিনী বিশ্বাস করিয়া থাকেন। শ্মশানশায়ী লালনকে একজন মুসলমান ফকীর সেবাশুশ্রূষায় আরোগ্য করিয়া লালনপালন করেন ও ধর্মশিক্ষা প্রদান করেন। এই ফকিরের নাম সিরাজ সা, জাতিতে মুসলমান। লালনের প্রণীত অনেক গানে এই সিরাজ সা দীক্ষাগুরুর উল্লেখ আছে।
লালনের ধর্মমত অতি সরল ও উদার ছিল। তিনি জাতিভেদ মানিতেন না, হিন্দু মুসলমানকে সমভাবে দেখিতেন ও শিষ্যদিগের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সকল জাতিকেই গ্রহণ করিতেন। লালন হিন্দু নাম, সা উপাধি মুসলমান জাতীয় সুতরাং অনেকেই তাঁহাকে জাতির কথা জিজ্ঞাসা করিত। তিনি কোনো উত্তর না দিয়া কেবল স্বপ্রণীত নিম্নলিখিত গানটি শুনাইতেন :
১ সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে?
লালন ভাবে–জাতির কি রূপ দেখলাম না এই নজরে।
কেউ মালা কেউ তজবী গলায়,
তাইতে ত জাত ভিন্ন বলায়,
যাওয়া কিম্বা আসার বেলায়
জাতের চিহ্ন রয় কার রে?
২ যদি সুন্নত দিলে হয় মোসলমান।
নারীর তবে কি হয় বিধান।
বামন চিনি–পৈতা প্রমাণ,
বামনী চিনি কিসে রে?
৩ জগৎ বেড়ে জেতের কথা,
লোকে গৌরব করে যথা তথা,
লালন সে জেতের কাতা,
ঘুচিয়েছে সাধ-বাজারে।
একটা কথা বলিয়া রাখি–লালন নিরক্ষর ছিলেন। তাঁর সুদীর্ঘ দেহ, উন্নত ললাট, উজ্জ্বল চক্ষু, গৌরবর্ণ মুখশ্রী এবং প্রশান্তভাব দেখিয়া তাঁহাকে হিন্দু বলিয়া চিনিতে পারা যাইত এবং স্বাভবিক তীক্ষ্ণবুদ্ধির সঙ্গে ধৰ্ম্মজীবনের প্রেমোন্নত্ততা মিলিত হইয়া তিনি যে নিরক্ষর তাহা যেন সহজে বুঝিতে পারা যাইত না।
লালনের ধর্মমতের নিকট হিন্দু মুসলমানের ভেদাভেদ ছিল না, স্ত্রী পুরুষেরও সমান অধিকার ছিল–অনেক রমণী ইহার শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়েছেন। সত্য কথন সত্য ব্যবহার লালনের সাধন ও তাঁহার স্বরচিত সঙ্গীত তাঁহার ভজন–ইহা ভিন্ন অন্য কোনো কথা বাহিরের লোকে জানে না, তিনিও জিজ্ঞাসা করিলে বাহিরের লোককে ইহার অধিক কিছু বলিতেন না।
বৈষ্ণবদিগের ধর্মমতের প্রতি ইহার স্বাভাবিক অনুরাগ ছিল এবং শ্রীকৃষ্ণকে কখন কখন অবতার বলিয়া স্বীকার করিতে শুনা গিয়াছে।
কুষ্টীয়ার নিকটবর্তী সেওরিয়া গ্রামে লালনের আস্তানা বা আখড়া ছিল। তিনি তথায় প্রতি বৎসর ৫৬ শত টাকা ব্যয় করিয়া শীতকালে একটি উৎসব করিতেন। তাহাতে সকল দেশের শিষ্য সম্মিলিত হইত। ইহার শিষ্য সংখ্যা প্রায় দশ হাজার –প্রায়ই নিরক্ষর কৃষক। ইনি সংসারী ছিলেন, স্ত্রী এখনও বৰ্ত্তমান, তিনিই গদীর অধিকারিণী ও শিষ্যদিগের গুরুমা।
লালন অশ্বারোহণে দেশবিদেশ ভ্রমণ করিতেন। এদানীক বৃদ্ধাবস্থায় প্রায় চলচ্ছক্তিহীন হইয়া পড়িয়াছিলেন। ১৮৯১ সালের ১৭ অক্টোবর শুক্রবার প্রাতে ১১৬ বৎসর বয়সে লালনের মৃত্যু হয়। পূৰ্ব্ব রাত্রে শিষ্য সঙ্গে গান গাহিয়া প্রভাতে বলিলেন “আমি চলিলাম” এবং তার পর হইতেই মৃত্যু আসিয়া উপস্থিত হইল। তাঁহার আদেশানুসারে আস্তানার একটি গৃহমধ্যে মৃতদেহ সমাধিস্থ হইয়াছে। তাঁহার সম্মত্তি জোত জমা ও নগদ কয়েক সহস্র টাকা ছিল তাহা কতক স্ত্রীকে কতক এক ধৰ্ম্মকন্যাকে ও কতক প্রধান শিষ্য শীতল সাকে ও কতক সকাৰ্য্যে দান করিয়া গিয়াছেন।
লালনের জীবনী লিখিবার উপকরণ সংগ্রহ করিবার কখনও চেষ্টা করি নাই; তাঁহার রচিত গানগুলিও লিখিয়া রাখি নাই। সেগুলি সংগ্রহ করিতে পারিলে কতক পরিচয় দিতে পারিতাম।
লালনের শিষ্যেরা প্রায়ই নিরক্ষর ও দরিদ্র, কিন্তু তাহাদের সত্যনিষ্ঠা খুব প্রশংসনীয়। ইহারা স্ত্রী-পুরুষে মিলিয়া গান গাহিয়া ভজন করে এবং লালনকে গুরু বলিয়া মানে। লালন নিজেও গুরুবাদী ছিলেন।
লালনের ধর্মমত কোনো পুস্তকে লিখিত নাই, তিনিও কোনো পুস্তক মানিতেন না; তবে বৈষ্ণব কবিদিগের করচাগ্রন্থ আদরের সঙ্গে শ্রবণ করিতেন এরূপ দেখা গিয়াছে।
শ্রীযুক্ত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের চিত্র পুস্তকে ইহার একটি প্রতিকৃতি দেখিয়াছি তাহাই লালনের পার্থিবদেহের একমাত্র ছায়া–অসম্পূর্ণ হইলেও তাহাই একমাত্র আদর্শ।
কুষ্টীয়ার উকীল বাবু রাইচরণ বিশ্বাস, কুমারখালীর খ্যাতনামা হরিনাথ মজুমদার ও তাঁহার ফিকিরচাঁদের দলস্থ লোকেরা লালনের অনেক গান ও জীবনের অনেক ঘটনা জানেন এবং লালনের মৃত্যুর পরই কুষ্টীয়া হইতে প্রকাশিত “হিতকরী” নামক সংবাদপত্রে তাঁহার একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী প্রকাশিত হইয়াছিল। আমি কুমারখালীতে অনুসন্ধান করিয়া যতদূর জানিয়াছি তাহা লিখিলাম।
ভারতী, ভাদ্র, ১৩০২
কাঙ্গাল হরিনাথ
বিগত ৫ই বৈশাখ বৃহস্পতিবার অপরাহ্ন ৩০ ঘটিকার সময়ে কুমারখালি নিবাসী কাঙ্গাল সাহিত্যসেবক হরিনাথ মজুমদার ইহলোক হইতে অবসর গ্রহণ করিয়াছেন। “বিজয়-বসন্ত”-প্রণেতা হরিনাথ মজুমদার বাঙ্গলা সাহিত্যজগতে সুপরিচিত হইলেও, তাঁহার জীবনকাহিনী সৰ্বজনবিদিত নহে। আমাদের দেশে জীবিত সাহিত্যসেবকদিগের সমাদর নাই, সংবাদপত্রেও তাঁহাদের জীবনী বা প্রতিকৃতি প্রকাশিত হয় না। সেই জন্য কি জীবনে, কি মরণে, তাঁহারা চিরদিনই অনাদরে পড়িয়া থাকেন।
হরিনাথের জীবনকাহিনী নিরবচ্ছিন্ন দুঃখ দারিদ্র্যের কথায় পরিপূর্ণ। কলিকাতার ন্যায় গুণগ্রাহী বিদ্বৎসমাজের বুকের মধ্যে থাকিয়া, ধনকুবের মহারাজা স্যর যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর প্রভৃতির হৃদয়বন্ধু অমর কবি মধুসূদন দত্ত যে দেশে দাঁতব্য চিকিৎসালয়ে জীবন বিসর্জন করিয়া গিয়াছেন, সে দেশের অর্ধশিক্ষিত পল্লীসমাজে বাস করিয়া, জরাজীর্ণ পর্ণকুটীরের মধ্যে ছিন্নকন্থাশায়ী হরিনাথ যে অনাদরে জীবন বিসৰ্জন করিলেন, তাহাতে আর দুঃখ কি? কেবল দুঃখ এই যে, হরিনাথের ন্যায় পল্লীহিতৈষী দরিদ্ৰবন্ধু সত্যপরায়ণ সাহসী সাহিত্যসেবক বাঙ্গলা দেশে বড় অধিক দেখা যাইত না; ভবিষ্যতে কেহ তাঁহার স্থান পূর্ণ করিবেন কি না, তাহাতেও সন্দেহ!
।১৮২৯ খৃষ্টাব্দে হরিনাথের জন্ম হয়, কিন্তু বৎসর পূর্ণ না হইতেই তিনি মাতৃহীন হইয়াছিলেন। শৈশবে পিতৃবিয়োগ হইয়া তাঁহার দুঃখের ঘড়া পূর্ণ হইয়াছিল! অন্ন বস্ত্রের অভাব বড়ই শোচনীয় অভাব; তাহার নির্মম নিপীড়নে প্রতিভা চূর্ণ বিচূর্ণ হইয়া যায়। সেই অভাবে হরিনাথের বিদ্যাশিক্ষা হইল না। তিনি নিজেই লিখিয়া গিয়াছেন যে :
যখন আমার বয়স এক বৎসর অতিক্রম করে নাই, তখন মাতৃদেবী ইহলোক পরিত্যাগ করেন। আমি মাতৃহীন হইয়া অজ্ঞানাবস্থায় যে কত কাঁদিয়াছি, তাহা কে বলিতে পারে? খুল্লপিতামহী আমাকে প্রতিপালন করেন। আমার পিতা পুনরায় দার পরিগ্রহ করেন নাই, কিন্তু বোধ হয় তন্মিমিত্তই সংসারে উদাসীন ছিলেন। তিনি বিষয়কার্য্যে তাদৃশ মনোযোগ বিধান না করায়, পৈত্রিক সম্পত্তি যাহা ছিল, তৎসমুদায়ই নষ্ট হয়। সুতরাং মাতৃবিয়োগ হইতেই সাংসারিক দুঃখ যে আমার সহচর হইয়াছে, সে কথা বলা বাহুল্য। বাল্যখেলার সময় অন্য বালকেরা ক্রীড়োপযোগী বস্তু পিতামাতার নিকটে সহজে পাইয়া আনন্দ করিয়াছে, আমি তন্নিমিত্ত ক্রন্দন করিয়া মাটি ভিজাইয়াছি; এই অবস্থায় কতক দিন গত হয়। পরে বিদ্যাভ্যাসের সময় উপস্থিত হইল। পিতৃদেব স্বর্গারোহণ করিলেন, নিতান্ত নিরাশ্রয় হইয়া কত কাঁদিলাম, তাহার ইয়ত্তা নাই। এই সময় কুমারখালীবাসী শ্ৰীযুক্ত বাবু কৃষ্ণধন মজুমদার মহাশয় একটি ইংরাজী স্কুল স্থাপন করিয়াছিলেন। অধ্যয়নের নিমিত্ত তাহাতে প্রবেশ করিলাম। খুল্লতাত শ্ৰীযুক্ত নীলকমল মজুমদার মহাশয় পুস্তকাদির ব্যয় ও স্কুলের বেতন সাহায্য করিতে লাগিলেন। দুর্ভাগ্যবশত তাঁহার কৰ্ম্ম গেল। অর্থাভাবে আমারও লেখা পড়া বন্ধ হইল। স্কুলের হেডমাষ্টার কৃষ্ণধন বাবু বিনা বেতনে কতক দিন শিক্ষা দিয়াছিলেন; কিন্তু অন্ন বস্ত্রের ক্লেশ ও পুস্তকাদির অসদ্ভাবে আমাকে অধিক দিন বিদ্যালয়ে তিষ্ঠিয়া থাকিতে দিল না।
গুরু মহাশয়ের পাঠশালায় যাহা কিছু বিদ্যা শিক্ষা হইয়াছিল, তাহা লইয়াই হরিনাথ জীবনসংগ্রামে অগ্রসর হইলেন। সে সংগ্রাম নিজের জন্য নহে, দেশের জন্য, মাতৃভূমির দুঃখ দুর্গতি দূর করিবার জন্য! অনেকে মনে করিতে পারেন, যাহার “চাল চুলার” সংস্থান নাই, সে কেমন করিয়া মাতৃভূমির সেবা করিবে? হরিনাথের জীবন তাঁহাদের সকল তর্কের মীমাংসা করিয়া দিয়াছে। বাল্যকালে যিনি রাজা রামমোহন রায়ের ‘চূর্ণক” নামক গ্রন্থ নকল করিয়া পরিধেয় বস্ত্র সংগ্রহ করিয়াছিলেন, যৌবনে বার্ধক্যে এবং মৃত্যু দিনেও তাঁহার সেইরূপ দৈন্যদশা সঙ্গের সঙ্গী হইয়াছিল। সেই জন্য তিনি নিজের পরিচয় দিবার জন্য “কাঙ্গাল’ ভণিতায় গীত রচনা করিতেন।
জমিদারের উৎপীড়নে প্রজাপুঞ্জের দুঃখ দুর্দশা দেখিয়া এই কাঙ্গাল বালকের হৃদয় বিগলিত হইয়াছিল। তিনি সেই দিন হইতে দরিদ্রপীড়ন নিবারণ করিবার জন্য সেবাব্রত গ্রহণ করেন। কুমারখালীতে গোরা পল্টনের বড়ই উপদ্রব ছিল; তাহাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করিয়া ফল হইত না। হরিনাথের অসীম সাহস ও অপরিসীম বাহুবল ছিল; তিনি গোরা পল্টনের অত্যাচার সময়ে দুৰ্ব্বলের বল বাহুবলের আশ্রয় লইয়া সগর্ধ্বে গোরা ঠেঙ্গাইয়া বেড়াইতেন। ইহাতে ইংরাজেরা অনেকরূপ শিক্ষা পাইয়াছিলেন। গোরার অত্যাচার সহজেই নিবারিত হইল, কিন্তু জমীদারের অত্যাচার নিবারিত হইল না; তজ্জন্য হরিনাথ সংবাদ-প্রভাকরে লিখিতে আরম্ভ করিলেন। কবিবর ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের উপদেশে ও সহায়তায় হরিনাথ সুলেখক হইয়া উঠিলেন। তখন সেই লেখনীপ্রসূত “বিজয়-বসন্ত” বাঙ্গলাদেশের ঘরে ঘরে পরম সমাদরে পঠিত হইতে লাগিল। বিজয়বসন্তের দ্বাদশ সংস্করণ হইয়াছে; নিতান্ত শিশুপাঠ্য বর্ণপরিচয়দি ভিন্ন অন্য কোনও বাঙ্গলা গ্রন্থের এরূপ বহুল প্রচার হইয়াছে কি না, জানি না;–পল্লীবাসী সাহিত্য-সেবকের কোনও গ্রন্থই এরূপ সমাদর লাভ করে নাই। ইহাতে যে অর্থাগম হইল, তাহাতে সাংসারিক দুঃখ ক্লেশের অবসান হইল না। হরিনাথ পল্লীবাসীদিগের করুণ আর্তনাদ রাজদ্বারে বহন করিবার জন্য গ্রামবার্ত্তা-প্রকাশিকা নামক এক সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিলেন। এই পত্রিকা কলিকাতা গিরীশ বিদ্যারত্ন যন্ত্রে মুদ্রিত হইত; বিদ্যারত্ন মহাশয় যথেষ্ট শ্রম স্বীকার করিয়া ইহার সম্পাদনকার্য্যের সহায়তা করিতেন; এবং তাঁহার রচিত পরিচয়-শ্লোক গ্রামবার্তা র কলেবরের শোভা সম্পাদন করিত। শ্লোকটি এইরূপ :
“গুণালোকপ্রদা দোষপ্রদোষধবান্তচন্দ্রিকা।
রাজতে পত্রিকা নাম গ্রামবার্ত্তা-প্রকাশিকা।”
হরিনাথের গ্রামবার্তা সত্য সত্যই দেশের মধ্যে “দোষপ্রদোষধবান্তচন্দ্রিকা” হইয়া উঠিল। ইহাতে দেশের অনাথ প্রজাপুঞ্জের উপকার হইতে লাগিল, কিন্তু অনেকে হরিনাথের শত্রু হইয়া উঠিলেন। হরিনাথ যেরূপ নির্ভীকভাবে “দোষপ্রদোষ’’ বিধবস্ত করিতে আরম্ভ করিলেন, তাহাতে জেলার মাজিষ্ট্রেট এবং পরগণার জমিদার, উভয়েই খড়গহস্ত হইয়া উঠিলেন। হরিনাথকে হস্তগত করিবার জন্য অর্থলোভন ও তর্জন গর্জন প্রদর্শনের কিছুমাত্র ত্রুটি হইল না। অবশেষে হরিনাথ গ্রামবার্তায় লিখিলেন :
মাতৃ ও পিতৃভক্ত কোনো ব্যক্তিকে কেহ যদি বলে, তুমি তোমার পিতা-মাতার সেবা পরিত্যাগ কর, যদি না কর তবে দণ্ডিত হইবে। এই দণ্ডভয়ে কি কেহ পিতা-মাতার সেবা পরিত্যাগ করিতে পারেন? সত্যপালনই জগৎপিতার সেবা করিবার উপায়; এই সত্য পালন করিয়া জগৎপিতার সেবা করিতে যদি কেহ দণ্ড করেন, তাহা হইলে কি আমরা তাঁহার সেবা পরিত্যাগ করিব? অতএব যাঁহারা নূতন আইনের কথা শুনিয়া গ্রাম ও পল্লীবাসীদিগের প্রতি অত্যাচার করিতে আরম্ভ করিয়াছেন, আমরা তাহাদিগকে বলিতেছি, ভ্রাতৃভাবে বিনয় করিয়া বলিতেছি, অত্যাচার পরিত্যাগ করুন। তাঁহার নিরীহ ও দুৰ্বল সন্তানগুলি অত্যাচারিত না হয়, ঈশ্বর এই নিমিত্ত ভারতরাজ্য ব্রিটিশ সিংহের হস্তে অর্পণ করিয়াছেন। অত্যাচার করিয়া এক দিন, না হয় দু দিন পার পাইবে, তিন দিনের দিন অবশ্যই তাহা রাজার কর্ণগোচর হইবে। আমরা এত দিন সহ্য করিয়াছি, আর করিতে পারি না। কথা প্রকাশ করিয়া কর্তব্য সম্পাদন করিতে ত্রুটি করিব না। ইহাতে মারিতে হয় মার কাটিতে হয় কাট, যাহা করিতে হয় কর, প্রস্তুত আছি। ধৰ্ম্মমন্দিরে ধর্মালোচনা আর হয়ে আসা মনুষ্যশরীরে নিরপরাধে পাদুকা-প্রহার, এ কথা আর গোপন করিতে পারি না। ব্রিটিশরাজ্যের প্রতি এই অত্যাচার দেখিয়া যে প্রকাশ না করে, আমাদিগের মতে সেই রাজদ্রোহী।
হরিনাথ স্বদেশসেবার জন্য জীবনদান করিতে প্রস্তুত হইলেও জমিদার লজ্জিত হইলেন না; তাঁহাকে নির্যাতন করিবার জন্য পঞ্জাবী “গুণ্ডা’ পৰ্য্যন্ত নিযুক্ত হইল। অবশেষে কাঙ্গাল হরিনাথেরই জয় হইল। কুমারখালীতে ছাপাখানা সংস্থাপন করিয়া এক পয়সা মূল্যে হরিনাথ গ্রামবার্তা বিক্রয় করিতে লাগলেন; কাঙ্গাল হইয়াও প্রজাসমাজে হরিনাথই রাজা হইয়া উঠিলেন। কিন্তু ঋণভারে গ্রামবার্ত্তা অবসন্ন হইয়া পড়িতে লাগিল; এবং ২২ বৎসর পল্লীবার্তা বহন করিয়া গ্রামবার্তা বন্ধ হইয়া গেল।
স্ত্রীশিক্ষা ও বাঙ্গলা শিক্ষার জন্য সেকালে অল্প লোকেই অনুরাগ প্রকাশ করিতেন। হরিনাথ স্বয়ং বালিকা পাঠশালা ও বাঙ্গলা পাঠশালা সংস্থাপন করিয়া অধ্যাপনা ও অধ্যয়ন কাৰ্যে যুগপৎ মনোনিবেশ করেন। তাঁহার প্রতিষ্ঠিত উভয় পাঠশালাই জীবিত রহিয়াছে এবং অনেক অজ্ঞানান্ধ নর-নারীর চক্ষুরুন্মীলনের সহায়তা করিতেছে!
যুবকদল নির্দোষ আমোদ প্রমোদের অভাবে অন্যত্র বিচরণ করিয়া আত্মাপরাধ বৃক্ষের বিষময় ফল ভোজন করিতে শিক্ষা করে। হরিনাথ তাহাদের উদ্ধারের জন্য নানাবিধ নির্দোষ সঙ্গীতসম্প্রদায়ের সৃষ্টি করিয়াছিলেন। যাহারা তাঁহার সাহিত্যসেবার সংবাদ লইবার অযোগ্য, সেই সকল নিরক্ষর কৃষক সন্তানেরাও হলচালনা করিতে করিতে “কাঙ্গল ফিকিরচাঁদ ফকীরের” গীতি-সুধা সম্ভোগ করিয়া আসিতেছে!
যাত্রা, পাঁচালি, গীতাভিনয়, বাউল-সঙ্গীত এবং সংকীৰ্ত্তনাদিতে হরিনাথ যে কত সঙ্গীত রচনা করিয়া গিয়াছেন, তাহার সংখ্যা নির্ণয় করা সহজ নহে। তাঁহার অনেকগুলি সঙ্গীত ‘ভারতীয় সঙ্গীতমুক্তাবলীতে” বাঙ্গলা গীতিকবিতার নিদর্শনস্বরূপ গৃহীত হইয়াছে।
বিজয়বসন্তের কথা বাঙ্গালীর নিকট নূতন করিয়া লিখিবার আবশ্যক নাই। কিন্তু বিজয়বসন্ত ভিন্নও হরিনাথ আরও অনেকগুলি গদ্য পদ্য গ্রন্থ রচনা করিয়া গিয়াছেন। এ দেশে সাহিত্যসেবকের ভাগ্যে যাহা ঘটিয়া থাকে, হরিনাথের ভাগ্যেও তাহাই ঘটিয়াছিল;–সরস্বতীর কৃপার ত্রুটি ছিল না; লক্ষ্মীর কৃপা ঘটিয়া উঠিল না! কাঙ্গাল হরিনাথ স্বদেশসেবায় আত্ম উৎসর্গ করিয়া ৬৭ বৎসর বয়সে রোগক্লিষ্ট দুৰ্বলদেহ পরিত্যাগ করিয়া, সাধনোচিত উন্নতলোকে প্রস্থান করিলেন!
হরিনাথের আদর্শে, হরিনাথের উপদেশে, হরিনাথের সহায়তায়, কুমারখালী প্রদেশে অনেকের হৃদয়ে সাহিত্যানুরাগ সঞ্চারিত হইয়াছিল। তাঁহাদের মধ্যে বাগ্মীপ্রবর পণ্ডিত শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব এবং সুললিতবর্ণনানিপুণ শ্রীযুক্ত জলধর সেন বঙ্গীয় সাহিত্যসমাজে সুপরিচিত হইয়া উঠিয়াছেন।
হরিনাথ আবাল্য ধর্মানুপ্রাণিত হৃদয়ে সংসারক্ষেত্রে বিচরণ করিতেন। যৌবনে স্বদেশসেবায় নিযুক্ত থাকিবার সময়ে যে আদর্শ সম্মুখে রাখিয়াছিলেন, তাহার সারমর্ম একটি ক্ষুদ্র কবিতায় লিখিয়া গিয়াছেন :
পাপেতে পৃথিবী খার। পৃথিবী ঢাকিয়া আছে।।
ধর্ম তথা নাই আর। ধর্ম যদি চাও ভাই।
অনেকে “মিলের’ ছাত্র। ধৰ্ম্মসাজে কাজ নাই।।
ধৰ্ম্ম কৰ্ম্ম কথা মাত্র। কপটতা পরিহর।
কপটতা ধৰ্ম্ম সাজে। ভাল হও ভাল কর।।
এই আদর্শ হইতে প্রাণে যে ধর্মানুরাগ জাগিয়া উঠিয়াছিল, তাহাতেই শেষ জীবন অতিবাহিত করিয়া গিয়াছেন। এক দিনের জন্যও তাঁহার লেখনী বিশ্রামলাভ করে নাই। “ব্রহ্মাণ্ডবেদ” নামক সুবৃহৎ গ্রন্থ মাসে মাসে তাঁহার সাধনতত্ত্ব প্রকাশ করিত, এবং ক্ষয়রোগে শয্যাশায়ী হইয়াও মৃত্যুর অল্প দিন পূর্বে “মাতৃমহিমা” নামে একখানি পুস্তক লিখিয়া গিয়াছেন। ২২ শে চৈত্র তাঁহার মৃত্যুদশা উপস্থিত হইয়াছিল; কিন্তু সে যাত্রা রক্ষা পাইয়া যে শেষ উপদেশ কবিতা রচনা করিয়াছিলেন, তাহাতেই মুমুর্মু সাহিত্যসেবকের প্রাণের নিবেদন প্রকাশিত হইয়া রহিয়াছে! সেই শেষ উপদেশ এখনও যেন কর্ণোপান্তে ধবনিত হইতেছে :
আগেও উলঙ্গ দেখ, শেষেও উলঙ্গ। সত্য রাখি কর কর্ম সংসার পালন।
মধ্যে দিন দুই কাল বস্ত্রের প্রসঙ্গ। পাপ নাহি হবে দেহে মৃত্যুর কারণ।।
মরণের দিন দেখ সব ফক্কিকার। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু সকলেই জানে।
তবে কেন মূঢ় মন কর অহঙ্কার। লোভের ধাঁধায় পড়ে কেহ নাহি মানে।।
আমি ধনী আমি জ্ঞানী মানী রাজ্যপতি। মানে কুবুদ্ধি, লোক মনে ভরা মল।।
শ্মশানে সকলের দেখ একরূপ গতি। আগুনে পুড়িয়া মরে পতঙ্গের দল।।
কেবা রাজা, কেবা প্রজা, কে চিনিতে পারে। মায়ের সমান নাই শরীরপালিকা।
তবে কেন মর জীব ধন-অহঙ্কারে। ভাৰ্যার সমান নাই শরীরতোষিকা।।
পুঁথি পড়, পাঁজি পড় কোরাণ পুরাণ। আনন্দ কারণ দেখ বালক বালিকা।
ধর্ম নাই এ জগতে সত্যের সমান। সৰ্ব্বদুঃখহরা দুর্গা রাধিকা কালিকা।।
যতদিন “গ্রামবার্তা” জীবিত ছিল, প্রায় ততদিনই কোন-না-কোনরূপে হরিনাথকে জমীদারের উৎপীড়ন সহ্য করিতে হইত। ১২৮৫ সালের ২১ চৈত্র তারিখের একখানি স্বহস্তলিখিত পত্রে হরিনাথ তাঁহার কোনও স্নেহভাজন সাহিত্যসেবক প্রিয়শিষ্যকে লিখিয়া গিয়াছেন যে :
জমিদারেরা প্রজা পরিত্যাগ করিয়া আমার প্রতি যত দূর সাধ্য অত্যাচার করেন। কিন্তু তাহাতে কৃতকার্য হইতে না পারিয়া, পরিশেষে অত্যাচারে হাত খৰ্ব্ব করিয়া আনিয়াছেন। এখন আর তাঁহাদিগের অত্যাচারের কথা শুনিতে পাওয়া যায় না। গ্রামবার্তা যথাসাধ্য প্রজার উপকার করিয়াছে। পরে কি ঘটে, বলিতে পারি না।
জমিদারেরা যখন আমার প্রতি অত্যাচার করে, এবং আমার নামে মিথ্যা মোকদ্দামা উপস্থিত করিতে যত্ন করে, আমি তখন গ্রামবাসী সকলকেই ডাকিয়া আনি এবং আত্মাবস্থা জানাই। গ্রামের একটি কুকুর কোন প্রকারে অত্যাচারিত হইলেও গ্রামের লোকে তাহার জন্য কিছু করে, কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, ও আমার এত দূরই দুর্ভাগ্য যে, আমার জন্য কেহ কিছু করিবেন, এরূপ একটি কথাও বলিলেন না। যাঁহাদের নিমিত্ত কাঁদিলাম, বিবাদ মাথায় করিয়া বহন করিলাম, তাঁহাদিগের এই ব্যবহার!
যে জমিদারের অত্যাচারে হরিনাথ এরূপ সকরুণ আর্তনাদ করিয়া গিয়াছেন, কোনও স্থানে তাঁহার নামোল্লেখ করেন নাই। আকারে ইঙ্গিতে যাহা জানাইয়া গিয়াছেন, তাহাতে যাঁহাদিগের কৌতূহল দূর হইবে না, আমরা তাঁহাদের কৌতূহল চরিতার্থ করিতে অসমর্থ। হরিনাথ যাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া সুতীব্র সমালোচনায় রাজদ্বারে পল্লীচিত্র বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন, তিনি এ দেশের সাহিত্যসংসারে এবং ধর্মজগতে চিরপরিচিত;–তাঁহার নামোল্লেখ করিতে হৃদয় ব্যথিত হয়, লেখনী অবসন্ন হইয়া পড়ে! এক দিকে হরিনাথ যেমন জমিদারের তাড়নায় জর্জরিত হইয়া গ্রামবাসীদিগের নিকট সাহায্য ভিক্ষা করিয়াও অরণ্যে রোদন করিয়া গিয়াছেন, অন্য দিকে আবার অন্যান্য জমিদারেরা সময়ে সময়ে অর্থদান করিয়া তাঁহার নিঃস্বার্থ মাতৃপূজার সহায়তা করিয়াছেন। যে সকল জমিদার কাঙ্গাল সম্পাদকের অশ্রুধারা বিদূরিত করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, তাঁহাদিগের মধ্যে দিঘাপতিয়াধিপতি স্বর্গীয় রাজা প্রমথনাথ রায়বাহাদুর এবং কাশিমবাজার নিবাসিনী দীনপালিনী মহারাণী স্বর্ণময়ী ও তাঁহার সুযোগ্য সচিব স্বর্গীয় রায় রাজীবলোচন রায় বাহাদুরের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
সাহিত্য, বৈশাখ, ১৩০৩
কান্তকবির স্মৃতি-সম্বর্ধনা
ওগো ধরায় উজল কবি!
আজ–কি দিয়ে তোমারে করিব বরণ
কি আছে মোদের সম্বল,
বঙ্গের উজল কবি!
আজ–কি ফুলে রচিব পূজা-উপহার,
কি দিয়ে দিব অর্ঘ্য-সম্ভার,
ধরার অমল রবি!
তব “বাণী” কল্যাণে ‘কল্যাণী’ লেখনী
‘‘অমৃত” ঢালিল ভুবনে,–
ধরায় স্বরগ ছবি!
শেষে–’’অভয়া’র কোলে শ্রান্ত দেহ মন,
সিদ্ধ-সাধ মুদিলে নয়ন
অন্তিম “বিশ্রাম’ লভি।
যার–ওঙ্কার গাথা সাম-ঝঙ্কার
আজিও বাজিছে বিমানে,
হে ধন্য অমর কবি,
আজ–সে যে নিৰ্ম্মল হইয়া “সুমঙ্গল করে’’
পৃথ্বি-লব্ধ ধূলা মাটী ঝেড়ে’
স্বর্গের-অমল ছবি!
আজ–শূন্য মরুভূমি কর্মক্ষেত্রে তব
আঁখি-পূর্ণ তপ্ত অশ্রুতে,–
দীনের সম্বল সবি’,–
ভক্তি প্ৰেমডালি করিনু অর্পণ
শুধু একবার ফিরায়ে নয়ন
দেখিও অমর কবি।
রজনীকান্তের সঙ্গে রাজসাহী কলেজের সম্পর্ক ছিল। আমার সঙ্গেও এই কলেজের কিছু কিঞ্চিৎ সম্পর্ক আছে। এই কলেজের আলোচনা-সভায় রজনীকান্তের স্মৃতি-সম্বর্ধনার আয়োজন করিয়া, ও সেই সভায় আমাকে বক্তৃতা করিবার জন্য আহ্বান করিয়া, বৰ্ত্তমান অধ্যাপকগণ ও ছাত্রগণ এই কলেজের পূর্ধ্বতন ছাত্রবৃন্দের প্রতি যে সমাদর প্রদর্শন করিয়াছেন, তজ্জন্য পূৰ্বৰ্তম ছাত্র বৃন্দের পক্ষ হইতে আমি বার বার ধন্যবাদ করি। আজকার এই সৌভাগ্যে পূৰ্ব্বকালের অনেক কথা স্মৃতিপথে উদিত হইতেছে, যেন বাল্যকালের অনাবিল সৌন্দৰ্য্য আবার ফিরিয়া আসিতেছে।
রজনীকান্ত নাই। মৃত্যুর পরপারে গিয়া রজনীকান্ত অমর হইয়াছে,–যে কেবল ‘আমাদের” ছিল, সে এখন সমগ্র বাঙ্গালার “সকলের” হইয়াছে। ইহা আমাদের পক্ষে অল্প গৌরবের কথা নয়। সমগ্র বাঙ্গালার সকলে তাহাদের ‘কান্তকবির” পরলোকগমনে কত ভাবে শোকপ্রকাশ করিয়াছে; আমি কিছুই করি নাই,কেন করি নাই, তাহা বলিবার জন্য অবসর লাভ করি নাই, আজ আপনারা আমাকে সেই অবসর দিয়াছেন। আমি রজনীকান্তের সম্বন্ধে কোনো কথা বলিবার জন্য এখনও যোগ্য হইতে পারি নাই। কোন কথা বলিতে হইলে, বাগ্মীপ্রবর এডমণ্ড বার্কের পুত্রের অকালমৃত্যুর পর তাঁহার বক্তৃতার ভাষায় আমাকে বলিতে হইত, –”যাহারা থাকিবে তাহারা চলিয়া গেল; যাঁহারা চলিয়া যাইবে, তাহারাই পড়িয়া রহিয়াছে!” আজ রজনীকান্ত আমার জন্য শোক করিবে; তাহা না হইয়া, বিধাতার বিধানে তাহার জন্য আমি শোকপ্রকাশ করিতেছি! আমার পক্ষে ইহা কিরূপ মর্মন্তুদ ব্যাপার, রাজসাহীতে তাহা কাহারও অবিদিত নাই।
