হালিমা হাসান আবদুল্লাহির দুই জমজ নাতনি এবলা ও আবদিয়ার কবরে এখনও রয়েছে কাঁটা গাছের ডালপালা। এক মাস আগে জন্ম নেওয়ার পর মাত্র একদিন বেঁচেছিল এবলা-আবদিয়া। তার পরই তাদের মৃত্যু হয়।
এই শিশুদের মৃত্যুর প্রধান কারণ তাদের মায়ের পুষ্টিহীনতা ও খাদ্যের অভাব। বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে হালিমা বলেন, ‘বাচ্চা দু’টির জন্মের সময় তাদের মা পুষ্টিহীনতায় ভুগছিল, আমার নাতনিদের মৃত্যুর মূল কারণ ক্ষুধা।’
দীর্ঘদিন ধরে চলা গৃহযুদ্ধ ও জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের অনুসারী আল-শাবাবের তৎপরতার কারণে গত কয়েক বছরে হাজার হাজার পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে পূর্ব আফ্রিকার দেশ সোমালিয়ায়। গ্রাম ছেড়ে বিভিন্ন শহরের অস্থায়ী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন তারা। হালিমা হাসান আবদুল্লাহির পরিবারও তেমনি একটি বাস্তুচ্যুত পরিবার। মাস দেড়েক আগে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ডলো শহরে এসে ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন হালিমা ও তার পরিবারের সদস্যরা।
এই সদস্যদের মধ্যে তার গর্ভবতী পুত্রবধুও ছিলেন। খাদ্যপণ্যের সংকট ও খাবারের মূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে গর্ভাবস্থায়ও খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে বাধ্য হয়েছেন হালিমার পুত্রবধু। তার পরিণতিতেই দুর্বল দুই শিশুর জন্ম দেন তিনি, যারা জন্মের পর বেঁচে ছিল মাত্র এক দিন।
ডলো শহরের যে ক্যাম্পটিতে তারা আশ্রয় নিয়েছেন, সেটি মাথা তুলেছে চলতি বছর জানুয়ারিতে। প্রায় ১৩ হাজার মানুষ বসবাস করেন এই শিবিরে।
টানা চার বছর ধরে বৃষ্টিপাত হচ্ছে না সোমালিয়ায়, কিংবা হলেও হচ্ছে একেবারেই কম। দেশটির আবহাওয়াবিদদের মতে, গত ৪০ বছরে এমন ভয়াবহ খরা দেখেনি সোমালিয়া।
পানির অভাবে দেশটির কৃষি ব্যাবস্থা প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে, বিপুল সংখ্যক গবাদি পশু মৃত্যুও হয়েছে এই খরার কারণে।
গৃহযুদ্ধ ও খরাজনিত কারণে বাস্তুচ্যুত হয়ে সোমালিয়ার বিভিন্ন শহরে বর্তমানে আশ্রয় নিয়েছেন অন্তত ৬০ লাখ মানুষ। জরুরি ভিত্তিতে আর্থিক ও মানবিক সহায়তা প্রয়োজন তাদের।
যুদ্ধের কারণে বর্তমানে গোটা বিশ্বের মনযোগ এখন ইউক্রেনের দিকে, কিন্তু আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও জাতিসংঘ সোমালিয়ার দুর্গতদের জন্য বিশ্বের মনযোগ আকর্ষণ করতে প্রাণপন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের বক্তব্য অনুযায়ী, বর্তমানে সোমালিয়ায় খাদ্য সংকটজনিত কারণে যে দুর্যোগ দেখা দিয়েছে, তার সঙ্গে দেশটির ২০১১ সালের মহা দুর্ভিক্ষের তুলনা করা চলে। ওই দুর্ভিক্ষে সোমালিয়ায় আড়াই লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এবং তাদের অধিকাংশই ছিল ৫ বছরের কম বয়সী শিশু।
জাতিসংঘ অবশ্য ইতোমধ্যে সোমালিয়ার দুর্গত লোকজনের জন্য কিছু আর্থিক বরাদ্দ দিয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই তহবিলের মাত্র ১৫ শতাংশ পৌঁছেছে দেশটিতে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে এ পর্যন্ত ২৮ লাখ দুর্গত মানুষ সেই তহবিল থেকে আর্থিক সহায়তা পেয়েচেন, আর এখনও কোনো সহায়তা পাননি অন্তত ৩১ লাখ মানুষ।
