২০০৯ সালের ২৫ মে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় জনপদে আঘাত হেনেছিল সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড় “আইলা”। মুহুর্তেই লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা। মানুষ, গবাদিপশুর মৃতদেহ, ভাঙা বাড়িঘর আর ভেঙে যাওয়া গাছপালায় যেন নরক নেমে আসে।
আইলার আঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল খুলনার কয়রা অঞ্চল। ঘূর্ণিঝড়ের ১৩ বছর পেরিয়ে গেছে, অথচ এখনও খাবার পানির জন্য কয়রাবাসীকে ছুটতে হয় মাইলের পর মাইল। মেরামত হয়নি বেশিরভাগ রাস্তাঘাট-বেড়িবাঁধ, আজও নেই চিকিৎসার সুব্যবস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় উপাসনালয়ের ভগ্নদশা। সব মিলিয়ে কয়রার সর্বত্রই এখনও রয়ে গেছে আইলার দংশনের চিহ্ন।
।
আইলার আঘাতে বেঁড়িবাঁধ ভাঙার কারণে দক্ষিণ মঠবাড়ী গ্রামকে দু’ভাগ করে সৈয়দখালী নামক একটি শাখা নদী তৈরি হয়। সেখান থেকে স্কুল কলেজ, মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীসহ স্থানীয় মানুষ প্রতিদিন খেয়া নৌকায় ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হচ্ছেন। অন্যদিকে দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের জোড়সিং গ্রামের নতুন বাজার সংলগ্ন হারেজ খালিতেও প্রতিদিন ৫ শতাধিক মানুষ ঝুঁকি নিয়ে খেয়াপারাপার হয়ে থাকেন। আইলার ক্ষতচিহ্ন এখনও দৃশ্যমান বিভিন্ন রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ একাধিক বাড়ি-ঘরে। এছাড়া উপজেলার ৪ ও ৫নং কয়রা এবং হরিহরপুর, পদ্মপুকুর, গাতীরঘেরি, হাজত খালী গ্রামের অনেক পরিবার এখনও বেঁড়িবাঁধের ওপর বসবাস করছেন।
আইলার ১৩ বছর পরও হরিহরপুর গ্রামের কপোতাক্ষ নদীর বেঁড়িবাঁধের ওপর বসবাস করছেন ৭২ বছর বয়সী বৃদ্ধ আনার মোল্যা ও তার স্ত্রী ফুলি বিবি। তারা জানান, আইলার আঘাতে তাদের কয়েক কাঠা জমির ওপর থাকা বাড়ি-ঘর চোরামুখা গেটের খালের মধ্যে চলে যায়। সেখানে এখন ১০/১২ হাত পানি।
তারা বলেন, “আমাদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। তারা অন্য এলাকায় বসবাস করছে। আইলার পর থেকেই বাঁধের ওপর ঝুপড়ি ঘরের মধ্যে থাকি। নদীতে চরে চিংড়ি পোনা ধরে কোনো রকমে দুইজনের খাবার জোগাড় হয়। এখন আর কেউ খোঁজ নেয় না। সরকারি ঘর পেলে সেখানে জীবনের বাকি দিনগুলো কাটাতাম।”
শুধু আনার মোল্লা নয়। ৫নং কয়রা বাঁধের ওপর বসবাস করেন ৭৫ বছর বয়সী অন্ধ রহিম বকস, করিমন বিবি, জহিরোন ও ভদিবিবিদেরসহ অনেকে। অথচ একদিন তাদেরও ঘর-বাড়ি সব ছিল। কিন্তু আইলায় নদী ভাঙনে সবকিছু কয়রা নদী গ্রাস করায় তাদের সব শেষ।
কয়রা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এসএম বাহারুল ইসলাম জানান, কয়েক মাস হল তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচিত হয়েই তিনি ক্ষতিগ্রস্থ রাস্তাঘাট সংস্কার করে যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল করাসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোত মেরামতের কাজ শুরু করেছেন। তিনি বলেন, “প্রাকৃতিক দূর্যোগে গৃহহারা ভূমিহীন ও অসহায় পরিবারে তালিকা প্রস্তুত করে দ্রুত ঘর নির্মাণ করাসহ সকল ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারকে সহযোগিতার প্রস্তুতি নিচ্ছি।”
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলায় খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ উপকূলের বিভিন্ন স্থানে ৫৯৭ কিলোমিটার বাঁধ জ্বলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায়। আইলার পর উপকূলের মানুষের দাবি ছিল টেকসই বেড়িবাঁধ। কিন্তু ১৩ বছরেও তা’ নির্মিত হয়নি। আইলার আঘাতে কয়রার পাউবোর বেড়িবাঁধের ২৭টি পয়েন্ট জলোচ্ছ্বাসে ভেঙে লোনা পানিতে তলিয়ে যায়। আইলার ১৩ বছর পেরিয়ে গেলেও মানুষ এখনও ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের আংটিহারা, খাসিটানা, জোড়শিং, মাটিয়াভাঙা উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের গাতিরঘেরি, গাববুনিয়া, গাজিপাড়া, কাটকাটা, কয়রা সদর ইউনিয়নের ৬নং কয়রা, ৪নং কয়রার পুরাতন লঞ্চঘাট সংলগ্ন এলাকা, ঘাটাখালি, হরিণখোলা, মহারাজপুর ইউনিয়নের উত্তর মঠবাড়ি, দশালিয়া, লোকা, মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের কালিবাড়ি, নয়ানি, শেখেরটেক এলাকার বেড়িবাঁধগুলো অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ সব বেড়িবাঁধ সংস্কার করা না হলে যে কোনো মুহূর্তে ভেঙে আবারও গোটা উপজেলা লোনা পানিতে তলিয়ে যেতে পারে।
আইলার ৩ বছর পর ভেঙে যাওয়া পবনা বাঁধ, হারেজখালি, পদ্মপুকুর, শিকারিবাড়ি, পাথরখালি মেরামত হয়। কিন্তু আইলার ১৩ বছর কেটে গেলেও কয়রার ক্ষতিগ্রস্ত ৬টি ইউনিয়নের কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদীর পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৬০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধে পর্যাপ্ত মাটি নেই। মাটি না দেওয়ায় বাঁধগুলোর দুর্বল অবস্থায় রয়েছে।