গণপরিবহনে ৬৩% নারীরা নানা ধরনের হয়রানির শিকার হন। এর মধ্যে যৌন হয়রানির শিকার হন প্রায় ৪৭% নারী। ভুক্তভোগীদের মধ্যে প্রায় ৪৫% পরবর্তী সময়ে মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হন। নিপীড়নকারীদের মধ্যে ৪০ বছরের বেশি বয়সীদের সংখ্যা বেশি।
শুক্রবার (৩ জুন) প্রকাশিত আঁচল ফাউন্ডেশনের “ঢাকা শহরে গণপরিবহনে হয়রানি: কিশোরী এবং তরুণীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব” শীর্ষক এক জরিপ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। জরিপে ১৩ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ৮০৫ নারী অংশ নেন।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮৬%। জরিপ শুরুর সময়ের ছয় মাস আগ পর্যন্ত হয়রানির মুখোমুখি হয়েছেন এমন নারীদের তথ্য যুক্ত করা হয়েছে। অফলাইন ও অনলাইনে জরিপ করা হয়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলা হয়। জরিপটি পরিচালনা করা হয় এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত।
জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যৌন হয়রানির মধ্যে রয়েছে গণপরিবহনে ওঠা-নামার সময় চালকের সহকারীর অযাচিত স্পর্শ, বাসে জায়গা থাকার পরও যাত্রীদের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো, বাজেভাবে স্পর্শ করা, ধাক্কা দেওয়া, বাজে মন্তব্য। জরিপে অংশগ্রহণকারী বেশির ভাগ নারী ঝামেলা এড়াতে এসব ঘটনার প্রতিবাদ করেননি।
আঁচল ফাউন্ডেশন জানায়, জরিপ প্রতিবেদনে রাজধানী ঢাকার বাস, ট্রেন, লেগুনা, রাইড শেয়ারিং ইত্যাদিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আজিমপুর, মিরপুর, গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি , বারিধারাসহ বিভিন্ন এলাকার স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং কর্মজীবী নারী ও কিছু সংখ্যক গৃহবধূর ওপর জরিপ পরিচালনা করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যৌন হয়রানির পাশাপাশি ১৫% বুলিং, ১৫% সামাজিক বৈষম্য, ১৫% লিঙ্গবৈষম্য এবং ৮% শারীরিক গঠন নিয়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন। কারা যৌন নিপীড়ন করেছে জানতে চাইলে জরিপে অংশ নেওয়া ৭৫% নারী জানিয়েছেন, তারা অন্য যাত্রীদের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হয়েছেন। ২০% চালকের সহকারী, ৩% হকার এবং ২% চালকের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
প্রায় ৬২% কিশোরী ও তরুণী জানিয়েছেন, ৪০ থেকে ৫৯ বছর বয়সীদের মাধ্যমে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। ৩৬% জানিয়েছেন, কিশোর ও যুবক অর্থাৎ ১৩ থেকে ৪৯ বছর বয়সীদের মাধ্যমে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। নারী যাত্রী ওঠানো-নামানোর সময় চালকের সহকারীদের নেমে দাঁড়ানোর কথা থাকলেও তারা বাসের দরজায় অবস্থান করে অযাচিতভাবে স্পর্শ করে বলে অভিযোগে এসেছে। প্রায় ৬১% নারী জানিয়েছেন, ওঠা-নামার সময় সহকারীরা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে স্পর্শ করেছে। প্রায় ২৫% নারী জানিয়েছেন, ছয় মাসে অন্তত তিনবার তাদের এ ধরনের স্পর্শের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
গণপরিবহনে কোন ধরনের যৌন হয়রানির শিকার বেশি হয়েছেন জানতে চাইলে জরিপে অংশগ্রহণকারী ৩১% কিশোরী ও তরুণী জানিয়েছেন, গণপরিবহনে অনেক সময় ফাঁকা জায়গা থাকলেও অন্য যাত্রীরা ইচ্ছাকৃতভাবে গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। ইচ্ছাকৃতভাবে হালকাভাবে স্পর্শের শিকার হয়েছেন ১৮%। ইচ্ছাকৃতভাবে ধাক্কার শিকার হয়েছেন ১৪%। প্রায় ১৪% কিশোরী-তরুণী জানিয়েছেন তারা বাজে মন্তব্যের শিকার হয়েছেন। হালকা ভিড়ে প্রায় ৩৩% এবং অতিরিক্ত ভিড়ে ২৭% যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। ঝামেলা এড়াতে বেশির ভাগ নারীই প্রতিবাদ করেননি।
অনুষ্ঠানে জরিপ প্রতিবেদনের তথ্য উপস্থাপন করেন আঁচল ফাউন্ডেশনের নির্বাহী সদস্য ফারজানা আক্তার। অনুষ্ঠানে অতিথির বক্তব্যে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান মো.ইসমাইল হোসাইন বলেন, জরিপে যা উঠে এসেছে তা উদ্বেগজনক। সমাজে জেন্ডার ভারসাম্য ও সমতার বিষয়টি যে নেই তা এ তথ্য থেকেই বোঝা যাচ্ছে। এ সমস্যার সমাধানের জন্য আইনি ও সামাজিকভাবে উপায় বের করতে হবে। সামাজিক উপায় হিসেবে সমাজে বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব দূর করতে সচেতনতা বাড়াতে হবে। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
অনুষ্ঠানে আইনজীবী শাইখ মাহদি বলেন, গণপরিবহনে নারী হয়রানি ও যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট কোনো আইনি প্রতিকার নেই। তবে দণ্ডবিধি এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের কিছু ধারায় এ ধরনের কিছু হয়রানির বিরুদ্ধে প্রতিকার পাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে অনেক নারী আরও হয়রানির ভয়ে বা আইনি ব্যবস্থা নিয়ে ছুটোছুটি করার ঝামেলা এড়াতে প্রতিবাদ করতে সাহসী হন না। নীরব থাকলে অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে।
তাই তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ, ৯৯৯ বা ১০৯ এ কল করে সাহায্য চাওয়া এবং আইনি ব্যবস্থা নিতে কিছু প্রমাণ জোগাড় করা যেমন মুঠোফোনে ভিডিও করা বা কথা রেকর্ড করে রাখার মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে পারেন নারীরা। এসব প্রমাণ উপস্থাপন করে ভ্রাম্যমাণ আদালতে বিচার পাওয়া যায়।
অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন আঁচল ফাউন্ডেশন এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ।