প্রাককথন

সাময়িকী আর্কাইভ
সাময়িকী আর্কাইভ
52 মিনিটে পড়ুন

অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় রচনাসংগ্রহ (নন-ফিকশন)
সম্পাদনা : রাজনারায়ণ পাল
সম্পাদকের উৎসর্গ : বাঙালির গৌরবময় বিস্মৃত অতীত প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসু পাঠককে

প্রাককথন

ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকের জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের মধ্যে এক উজ্জ্বল নাম অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়। তবে শুধু ঐতিহাসিক বললে ভুল হবে, তিনি ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, শিল্পরসিক, নাট্যশাস্ত্রবিদ ও বাগ্মী, যিনি বাঙালির ইতিহাসকে সাম্রাজ্যবাদী লেখকদের মসিলিপ্ত করার অসাধু উদ্যোগকে খণ্ডন করে ন্যায়নিষ্ঠ বিচারকের মতো যুক্তির কাঠগড়ায় দাঁড় করান, সত্য নয় অথচ সত্য হিসেবে অতীত ঘটনাকে পরিগণিত করার বিজাতীয় প্রয়াস যুক্তিবাণে অপনোদন করে জাতীয় কলঙ্ক মোচনে সচেষ্ট হন এবং ইউরোপীয় বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অবলম্বন করে সংস্কার-বর্জিত চিন্তার আলোকে বঙ্গদেশে ইতিহাস আলোচনার প্রবর্তন করেন। বন্ধুপ্রতিম এই ঐতিহাসিক সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ তাই নির্দ্বিধায় লিখেছিলেন, ‘বাঙ্গালা ইতিহাসে তিনি যে স্বাধীনতার যুগ প্রবর্তন করিয়াছেন সেজন্য তিনি বঙ্গ-সাহিত্যে ধন্য হইয়া থাকিবেন। এহেন মনীষীর জন্মসার্ধশত বছরে এ সংকলন তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত তর্পণ। সিরাজদ্দৌল্লা, মিরকাশিম-এর মতো একাধিক গ্রন্থপ্রণেতা অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় বহুবিধ বিষয়কে কেন্দ্র করে অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছেন যা ছড়িয়ে আছে। সমকালীন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় যার অধিকাংশই আজ আর সহজলভ্য নয়। সে-সব দুর্লভ পত্রিকার জরাজীর্ণ পাতার অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা অক্ষয়-সৃষ্টিকে বিস্মৃতির অন্তরাল থেকে উদ্ধার করে সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রেরণায় এ গ্রন্থের আবির্ভাব।

বাংলাদেশের রাজশাহি বরেন্দ্র গবেষণা কেন্দ্রের অন্যতম রূপকার অক্ষয়কুমার বিখ্যাত হয়ে আছেন নবাব সিরাজদ্দৌল্লার অন্ধকূপ হত্যা সংক্রান্ত কলঙ্ক মোচনে। কিন্তু এর বাইরেও উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন উদ্ধার, বৌদ্ধ সভ্যতা ও সংস্কৃতিচর্চা, আবিষ্কৃত লেখ পাঠোদ্ধার করে অতীত ইতিহাসের স্বরূপ উন্মোচন, ইতিহাসে বাঙালির গৌরবময় ও বলদীপ্ত উপস্থিতির চিত্র চিত্রণে তিনি যে উজ্জ্বল প্রতিভার সাক্ষ্য রেখেছিলেন আজ ক-জনই বা সে-কথা মনে রেখেছে? বাঙালি বিস্মৃত জাতি বলে খেদোক্তি শোনা গিয়েছিল সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের কণ্ঠে। তাঁর আক্ষেপ যথার্থ। নানা জনের সার্ধশতবছর উদযাপনের তুর্যনাদে যখন চারদিক মুখরিত তখন অক্ষয়কুমার থেকে যান সাধারণের দৃষ্টির অন্তরালে। ক্ষতি আমাদের। তবে সে-ক্ষতি যাতে অপূরণীয় হয়ে না-ওঠে সেজন্য তাঁর কিছু প্রবন্ধ ও চিঠিপত্র উদ্ধার করে একত্রিত করা হল দুই মলাটের ভেতর।

অক্ষয়কুমারের বাংলা ভাষায় রচিত প্রবন্ধ তালিকা প্রথম প্রণয়ন করেন ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। পরবর্তীকালে ফজলুল হক বিরোচিত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় শীর্ষক জীবনী গ্রন্থে বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় তাঁর রচিত প্রবন্ধাবলির আরেকটি তালিকা পাওয়া যায়। এ ছাড়া অশোক উপাধ্যায় সাময়িকপত্রে প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাসচর্চা পথিকৃৎ প্রবন্ধপঞ্জি-তেও অক্ষয়কুমারের রচনাপঞ্জী অন্তর্ভুক্ত করেছেন। বর্তমান গ্রন্থ প্রণয়নে এসব তালিকার ঋণ অনস্বীকার্য। জাতীয় গ্রন্থাগার, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, বিধানচন্দ্র গ্রন্থাগার, রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচারের গ্রন্থাগার এবং নৈহাটি বঙ্কিম ভবন গবেষণা কেন্দ্র থেকে সংকলনভুক্ত রচনাগুলি আহৃত। তাই এই সারস্বত প্রতিষ্ঠানগুলির কর্তৃপক্ষ ও কর্মীবৃন্দের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা সীমাহীন।

- বিজ্ঞাপন -

প্রয়োজনীয় মুহূর্তে উপযুক্ত পরামর্শ ও উৎসাহ দিয়ে যিনি এ কাজ ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করেছেন, আমার শিক্ষাগুরু অধ্যাপক নিখিলেশ গুহকে এই সুযোগে সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করি। উপযুক্ত নির্দেশ দানে বাধিত করেছেন অধ্যাপক অলোক রায়। তিনি আমার প্রণম্য। সর্বোপরি যার সহৃদয়তা ও সহযোগিতা ব্যতিরেকে এ সংকলনের গ্রন্থে উত্তরণ সম্ভব হত না, সেই পারুল প্রকাশনীর কর্ণধার গৌরদাস সাহাকে জানাই সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ। একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে আজ থেকে শতবর্ষ পূর্বে বাঙালির ইতিহাস রচনার একটি যথার্থ দর্পণ হিসেবে সুধী পাঠকবর্গ এ গ্রন্থকে গ্রহণ করলে আমাদের উদ্দেশ্য সার্থক জ্ঞান করব।

ভূমিকা

বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসে ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দ স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। ওই বছরে বাংলার জনজীবনে একঝাঁক জ্যোতিষ্কের আবির্ভাব ঘটে, যারা নিজ মনীষায় ভাস্বর করেছিলেন পারিপার্শ্বিক জগৎকে। এ তালিকায় যেমন আছেন রবীন্দ্রনাথের মতো কবি, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো বৈজ্ঞানিক তেমনি আছেন নীলরতন সরকারের মতো প্রথিতযশা চিকিৎসক, অক্ষয়কুমার মৈত্রয়ের মতো সাহিত্যিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক যাঁকে রবীন্দ্রনাথও বাঙালি লেখকগণের শীর্ষস্থানীয় বলে সম্মান জানিয়েছিলেন।(১) বাঙালির ইতিহাস রচনার সূচনা ইংরেজদের হাতে হলেও ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতীয় অনুসন্ধিৎসা স্বদেশের ইতিহাস রচনায় আত্মনিয়োগ করে। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে স্যার উইলিয়াম জোন্সের নেতৃত্বে এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ভারত-ইতিহাসচর্চার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়। সেই বুনিয়াদের ওপর সুমহান প্রাচ্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির পুনরাবিষ্কারের হর্ম নির্মাণের দায়ভার বহন করেন উইলসন, কোলক, প্রিন্সেপ, কানিংহাম, ম্যাক্সমূলার প্রমুখ। অতীতের গৌরবোজ্জ্বল ভারতবর্ষ পুনরাবিষ্কৃত হয় এঁদের প্রচেষ্টায়। সেই অতীত ইতিহাস যেকোনো পাশ্চাত্য সভ্যতা অপেক্ষা খর্ব নয়, এই প্রথম অনুধাবন করল ভারতবাসী। কিন্তু এরই পাশাপাশি জেমস মিল, উইলিয়াম ওয়ার্ড, মার্শম্যানের মতো এমন কতিপয় লেখকের আবির্ভাব হল যাদের সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও অহংদৃপ্ত লেখনী ভারতীয় সভ্যতাকে হীন প্রতিপন্ন করে পাশ্চাত্যের জয়গান গাইল। প্রতীচ্যের উন্নত সভ্যতার আলোকবর্তিকা প্রাচ্য ভারতের তমসার অবসান সূচিত করেছে এ বিশ্বাসে অটল এসব লেখকদের উন্নাসিক দৃষ্টিভঙ্গি ও এদেশীয় ইতিহাস সংস্কৃতির প্রতি অসূয়া মনোভাবপ্রসূত রচনা ভারতীয় মনীষাকে প্রণোদিত করে স্বভূমির ইতিহাসের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচনে। জাতীয় চেতনার সেই উষা লগ্নে ‘বাঙালির ইতিহাস নাই’ বলে বিলাপ শোনা গিয়েছিল বঙ্কিমচন্দ্রের কণ্ঠে। জাতির উদ্দেশ্যে তাঁর আহ্বান– ‘আইস আমরা সকলে মিলিয়া বাংলার ইতিহাস অনুসন্ধান করি’– অশিক্ষিত দেশের প্রজ্ঞাবানের হৃদয়কে আলোড়িত করে। শুরু হয় বাঙালির ইতিহাসচর্চার নতুন এক অধ্যায়।

ইতিপূর্বে নীলমণি বসাক, কেদারনাথ দত্ত-র মতো ব্যক্তিরা যাঁরা উপাদানের অপ্রতুলতাকে উপেক্ষা করে বাংলা ভাষায় দেশের পুরাবৃত্ত রচনার গুরুদায়িত্ব নিজ স্কন্ধে বহন করেছিলেন তাঁদের হাত ধরে বাঙালির ইতিহাসচর্চার যে ধারার সূচনা ঘটে, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর লেখনীমুখে তা আরও প্রশস্ত হয়। পরবর্তীকালে অক্ষয়কুমারের যুক্তিবাদী ইতিহাসচর্চার অবতারণা রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুরাতত্ত্ব অনুসন্ধান ও যদুনাথ সরকারের ইতিহাসের তথ্যনিষ্ঠ অনুসন্ধানের ইমানদারি সেই ধারারই অনুসারী।

বঙ্গদেশে যে কতিপয় ব্যক্তিবর্গ নিজ নামের প্রতি সুবিচার করে স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়েছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়। পিতা মথুরানাথ মৈত্রেয় ও মাতা সৌদামিনী দেবীর পুত্র অক্ষয়কুমারের জন্ম ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ১ মার্চ কুষ্ঠিয়া জেলার নওপাড়া থানার অন্তর্গত শিমুলিয়া গ্রামে।

অক্ষয়কুমারের পিতা মথুরানাথ তাঁর পিতা উমাকান্ত মৈত্রেয়র প্রথম পক্ষের সন্তান। ইনি ফরিদপুরের রুক্মিণী গ্রামে বসবাস করতেন। পরবর্তীকালে মথুরানাথের মাতা নীলকরের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে রুক্মিণী থেকে কুমারখালিতে আশ্রয় নেন। সেখান থেকেই মথুরানাথ ও তাঁর উত্তরসূরিরা কুমারখালির বাসিন্দা। বালক অক্ষয়কুমারের বিদ্যাশিক্ষার সূচনাও এখানে। সে-সময়ে কুমারখালিতে বাস করতেন সাহিত্যসেবক হরিনাথ মজুমদার যিনি কাঙাল হরিনাথ নামে বিখ্যাত। অক্ষয়কুমারের পিতা মথুরানাথ ও হরিনাথ ছিলেন আবাল্য বন্ধু। শিশু অবস্থায় অক্ষয়কুমারের বিদ্যাশিক্ষার দায়িত্ব তাই মথুরানাথ-হরিনাথের ওপরই বর্তে ছিল। এমনকি তৎকালীন প্রখ্যাত অক্ষয়কুমার দত্তের নাম অনুসারে মথুরানাথের পুত্রের নামকরণও করেন গ্রামবার্তা প্রকাশিকার এই সম্পাদক। কুমারখালিতে এসময়ে মথুরানাথ, হরিনাথ মজুমদার ও অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের উদ্যোগে বঙ্গ-শিক্ষা বিদ্যালয় স্থাপিত হয় যেখানে হরিনাথ শিক্ষকতা করতেন। এই বিদ্যালয়ে শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব, জলধর সেন প্রমুখের সঙ্গে অক্ষয়কুমারও হরিনাথের কাছে বিদ্যাভ্যাস শুরু করেন। সেদিক থেকে এরা তিনজনেই ছিলেন হরিনাথের মন্ত্রশিষ্য। বস্তুত সে-সময়ে হরিনাথের আদর্শে ও সহায়তায় রাজশাহির অনেকের হৃদয়েই সাহিত্যানুরাগ সঞ্চারিত হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে সুবক্তা পণ্ডিত শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব, সুললিত বর্ণনা নিপুণ জলধর সেন, সুসাহিত্যিক ও যুক্তিনিষ্ঠ ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় বঙ্গীয় সাহিত্য সমাজে নিজ প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন। বোধকরি অক্ষয়কুমারের উর্বর সাহিত্য মননে সৃষ্টিশীলতার প্রথম বীজ বপন করেছিলেন এই কাঙাল হরিনাথই। তাঁর সাহিত্য-পথের এই গুরুর কাছ থেকেই তিনি রচনাশিক্ষার প্রয়োজনীয় উপদেশ লাভ করেছিলেন।

- বিজ্ঞাপন -

বিদ্যাশিক্ষা অর্জনের প্রথম পাঠ কুমারখালিতে পেলেও ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে অক্ষয়কুমার বোয়ালিয়া-গভর্নমেন্ট স্কুলে ভর্তি হন ও সেখানেই তার ইংরেজি ও সংস্কৃত শিক্ষার আরম্ভ। সে-সময়ে এই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন চন্দ্রকুমার তর্কবাগীশ, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ও রামকুমার ভট্টাচার্য, যিনি পরবর্তীকালে স্বামী দয়ানন্দ ভারতী নামে খ্যাতি লাভ করেন। এঁদের সান্নিধ্যে সংস্কৃত শিক্ষায় অক্ষয়কুমারের জ্ঞান ও গভীরতা অর্জন করে। এখানে ভুললে চলবে না, অক্ষয়কুমারের পরিবারেও সংস্কৃতচর্চার এক ঐতিহ্য ছিল। তাঁর মাতামহ বৈদ্যনাথ বাগচী সংস্কৃত ও ফারসি ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। তাই এই দেবভাষার প্রতি অক্ষয়কুমারের যে অনুরাগ ও পারদর্শিতা পরবর্তীকালে প্রকাশ পেয়েছিল তা হয়তো তিনি মাতৃকুল থেকে উত্তরাধিকারী সুত্রে লাভ করেছিলেন। পণ্ডিতবর্গের সাহচর্য তাঁকে আরও পরিশীলিত করেছিল মাত্র। প্রাচীন বাংলার লিপিমালার পাঠোদ্ধারে তাঁর এই সংস্কৃত জ্ঞান বাঙ্ক্ষয় হয়ে ওঠে। গৌড়লেখমালার পাতায় পাতায় এই প্রতিভার দ্যুতি বিচ্ছুরিত হয়। যাইহোক ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে এই বোয়ালিয়া গভর্নমেন্ট স্কুল থেকেই প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি রাজশাহি কলেজে ভরতি হন। সেখান থেকে এফ এ পাস করে কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভরতি (১৮৮০) ও অবশেষে ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে বি এ পাস। অতঃপর রসায়ন ও বিজ্ঞানশাস্ত্রে এম এ করার জন্য প্রস্তুতি নিলেও শারীরিক অসুস্থতার কারণে কলকাতা পরিত্যাগ করেন। পরবর্তীকালে পিতার উৎসাহে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহি কলেজ থেকে আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ব্যবহারজীবীর বৃত্তি গ্রহণ করেন।

আইনব্যবসায়ে অক্ষয়কুমার সুনাম অর্জন করেছিলেন। তীক্ষ্ণবুদ্ধির বাস্তব প্রয়োগ দ্বারা যুক্তিতর্কে প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ইংরেজি জ্ঞানের পাণ্ডিত্য ও বাগ্মিতা ব্যবহারজীবী হিসেবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছিল। সিভিল ও ক্রিমিনাল–উভয় প্রকার মামলাতেই ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। বস্তুত বাগ্মিতায় অক্ষয়কুমারের ছিল জন্মগত অধিকার। বক্তৃতাশক্তির যে প্রকাশ তাঁর মধ্যে দেখা যায় তা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও চিত্তরঞ্জন দাশকে স্মরণ করায়। একদা তাঁর সহকর্মী ও অনুরাগী ভবানীগোবিন্দ চৌধুরি তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘ব্রাহ্মসমাজের মঞ্চে, ছাত্রদের সভায় ও নানা স্থানে নানা বিষয়ের বক্তৃতায় তিনি সকলকে মুগ্ধ করিয়াছেন। কংগ্রেসে তাহাকে বক্তৃতা করিতে শুনি নাই। যদি তিনি তাঁহার এই শক্তির বিকাশ কংগ্রেসের আদিস্থানে করিতেন, তাহা হইলে তাঁহার বাঙ্গালা ও ইংরেজি বক্তৃতার পূর্ণ বিকাশ ভারতব্যাপী হইত। ইংরেজি বাঙ্গলা উভয় ভাষায় এইরূপ সুললিত শব্দবিন্যাসে বক্তৃতা দিবার ক্ষমতা অধিক লোকের দেখি নাই। শ্ৰীযুক্ত বিপিনচন্দ্র পালের এই ক্ষমতা দেখিয়াছি, আর অক্ষয়বাবুর।’(২) বঙ্গদেশের পল্লিজীবনের স্বল্প পরিসরের মধ্যে অক্ষয়কুমারের জীবন অতিবাহিত হওয়ায় মুদ্রণযন্ত্রের প্রসাদগুণে কেবল তাঁর সাহিত্যপ্রতিভার পরিচয় বহির্জগতের ব্যক্তিবর্গ কয়েকটি গ্রন্থের মাধ্যমে পেয়েছিলেন বটে কিন্তু বাগ্মিতার পরিচয় তেমন লাভ করেননি। তাঁর সমসাময়িক রাজেন্দ্রলাল আচার্যের একটি মন্তব্য এ প্রসঙ্গে উদ্ধার করি। তিনি লিখেছেন, ‘যাহারা তাঁহাকে নিকট হইতে দেখিয়াছে তাহারা মনে করে যে তাঁহার লেখনী তাঁহাকে যে মান দিয়াছে, তাঁহার কণ্ঠ হয়তো তাহার অপেক্ষাও অনেক বেশি মান দিতে পারিত।’(৩) স্বদেশিযুগে তাঁর বাগ্মিতা বাঙালির হৃদয়-আবেগকে আলোড়িত করেছিল। বস্তুত অল্পবয়স থেকেই তিনি নানা সভাসমিতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। রাজশাহি ছাত্রসভা, কলিকাতা স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন, রাজশাহি অ্যাসোসিয়েশন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। দীর্ঘ সাত বছর শেষোক্ত সভার সম্পাদকও ছিলেন। পরবর্তীকালে রাজশাহি মিউনিসিপ্যালিটি, লোকাল বোর্ড, ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সভ্যরূপেও কাজ করেছেন। এসব সভাসমিতিতে নিজ বক্তব্য উপস্থাপন ও ওকালতি পেশার দাবি মতো বাচনভঙ্গিমা ও বক্তব্য উপস্থাপনের দক্ষতা অর্জন তাঁকে বাগ্মীতে পরিণত করে। বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি গৃহের শিলান্যাস অনুষ্ঠানে তাঁর মনোমুগ্ধকর বক্তৃতা উপস্থিত দর্শককুলের চোখে জল এনে দিয়েছিল। বহুদিন পরে স্মৃতির মণিকোঠায় অমলিন সে-ঘটনার কথা বলতে গিয়ে ভবানীগোবিন্দ চৌধুরি লিখেছেন, ‘আর্যসভ্যতা বর্ণনা করিয়া বক্তৃতা শেষে এই বরেন্দ্র অনুসন্ধান মন্দির সম্বন্ধে যে বলিয়াছিলেন, If it is God’s it will stand up for ever; if it is man’s it will fall, সে-কথা এখনও আমাদের কানে বাজিতেছে! যেমন ভাষা, তেমনি বাক্য-বিন্যাস, আর তেমনই প্রকাশ-মাধুর্য। আর্যসভ্যতার সে বর্ণনা শুনিয়া কত লোক কাঁদিয়া ফেলিয়াছিল– আমার বেশ স্মরণ আছে। তখন বাবু হেমচন্দ্র নিয়োগী ছিলেন এখানে সাবজজ। তিনি বক্তৃতা শুনিয়া বাহিরে আসিয়া বলিলেন তিনি কেঁদে ফেলেছেন, আর এমন বক্তৃতা কখন তিনি শুনেন নাই। সে বক্তৃতা আকাশে মিলাইয়া গিয়াছে–তাহা পাইবার উপায় নাই।’(৪)

ইতিহাসের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ তাঁকে ইতিহাস সমুদ্রে অবগাহন করতে প্ররোচিত করে। ব্যবহারজীবী হয়েও তাই অক্ষয়কুমার ইতিহাস ও সাহিত্যকে জীবনের সাধনা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর ইতিহাস আসক্তি এত তীব্র ছিল যে, দু-তিন দিন অনাহারে জ্বর গায়ে শয্যাশায়ী হয়ে থাকলেও ইতিহাস-পাঠ থেকে বিরত হননি। এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে বরং বলতেন, ‘উহাতে আমার কষ্ট হয় না, বরং জ্বরের গ্লানি কম হয়। তবে তাঁর এই ইতিহাস-অনুরাগ আকস্মিক নয়, ইতিহাস-প্রিয় পিতা মথুরানাথের উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রাপ্ত। এ ব্যাপারে রাজশাহির অপর বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব যদুনাথ সরকারের সঙ্গে তাঁর আশ্চর্য মিল। ভারত ইতিহাসের কলম্বাস এই ঐতিহাসিকের মধ্যে ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর পিতা রাজকুমার সরকার। পিতার স্মৃতিচারণায় তিনি জানিয়েছেন, ইতিহাস ছিল তাঁর (রাজকুমার সরকার) প্রিয় পাঠ্য। তিনি আমার বালক চিত্তে ইতিহাসের নেশা জাগিয়ে দেন।’(৫) সম্ভবত অক্ষয়কুমারের অন্তরেও ইতিহাসের বীজ প্রথম বপন করেছিলেন তাঁর পিতা। সরকারি কর্মী মথুরানাথ মৈত্রেয় ছিলেন ইতিহাসের উৎসাহী পাঠক। এ প্রসঙ্গে পিতার সম্পর্কে তাঁর ঐতিহাসিক পুত্র লিখেছেন, ‘ইতিহাসের প্রতি পিতার ন্যায় আমারও কেমন আন্তরিক অনুরাগ জন্মিয়াছিল।’(৬) বুঝতে অসুবিধা হয় না যে পিতার ইতিহাস অনুরাগ তাঁর এই উত্তরাধিকারীর মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল।

