কাজী নজরুল ইসলাম- ছোট থেকেই আমাদের সমবয়সীদের কাছে পরিচিত নাম- তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, ফুলকির আগুনধারা দিয়ে। কিন্তু আজ বলব সেই চুরুলিয়ার কথা- যেখানে কবি নজরুলের জন্ম। যেখানে এখনও ধূধূ রাস্তা দিয়ে চুরুলিয়া পৌঁছতে হয়। চুরুলিয়ায় কবির জন্মভিটেয় ১৯৭৮ সালে প্রয়াত নজরুল বিশেষজ্ঞ কল্পতরু সেনগুপ্ত মহাশয়ের পরামর্শে নজরুল মেলা’র আয়োজন করে নজরুল একাডেমী। সেই থেকে প্রতিবছর কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সপ্তাহ খানেক ধরে মেলা বসে। দূরদূরান্ত থেকে শিল্পীরা আসেন, বহু মানুষের সমাগম ঘটে। এঁর পরিকল্পনা ও প্রাণপুরুষ মঙ্গুদা। তাঁকে নিয়েই আমার এই লেখা। বিদ্রোহী কবিকে শ্রদ্ধা সেই সঙ্গে।
কাজী মজহার হুসেন ওরফে মঙ্গু যাকে আমি মঙ্গুদা বলে ডাকতাম- আজ তাঁকে খুব মিস করছি। মঙ্গুদা সম্পর্কে কাজী নজরুল ইসলামের ভাইপো। আমার বিয়ের পরপরেই একদিন কলেজস্ট্রিটে গিয়েছিলাম ওখানেই মঙ্গুদার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ ও পরিচয় ঘটে। আমার ঘরসঙ্গী অধ্যাপক ও গবেষক ইমানুল হক, আমি, কবি জিয়াদ আলী আর নবজাতক প্রকাশনীর মাজহারুল ইসলাম ছিলাম সেবার। শুনেছিলাম, মঙ্গুদার বাইপাস হয়েছে আর তিনি চপ খাচ্ছেন! জিয়াদদা (কবি জিয়াদ আলী) ওঁকে বারণ করছেন। তখন সেলফি তোলার বিষয়টা তো ছিল না। যা থাকত সব মনের মণিকোঠায়। ফেসবুক তখনো আসেনি। যোগাযোগ ছিল ফোন কলে অথবা চিঠিতে। আর সে কারণেই সম্পর্ক দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যেত না। মঙ্গুদাকে দেখেই বলেছিলাম, আপনাকে কিন্তু নজরুলের মত দেখতে।
মানুষ হিসেবে মঙ্গুদা সংগঠক মনের, ফলে আসানসোল গার্লস কলেজে পড়ানোর সময় জড়ালাম নজরুল মেলার সাথে। ডকুমেন্টসন বলতে তখন বুঝতাম লেখা, সেরকম ছবি প্রতিবার তোলা হয়নি।কিন্তু আসানসোলের এক চেনা ফটোর দোকান থেকে এক ফটোগ্রাফার সেবার ছবিগুলো তুলেছিলেন এবং সময়মতো দিয়েছিলেন, তাই আছে। কলকাতায় আসার পরে মঙ্গুদার ডাকে চুরুলিয়ায় গেছি অনেকবার, কখনো বর্ধমান, বা আসানসোলে, কোন কোন দিন ওনার ওখানে থেকে গিয়েছি। এমনও হয়েছে দিনরাত গল্প আড্ডার পরে ভোরে বাড়ি ফিরেছি। এখনো মেলা হচ্ছে। মঙ্গুদার ভাইপো শান্ত কাজীএ হাত ধরেই এখন নজরুল মেলা পরিচালিত হচ্ছে। কোভিড-১৯ এর কারণে ২০২০ সাল থেকে আর যাওয়া হয়নি।
প্রতিবার যাঁর দায়িত্বে নজরুলের চুরুলিয়ায় একটা মেলা হতো। কবি নজরুল ইসলাম স্মরণে এই মেলা ও অনুষ্ঠানমালাকে কেন্দ্র করে কখনো কখনো আসানসোল কলেজের কোয়ার্টারে সেসব মিটিং হতো। আসানসোল থাকাকালীন প্রতিবার মেলাতে যেতাম। মেলা ছাড়া সাতদিন নজরুল মেলা কমিটি নানারকম অনুষ্ঠান-গান, আবৃত্তি, কুইজ প্রতিযোগিতা চলতো এবং তিনি বিশিষ্ট সাহিত্যিক,শিক্ষাবিদ ও শিল্পীদের আমন্ত্রণ দিয়ে নিয়ে আসতেন এই অনুষ্ঠানে। সাতদিন ধরে এই