যে রচনা-প্রতিভার বিকাশ-গৌরবে রজনীকান্ত গৌরব লাভ করিয়া আমাদিগকে চিরগৌরবান্বিত করিয়া গিয়াছেন, তাহা তাঁহার পিতৃধন ছিল। তিনি তাঁহার পিতার রচিত হস্তলিখিত খাতানিবদ্ধ কবিতাগুলির আবৃত্তি করিয়া আমাকে শুনাইতেন। ভাবে, ভক্তিতে, রচনালালিত্যে সে কবিতা বড় মর্মস্পর্শ করিত। আমার দ্বারা সেগুলি সম্পাদিত হইয়া পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়, সেই আশায় রজনীকান্ত খাতাখানি আমার হস্তে সমর্পণ করিয়াছিলেন। ভূমিকম্পের অত্যাচারে যখন আমার পূৰ্ব্বসঞ্চিত গ্রন্থরাশি ধবংসপ্রাপ্ত হয়, তখন সে খাতাখানিও অন্তর্হিত হয়। আর পাওয়া যাইবে না বলিয়া রজনীকান্তের নিকট কত লজ্জিত ছিলাম। রজনীকান্তের পরলোকগমনের অল্পকাল পরে জানিয়াছি,–সে খাতা বিনষ্ট হয় নাই, তাহা কুড়াইয়া লইয়া আমারই একজন স্নেহের পাত্র রক্ষা করিতেছেন। তিনি তাহা হইতে নানা অংশ উদ্ধৃত করিয়া “প্রবাসী” পত্রে এক প্রবন্ধ প্রকাশিত করিয়াছেন। যাঁহারা পড়িয়াছেন, তাঁহারা দেখিয়াছেন,-রজনীকান্ত কোন স্থান হইতে রচনা প্রতিভার বীজগুলি লাভ করিয়াছিলেন।
এই বীজগুলি অনুকূল ক্ষেত্র প্রাপ্ত না হইলে, অঙ্কুরে বিনষ্ট হইত, কি ফলফুল প্রসব করিত, তাহা কে বলিতে পারে? কিন্তু রজনীকান্তের শিক্ষাক্ষেত্র এবং কর্মক্ষেত্ৰ সৰ্বাংশে ইহার অনুকূল হইয়াছিল। আমাদের পঠদ্দশায়, রাজসাহীর ছাত্রবৃন্দের মধ্যে রচনাশিক্ষার আগ্রহ ছিল। এ বিষয়ে যিনি সকলের অগ্রণী ছিলেন, তাঁহার নাম শরচ্চন্দ্র; তিনি এখনও শরচ্চন্দ্রের মতই বঙ্গীয় সাহিত্যাকাশে স্নিগ্ধজ্যোতিঃ বিকীরণ করিতেছেন। রজনীকান্ত যখন অধ্যয়ন-নিরত, তখনও রাজসাহী কলেজে ইহার স্মৃতি ও আদর্শ বৰ্তমান ছিল তাহার পর কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করিয়া রজনীকান্ত রচনা-প্রতিভা-বিকাশে যথেষ্ট উৎসাহ লাভ করিয়াছিলেন। অনেক সঙ্গীত আমার সমক্ষে রচিত হইয়াছে, অন্যকে শুনাইবার পূর্বে আমাকে শুনান হইয়াছে; মজলিশে সভামণ্ডপে পুনঃ পুনঃ প্রশংসিত হইয়াছে। ইহা রাজসাহীর পক্ষে একটি উল্লেখযোগ্য কথা। তথাপি সঙ্গীতগুলি পুস্তকাকারে প্রকাশিত করিতে রজনীকান্তের ইতস্ততের অভাব ছিল না। রজনীকান্তের গুণগ্রাহিতা ছিল, সরলতা ছিল, সহৃদয়তা ছিল, রচনা-প্রতিভা ছিল, কিন্তু আত্মপ্রকাশে ইতস্ততের অভাব ছিল না। কিরূপে তাহা কাটিয়া গেল, তাহা তাঁহার সাহিত্য-জীবনের একটি জ্ঞাতব্য কথা। তাহার সহিত আমার সম্পর্ক আছে বলিয়া, আমার নিজের কথাও বলিতে হইবে। ইহাকে কেহ “আত্মকথা” বলিয়া গ্রহণ করিবেন না, আমাকে ভুলিয়া গিয়া ইহা যে রজনীকান্তের জীবনের কথা, সেই ভাবেই ইহাকে গ্রহণ করিবেন।
সেবার বড়দিনের ছুটিতে কলিকাতায় যাইবার জন্য একখানি ডিঙ্গী নৌকায় উঠিয়া পদ্মাবক্ষে ভাসিবার উপক্রম করিতেছি, এমন সময়ে তীর হইতে রজনী ডাকিলেন,–
“দাদা! ঠাঁই আছে?’
তাঁহার স্বভাব এইরূপই প্রফুল্লতাময় ছিল। অল্পকাল পূৰ্ব্বে “সোণার তরী” বাহির হইয়াছিল। রজনী তাহারই উপর ইঙ্গিত করিয়া এরূপ প্রশ্ন করিয়াছিলেন; হয়ত আশা ছিল, আমি বলিয়া উঠিব : “ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোট এ তরী, আমারই সোনার ধানে গিয়াছে ভরি!” আমি বলিলাম,–”ভয় নাই, নির্ভয়ে আসিতে পার, আমি ধানের ব্যবসায় করি না।” এইরূপে দুইজনে কলিকাতায় চলিলাম। সেখান হইতে রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে বোলপুর যাইবার সময়ে, রজনীকান্তকেও সঙ্গে লইয়া চলিলাম। সেখানে রবীন্দ্রনাথের ও তাঁহার আমন্ত্রিত সুধীবর্গের নিকটে উৎসাহ পাইয়াও, রজনীকান্তের ইতস্তত দূর হইল না। কলিকাতায় ফিরিয়া আসিয়া রজনীকান্ত বলিল,–”সমাজপতি থাকিতে আমি কবিতা ছাপাইতে পারিব না!”