- বিজ্ঞাপন -

বাল্যকাল থেকে পিতার সাহচর্যে যে আগ্রহ অঙ্কুরিত হয়েছিল, এফ এ ক্লাসে পড়ার সময় তা আরও পরিণতি লাভ করে। বিদেশি লেখকদের রচনার অভ্রান্ততা সম্পর্কে তাঁর মন সন্দিগ্ধ হয়ে উঠতে থাকে সেই সময় থেকেই। সেকালে মেকলে ও হেস্টিংসের গ্রন্থ ওই শ্রেণির পাঠ্য ছিল। সেই পাঠ গ্রহণকালে অক্ষয়কুমার কলেজের অধ্যক্ষ ও অধ্যাপক ডাউডিং সাহেবের সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হতেন। মেকলের বক্তব্য যে সত্যের অপলাপ মাত্র, তা তাদের বোঝাবার জন্য নানা তথ্য অনুসন্ধান করে যুক্তির বেড়াজাল বিস্তার করতেন। ফলে এ সময়ে তাঁর ইতিহাসচর্চা ও সত্যানুসন্ধান গভীরতা লাভ করে। পরবর্তী প্রায় পাঁচ দশকের অধিককাল তিনি এই অনুসন্ধানে ছিলেন নিরলস।

বাল্যে সপ্তম শ্রেণিতে পড়বার সময় গ্রে সাহেবের এলিজি-র বঙ্গানুবাদ করে রচনা-নৈপুণ্যের যে পরিচয় তিনি দিয়েছিলেন তাতে তাঁর সাহিত্য প্রতিভার প্রথম স্ফুরণ পরিলক্ষিত হলেও বঙ্গবিজয় কাব্য রচনার মধ্য দিয়েই সাহিত্যজগতে অক্ষয়কুমারের অনুপ্রবেশ। তখন তিনি নেহাতই প্রবেশিকা পরীক্ষার দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত বালকমাত্র। স্কুল-পাঠ্য ইতিহাস-গ্রন্থ পড়ে তাঁর অন্তরে জাগ্রত ভাবাবেগ এ রচনার প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। সপ্তদশ অশ্বারোহী সমভিব্যাহারে বক্তিয়ার খলজির বঙ্গ-বিজয়ের কাহিনি ভ্রান্ত প্রমাণ করতে প্রণোদিত হয়েছিলেন তিনি এ কাব্যে, যদিও রচনাটি প্রকাশিত হওয়ার পূর্বেই গৃহদাহে ভস্মে পরিণত হয়েছিল। পরবর্তীকালে পরিণত বয়সে অবশ্য তিনি এ সম্পর্কে তাঁর সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেছেন বক্তিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয়, লক্ষ্মণসেনের পলায়ন কলঙ্ক রচনায় ও রমাপ্রসাদ চন্দ প্রণীত গৌড়রাজমালা-র ভূমিকায়। তাঁর প্রথম গদ্য প্রবন্ধ ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস হরিনাথ মজুমদারের তাড়নাপ্রসূত।

অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র প্রথম ঐতিহাসিক-গ্রন্থ সমর সিংহ প্রকাশিত হয় ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে। ইতিহাসের দরবারে তেমন সমাদর লাভ না-করলেও এই রচনা সর্বসমক্ষে তাঁর ইতিহাসবোধকে উন্মোচিত করে। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় সিরাজদ্দৌল্লা (১৮৯৭), সীতারাম (১৮৯৮), মীরকাশিম (১৯০৬), গৌড়লেখমালা (১৯১২) ও ফিরিঙ্গি বণিক (১৯২২)। তবে এর মধ্যে যুক্তিবাদী ঐতিহাসিক ও সুসাহিত্যিক হিসেবে অক্ষয়কুমারকে যে গ্রন্থ পণ্ডিতমহলে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে তা সিরাজদ্দৌল্লা। রবীন্দ্রনাথ যখন সাধনা সম্পাদনা করছেন তখন। সিরাজদ্দৌল্লা ওই পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। পরে সাধনা-র প্রকাশ বন্ধ হয়ে গেলে সিরাজদ্দৌল্লা-র অবশিষ্টাংশ ভারতী-তে প্রকাশিত হয়। ঘটনার বিন্যাস, তথ্যের যুক্তিনিষ্ঠ বিচারবিশ্লেষণ ও রচনাশৈলীর দক্ষতায় যে মুনশিয়ানা এ গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছিলেন তা সমকালীন পণ্ডিত সমাজকে বিস্ময়াভূত করে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ সিরাজদ্দৌল্লা ও তার রূপকার সম্পর্কে ভারতী-তে লিখেছিলেন, ‘নিপুণ সারথী যেমন এককালে বহুঅশ্বযোজন করিয়া রথ চালনা করিতে পারে, অক্ষয়বাবু তেমনি প্রতিভাবলে এই বহুনায়ক সংকুল জটিল দ্বন্দ্ববিবরণকে আরম্ভ হইতে পরিণাম পর্যন্ত সবলে অনিবার্য বেগে ছুটাইয়া লইয়া গিয়াছেন।’

‘তাঁহার ভাষা যেরূপ উজ্জ্বল ও সরস, ঘটনাবিন্যাসও সেইরূপ সুসংগত, প্রমাণ বিশ্লেষণও সেইরূপ সুনিপুণ। যেখানে ঘটনা সকল বিচিত্র এবং নানাভিমুখী, প্রমাণ সকল বিক্ষিপ্ত, এবং পদে পদে তর্কবিচারের অবতারণা আবশ্যক হইয়া পড়ে সেখানে বিষয়টির সমগ্রতা সর্বত্র রক্ষা করিয়া তাহাকে ক্ষিপ্ত গতিতে বহন করিয়া লইয়া যাওয়া ক্ষমতাশালী লেখকের কাজ। বিশেষত প্রমাণের বিচারে গল্পের সূত্রকে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেয়, কিন্তু সেই সকল অনিবার্য বাধা সত্ত্বেও লেখক তাহার ইতিবৃত্তকে কাহিনির ন্যায় মনোরম করিয়া তুলিয়াছেন এবং ইতিহাসের চিরাপরাধী অপবাদগ্রস্ত দুর্ভাগা সিরাজদ্দৌল্লার জন্য, পাঠকের করুণা উদ্দীপন করিয়া তবে ক্ষান্ত হইয়াছেন।’(৭)

মুর্শিদাবাদে লব্ধ ও ইংরেজ সরকারের দপ্তরে রক্ষিত অনেক নথিপত্র থেকে আহৃত তথ্য ব্যবহারজীবীর যুক্তিতে জারিত হয়ে তবেই তা এ গ্রন্থে ইতিহাসের উপজীব্য হয়ে উঠেছে। সন্দেহ নেই বাংলা ভাষায় এ ধরনের যুক্তিনির্ভর ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছিলেন। তবে ভাষা, রচনা-নৈপুণ্য ও যুক্তিপূর্ণ বিশ্লেষণের প্রশংসা করেও ‘কিঞ্চিৎ উদ্যম সহকারে সিরাজের পক্ষ অবলম্বনের জন্য কবিগুরু অক্ষয়কুমারের বিরুদ্ধে ইতিহাস-নীতি লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছেন–’শান্তভাবে কেবল ইতিহাসের সাক্ষ্য দ্বারা সকল কথা ব্যক্ত না-করিয়া সঙ্গে সঙ্গে নিজের কিঞ্চিৎ অধৈর্য ও আবেগের সহিত প্রকাশ করিয়াছেন। সুদৃঢ় প্রতিকূল সংস্কারের সহিত যুদ্ধ করিতে গিয়া এবং প্রচলিত বিশ্বাসের অন্ধ অন্যায়পরতার দ্বারা পদে পদে ক্ষুব্ধ হইয়া তিনি স্বভাবতই এইরূপ বিচলিত ভাব প্রকাশ করিয়াছেন। কিন্তু ইহাতে সত্যের শান্তি নষ্ট হইয়াছে এবং পক্ষপাতের অমূলক আশঙ্কায় পাঠকের মনে মধ্যে মধ্যে ঈষৎ উদবেগের সঞ্চার করিয়াছে।’(৮) তৎসত্ত্বেও এটা অনস্বীকার্য যে সিরাজদ্দৌল্লা রচনায় তিনি যে নির্ভীকতা, স্বাধীনচেতা মানসিকতার ও যুক্তিনিষ্ঠ ইতিহাসবোধের পরিচয় দিয়েছিলেন সমকালীন ব্রিটিশ-ভারতে তা দুঃসাহসিকতার নামান্তর। তাই প্রকাশের অনতিকালের মধ্যে নব্যভারত পত্রিকার দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরি লিখেছিলেন, ‘অক্ষয়কুমার যে সাহসের সহিত ইংরাজ-কলঙ্ক ঘোষণা করিয়াছেন, তাহা এ দেশে দুর্লভ। আমরা ভীরু বাঙালি, সত্য কথা বলিবার সাহস আমাদের নাই বলিলেই হয়। অক্ষয়কুমার অসীম সাহসে, ধীরতা ও বিজ্ঞতার সহিত, সংযত লেখনী সাহায্যে সিরাজের জীবনী বিবৃত করিয়াছেন। তিনি এই গ্রন্থ প্রণয়নে যে সহৃদয়তা এবং স্বদেশানুরাগের পরিচয় দিয়াছেন, তাহা স্বর্ণাক্ষরে লিখিয়া রাখিবার যোগ্য।’(৯)

অক্ষয়কুমারের সিরাজদ্দৌল্লা ইংরেজের মনে বীতরাগ সৃষ্টি করে। এ গ্রন্থ পাঠে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পত্ৰ ক্ৰোধ প্রকাশ করেছিল। তখন রবীন্দ্রনাথ অক্ষয়কুমারের পাশে দাঁড়িয়ে ভারতী পত্রিকায় তাঁর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন এভাবে : ‘শ্ৰীযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্র মহাশয়ের সিরাজদ্দৌল্লা পাঠ করিয়া কোনো অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পত্র ক্রোধ প্রকাশ করিয়াছেন। স্বজাতি সম্বন্ধে পরের নিকট হইতে নিন্দোক্তি শুনিলে ক্রোধ হইতেই পারে। সমূলক হইলেও।’ শুধু তাই নয় সকৌতুকে লিখেছিলেন, ‘আমাদিগকে বিদেশি লিখিত নিন্দোক্তি বাধ্য হইয়া অধ্যয়ন করিতে হয়, তাহা মুখস্থ করিয়া পরীক্ষা দিতে হয়। কিন্তু অক্ষয়বাবুর সিরাজদ্দৌল্লা কোনো কালে সম্পাদক মহাশয়ের সন্তানবর্গের পাঠ্যপুস্তকরূপে নির্ধারিত হইবার সম্ভাবনা দেখি না।’(১০) ব্রিটিশ-ভারতে প্রাচ্য-চরিত্র, শাসননীতি সম্পর্কে ইংরেজি গ্রন্থে ছোটো-বড়ো অসংখ্য কটুক্তির ছড়াছড়ি শিক্ষিত ভারতবাসীর মনে অপমানবোধজনিত ক্ষোভের সঞ্চার ঘটায় যা তাকে দেশে ব্রিটিশের অপকর্ম ও নিষ্ঠুরতার স্বরূপ উন্মোচনে প্রণোদিত করে। সিরাজদ্দৌল্লা সেই প্রচেষ্টারই ফলশ্রুতি। কবিগুরু তাই বন্ধু ঐতিহাসিকের পাশে দাঁড়িয়ে ইঙ্গ-সমালোচকদের প্রত্যুত্তর দিয়েছিলেন এই বলে– ‘অক্ষয়বাবু যে অন্ধকূপ হত্যার সহিত গ্লেনকার হত্যাকাণ্ড ও সিপাহি বিদ্রোহকালে অমৃতসরের নিদারুণ নিধন ব্যাপারের তুলনা করিয়াছেন ইতিহাস বিকৃতিস্থলে তাহা অপ্রাসঙ্গিক হইতে পারে এবং ইংরেজ সমালোচকদের তপ্রতি ত্ৰু দ্ধ কটাক্ষপাতও সংগত হইতে পারে কিন্তু আমরা ইহাকে নিরর্থক বলিতে পারি না।’