অনুষ্ঠান চলতো এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হতো। মেলাটির বিশেষত্ব-একুশ শতকের গোড়ার দিকেও- ক্রমশ রাতের বেলায় জমে উঠতো। আর ওই গ্রামের লোকেরা বেশ রাত করেই মেলায় যেত। সন্ধ্যা সাতটার দিকে বরং মেলা ফাঁকা ফাঁকা লাগতো। মেলার সেসব দিনগুলোতে কতজন যে আসতেন, আর কত জনের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হতো তার সংখ্যা গুনে বলা কঠিন।
২০০৮ সালে এসেছিলেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উজ্জ্বল কুমার মজুমদার। আমি তাঁর হাতে একাডেমীর পক্ষ থেকে পুরস্কার তুলে দিয়েছিলাম। অন্যদিকে নজরুল একাডেমীর পঞ্চাশ বছর উপলক্ষ্যে এসেছিলেন, নজরুলের ছোট ছেলে কাজী অনিরুদ্ধের স্ত্রী কল্যাণী কাজী। সেদিন তাঁর সঙ্গে বেশ আলাপ হয়েছিল। একবার শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের শ্যালক কন্যা এসেছিলেন নজরুল মেলাতে। শৈলজানন্দ, যিনি ছিলেন নজরুলের সিয়ারসোল স্কুলের সহপাঠী এবং ‘কয়লাকুঠীর দেশে’র লেখক। গৌড়ীয় নৃত্যকার হিসেবে যিনি গবেষণা করেছেন, তিনি অর্থাৎ নৃত্যকার মহুয়া মুখোপাধ্যায় এলেন একবার।
নজরুলের ভাইপোরা (আর একজন রেজাউল হক) নজরুলকে প্রাণপণে আঁকড়ে ছিলেন, রক্ষা করতে চেয়েছিলেন কবির সকল কাব্য। সরকারি হাতে পরে মূল্যায়ন হবে কিনা এ নিয়ে তাঁদের প্রবল সংশয় ছিল। ২০১৫ তে এক মন্ত্রী যেতেই দু ঘন্টা ধরে মঙ্গুদার কী তর্ক! অথচ নজরুলের নামে বিশ্ববিদ্যালয় হল। কলেজ হল চুরুলিয়াতে। তবু এই পরিবার যক্ষের ধনের মত আগলে রেখে নজরুল ইসলামের স্মৃতিকে প্রসার করতে চেয়েছিলেন।
ওখানে যাঁরা যেতেন তাদেরকে দুমুঠো খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হতো কাছের একটি স্কুলে। সম্বল ছিল চাঁদা অর্থাৎ স্থানীয় ও পরিচিত জনেরা সাধ্য অনুযায়ী যে যা অর্থ দিয়ে সহায়তা করতেন। ২০০৭ সালে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর পাঠ্যসূচী থেকে কবি নজরুল ইসলাম ‘সঞ্চিতা’ বাদ দেয়া হয়েছিল-এ নিয়ে মঙ্গুদার লড়াইয়ের অন্ত ছিল না। একজন প্রতিভাবান কবিকে যখন মুছে দিতে চায় সমাজ, তখন তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে একটি প্রতিবাদপত্র প্রেরণ করেন এবং তার প্রতিলিপি ডাকযোগে মোট ১৩৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারী দপ্তরে প্রেরণ করেছিলেন এবং পশ্চিমবঙ্গের সকলকে প্রতিবাদের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন বিশ্বকোষ পরিষদের শ্রী পার্থ সেনগুপ্ত, বর্ধমান জেলা পরিষদের শ্রী উদয়শংকর সরকার, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর সুরঞ্জন দাস সহ অনেকে। সেসময় ‘নজরুল অন্বেষা’ পত্রিকায় ওই প্রবাদলিপিটি ছাপা হয়।
নজরুল একাডেমী প্রচেষ্টায় নজরুলের স্মৃতি সংগ্রহ হয়েছিল। যেমন-চিঠি, ফটোগ্রাফি, বই, কবির ব্যবহৃত জিনিসপত্র, নজরুলের প্রাপ্ত পুরস্কার সহ আরও অনেক কিছু। নজরুল একাডেমী থেকে প্রকাশ করা হতো নজরুল স্মরণিকা এবং গবেষণাধর্মী লেখা নিয়ে নজরুল অন্বেষা পত্রিকা। সম্ভবত ২০০৬ বা ০৭ সাল, কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ডাকটিকিট প্রকাশের উদ্যোগ মঙ্গুদা নিয়েছিলেন। সেই নজরুলের ডাকটিকিট প্রকাশ নিয়ে মঙ্গুদাকে অনেক লড়াই করতে দেখেছি। সাক্ষী ছিলাম চুরুলিয়ায় প্রমীলার স্মারক উদ্বোধনে। নজরুল বাংলাদেশে হলেও প্রমীলা চুরুলিয়ায় থাকলেন। চুরুলিয়ায় এখন বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে এবং পূর্বতন আসানসোল গার্লস কলেজটি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ন্তভুক্ত হয়েছে। মঙ্গুদা আসানসোল গার্লস কলেজে আসতেন অধ্যক্ষ, মহাশয় ড. প্রশান্ত কুমার দে সরকারের কাছে নজরুল একাডেমীর প্রসার সহায়তা, অধ্যক্ষ মহাশয়কে বক্তব্য দানের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে।
সেসময় কাজী নজরুল ইসলাম নিয়ে গোলাম মুরশিদের লেখা পড়ে বেশ রাগ দেখাতেন মঙ্গুদা। আমি যেহেতু গোলাম মুরশিদের লেখা ও গবেষণায় মুগ্ধ, তাই তখন তেমন কিছুই বলতে চাইনি। তবে এটা আমার একান্ত নিজের বক্তব্য- সত্য ও সুন্দরের সহাবস্থান না হলেও কিন্তু সত্যসমাহার জীবনীতে আসা প্রয়োজন। মানুষ কখনও ভগবান নয়, আল্লা নয়। সাহিত্যিক ও স্রষ্টার জীবনে নানা বাঁক থাকবেই। কিন্তু সাহিত্যিক উত্তীর্ণ হয়ে কতটা ক্লাসিক হয়ে উঠতে পেরেছেন, সেটাই বড় কথা। নজরুলকে কারারুদ্ধ করে তাঁর কলম থামানো যায় নি। তাঁর লিখিত গান থেকে সুর ও তাল বিচ্ছিন্ন করা যায়নি। এখানেই শিল্প সার্থক। নতুন ভাবে নতুন পথে কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে চর্চা চলমান রয়েছে। তাঁর বিদ্রোহের আগুনে এ সময়কার ভণ্ডামি দূর হয়ে যাবে- এই কথা খুব মনে হয়। নজরুলের চর্চা যাঁরা করেন, সে গানে, গল্পে, জীবনে তাঁরা অবশ্যই নমস্য।
সংগঠক ও মিশুক মঙ্গুদা তাঁর চুরুলিয়ার মতোই প্রচারবিমুখ, কাজে বিশ্বাসী। নজরুলের জন্য গবেষণার জন্য যাঁরাই এসেছেন বিদেশ থেকে তাদের জন্য খুলে দিয়েছেন গবেষণাগার। তবে মঙ্গুদার মত দৃঢ় মানুষ কীভাবে নজরুল ইসলাম ও তাঁর সাহিত্য বাঁচিয়ে রাখার অবিরত যে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন তা আশ্চর্যের হলেও শিক্ষণীয়।
পুনশ্চ: ২০২২, ২৩ মে নজরুল জন্মবার্ষিকী পালনের আগে নজরুল অন্বেষার দায়িত্বে যিনি ছিলেন তাঁর কাছে এইমাত্র খবর পেলাম, এ বছর নজরুল একাডেমীর দায়িত্ব ভার গ্ৰহণ করেছে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়। বললেন, ওঁদের মত পারবে না এরা। প্রতিভাবান কবিকে যখন কেউ মুছে দিতে চায়, তখন কোনও কোনও কাণ্ডারি ধরেন হাত, একক প্রচেষ্টার মাধ্যমে। বারবার সেকথা মনে হচ্ছে। নজরুলের সঙ্গে সেই পারিবারিক আন্তরিক আনন্দ হয়তো থাকবে না আর।