মুখে যে যাহা বলুক, সমাজপতির সমালোচনার ভয়ে কবিকুল যে কিরূপ আকুল, তাহার এইরূপ অভ্রান্ত পরিচয় পাইয়া, প্রিয়বন্ধু জলধরের সাহায্যে সমাজপতিকে জলধরের কলিকাতার বাসায় আনাইয়া, নূতন কবির পরিচয় না দিয়া, গান গাহিতে লাগাইয়া দিলাম। প্রাতঃকাল কাটিয়া গেল, মধ্যাহ্ন অতীত হইতে চলিল, সকলে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় সঙ্গীতসুধাপানে আহারের কথাও বিস্মৃত হইয়া গেলেন। কাহাকেও কিছু করিতে হইল না; সমাজপতি নিজেই গানগুলি পুস্তকাকারে ছাপাইয়া দিবার কথা পাড়িলেন। ইহার পর আলবার্ট হলের এক সভায় রবীন্দ্রনাথের ও দ্বিজেন্দ্রলালের সঙ্গীতের পরে রজনীর সঙ্গীত যখন দশজনে কান পাতিয়া শুনিল, তখন রজনীর ইতস্ততঃ মিটিয়া গিয়া আমার ইতস্ততের আরম্ভ হইল।
আমার ইতস্ততের যথেষ্ট কারণ ছিল। আমাকে পুস্তকের ও পুস্তকে মুদ্রিতব্য প্রত্যেক সঙ্গীতের নামকরণ করিতে হইবে, গানগুলির শ্রেণীবিভাগ করিয়া, কোন পৰ্য্যায়ে কোন শ্রেণী স্থান পাইবে, তাহাও স্থির করিয়া দিতে হইবে, এবং গ্রন্থের ভূমিকাও লিখিতে হইবে,–এই সকল সৰ্ত্তে রজনীকান্ত গ্রন্থ-প্রকাশের অনুমতি দিয়া, আমাকে বিপন্ন করিয়া তুলিয়াছিলেন। আমি যাহা করিয়াছি, তাহা সঙ্গত হইয়াছে কি না, ভবিষ্যৎ তাহার বিচার করিবে। তবে আমার পক্ষে দুই একটি কথা বলিবার আছে। গ্রন্থের নাম হইল–বাণী। সঙ্গীতগুলিরও একরূপ নামকরণ হইয়া গেল। শ্রেণিবিভাগও হইল,–তাহারও নামকরণ হইল “আলাপে, বিলাপে, প্রলাপে।” কিন্তু গানগুলি কোন পর্যায়ে সাজাইব, প্রলাপে বিলাপে আলাপে– প্রলাপে আলাপে বিলাপে–বিলাপে আলাপে প্রলাপে–বিলাপে প্রলাপে আলাপে –অথবা আলাপে প্রলাপে বিলাপে? ইহা স্থির করিতে গিয়া, আমাকে প্রকারান্তরে সমালোচনার ভার গ্রহণ করিতে হইয়াছিল, এবং আমার বিচারে হাস্যরসের গানগুলি নিকৃষ্ট বলিয়া, “প্রলাপ” নাম দিয়া, তাহাকে সকলের শেষে ঠেলিয়া, ‘‘আলাপকে” প্রথম স্থান ও “বিলাপকে” দ্বিতীয় স্থান দিতে বাধ্য হইয়াছিলাম। তখনও এবং এখনও বহুস্থানে দেখিয়াছি ও দেখিয়া আসিতেছি–আমি যাহাকে ‘প্রলাপ’ নাম দিয়া সকলের শেষে ঠেলিয়া দিয়াছিলাম, তাহাই সমধিক করতালি আকর্ষণ করে। কিন্তু দেশের অশিক্ষিত নরনারী কি ভাবে গানগুলি গ্রহণ করিয়াছে, তাহার সন্ধান লইতে গিয়া দেখিয়াছি,–সভামণ্ডপে ও শিক্ষিত-সমাজে যাহাই হউক, রজনীকান্তের হাস্যরসের গানগুলি জনসাধারণে তেমন গ্রহণ করে নাই; তাহারা তাহার “আলাপ” ও “বিলাপই” কণ্ঠস্থ করিয়া ফেলিয়াছে; তাহা কলাবতদিগের নিকটেও আদর পাইয়াছে। বিশুদ্ধ হাস্যরসের অবতারণা করা কত কঠিন তাহা না জানিয়া, অনেকেই পদেপদ্যে হাস্যরসের অবতারণা করিবার চেষ্টা করিয়া থাকেন। মূল রস চারিটি–শৃঙ্গার, রৌদ্র, বীর, বীভৎস। তাহা হইতে পৰ্য্যায়ক্রমে উদ্ভূত হয়,–হ্যাঁস্য, করুণ, অদ্ভুত এবং ভয়ানক।
শৃঙ্গারাদ্ধি ভবেৎ হাস্যং রৌদ্রাচ্চ করুণোরসঃ
বীরাচ্চৈবাদ্ভুততাৎপত্তি বীভৎসাচ্চ ভয়ানকঃ৷৷
ইহাই আমাদের দেশের চিরন্তন সংস্কার। সুতরাং হাস্যরস নামে যাহা সচরাচর অভিহিত হইতেছে, তাহার অধিকাংশই ‘ভয়ানক’ রস নামেই কথিত হইতে পারে। রজনীকান্ত ইহা জানিতেন, এ বিষয়ে অনেক বাদানুবাদ করিতেন, এবং কিরূপ বিশুদ্ধ হাস্যরসের অবতারণা করিতে পারিতেন, তাহা এই সভায় “দেবলোক হিতৈষিণী” নামক কবিতার আবৃত্তি শুনিয়া সকলেই অনুভব করিতে পারিয়াছেন। তথাপি রজনীকান্তের “আলাপই” সর্বশ্রেষ্ঠ বলিয়া আমার ধারণা;–তাহা অনাবিল,–তাহা মধুময়,–তাহা ভাবে ভক্তিতে রচনা লালিত্যে অনুপম।
রাজসাহী হইতে সাহিত্যালোচনা অন্তর্হিত হয় নাই। শীঘ্র হইবে বলিয়া আশঙ্কা করিবার কারণ নাই। তাহার প্রমাণ আজ এই সভাস্থলেই প্রাপ্ত হইয়াছি। ছাত্রবৃন্দ যে রচনা-প্রতিভার পরিচয় দিয়াছেন, কেহ কেহ যে সুন্দর সুন্দর রচনা পাঠ করিয়াছেন, তাহাতেই ইহার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। আজ রজনীকান্ত পরলোকগত। কিন্তু আজ তাঁহার জন্য উচ্চ কলরবে কতকগুলি অশিক্ষিত লোক উৰ্দ্ধবাহু হইয়া হায় হায় করিলে, তাঁহার স্মৃতিসম্বৰ্ধনা হইত না। যাঁহারা সুশিক্ষায় স্বদেশে বিদেশে খ্যাতি লাভ করিয়াছেন, সেই সকল অধ্যাপকবৃন্দ ও তাঁহাদের প্রতিভাশালী ছাত্রবৃন্দ একত্র মিলিত হইয়া, এই বিদ্যামন্দিরে পরলোকগত কবির প্রতি সমাদর প্রদর্শনের জন্য যাহা করিলেন, ইহাতে আমাদিগের শোক আপনোদিত হইল; পরলোকগত আত্মাও ইহাতে সমধিক তৃপ্তিলাভ করিবে।
মানসী, কার্তিক, ১৩১৯
সুরেশ-স্মৃতি
ভগ্ন স্বাস্থ্য লইয়া পুরীধামের সমুদ্রসৈকতে শয্যা গ্রহণ করিয়াছিলাম। যখন দেশে ফিরিলাম, তখন আর কর্মশক্তি ফিরিয়া পাইলাম না। দেহ দুৰ্বল, মন অবসন্ন, কৰ্ম্ম শৃঙ্খলাহীন,–দিনগুলি কোনরূপে কটিয়া যাইতে লাগিল। এমন অসময়ে সংবাদ পাইলাম,–সমাজপতি নাই, ‘সাহিত্য’ নিৰ্ব্বাণ লাভ করিয়াছে! আছে কেবল স্মৃতি,–সুখদুঃখবিজড়িত এক অনির্বচনীয় স্মৃতি,–তাহাও কালে বিলুপ্ত হইয়া যাইবে!
সকলই যায়, কৰ্ম্মফল যায় না; সমাজপতি ও ‘সাহিত্য’ যাহা করিয়া গিয়াছে, তাহা যাইতে পারে না। নাম যায়, স্মৃতি যায়, কৰ্ম্মফল কদাচ লুপ্ত হয় না।
এতদিন কেহ তাহার কথা জিজ্ঞাসা করে নাই। বন্ধুজন প্রথারক্ষার্থ শোকসভা করিয়া হৃদয়ভার লঘু করিয়া লইয়াছে, সামাজিক কর্তব্য পরিসমাপ্ত হইয়াছে। একখানা চিত্রপট কিছুদিন কীটকীটাণুর দ্বন্দ্বযুদ্ধে আত্মরক্ষার চেষ্টা করিবে।
এখন শুনিতেছি, সাহিত্যে’র পুনঃ প্রচারের প্রয়োজন অনুভূত হইয়াছে, তাহার যথাযোগ্য আয়োজন হইয়াছে, আবার ‘সাহিত্য’ বাহির হইতেছে। যাঁহারা এই কার্যে অগ্রসর হইয়াছেন, তাঁহারা সাধুবাদের পাত্র। তাঁহাদের চেষ্টা সাধু চেষ্টা, তাহার সহিত ‘অসহযোগ’ চলে না। তাই এ সম্বন্ধে কিছু লিখিবার জন্য অনুরুদ্ধ হইয়াছি। সমাজপতির সহযোগীগণ কেহই বেশী কথা লিখিতে পারিবেন না, কারণ, সকলের পক্ষেই সাহিত্যের’ কথা অল্প বিস্তর আত্মকথা।
‘সাহিত্যে’র একটা আসর ছিল। সুর ছিল বলিয়াই আসর ছিল। অর্থ ছিল না, প্রভুত্ব ছিল না, নিয়মিত সময়ে প্রকাশিত হইবার সামর্থ্য ছিল না। তথাপি ‘সাহিত্যের’ আদর ছিল, কদর ছিল, সমজদার ছিল। তাহার কারণ ঐ সুর। তাহা দেশের সুর, দশের সুর, একতান বাদ্যের সম্মিলিত সুর। তাহাতে অপূর্ণতা ছিল না, অবসাদ ছিল না, ‘হা হতোহস্মি’ ছিল না, প্রাণপূর্ণতা ছিল।
কি ছিল, এক কথায় তাহা ব্যক্ত করা যায় না। কি ছিল না, তাহা এক কথায় ব্যক্ত করা যায়, ছিল না–ভণ্ডামি। তাহা অশেষ মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করিয়া বঙ্গসাহিত্যের অশেষ কল্যাণ সাধন করিত।
প্রবন্ধ নিৰ্বাচনের কড়াকড়ি ‘সাহিত্য’কে, এই অসাধারণ গৌরব দান করিয়াছিল। এখন লেখকের সংখ্যা অসংখ্য, বুঝি বা পাঠকের সংখ্যা অপেক্ষা অধিক। এমন দিনে যে কেহ লিখিতেছেন, যাহা ইচ্ছা লিখিতেছেন, বিষয় বিন্যাসে ও বচনবিন্যাসে স্বেচ্ছাচার সমানভাবে প্রশ্রয় লাভ করিতেছে। এমন দিনে প্রবন্ধ নিৰ্বাচন করা যে কত কঠিন, তাহা ‘সাহিত্য সম্পাদককে সর্বদা স্বীকার করিতে হইত। তথাপি দৃঢ়তা তাঁহার রক্ষাকবচ ছিল।
এই দৃঢ়তা কেবল প্রবন্ধবর্জনেই ব্যক্ত হইত না, প্রবন্ধসৃষ্টিতেও ইহা আর এক আকারে আত্মপ্রকাশ করিত, তাহা আব্দার। সম্পাদক অনেক সময়ে নিজেই বিষয়নিৰ্বাচন করিতেন, লেখক নির্বাচন করিতেন, এবং লেখার জন্য ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিতেন। এই দৃঢ়তা ‘সাহিত্যে’র আসরে যাহাদিগকে টানিয়া আনিয়াছিল, তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই হয় ত টানাটানিতে না পড়িলে লেখনী ধারণ করিতেন না। ইহাতে অনেক নূতন পুরাতন লেখক জড়তা ত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছেন। ইহার জন্য যে তাড়না ছিল, সে বড় মধুর স্নেহের তাড়না, তাহা কেমন করিয়া প্রয়োগ করিতে হয়, সমাজপতিই তাহা জানিতেন।
‘সাহিত্যে ভণ্ডামি ছিল না বলিয়াই গোঁড়ামি তাহাকে সঙ্কীর্ণ নীতিতে গণ্ডীবদ্ধ করিতে পারে নাই। এই উদারতা না থাকিলে প্রকৃত সাহিত্য গড়িয়া উঠিতে পারে না। বিদেশের সাহিত্যে যাহা কিছু ভালো বাহির হইত, বিদেশী বর্জনের তুমুল আন্দোলনের দিনেও, তাহা সাদরে সাহিত্যে স্থান লাভ করিত।
সাহিত্যের সমালোচনা ‘সাহিত্যের বিশিষ্ট গৌরব বলিয়া খ্যাতিলাভ করিয়াছিল। তাহাতে অকুণ্ঠিতভাবে তিরস্কার পুরস্কার বিতরিত হইত। সাহিত্যকে অনাবিল রসের আধার করিবার আন্তরিক আকুলতাই ‘সাহিত্য’ সম্পাদককে সমালোচনায় সীমাশূন্য, ক্ষমাশূন্য কশাঘাত প্রকাশ করিতে অভ্যস্ত করিয়া তুলিয়াছিল। মমত্ববোধ যত আন্তরিক হয়, অনধিকারচৰ্চ্চাকে সুশাসিত করিবার ইচ্ছা ততই প্রবল হইয়া থাকে। আমার দেশ, আমার ভাষা, আমার সাহিত্য, এই মমত্ববোধ প্রবল হইলে, তাহার প্রতি উৎপীড়ন অত্যাচার নিবারণের জন্য স্বতই সীমাশূন্য ক্ষমাশূন্য কশাঘাত প্রয়োগ করিবার প্রয়োজন অনুভূত হইয়া থাকে। ইহাতে বঙ্গসাহিত্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় নাই,–লাভবান হইয়াছে।
সুরেশ শক্তিধর ছিল। বক্তৃতায় ও রচনায় তাহার অনেক পরিচয় প্রকাশিত হইয়া রহিয়াছে। তাহার মূল আন্তরিকতা। এই গুণ তাহার অনেক দোষ ঢাকিয়া ফেলিয়ছিল, এই গুণে অনেক সময়ে তাহাকে তিরস্কার করিতে গিয়া ক্ষমা করিয়া ফিরিয়া আসিতে হইত। সুরেশ চলিয়া যাইবে, আমাকে তাহার কথা লিখিতে হইবে, এমন কথা একদিনও মনে হয় নাই। ইহাই আমার প্রধান শোক। বড়াল কবি বাঁচিয়া থাকিলে শোক যথাযোগ্য ভাষায় প্রকাশিত হইতে পারিত। আমার পক্ষে নীরবে অশ্রুপাতই শোকপ্রকাশের একমাত্র উপায়। যাহা গিয়াছে, তাহা গিয়াছে। তাহার আরব্ধ কাৰ্য্য সমাপ্ত হয় নাই, ‘সাহিত্যের প্রয়োজন তিরোহিত হয় নাই, বরং তাহা কিছু অধিক হইয়া উঠিতেছে। যাঁহারা ইহার পুনঃপ্রচারে বদ্ধপরিকর হইয়াছেন, তাঁহাদের সাধু চেষ্টা সফল হউক।
সাহিত্য, ফাল্গুন ও চৈত্র, ১৩২৭