নজরুলের প্রেমের কবিতার বর্ণপ্রকরণ

ড. কাজী মোজাম্মেল হেসেন
ড. কাজী মোজাম্মেল হেসেন
12 মিনিটে পড়ুন
ছবি: সংগৃহীত

পরস্পর পরস্পরের প্রতি আস্থার নাম প্রেম। প্রেমের আক্ষরিক অর্থ যদি আকর্ষণ হয়- তা হলে সে আকর্ষণে এ নিখিল সৌরজগতের প্রতিটি গ্রহ-উপগ্রহ; এমনকি গ্রহ-উপগ্রহের সৃষ্ট প্রতিটি অণু-পরমাণু পর্যন্ত একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে প্রেমাবন্ধনে অবদ্ধ। প্রেম কখনও একা পথ চলে না, সঙ্গে নিয়ে চলে আনন্দ-উল্লাসসহ বিরহ-বেদনা।  

পরস্পরের প্রতি প্রবল আকর্ষণ প্রেমের বহিঃপ্রকাশ। প্রেমের চেতনা সুখের চেয়েও অধিক মধুর। প্রেম কোনো জাত-ধর্ম-সংস্কার মানে না। ধর্মীয় সামাজিক সকল পার্থিব অনুশাসনই প্রেম দূরে ছুড়ে ফেলে দেয় তুমুল ক্ষোভের সঙ্গে। আমাদের আলোচ্য বিষয়- কাজী নজরুল ইসলামের প্রেমের কবিতার বর্ণপ্রকরণ অনুসন্ধান: যা নজরুলমানস মূল্যায়ণে সাহায্য করবে।

কাজী নজরুল ইসলামের একশত তেইশতম জন্মজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে বলা যায়- ত্রিশের দশকে রবীন্দ্র প্রভাবিত বাংলা কবিতার মোড় ঘুরিয়ে বিদ্রোহী কবি হিসাবে কাজী নজরুল ইসলামের যাত্রা শুরু হলেও- তাঁর কবিমানসে বিদ্রোহের তুলনায় প্রেমাভাবই ছিল সর্বাধিক। আর সে কারণে নজরুল আজও আমাদের কাছে বিদ্রোহীর তুলনায় সফল এক প্রেমের কবি হিসাবেই বেশি সমাদৃত। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর ‘বিদ্রোহী প্রেমিক’ প্রবন্ধে প্রেমিক কবি নজরুল সম্পর্কে যে এক সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন- তা এরকম:

‘তাঁর কবিতার আর একটি উপাদান ভালোবাসা। তাঁর মতন একটা জোড়ালো রোল তুলে সম্ভবতঃ আর কেউ কখনও বিদ্রোহের দামামা বাজান নি। ঠিক কথা। কিন্তু প্রেমের কথাই বা তাঁর মতন মধুর গলায় আর কজন কবি বলতে পেরেছেন? অনেকের ধারণা বিদ্রোহী কিংবা যোদ্ধার গলায়- প্রেমের কথা ঠিক মানায় না। খুবই ভুল ধারণা, যোদ্ধাই সম্ভবতঃ শ্রেষ্ঠ প্রেমিক।‘

- বিজ্ঞাপন -

বর্ণ বা রঙ  চিত্রকলার প্রধান উপকরণ হলেও কবিতা-সাহিত্যে রঙের ব্যবহার নেহায়েত কম নয়। রঙ মনের কথা বলে। রঙের রয়েছে মোহনীয় ক্ষমতা। রঙের সঙ্গে মানবমনেরও রয়েছে এক গভীর সম্পর্ক। ভাবপ্রকাশে রঙের ভূমিকা অসাধারণ। রোগ সারাতেও রঙের ভূমিকা অনন্য। আর এ কারণেই মানুষ রঙ ভালোবাসে। রঙের মাধ্যমে চিত্রী-কবি-সাহিত্যিক তার দর্শক-শ্রোতার নিকট আপন মনোভাব তুলে ধরার চেষ্টা করে: রঙ পর্যালোচনার মাধ্যমে চিত্রি-কবি-সাহিত্যিকের ভাবকল্পনার সঙ্গে আমরা যেমন পরিচিত হতে পারি, তেমন পারি তার অন্তরাত্মার সঙ্গে সুপরিচিত হতে। একইভাবে রঙবিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা শিল্পীর মনের বাস্তব চিত্র তুলে আনতে পারি; পারি তার মনোসমীক্ষণ চালাতে।

হাজারো মিষ্টিমধুর রঙের পরশে নজরুল তাঁর প্রেমের কবিতাকে অপরূপ করে তুলেছেন। ফলে বলা যায়- প্রেমের কবিতায় সার্থক রঙ ফলাতে নজরুল ছিলেন অনন্য। একজন রঙদক্ষ চিত্রীর মতো মিষ্টিমধুর রঙ দিয়ে নজরুল তাঁর প্রিয়াকে যে অপরূপ সাজে সাজিয়ে তুলেছেন- তা দেখে অবাক হতে হয় এই ভেবে যে- রঙ দিয়ে কবিতার তাঁর কবিমানস সাজিয়েছেন, না নজরুলমানসকে রঙের সহায়ক হিসাবে ব্যবহার করেছেন। নজরুলের প্রেমের কবিতার রঙ পর্যালোচনায় কবির  মনের গভীরে প্রবেশ করা সম্ভব, সম্ভব তাঁর মনোসমীক্ষণ।

প্রেমের কবিতায় নজরুল তাঁর প্রিয়াকে অপরূপ রঙে সাজিয়ে তুলতে যে নতুনতর রঙের সমাবেশ ঘটিয়েছেন, তার প্রতি একটু গভীর দৃষ্টি দিলে অনুধাবন করা যাবে- কবি তাঁর আনন্দ-উল্লাস, ব্যথা-বেদনা, প্রেম-বিরহের ভাব প্রকাশে ব্যবহার করেছেন: লাল, টকটকে লাল, গোলাপি, হাল্কা লাল, কুসুমি লাল, কমলা, জামরুলের লাল, সিঁদুরে লালসহ আরও অসংখ্য লাল ও তার নানা বিচিত্র আভা। একইভাবে কবি নজরুল তাঁর প্রেমের কবিতায় সোনালি, রূপালি, হলুদ, সবুজ, নীল, সাদা, কালো, ধূসর প্রভৃতি রঙ ব্যবহার করে কবিতাকে যেমনি করেছেন আবেগময়, তেমনি করেছেন হৃদয়গ্রাহী। 

পবিত্রতা ও শান্ত ভাব প্রকাশার্থে নজরুল তাঁর কবিতায় ব্যবহার করেছেন শুভ্র, স্বেতচন্দন, কাশবনসম ধবল ইত্যাদি উপমার-প্রতীকী রঙ- যা কবির কবিতাকে আরও বেশি স্নিগ্ধ ও আবেগময়ী করে তুলতে সাহায্য করেছে।

একইভাবে নজরুল তাঁর কাব্যদর্শনের নিগুড়তর বক্তব্য উপস্থাপনে ব্যবহার করেছেন অনুজ্জ্বল অথচ ভারি শব্দবর্ণের রঙ। ব্যথা-বেদনা, দ্বন্দ-হতাশা প্রকাশার্থে কবি ব্যবহার করেছেন ধূসর, পান্ডুর, নীল, গাঢ় নীল, নীলাম্বরি, নীলাভ, নীলিমার নীলসহ কালো, কুচকুচে কালো, কাজল, সুরমা, ছাই, ইত্যাদি রঙসহ তার বিভিন্ন আভা। বিপরীতে কবি তাঁর কবিতায় কালো মেঘ, কালো কলঙ্কের ছাপ, মিশকালো, হিঙ্গুল, বাদামি প্রভৃতি রঙ ব্যবহার করে তাঁর কবিতাকে যেভাবে বিষাদময় করে তুলেছেন- তা অতুলনীয়।

- বিজ্ঞাপন -
কাজী নজরুল ইসলাম ও প্রমীলা দেবী নজরুলের প্রেমের কবিতার বর্ণপ্রকরণ
১৯২৮ সালে কৃষ্ণনগরে স্বামী নজরুল ইসলামের সঙ্গে প্রমীলা। ছবি: সংগৃহীত