আব্দুল্লাহি সেই হতভাগ্যদের মধ্যে একজন। এখন পর্যন্ত কোনো আর্থিক সহায়তা পাননি তিনি ও তার পরিবার। রয়টার্সকে তিনি বলেন, ১৯৯০ সালের পর এমন পরিস্থিতি দেখেননি তিনি; নিজেদের জমি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয়ও নিতে হয়নি তাদের।
পরিবারের ১৩ সদস্যের মুখে খাবার তুলে দিতে ভালো দিনগুলোতে শহরে কাপড় কাচার কাজ করেন আবদুল্লাহি। এতে দৈনিক আয় হয় দেড় ডলারের মতো। এই অর্থে পরিবারের সদস্যরা সবাই খানিকটা করে ভুট্টার জাউ খেতে পারে।
কিন্তু এই অর্থ মোটেও যথেষ্ট নয়। আবদুল্লাহির পুত্রবধু টাইফয়েডে ভুগছেন এবং তার ওষুধের জন্য যে পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন, তা তার দৈনিক মজুরির ১০ গুণ বেশি।
ক্যাম্পে আবদুল্লাহির অস্থায়ী ঘরের ভেতর উঁকি দিলে দেখা যায় তার পুত্রবধুকে। রোগা একটি মেয়ে চুপচাপ কম্বলের ওপর শুয়ে আছে। তার চেয়েও রোগা হাড় জিরজিরে একটি শিশু তার স্তন চুষেই যাচ্ছে। কাছেই ময়লা জিনিসপত্রের মধ্যে পড়ে আছে নকশা করা একটি লাল রঙের হাইহিল জুতা। এটি সেসব অল্প কয়েকটি জিনিসের একটি, যা মেয়েটি বাড়ি ছেড়ে ক্যাম্পে আসার সময়ে নিয়ে এসেছিল। এখন সে এতই দুর্বল যে ঠিকমতো কথাও বলতে পারছে না।
আবদুল্লাহি কোমল কণ্ঠে তাকে ‘আবদিয়া’ বলে ডাকেন, জাগানোর চেষ্টাও করেন, কিন্তু মেয়েটি ফিরেও তাকায় না।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, সোমালিয়ার ৬ টি এলাকার প্রায় দেড় কোটি মানুষ খরার কারণে ব্যাপক সংকটে পড়েছেন। তাদের মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ লাখ মানুষ বিভিন্ন শহর ও তার আশপাশের এলাকাগুলোতে থাকেন, বাকিরা থাকেন দেশটির অন্যান্য দুর্গম অঞ্চলে। সেসব অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ করছে জঙ্গি গোষ্ঠী আল শাবাব।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির পূর্ব আফ্রিকা শাখার প্রধান রুকিয়া ইয়াকুব রয়টার্সকে বলেন, ‘বর্তমান দুর্ভিক্ষ এড়ানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো দরিদ্রদের অর্থ সহায়তা দেওয়া।’
উদ্বাস্তু শিবিরে লোকজন ঘর বানিয়েছে লাঠির কাঠামোর ওপর কমলা রঙের তেরপল, প্লাস্টিক ও টুকরো কাপড় দিয়ে। সরেজমিনে এসব ত্রাণ শিবির ঘুরে রয়টার্স দেখতে পেয়েছে, করোগেটেড টিন দিয়ে উদ্বাস্তুদের জন্য টয়লেট বানানো হচ্ছে, বহু ত্রাণ শিবিরের সামনেই ভিড় করছেন শহরে নতুন আসা উদ্বাস্তুরা, কিন্তু তাদেরকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন ত্রাণ শিবিরের লোকজন।
সাহায্য চাওয়ার পরিবর্তে অনেক পরিবার এক মুঠো খাবার কিংবা সামান্য কিছু পয়সা ভিক্ষাও চাইছে, কিন্তু তাও মিলছে না ঠিকমতো।
ক্ষুধা-অপুষ্টির পাশাপাশি রোগে ভুগেই ত্রান শিবিরে মারা যাচ্ছে অনেক শিশু। ডোলো শহরের ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নেওয়া আশা আলি ওসমান নামের ২৫ বছর বয়সী এক তরুণী গত মাসে তার তিন ও চার বছর বয়সী দুই সন্তানকে হারিয়েছেন। হাম হয়েছিল তাদের।
এখন তার তিন সন্তানের মধ্যে কোনোভাবে বেঁচে আছে তার সর্বকনিষ্ঠ সন্তান, যার বয়স এখনও এক বছরও হয়নি। রয়টার্সকে করুণ কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার খুব কষ্ট হয়, কারণ আমি তাকে বুকের দুধ খাওয়াতে পরি না।’
‘যখন সে ক্ষুধায় কাঁদে, প্রতিবেশীদের কাছ থেকে চেয়ে চিন্তে খানিকটা চিনি মেশানো পানি এনে তাকে খাওয়াই, কিন্তু মাঝে মাঝে তাও যখন পাওয়া যায় না, সে সময় আমরা দুজনই একসঙ্গে শুয়ে কাঁদি।’