রবীন্দ্রনাথ ও অক্ষয়কুমারের এই বন্ধুত্ব আকস্মিক নয়। উভয়ের সখ্যতার শুরু ঊনবিংশ শতকের শেষের বছরগুলিতে। ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় হয়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর লোকেন্দ্ৰনাথ পালিতের আহ্বানে রবীন্দ্রনাথ ওই বছর নভেম্বর মাস নাগাদ রাজশাহি যান। এ যাত্রায় তাঁর সঙ্গী ছিলেন প্রমথ চৌধুরি। রাজশাহিতে তাঁরা দিন পনেরো লোকেন্দ্র পালিতের আতিথ্য গ্রহণ করেন। সাহিত্যরসিক এই জেলাশাসককে কেন্দ্র করে সে-সময়ে রাজশাহিতে এক সাহিত্যচক্র গড়ে উঠেছিল। সেখানেই অক্ষয়কুমারের সঙ্গে রবি ঠাকুরের প্রথম পরিচয়।(১১) ক্রমশ সেই পরিচিতির উত্তরণ ঘটে বন্ধুত্বে। রাজশাহিতে থাকাকালে নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায় ও সম্ভবত অক্ষয়কুমারেরও অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ রাজশাহি অ্যাসোসিয়েশনের(১২) উদ্যোগে আয়োজিত এক সভায় ‘শিক্ষার হেরফের’ নামক তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধটি পাঠ করেন। ওই অনুষ্ঠানে শিক্ষা সংক্রান্ত এক আলোচনারও আয়োজন করা হয় যেখানে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে অক্ষয়কুমারও আলোচনার অংশ নিয়েছিলেন। গ্রন্থগত শিক্ষার সঙ্গে চরিত্রগত শিক্ষার সম্মিলনের ওপর গুরুত্ব আরোপের পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। আধুনিককালের উপযোগী চরিত্র শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা ব্যক্ত করেছিলেন তাঁর ‘শিক্ষা সমস্যা’ প্রবন্ধে। শুধু পুথিগত বিদ্যা যে মানুষের শিক্ষাকে পূর্ণতা দিতে পারে না, বিংশ শতকের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি তা উপলব্ধি করেছিলেন। আর এজন্য ‘বিদ্যালয়গুলির সম্পূর্ণ রূপ পরিবর্তনের সুপারিশ করেছিলেন।(১৩) সন্দেহ নেই একবিংশ শতকেও শিক্ষা সংক্রান্ত তার এরূপ চিন্তাভাবনা সমানভাবে প্রযোজ্য।

স্বদেশপ্রেম ও স্বাজাত্যপ্রীতি যেমন অক্ষয়কুমারকে ইতিহাস অনুসন্ধানে ব্রতী করেছিল তেমনি স্বদেশি শিল্প গড়ে তুলতে উৎসাহী করেছিল। তাঁর এই আগ্রহ থেকেই ১৩০৪ বঙ্গাব্দ নাগাদ রাজশাহি জেলার সদর রামপুর-বোয়ালিয়ায় গড়ে তোলেন এক রেশম বিদ্যালয়– লক্ষ্য ছিল ভারতের সুমহান রেশম শিল্পের পুনরুজ্জীবন। এখানে রেশমবস্ত্র উৎপাদন প্রণালী সম্পর্কে শিক্ষাদানের পাশাপাশি চলত বস্ত্র উৎপাদন। স্বয়ং অক্ষয়কুমার এখানে অধ্যাপনা করতেন। লোকবলের সীমাবদ্ধতা ও উৎপাদন-সামর্থ্যের স্বল্পতা সত্ত্বেও স্বদেশ-শিল্প-অনুরাগ ছিল এ প্রতিষ্ঠানের প্রাণশক্তি। রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে অবস্থানকালে এই শিল্প-বিদ্যালয়টি সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এর কাজকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে নিজ ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় বস্ত্র এখান থেকে ক্রয় করতেন এবং বন্ধুদেরও উপহার দিতেন। এ প্রসঙ্গে ত্রিপুরার কর্নেল মহিমচন্দ্র ঠাকুরকে প্রেরিত এক পত্রে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য উদ্ধার করি– ‘মহারাজার জন্য সর্বানন্দের হস্তে একটি সাদা রেশমের থান উপহার পাঠাইলাম… আপনার জন্য রাজশাহি শিল্প-বিদ্যালয় হইতে মটকার থান প্রস্তুত হইয়া আসিয়াছে উপহার পাঠাইব… শিল্প-বিদ্যালয়কে উৎসাহ দিবার জন্য সেখান হইতে আমি সর্বদাই রেশমের বস্ত্রাদি ক্রয় করিয়া থাকি– দোষের মধ্যে লোক ও সামর্থ্য অল্প হওয়াতে তাহারা শীঘ্র ও অধিক পরিমাণে কাপড় জোগাইতে পারে না–বন্ধুদের নিকট আমার এই সকল বস্ত্র উপহার নহে তাহা স্বদেশের উপহার। অতএব আশা করি আপনারা তুচ্ছ বলিয়া ইহাকে অনাদর করিবেন না।

অক্ষয়কুমারের এই রেশম শিল্পোদ্যোগ রবীন্দ্রনাথকেও প্রভাবিত করে। শিলাইদহে তিনি রেশম চাষ শুরু করেন। অক্ষয়কুমার হন তাঁর এ যাত্রার সারথি। তবে আক্ষেপের বিষয় স্বদেশি শিল্পের পৃষ্ঠপোষক এই দুই বান্ধবের সে প্রয়াস বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেনি। তবু স্বদেশ-হিতৈষণার যে দৃষ্টান্ত তাঁরা দেখিয়েছিলেন তা পরবর্তী অনেককে অনুপ্রাণিত করেছিল। স্বদেশি যুগে এই প্রেরণা বাংলার শিল্পক্ষেত্রে পাথেয় হিসেবে কাজ করেছিল।

এ দেশে আধুনিক ইতিহাসচর্চার প্রয়াস শুরু ইংরেজ আমলা ও ঐতিহাসিকদের হাত ধরে। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত স্টুয়ার্টের হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল, টডের রাজস্থান (১৮২৯), হোবার্ট কন্টারের রোমান্স অফ হিস্ট্রি– ইন্ডিয়া (১৮৩৬) ছিল সেই উদ্যোগের ফলশ্রুতি। এইসব গ্রন্থগুলিকে ভিত্তি করেই পরবর্তী দীর্ঘদিন বাংলায় ইতিহাসচর্চার ধারা অব্যাহত ছিল। এমনকি মাতৃভাষায় গল্প-উপন্যাস রচনা করতে গিয়ে এদেশীয় লেখকগণও এইসব ইতিহাসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন এবং সত্য-মিথ্যার বিচার-বিবেচনা না-করেই ব্রিটিশ বর্ণিত ইতিহাসকে উপজীব্য করে গল্প-উপন্যাস রচনা করেন। এ তালিকায় ভূদেব মুখোপাধ্যায়ও যেমন আছেন, তেমনি বঙ্কিমচন্দ্রও আছেন। নিজের ইতিহাস-রসনাকে পরিতৃপ্ত করতে ভূদেব মুখোপাধ্যায় নির্ভর করেছিলেন কেন্টারের রোমান্স অফ হিষ্ট্রি-র ওপর, তেমনি বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনার জন্য দ্বারস্থ হন স্টুয়ার্ট টডের কাছে। বাঙালির ইতিহাস নেই বলে খেদ শোনা গিয়েছিল বঙ্কিমের কণ্ঠে। ব্রিটিশ প্রভাব মুক্ত হয়ে জাতির প্রকৃত ইতিহাস রচনার প্রয়োজনীয়তা প্রথম সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেছিলেন এই সাহিত্যসম্রাট– ‘বাঙলার ইতিহাস আছে কি? সাহেবরা বাঙলার ইতিহাস সম্বন্ধে ভূরিভূরি গ্রন্থ লিখিয়াছেন। স্টুয়ার্ট সাহেবের বই, এতবড়ো ভারি বই যে ছুড়িয়া মারিলে জোয়ান মানুষ খুন হয়, আর মার্শম্যান, লেথব্রিজ প্রভৃতি চুটকিতালে বাঙলার ইতিহাস লিখিয়া অনেক টাকা রোজগার করিয়াছেন; কিন্তু এ সকলে বাঙলার ঐতিহাসিক কোনো কথা আছে কি? আমাদিগের বিবেচনায় একখানি ইংরেজি গ্রন্থেও বাঙলার প্রকৃত ইতিহাস নাই। বাঙলার ইতিহাস চাই নহিলে বাঙালি কখনো মানুষ হইবে না।’(১৪) এই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে বাঙলায় ইতিহাসচর্চার রুদ্ধ বাতায়নকে প্রথম খুলে দেন রাজেন্দ্রলাল মিত্র তাঁর বিবিধার্থ সংগ্রহ প্রকাশ করে। অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে এ পত্রিকায় ঐতিহাসিক প্রবন্ধাবলিও প্রকাশিত হতে থাকে। ভুললে চলবে না অক্ষয়কুমার দত্তের তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাও প্রাচীন হিন্দুগণের সমুদ্রযাত্রা বা ‘ভারতবর্ষের সহিত অন্যান্য দেশের পূর্বকালীন বাণিজ্য বিবরণ’-এর মতো প্রবন্ধ প্রকাশ করে মাতৃভাষায় ইতিহাসচর্চার দৃষ্টান্ত রেখেছিল। তবে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গদর্শন-এর প্রকাশ এই ধারায় গতিবেগের সঞ্চার ঘটায়। আরও পরে রবীন্দ্রনাথ সাধনা ও ভারতীতে ঐতিহাসিক প্রবন্ধ প্রকাশ করে সেই ধারা অব্যাহত রাখেন। তবে কেবল ইতিহাসকে বিষয় করে কোনো পত্রিকার প্রকাশ তখনও পর্যন্ত ঘটেনি। এ ব্যাপারে প্রথম এগিয়ে আসেন অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়।

কাঙাল হরিনাথের গ্রামবার্তা-প্রকাশিকা সম্পাদনার মাধ্যমে পত্রিকাজগতে তাঁর হাতেখড়ি। লর্ড লিটনের সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত বিধিনিষেধের কড়াকড়ি শুরু হলে হরিনাথকে অব্যাহতি দিয়ে জলধর ও প্রসন্নচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে অক্ষয়কুমার এ পত্রিকার প্রকাশনার গুরুভার নিজ স্কন্ধে বহন করেছিলেন। বাঙালির ইতিহাস লিখতে হলে তাঁর বিবরণ সংকলনের প্রয়োজন। এই তাগিদ থেকে ও রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে তিনি ইতিহাস সংক্রান্ত একটি পত্রিকা প্রকাশে উদ্যোগী হন। নাম দেন ঐতিহাসিক চিত্র। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে পত্রিকাটি আবির্ভাবের পূর্বে এর উদ্দেশ্য ও আদর্শ নিয়ে একটি প্রস্তাবপত্র মুদ্রিত আকারে প্রকাশ করে বিভিন্ন ব্যক্তি, সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রের দপ্তরে পাঠানো হয়। প্রস্তাবপত্রটি সম্পর্কে ভারতী পত্রিকায় বিস্তারিত আলোচনা করে রবীন্দ্রনাথ অক্ষয়কুমারের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান, আশা প্রকাশ করেন যে পরের মুখে নিজেদের ইতিহাসের কথা না-শুনে ভারতের প্রকৃত ইতিহাস উদ্ধার এবার বুঝি সম্ভব হবে। তিনি লেখেন, ‘হৌক বা না-হৌক আমাদের ইতিহাসকে আমরা পরের হাত থেকে। উদ্ধার করিব। আমাদের ভারতবর্ষকে আমরা স্বাধীন দৃষ্টিতে দেখিব, সেই আনন্দের দিন আসিয়াছে। আমাদের পাঠকবর্গকে লেথব্রিজ সাহেবের চটির মধ্য হইতে বাহির করিয়া ইতিহাসের উন্মুক্ত ক্ষেত্রের মধ্যে আনিয়া উপস্থিত করিব; এখানা তাহারা নিজের চেষ্টায় সত্যের সঙ্গে সঙ্গে যদি ভ্রমও সংগ্রহ করেন সেও আমাদের পক্ষে পরিলিখিত পরীক্ষা পুস্তকের বিদ্যা অপেক্ষা অনেক গুণে শ্রেয়, কারণ সেই স্বাধীন চেষ্টার উদ্যম আর একদিন সেই ভ্রম সংশোধন করিয়া দিবে। কিন্তু পরদত্ত চোখের ঠুলি চিরদিন বাঁধা রাস্তায় ঘুরিবার যতই উপযোগী হউক, পরীক্ষার ঘানিবৃক্ষের তৈলনিষ্কাশনকল্পে যতই প্রয়োজনীয় হৌক নূতন সত্য অর্জন ও পুরাতন ভ্রম বিবর্জনের উদ্দেশ্যে অব্যবহার্য।’(১৫) আর অক্ষয়কুমারের এই মহৎ উদ্দেশ্যকে সপ্রশংস লেখনীতে বলেন, ‘বাঙলা সাহিত্যে আজকাল ইতিহাসের চর্চা বিশেষরূপে প্রবল হইয়া উঠিয়াছে তাহার অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। অতএব বিক্ষিপ্ত উদ্যমগুলিকে একত্র করিয়া একখানি ঐতিহাসিকপত্র বাহির করিবার সময় উপস্থিত হইয়াছে। উপযুক্ত সম্পাদক উপযুক্ত সময়ে এ কার্যে অগ্রসর হইয়াছেন ইহা আমাদের আনন্দের বিষয়।’(১৬)

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস অনুসন্ধানে অক্ষয়কুমারের উৎসাহ ছিল সীমাহীন। প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইতিহাসের স্বরূপ উদঘাটন ও সেজন্য প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহ ছিল তাঁর আগ্রহের বিষয়। স্বাভাবিকভাবেই সেই আগ্রহের প্রতিফলন ঘটেছিল নবপ্রকাশিত এই পত্রিকায়। সম্পাদকীয়তে তিনি ঐতিহাসিক চিত্রের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাই জানিয়েছিলেন, ‘ঐতিহাসিক চিত্র কোনো ব্যক্তি বা সম্প্রদায় বিশেষের মুখপত্র হইবে না, ইহা সাধারণত ভারতবর্ষের এবং বিশেষত বঙ্গদেশের, পুরাতত্ত্বের উপকরণ সংকলনের জন্যই যথাসাধ্য যত্ন করিবে। সে উপকরণের কিয়দংশ যে পুরাতন রাজবংশে ও জমিদার বংশেই প্রাপ্ত হওয়া সম্ভব, তাহাদের সহিত এদেশের ইতিহাসের ঘনিষ্ঠ সংশ্রব। সুতরাং, প্রসঙ্গক্রমে তাহাদের কথারও আলোচনা করিতে হইবে। যাঁহারা আধুনিক রাজা বা জমিদার তাঁহাদের কথা নানা কারণে ভবিষ্যতের ইতিহাসে স্থান প্রাপ্ত হইবে। সে ভার ভবিষ্যতের ইতিহাস-লেখকের হস্তে রহিয়াছে। ঐতিহাসিক চিত্র-র সহিত তাহার কিছুমাত্র সংশ্রব নাই– পুরাতত্ত্ব সংকলন করাই ইহার একমাত্র উদ্দেশ্য।’(১৭)

রবীন্দ্রনাথ ঐতিহাসিক চিত্র-র প্রথম সংখ্যার সূচনা লিখে দিয়েছিলেন। এ ধরনের উদ্যোগের ফল কেবল পাণ্ডিত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। অতীতের স্থান ও গৌরব মনোজগৎকেও আলোড়িত করে দেশের মানসিক বদ্ধ জলাশয়ে অনুরূপ স্রোতের সঞ্চার ঘটাবার আশাকে জাগ্রত করে। স্বদেশি কারখানার সঙ্গে এর তুলনা টেনে তাই কবি লিখেছিলেন, ঐতিহাসিক চিত্র ভারতবর্ষের ইতিহাসের একটি স্বদেশি কারখানা স্বরূপ খোলা হইল। এখনো ইহার মূলধন বেশি জোগাড় হয় নাই। ইহার কলেবরও স্বল্প হইতে পারে, ইহার উৎপন্ন দ্রব্যও প্রথম প্রথম কিছু মোটা হওয়া অসম্ভব নহে, কিন্তু ইহার দ্বারা দেশের যে গভীর দৈন্য, যে মহৎ অভাব মোচনের আশা করা যায়, তাহা বিলাতের বস্তা বস্তা সূক্ষ্ম ও সুনির্মিত পণ্যের দ্বারা সম্ভবপর নহে।’(১৮) রবীন্দ্রনাথ পত্রিকাটির দীর্ঘায়ু কামনা করেছিলেন। সে জন্য প্রয়োজনে অর্থ-সাহায্য করার ব্যাপারেও উদ্যোগী হয়েছিলেন। গগনেন্দ্রনাথকে লেখা তাঁর এক পত্রে ঐতিহাসিক চিত্র-এর চাঁদার জন্য তদবির করার দৃষ্টান্ত তাই অস্বাভাবিক মনে হয় না।(১৯) বস্তুত এ সময়ে অক্ষয়কুমার ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে যে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল তা পরস্পরকে নিকটতর করে। ঐতিহাসিক যেমন কবির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন, রবীন্দ্রনাথও তেমনি তাঁকে সাদরে আপ্যায়ন করতেন। কবি-পুত্র রথীন্দ্রনাথ তাঁর আত্মকথায় জানিয়েছেন, সে-সময়ে ঠাকুরবাড়িতে যারা নিয়মিত যাতায়াত করতেন অক্ষয়কুমার তাঁদের অন্যতম।

অক্ষয়কুমার কেবল ঐতিহাসিকই নন, সুসাহিত্যিকও বটে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাষা-সৌকর্যের গুণকীর্তন করে ‘ক্ষমতাশীল লেখক’ বলে তাঁকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। কাব্য রচনার মধ্য দিয়ে সাহিত্যজগতে যার পদার্পণ সুললিত ভাষা ও সৃষ্টিশীলতার নিরিখে তিনি যে অনন্যসাধারণ হবেন তা বলাই বাহুল্য। তাঁর সাহিত্য-রসজ্ঞান ও কবিত্বশক্তির প্রকাশ মেলে অক্ষয়কুমার বড়াল বিরচিত কনকাঞ্জলি কাব্যের ভূমিকাতে, রবীন্দ্রনাথের কথা, কণিকা কাব্যের সমালোচনায় ও সংস্কৃত নাট্যসাহিত্যের বিশেষত্ব আলোচনায়। কনকাঞ্জলি-র ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, ‘কবিবর অক্ষয়কুমার এই যুগের একজন সুকবি। তাঁহার রচনায় কৃত্রিমতা নাই, আন্তরিকতা আছে। তাঁহার ভাবের আকাশে কুঙ্কুটিকা নাই, শরৎ কৌমুদী আছে– তাঁর পদবিন্যাস কৌশলে বড়ম্বর নাই, সুশ্লীল সরলতা আছে। এষার কবি অক্ষয়কুমারের নাম সুপরিচিত। কিন্তু এযা সে কবিপ্রতিভার স্বর্ণমন্দির, তাহার কনকাঞ্জলি প্রভৃতি অন্যান্য কাব্য তাহারই সুবিন্যস্ত সুবর্ণসোপান।… আমি অনেকদিন হইতেই অক্ষয় গীতিকাব্যের পক্ষপাতী। তাঁহার এক-একটি কবিতা হিরার টুকরার মতো ঝলমল করে অল্প পরিসরের মধ্যে অনেক কথা মনের মধ্যে জাগাইয়া কাব্যমোদীগণকে বিমল কাব্যানন্দে পূর্ণ করিয়া দেয়। কবি শিক্ষক ও সংস্কারক, কবি দেশ-সেবক ও দেশ-নায়ক। কবি সাধক ও উত্তরসাধক। অক্ষয় গীতিকাব্যে ইহার অনেক পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়।

কাব্য নয়, চিত্র নয়, প্রতিমূর্তি নয়,
ধরণী চাহিছে শুধু হৃদয়-হৃদয়।
(শঙ্খ)

যে কবি ধরণীর এই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করিতে পারেন, তিনি যথার্থ কবি পদবাচ্য। অক্ষয়কুমার হৃদয়বান বলিয়াই তাঁহার গীতিকাব্যে এমন স্পষ্ট অভিব্যক্তি হইয়াছে।…এই গ্রন্থের সকল কবিতাই পৃথক কবিতা, তথাপি সকলগুলির মধ্যেই একটি ভাবের অনুবন্ধ দেখিতে পাওয়া যায়। সে ভাবের প্রবাহ স্বচ্ছ ও অনাবিল, তাহাতে গতি আছে, আবর্ত নাই, উচ্ছ্বাস আছে, তরঙ্গ নাই, সংযম আছে উচ্ছঙ্খলতা নাই। এই গুণে অক্ষয় গীতিকাব্য অলক্ষিতভাবে পাঠক হৃদয়ে সমবেদনার উদ্রেক করে। তাহা কখনও চিত্তকে উদাস করিয়া দেয়, কিন্তু কদাপি তীব্র কামগন্ধে ক্লিষ্ট করে না। তাঁহার প্রেমে লালসা নাই, আত্মবিসর্জন আছে। যাহা স্থায়ী রূপ, তাহাই কাব্যের প্রকৃত রস। সেই রসে অক্ষয় গীতিকাব্য চিরঅভিষিক্ত।’(২০)

কাব্য-রস-সুধা অনুধাবনে যাঁর এই জ্ঞানগাম্ভীর্য বাত্ময় হয়েছিল তিনি যে কাব্যপ্রতিভার আধার হবেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সাধে রবীন্দ্রনাথ তাঁর শক্তিশালী লেখনী সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত হননি। অক্ষয়কুমার ঐতিহাসিক হলেও সাহিত্য ছিল তাঁর বাহন। তাঁর অনুসন্ধানী চেতনা ইতিহাসের পথ পরিক্রমা করেছিল সাহিত্যের রথে চড়ে। প্রধানত বাংলা সাহিত্যকে উপজীব্য করে তিনি ইতিহাসের স্বরূপ উন্মোচনে ব্রতী হয়েছিলেন। ইংরেজি ও সংস্কৃত ভাষাজ্ঞান তাতে উপযুক্ত সংগত করেছিল। ‘রামায়ণ-এর রচনাকাল’, ‘সাহিত্য ও ব্যাকরণ’, ‘কবিকল্পদ্রুম’, ‘দানসাগর’, ‘রাজতরঙ্গিণী’, ‘অব্যক্তানুকরণ’ প্রভৃতির মতো অসংখ্য প্রবন্ধ তাঁর সেই সাহিত্য প্রতিভার দ্যুতিতে দেদীপ্যমান। এই সাহিত্যানুরাগ থেকে উত্তরবঙ্গে সাহিত্য সাধনার একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার একান্ত ইচ্ছা ছিল তাঁর। পরিণামে তাঁরই উৎসাহে উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের সূচনা ঘটে এবং রঙপুরে অনুষ্ঠিত এর প্রথম অধিবেশনের শুভারম্ভ হয় তাঁরই সভাপতিত্বে।

অক্ষয়কুমার কেবল ঐতিহাসিক বা সাহিত্যিক ছিলেন না, উৎসাহী প্রত্নতাত্ত্বিক হিসেবেও নিজ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। উত্তরবঙ্গে ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহ অনুসন্ধান ও গবেষণার কাজকে উৎসাহিত করার জন্য দীঘাপাতিয়ার রাজকুমার শরকুমার রায়, রমাপ্রসাদ চন্দ ও অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় নিরলস প্রচেষ্টায় ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে গড়ে তোলেন বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি। তাঁদের অক্লান্ত অধ্যবসায় ও দুর্দমনীয় ইতিহাস-অনুরাগ অনতিকালের মধ্যেই এই প্রতিষ্ঠানকে বরেন্দ্র-গবেষণার ক্ষেত্রে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। এ প্রসঙ্গে ভবানীগোবিন্দ চৌধুরির একটি মন্তব্য উদ্ধার করি : রাজশাহিতে যাহা কিছু অক্ষয়, তাহাতেই অক্ষয়কুমার ছিলেন। এখানকার পাবলিক লাইব্রেরি, এখানকার কলেজ, এখানকার বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি এখানকার টাউন হল– সব তাতেই তাঁহার প্রভাব কিছু-না কিছু আছে। তাঁহার অক্লান্ত চেষ্টা না-হইলে বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি এত অল্পসময়ের মধ্যে এত উন্নতি করিতে পারিত কিনা সন্দেহ। তাঁহার যুক্তি, তাঁহার বুদ্ধি, তাঁহার গবেষণা, তাঁহার পরিচালনা বরেন্দ্র রিসার্চের উন্নতির প্রাণ বলিলে অত্যুক্তি হইবে না।’(২১) এই গবেষণা কেন্দ্রের উদ্যোগে উত্তরবঙ্গের ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পন্ন স্থানে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে একাধিক অনুসন্ধানমূলক সফরের আয়োজন করা হয়। বয়সে প্রবীণ হলেও এই অনুসন্ধান যাত্রায় অক্ষয়কুমারের উৎসাহ ছিল নবীনের ন্যায়। গোরুরগাড়িতে, পদব্রজে ও হাতির পিঠে যাতায়াত, স্বল্প আহার বা অনাহার কিছুই এসময়ে তাঁকে নিরুদ্যম করতে পারেনি। সেসব যাত্রাপথের বিবরণ ধরা আছে তাঁর বরেন্দ্র-ভ্রমণ, বিজয়নগর, তপনদীঘি প্রভৃতি রচনায়। অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাঁরা বহুঅজ্ঞাতপূর্ব প্রত্নক্ষেত্র ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন উদ্ধারে সক্ষম হন যার কিছু কিছু বর্ণনা মেলে ‘বরেন্দ্র-খনন-বিবরণ’, ‘উত্তরবঙ্গের পুরাতত্ত্ব সংগ্রহ’, ‘বাঙ্গালির-জীবন-বসন্তের স্মৃতি-নিদর্শন’ প্রভৃতি প্রবন্ধে। আবিষ্কৃত নিদর্শন উপযুক্ত সংরক্ষণের জন্য ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটির ব্যবস্থাপনায় প্রতিষ্ঠিত হয় বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম। উভয় প্রতিষ্ঠানের প্রাণপুরুষ ছিলেন অক্ষয়কুমার। সন্দেহ নেই, দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি তাঁর এই সুদক্ষ সারথির কুশল পরিচালনায় প্রাচীন বাংলার ইতিহাসের অনেক নতুন পথ পরিক্রমা করেছিল। তাঁদের সেই অনুসন্ধানলব্ধ জ্ঞান ও ভূতপূর্ব ঐতিহাসিক তথ্য একত্রে সন্নিবিষ্ট করে গৌড় বিবরণ নামক গ্রন্থমালা রচনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। সম্পাদনার দায়িত্ব পড়ে অক্ষয়কুমারের ওপর। যার প্রথম ফসল গৌড়রাজমালা। রমাপ্রসাদ চন্দ প্রণীত এ গ্রন্থের ভূমিকা রচনা করেন অক্ষয়কুমার স্বয়ং এবং দ্বিতীয় গ্রন্থ গৌড়লেখমালা সংকলনের দায়ভারও নিজ স্কন্ধে বহন করেন তিনি।

রাজশাহির অপর বিখ্যাত ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারের মতো তিনিও ইতিহাস রচনায় বৈজ্ঞানিক পন্থা অবলম্বনের পক্ষপাতী ছিলেন। রাজেন্দ্রলাল মিত্র যেমন ঐতিহাসিক উপাদানের বিশ্লেষণ ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুসন্ধানের ভিত্তিতে ইতিহাস রচনার ওপর জোর দিতেন অক্ষয়কুমারও তেমনি ইতিহাস রচনার ভিত্তি হিসেবে প্রয়োজনীয় উপাদান সংকলনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। বাড়ি বসে ইতিহাস রচনার বিলাসিতা পরিত্যাগ করে প্রত্নক্ষেত্ৰ-খনন, লভ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহ ও পরীক্ষানিরীক্ষার ভিত্তিতে ইতিহাস-রচনার যৌক্তিকতাকে তিনি অপরিহার্য জ্ঞান করতেন। এ ব্যাপারে বঙ্কিমের মতো তাঁরও কণ্ঠে আক্ষেপ শোনা গিয়েছিল গৌড়রাজমালা-র উপক্রমণিকায়। সাহিত্য সম্রাটের প্রসঙ্গ অবতারণা করে সেখানে তিনি লিখেছিলেন, ‘বঙ্কিমচন্দ্র লিখিয়া গিয়াছেন, ‘গ্রিনলন্ডের ইতিহাস লিখিত হইয়াছে; মাওরি-জাতির ইতিহাসও আছে; কিন্তু যে দেশে গৌড় তাম্রলিপ্তি-সপ্তগ্রামাদি নগর ছিল, সে দেশের ইতিহাস নাই।’ উপাদানের অভাবকে ইহার প্রকৃত কারণ বলিয়া স্বীকার করা যায় না; অনুসন্ধান-চেষ্টার অভাবই প্রধান অভাব৷’(২২)

আর এ অভাব পূরণে নিজেই বেরিয়ে পড়তেন মাটি চাপা পড়ে থাকা ধবংসস্তূপের সন্ধানে। ফলে উদ্ধার হয়েছিল এমন সব প্রত্নক্ষেত্র ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন যা প্রাচীন বাংলার ইতিহাস রচনায় সহায়ক হয়। যে বঙ্গদেশ পর্বতশূন্য সমতল ভূমিতে অবস্থিত ছিল, সেখানে পাষাণ-প্রাসাদের অস্তিত্ব ব্যক্তি-প্রচেষ্টার পরিণাম বলেই মনে হয়। কালের কপোলতলে তা যখন ইতিহাসের গর্ভে বিলীন হয়ে যায় তখন তার ধবংসাবশেষের শেষ খণ্ডও উপেক্ষণীয় নয়। তা যেমন অতীত সভ্যতার শিল্প সুষমার পরিচয়বাহী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তেমনি ঐতিহাসিকের হাতে পড়ে হয়ে ওঠে ইতিহাসের সত্য উদঘাটনের শেষ-সম্বল। তাই প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহাসিকের তাগিদ থেকে অক্ষয়কুমার অনুভব করেছিলেন, ‘সে কালের বাঙালির প্রকৃত পরিচয় লাভ করিতে হইলে, পাষাণ-পরিচয় উদঘাটিত করিবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করিতে হইবে; তাহা অধুনা বিস্মৃত, অপরিজ্ঞাত উপেক্ষিত–কিন্তু তাহা চিরস্মরণীয় হইবার উপযুক্ত।’(২৩) এ ব্যাপারে সরকারি উদাসীনতা তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। তাই খেদের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, সরকারি পুরাতত্ত্ববিভাগ যেমন ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশে খনন কার্যের সূত্রপাত করিয়া, ভূগর্ভ নিহিত নানা নিদর্শন উদঘাটিত করিয়া আসিতেছেন, বঙ্গদেশে কুত্রাপি এ পর্যন্ত সেরূপ খনন কার্যের সূত্রপাত করেন নাই।’ বৌদ্ধ-কীর্তির স্মৃতিবিজড়িত পাহাড়পুর সম্পর্কে অক্ষয়কুমারই প্রথম সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরবর্তীকালে সরকারি উৎসাহে রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকারের নেতৃত্বে সেখানে খননকার্য শুরু হয়। বঙ্গদেশে খননকার্যের এটাই প্রথম উদ্যোগ দ্র. পাহাড়পুর।

আহৃত উপাদানকে যুক্তির কষ্টিপাথরে বিচার করে ন্যায়নিষ্ঠ বিচারপতির মতো নিয়ত সত্য উদঘাটন করাই ঐতিহাসিকের প্রধান কর্তব্য বলে অক্ষয়কুমার মনে করতেন। দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকারের সঙ্গে এ ব্যাপারে তার আশ্চর্য মিল ছিল।(২৪) ভাণ্ডারকারের মতো তিনিও ব্যক্তিগত, জাতিগত, সম্প্রদায়গত সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে নিরপেক্ষ স্বাধীন চিন্তাপ্রসূত বিচার ধারায় ইতিহাস রচনার কথা বলেছেন। জনশ্রুতি নির্ভর ইতিহাস তাঁর মতে প্রকৃত ইতিহাস পদবাচ্য হবার যোগ্য নয়। কেননা সেক্ষেত্রে ঐতিহাসিক বিচার প্রণালী মর্যাদা লাভ করে না।(২৫) লক্ষ্মণ সেনের পলায়ন কলঙ্ক ও হলওয়েলের মস্তিষ্কপ্রসূত অন্ধকূপ হত্যা কাহিনির দ্বারা বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব চরিত্রের কালিমা লেপনের অপচেষ্টাকে যুক্তিবানে অপনোদন করে লক্ষ্মণ সেন ও সিরাজ চরিত্রকে কলঙ্কমুক্ত করার অক্ষয়কুমারের প্রচেষ্টার মধ্যে সেই চেতনাই বাষ্ময় হয়ে ওঠে (দ্র. ‘লক্ষ্মণ সেনের পলায়ন কলঙ্ক’ ও ‘অন্ধকূপ হত্যা’)। সিরাজদ্দৌল্লার কলকাতা জয়ের পর (১৬ জুন, ১৭৫৬) ফোর্ট উইলিয়ামের ইংরেজ বন্দিদের (১৪৬ জন) একটি অপ্রশস্ত ঘরে সারারাত বন্ধ করে রেখেছিলেন। প্রভাতে সামান্য কয়েকজন (২৩ জন) মাত্র প্রাণ হাতে করে বার হতে পেরেছিলেন। সমকালীন ইংরেজ কর্মচারী হলওয়েল ‘অন্ধকূপ হত্যা’ নামে এই কাহিনি প্রচার করে পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছিলেন। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মার্চে ক্যালকাটা হিস্টোরিক্যাল সোসাইটির উদ্যোগে আয়োজিত এক সভায় অক্ষয়কুমার এ কাহিনির অসারত্ব প্রমাণ করেন। এ ব্যাপারে তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘বাঙলার ইতিহাসের প্রধান দুর্ভাগ্য সকল যুগেই সমানভাবে বর্তমান, — সকল যুগেই তাহা বিজেতার বিদ্বেষপূর্ণ বিকৃত লেখনী হইতে প্রসূত হইয়াছে — কোনো যুগেই দেশের লোকে দেশের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করিবার আয়োজন করেন নাই।(২৬)

আর এই স্বাধীন চিন্তা ও যুক্তিনিষ্ঠতার কারণেই গৌড়রাজমালা রচনায় জনশ্রুতির ওপর নির্ভর না-করে কেবল প্রাপ্ত লেখমালা বা তাম্রশাসনের ওপর নির্ভরতাকেই শ্রেয় জ্ঞান করেছিলেন। এক-এক যুগের বহুসংখ্যক লেখমালার অধ্যয়ন ওই যুগের প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটনে সহায়ক হয়ে থাকে। সে জন্য প্রাচীন বাংলার ইতিহাস রচনায় শিলালেখ বা তাম্রলেখ তাঁর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। তবে লেখমালায় বর্ণিত ঘটনা যে সর্বদা অভ্রান্ত সে ব্যাপারেও প্রকৃত ঐতিহাসিকদের মতো তিনি সন্দেহ পোষণ করতে কুণ্ঠিত হননি। লেখ থেকে আহৃত তথ্য অন্যান্য উপাদান থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনার মধ্য দিয়েই তাঁর সন্ধানী-মনন প্রকৃত ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে চাইত। বাংলায় পাল ও সেনযুগের ইতিহাসের অনুসন্ধানে তিনি এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে এ সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, ‘অষ্টম হইতে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সমগ্র উত্তরাপথে (মগধে ও উড়িষ্যায় তো বটেই) গৌড়ীয় পাল সাম্রাজ্যের প্রভাব বর্তমান থাকায়, সমগ্র উত্তরাপথের ভাষায়, রচনায়, শিল্পে ও লোকাঁচারে গৌড়ীয় প্রভাব প্রাধান্য লাভ করে।’(২৭)

কীর্তিমান বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যে আস্থাশীল অক্ষয়কুমারের ইতিহাসবোধ এ জাতির কলঙ্কমোচনে নিবেদিত হয়েছিল। তাঁর সমগ্র ইতিহাসচর্চার মধ্যে অন্তর্হিত এই মূল সুরটি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর নয়। রবীন্দ্রনাথ ক্ষীণকায় বাঙালির হীনবল চরিত্রের কথা যেখানে বলেছেন, রাজশাহির এই ঐতিহাসিক সেখানে বাঙালির বলদীপ্তি ও তেজস্বিতার ছবি এঁকেছেন। তাঁর জাতীয়তাবাদী চেতনা এক্ষেত্রে হয়তো সক্রিয় হয়েছিল ঠিকই কিন্তু সমকালীন পরিপ্রেক্ষিতে এ জাতীয় চেতনার অনিবার্যতাও উপেক্ষণীয় নয়। তাই রবীন্দ্রনাথও তাঁর ইতিহাসবোধকে সম্মানিত করেছিলেন এই বলে– ‘বাংলার ইতিহাসে তিনি যে স্বাধীনতার যুগ প্রবর্তন করিয়াছেন সেজন্য তিনি বঙ্গসাহিত্যে ধন্য হইয়া থাকিবেন।’ (ভারতী, ১৩০৫ ভাদ্র)।

ইতিহাসের সত্য-স্বরূপ উন্মোচনকে যিনি জীবনের ধ্রুব লক্ষ্য হিসেবে স্থির করেছিলেন জাগতিক বিষয়-আশয়ের প্রলোভন যে তাঁকে প্রলুব্ধ করতে ব্যর্থ হবে সেটাই স্বাভাবিক। স্বার্থপ্রণোদিত হয়ে কোনো এক বিখ্যাত পুস্তক ব্যবসায়ী এক লক্ষ টাকার বিনিময়ে দেশের মর্যাদাকে লঙ্ঘিত করে কারো স্বার্থে বিদ্যালয়ের উপযুক্ত পাঠ্যপুস্তক রচনার প্রস্তাব অক্ষয়কুমারকে দিলে তিনি নির্দ্বিধায় তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, ‘আত্মবিক্রয় করিয়া স্বদেশের অসত্য ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ করা তাঁহার অসাধ্য। ঐতিহাসিক সত্য উদঘাটন করাই তাহার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।(২৮)

শিল্পশাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অক্ষয়কুমারকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস অনুধাবনে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছিল। আবিষ্কৃত শিল্প-নিদর্শনের মূল্য কী, সমগ্র ভারত শিল্পে তার স্থানই বা কোথায় সে ব্যাপারে ঐতিহাসিক হিসেবে তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না। কেবল শিল্পের পথ ধরে ইতিহাসের আঙিনায় উপনীত হতে চেয়েছিলেন তিনি। বাংলার প্রাচীন ভাস্কর্য শিল্পকলায় তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল বিস্ময়কর। ভারত-শিল্প ও তার ইতিহাস সম্পর্কিত একাধিক প্রবন্ধে তাঁর সেই প্রতিভার সাক্ষ্য স্পষ্ট। প্রাচীন ভারতে যারা অক্ষরের পর অক্ষর সাজিয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন তারাই কেবল কবি ছিলেন না। যারা বাটালি চালিয়ে পাষাণের বুকে ছবি ফুটিয়েছেন তাঁরাও কবিপদবাচ্য হবার যোগ্য। পাল-নরপালগণের আমলে আবির্ভূত এমনই এক ভাস্কর-কবি হলেন ধীমান, যার ভাস্কর্ব বাংলার প্রান্তসীমা অতিক্রম করে নেপাল, তিববত, চিন, মঙ্গোলিয়া, কোরিয়া ও জাপানে প্রসারিত হয়ে পড়ে। ‘ধীমানের ভাস্কর্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে তাঁর শিল্পপ্রতিভা ও বরেন্দ্র-ভাস্কর্যের ঐশ্বর্য লিপিবদ্ধ করেছেন অক্ষয়কুমার। বস্তুত মূর্তি-শিল্প সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিল অগাধ, এমনকি স্থপতিবিদ্যার প্রাচীন ভারতীয় নিয়ম-রীতি সম্পর্কে সংস্কৃতশাস্ত্রে উল্লেখিত জ্ঞানও তিনি আয়ত্ত করেছিলেন। গৌড় ও মগধে প্রাপ্ত শিল্প নিদর্শনগুলির আলোচনায় প্রতিমা শিল্পের বহুমুখী নতুন সত্যের আবিষ্কারের মূলসূত্রগুলি তিনিই প্রথম নির্দেশ করেন। গৌড়ীয় শিল্পরীতি যে মগধ ও উৎকলের শিল্প সৃষ্টিকে বিকশিত করে যবদ্বীপে পরিণতি লাভ করে– এ বিশ্বাসে তিনি ছিলেন অটল২৯, তাই গৌড়-শিল্পের নিদর্শনগুলি সুরক্ষিত করার উদ্দেশ্যে সেগুলি সংগ্রহে যত্নবান হন। এজন্য কোনো বাধাই যেন তাঁর কাছে বাধা ছিল না। আর এই দুর্দমনীয় মনোভাবের ছাপ রয়েছে তাঁর লেখায়– ‘গৌড়-শিল্পের নিদর্শনগুলি নানা দেশে চলিয়া যাইতেছে বলিয়া আমরা তাড়াতাড়ি সংগ্রহ করিয়া রাখিতেছি… ইহার জন্য আমরা অনাহারে অকথ্য ক্লেশে নানা স্থানে যাতায়াত করিয়া ম্যালেরিয়াগ্রস্ত হইয়াছি।’ (দ্র. অর্ধেন্দুকুমার গাঙ্গুলিকে প্রেরিত অক্ষয়কুমারের পত্রাবলি)। গৌড় শিল্পরীতি ও তার ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর গবেষণা, পাণ্ডিত্য যে কীরূপ গভীরতা লাভ করেছিল তা শিল্প বিশেষজ্ঞ অর্ধেন্দ্রকুমার গঙ্গোপাধ্যায়কে প্রেরিত চিঠিপত্রে স্পষ্ট। শুধু স্থাপত্য-ভাস্কর্য শিল্পকলাই নয় ‘ভারত-চিত্রচর্চা’, ‘ভারত চিত্রচর্চার নববিধানের অন্তর বাহির’ প্রভৃতি প্রবন্ধে এ দেশের চিত্রকলার বিশিষ্টতা সম্পর্কে তিনি যেরূপ আলোকপাত করেছেন তা কেবল তার পক্ষেই সম্ভব।

নাট্যসাহিত্য ও নাট্যাভিনয় ছিল অক্ষয়কুমারের অন্যতম আগ্রহের বিষয়। প্রাচীন ভারতের নাট্যাভিনয়, নাট্যসাহিত্য সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান গভীরতা অর্জন করে। পৃথিবীর অন্যত্র ভারতীয় নাট্যশালার ন্যায় প্রাচীন নাট্যশালার অস্তিত্ব সম্পর্কে তিনি সন্দিগ্ধ ছিলেন। প্রাচীন ভারতের নাট্যশৈলী, নাট্যসাহিত্য ও নাট্যাভিনয় সম্পর্কিত একাধিক প্রবন্ধে তাঁর এই শৈল্পিক সত্তার প্রকাশ লক্ষ করা যায়। অতীত ভারতে নাট্যাভিনয়ের রীতি-পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি নাট্যাভিনয়, নাট্যশাস্ত্র সংজ্ঞক প্রবন্ধ রচনা করেন। নাট্যসাহিত্য সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা পরিলক্ষিত হয় ‘নাট্য-সাহিত্য’, ‘সংস্কৃত নাট্যসাহিত্যের বিশেষত্ব’ ‘নাট্যবিচার’ প্রভৃতি প্রবন্ধ সমূহে। শুধু তাই নয়, ভারতীয় নাট্যসাহিত্য গ্রিকনাট্যের ছায়া বলে যখন বিদেশি লেখকদের রচনায় প্রতিভাত হয়, অক্ষয়কুমার তার বিরোধিতায় অবতীর্ণ হন, তথ্য ও যুক্তিনিষ্ঠ বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভারতীয় নাটকের প্রাচীনত্ব ও বিশেষত্ব প্রমাণ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘ভারতীয় নাট্যসাহিত্যের প্রকৃতি ও রুচি বিচার করিলে, তাহার সর্বাঙ্গে কেবল ভারতীয় বিশেষত্বই লক্ষ করা যায়। গ্রিকনাট্যের অনুকরণে ভারতীয় নাট্যসাহিত্য সম্ভুত হইলে, এত বিচিত্রতা প্রকাশ করিতে পারিত না। এই বিচিত্রতা ভারতবর্ষের জনসাধারণের বিশেষ প্রকৃতি ও বিশেষ রুচির উপযোগী; পাশ্চাত্য সাহিত্যে এরূপ রুচি বর্তমান ছিল না। ভারতীয় নাট্যসাহিত্য যে সেকালে কেবল ভারতবর্ষেই প্রচলিত ছিল, তাহা বোধ হয় না। ভরত বিরচিত নাট্যশাস্ত্রে দেখা যায়, ভারতবর্ষের বাহিরে বাহ্রীকাদি রাজ্যেও ভারতীয় নাট্যগ্রন্থের অভিনয় সম্পাদিত হইত।… অধ্যাপক ওয়েবর ভারতীয় নাট্যসাহিত্যের বহিঃপ্রকৃতির আলোচনা করিয়াই নিরস্ত হইয়াছেন; অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলে, তাহাকে গ্রিকনাট্যের অনুকৃতিমাত্ৰ বলিতে কদাচ সাহসী হইতেন না।’(৩০)

নাটক সম্পর্কে কেবল আলোচনা, বক্তৃতা বা প্রবন্ধ রচনার মধ্যেই অক্ষয়কুমার তাঁর উদ্যমকে সীমায়ত রাখেননি। নাট্যাভিনয়েও তিনি ছিলেন সমান উৎসাহী। নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য দিনরাত এককরে মঞ্চসজ্জা, চিত্রের পরামর্শ, স্টেজ-তৈরি প্রভৃতি সমস্ত ব্যাপারে তিনি ছিলেন ক্লান্তিহীন। তাঁরই প্রচেষ্টার রাজশাহিতে সর্বপ্রথম সংস্কৃত নাটকের অভিনয় শুরু হয় এবং শকুন্তলা ও বেণীসংহার নাটক দুটি মঞ্চস্থ হয়। শুধু তাই নয় আশা ও আবাহন নামে দুটি নাটকও তিনি রচনা করেছিলেন। দুঃখের কথা তা অপ্রকাশিত রয়ে যায়।

ব্যবহারজীবী হিসেবে জীবন শুরু করলেও অক্ষয়কুমার ঐতিহাসিক হিসেবেই নিজ প্রতিভার সার্থক বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে শুধু ইতিহাসচর্চাই নয়, কী সাহিত্য, কী প্রত্নতত্ত্ব, কী শিল্পকলা, কী নাট্যশাস্ত্র সর্বক্ষেত্রে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ও সৃষ্টিশীলতা সার্ধশতবছর পরেও তাঁকে বাঙালিমানসে অক্ষর করে রেখেছে। সেদিক থেকে তিনি সত্যিই সার্থকনামা। তাঁর প্রতিভার স্বীকৃতি স্বরূপ ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘কাইজার-ই-হিন্দ’ সুবর্ণপদক (১৯১৫) ও. সি. আই. ই. উপাধিতে সম্মানিত করেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ ১৩১১ বঙ্গাব্দে তাঁকে সহ সভাপতি ও ১৩১৮ বঙ্গাব্দে বিশিষ্ট সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করে। অক্ষয়কুমারের রচনাপ্রবাহ মূলত বঙ্গসাহিত্যের উর্বরভূমিতে প্রবাহিত হলেও ইংরেজিতে তাঁর প্রবন্ধের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। দীর্ঘকাল ধরে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আচার্য প্রবোধচন্দ্র সেনের(৩১) মতো বিশিষ্টজনেরা তাঁর অগ্রন্থিত রচনাসমূহ দুই মলাটের মধ্যে একত্রিত করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। ‘সাহিত্যলোক’ কর্তৃক প্রকাশিত ও দীনেশচন্দ্র সরকার সম্পাদিত গৌড় সংক্রান্ত ও শিল্প সম্বন্ধীয় প্রবন্ধাবলি দুটি পৃথক গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হওয়া সেই তাগিদেরই ফসল। তবে গ্রন্থ দুটিতে অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধাবলি হিমশৈলের দৃশ্যমান উপরিভাগ মাত্র। বাংলার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় অক্ষয়কুমারের প্রায় দুই শতাধিক প্রবন্ধাবলি ছড়িয়ে রয়েছে। এই সংকলনে সেই বিপুল রত্নসম্ভারের কিয়দংশ একত্রিত করার আয়োজন প্রয়াস পেয়েছে এবং ভবিষ্যতে অবশিষ্টাংশ উদ্ধারের বাসনা সেই প্রয়াসের প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। অক্ষয়কুমারের প্রতিভা বহুমুখী, স্বভাবতই রচিত প্রবন্ধাবলিও বহুকেন্দ্রিক। এ যেন সৃজনধর্মী জীবনে চলার পথে পেছনে ফেলে যাওয়া সৃষ্টিশীলতার স্বাক্ষর, অক্ষয়কুমার নামক জীবনসভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। সেই নিদর্শন সমূহকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হওয়ার পূর্বেই উপযুক্ত সংরক্ষণের তাগিদ থেকেই এ সংকলনের আবির্ভাব। ভাবগত ঐক্য ও বিষয়-সূত্রের টানে অক্ষয়কুমারের প্রবন্ধগুলি এ গ্রন্থে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে মাত্র। বঙ্গদেশ ও জাতি হিসেবে বাঙালির প্রকৃতি, আদর্শ সম্পর্কিত অক্ষয়কুমারের দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যাবে বঙ্গভূমি ও বাঙ্গালী শীর্ষক অংশে। বৌদ্ধধর্ম, বুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান, বৌদ্ধ পর্যটক সম্বন্ধীয় একাধিক রচনায় বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে তাঁর আগ্রহের পরিচয় মেলে। এ সম্পর্কিত প্রবন্ধাবলি তাই জায়গা নিয়েছে ‘বৌদ্ধধর্ম’ শিরোনামে। পুরাবস্তু সম্পর্কিত রচনাগুলিকে ‘পুরাতত্ত্ব’ অংশে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাংলায় পাল ও সেন যুগের ইতিহাসচর্চায় অক্ষয়কুমার দীর্ঘকাল অতিবাহিত করেছেন, এজন্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহ ও লেখমালার তাৎপর্য অনুধাবনে অক্লান্ত পরিশ্রমও করেছেন। তাঁর সেই পরিশ্রমলব্ধ গবেষণার ফসলগুলিকে ‘বঙ্গে তুর্কি আক্রমণ’, এবং ‘তাম্রশাসন’ শীর্ষনামের অধীনে রাখা হয়েছে। বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটির উদ্যোগে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের উদ্ধারে একাধিক অনুসন্ধান সফরের আয়োজন করা হয়। অতীতের ইতিহাস উদ্ধারে আদর্শ প্রত্নতাত্ত্বিকের উদ্যম কষ্ট সহিষ্ণুতা ও অনুসন্ধিৎসার যে পরিচয় অক্ষয়কুমার রেখে গিয়েছেন তাঁর ভ্রমণ বর্ণনায় তার পরিচয় মিলবে ‘উত্তরবঙ্গের পুরাকীর্তি’ অংশে। ভারতীয় শিল্পের কথা নামক পুস্তকে ইতিপূর্বে শিল্প সম্বন্ধীয় তাঁর নিবন্ধগুলি প্রকাশিত। তাই ওই গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধগুলিকে এ সংকলনের বাইয়ে রাখা হয়েছে যদিও একই বিষয়কেন্দ্রিক অপর কয়েকটি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে ‘ভাস্কর্য ও চিত্রকলা’ সংজ্ঞক সারণিতে। সিরাজদ্দৌল্লা প্রকাশের পরেও অক্ষয়কুমার সিরাজ-সম্পর্কিত প্রবন্ধ রচনা থেকে বিরত হননি। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলার স্বাধীনতার সূর্যাস্ত ও ব্রিটিশরাজের সূর্যোদয়ের ইতিহাস সম্পর্কিত নিবন্ধগুলিকে স্থান দেওয়া হয়েছে ‘অষ্টাদশ শতকের বাংলা’ অংশে। রেশম-শিল্প সম্পর্কে এই ঐতিহাসিকের জ্ঞান আমাদের বিস্ময়ের সীমা অতিক্রম করে যায়। সে জ্ঞানের বিচ্ছুরণ ধরা আছে ‘বস্ত্র শিল্প’ নামক আধারে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত পাল সাম্রাজ্যের অধঃপতন সম্পর্কিত অক্ষয়কুমারের বক্তৃতা সংকলন করেন রমেশচন্দ্র মজুমদার। তাঁর সেই বাগ্মিতার ছবি পাওয়া যাবে ‘অভিভাষণ’ অংশে। এ ছাড়া সমকালীন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সম্পর্কে অক্ষয়কুমারের স্মৃতিচারণার পরিচয় মিলবে ‘জীবনকথা ও স্মৃতিচারণ বিভাগে। বন্ধুবর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও স্নেহধন্য শিল্প-বিশেষজ্ঞ অর্ধেন্দ্রকুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ পত্রালাপ চলেছিল। সে-সব চিঠিপত্র পরবর্তীকালে বিশ্বভারতী পত্রিকা ও প্রবাসী-তে প্রকাশিত হয়। পরিশিষ্ট অংশে পাঠক সে-সব পত্রাবলির রসাস্বাদনে সক্ষম হবেন। প্রায় একাশী বছর হল অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছেন (১০.২.১৮৩০)। বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন এই ঐতিহাসিকের মনন ও সৃষ্টিশীলতার জগতে প্রবেশ করে তাঁর মৃত্যুর এত বছর পর তাঁকে পুনরাবিষ্কারের চেষ্টায় সহায়তা করার তাগিদেই এ সংকলনের আবির্ভাব। সে উদ্দেশ্য যদি সামান্য পরিমাণেও সফল হয় তবে এই শ্রম সার্থক মনে করব।

রাজনারায়ণ পাল

তথ্যসূত্র :

১ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রসঙ্গকথা, ভারতী (বৈশাখ, ১৩০৫), ৯৩।

২ ভবানীগোবিন্দ চৌধুরি, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, ভারতবর্ষ (বৈশাখ, ১৩৩৭), ৮২৬।

৩ রাজেন্দ্রলাল আচার্য চৌধুরি, স্মৃতির পূজা। ( অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়), ভারতবর্ষ (জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৭), ৯৮৬।

৪ প্রাগুক্ত ৮২৬-৮২৭।

৫ যদুনাথ সরকার, আমার জীবনের তন্ত্র, প্রবাসী (পৌষ ১৩৫৫)।

৬ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, আত্মকথা। দ্র. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় (বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলকাতা), ১২।

৭ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সিরাজদ্দৌল্লা, প্রসঙ্গ কথা, ভারতী (জ্যৈষ্ঠ ১৩০৫), ১৪৬-১৪৭।

৮ প্রাগুক্ত। ৯নব্যভারত (ষোড়শ খণ্ড, বৈশাখ-চৈত্র, ১৩০৫), ২৮০৷ ১০ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রসঙ্গ কথা। ভারতী (শ্রাবণ ১৩০৫), ৩৬৬। ১১ প্রমথ চৌধুরি, আত্মকথা (বিশ্বভারতী পত্রিকা, ফাল্গুন ১৩৪৯), ৫১২। ১২ রাজশাহি অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন সভাপতি ছিলেন জগদিন্দ্রনাথ রায় এবং অন্যতম সদস্য অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়।

১৩ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, শিক্ষা সমস্যা, উৎসাহ (আশ্বিন-কার্তিক, ১৩০৮), ৩৫৪।

১৪ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বাঙ্গলার ইতিহাস সম্বন্ধে কয়েকটি কথা’, বিবিধ প্রবন্ধ, দ্বিতীয় খণ্ড।

১৫ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রসঙ্গ কথা, ভারতী (ভাদ্র ১৩০৫), ৪৭৬-৪৭৭।

১৬ প্রাগুক্ত, ৪৬৮।

১৭ ঐতিহাসিক চিত্র (১৮৯৯)-তে প্রকাশিত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় রচিত সম্পাদকের নিবেদন।

১৮ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সূচনা, ঐতিহাসিক চিত্র (১৮৯৯)।

১৯ গগনেন্দ্রনাথকে লেখা তারিখহীন এক চিঠিতে অক্ষয়কুমারের হয়ে চাঁদার জন্য রবীন্দ্রনাথ তাগাদা দিয়ে লিখছেন : ‘অক্ষয়বাবুর তাঁর ঐতিহাসিক চিত্র-র চাঁদার জন্যে আবার তাগিদ পাঠিয়েছেন। তাঁর ঠিকানায় টাকাটা পাঠিয়ে দিয়ো।’ দ্র, প্রশান্তকুমার পাল, রবিজীবনী, ৪র্থ খণ্ড, ২১৫।

২০ সজনীকান্ত দাস (সম্পা.) সম্পাদকীয় ভূমিকা’, অক্ষয়কুমার বড়াল গ্রন্থাবলি (কলিকাতা ১৩৬৩)।

২১ ভবানীগোবিন্দ চৌধুরি, প্রাগুক্ত ৮২৫। ২২ রমাপ্রসাদ চন্দ, গৌড়রাজমালা, উপক্রমণিকা (রাজশাহি ১৩১৯), ১০। ২৩ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, বরেন্দ্র খনন বিবরণ, সাহিত্য, ফাল্গুন ১৩২৩। ২৪ ভাণ্ডারকার ইতিহাস রচনার প্রণালী সম্পর্কে লিখেছেন : In dealing with all these materials (historical materials) one should proceed on such principles of evidence as are followed by a Judge. One must in the first place be impartial with no particular disposition to find in the materials before him something that will tend to the glory of his race and country, nor should he have an opposite prejudice against the country or its people. Nothing but dry truth should be his object. Collected Works of Sir R. G. Bhandarkar. Vol. I, p. 4.

২৫ রমাপ্রসাদ চন্দ, গৌড়রাজমালা, উপক্রমণিকা (রাজশাহি ১৩১৯), ১০।

২৬ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, লক্ষ্মণ সেনের পলায়ন-কলঙ্ক। প্রবাসী (মাঘ ১৩১৫), ৫৩৪।

২৭ অর্ধেন্দ্রকুমার গঙ্গোপাধ্যায়কে প্রেরিত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়-র পত্রাবলি, প্রবাসী (আষাঢ় ১৩৩৭)।

২৮ ক্ষিতীশচন্দ্র সরকার, আচার্য অক্ষয়কুমারের স্মৃতি-পূজা, প্রবাসী (চৈত্র ১৩৩৬), ৮২৬।

২৯ দ্র. পরিশিষ্ট-২ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়-র কয়েকখানি পত্র। ৩০ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, নাট্যবিচার, প্রবাসী (ফাল্গুন-চৈত্র ১৩০৮), ৪২৭।

৩১ প্রবোধচন্দ্র সেন, ইতিহাস-তপস্বী অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, দেশ (সাহিত্য সংখ্যা, ১৩৭৩), ১৫৯।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!