নজরুলের প্রেমের কবিতার বর্ণবৈচিত্র্য খোঁজার প্রথমেই ‘পুজারিণী’ কবিতার বর্ণবৈচিত্র্য খুঁটিয়ে দেখা যাক। ‘পূজারিণী’ কবিতাটি কবি নজরুলের প্রেমের কবিতার অন্যতম এক শ্রেষ্ঠ কবিতা। কবিতাটি ১৯২৩ সালে কবির রচিত দোলন-চাঁপা কাব্যগ্রন্থের অর্ন্তভুক্ত কবিতা। দৌলতপুরের নার্গিসকে রেখে এসে অশ্রুজলে বুক ভিজিয়ে কবি যখন কুমিল্লার গোমতীর তীরে এসে দাঁড়ান; ঠিক তখনই সেই পূণ্য গোমতীর তীরে সাক্ষাত ঘটে কবির আর এক প্রাণপ্রিয়া, কবিরানী বিজয়িনী মানসী প্রমীলা দেবীর সঙ্গে। ফলে কবি এক নারীর কাছ থেকে যেমনি পান চরম আঘাত; তেমনি অপরজন (প্রমীলা দেবী) কবির জন্য নিয়ে আসেন পূজার উপাচার। আর এ কারণেই প্রমীলা সেনগুপ্তা কবির কাছে হয়ে ওঠেন দেবী, কবিরাণী ও পূজারিণী। ‘পূজারিণী’ কবিতায় কবি তাঁর দেবী-রানীকে যে সকল বাস্তব, উপমা ও প্রতীকী শব্দবর্ণ এবং তার নানা আভা দিয়ে রাঙিয়ে তুলেছেন তা এরকম: এতদিন অ-বেলায় / প্রিয়তম!/ ধুলি-অন্ধ-ঘুর্ণিসম / দিবাযামি / যবে আমি / নেচে ফিরি রুধিরাক্ত মরণ খেলায়।’

পূজারিনী কবিতায় কবি তাঁর প্রাণপ্রিয়াকে রাঙিয়ে তোলার  উদ্দেশ্যে যে সকল আবেগ-অনুভূতির শব্দবর্ণ ব্যবহার করেছেন তার মধ্যে: ‘এতদিন অ-বেলায়’ (ধূসর), ‘ক্লান্ত শুষ্ক বিদগ্ধ পুলিনে’ (ধূসর), ‘দিবাযামি’ (হাল্কা রক্তলাল), ‘রুধিরাক্ত’ (গাঢ় লাল),  ‘হোমশিখা জ্বালি’ (গাঢ় লাল), ‘দেয়ালীর আলো’ (উজ্জ্বল লাল), ‘আমি-আসি ঊষা-সম’ (উজ্জ্বল লাল), ‘কুসুম-ফোঁটানো’ (সিঁদুরে লাল), ‘স্নিগ্ধ রাগ-রাঙা আলো’ (সিঁদুরে লাল), ‘পুলকের রাঙা বান ডাকে’ (সিঁদুরে লাল), ‘বিদায়ের অভিমান রাঙা’ (বিষাদযুক্ত কালছে লাল), ‘কান্না রাঙা মুখ’ (বিষাদযুক্ত কালছে লাল), ‘অস্তপারের সন্ধা তারা’ (মলিন রূপালি), ‘নিশিত রাতে’ (গাঢ় নীল), ‘গাঢ় ঘন বেদনা’ (গাঢ় নীল), ‘নীল নভোগাঁয়’ (গাঢ় নীল), ‘শিশির ছোঁয়া রাত্রি’ (ধূসর), ‘জীবনের অস্ত-ঘাটে’ (বিষাদযুক্ত কালছে লাল), ‘দিনান্তের প্রান্তে’ (গাঢ় নীল), ‘বিষে নীলকণ্ঠ কবি’ (গাঢ় নীল), ‘রক্ত-সুধা বিষ আন’ (গাঢ় লাল-নীলের মিশ্রণ), ‘অগ্নি-রথ রক্ত-কেতন’ (গাঢ় লাল), ‘হিংসা রক্ত আঁখি’ (গাঢ় লাল), ‘বিদায়ের অভিমান রাঙা’ (গাঢ় লাল), ‘বসন্তের শেষে’ (মলিন হলুদ), ‘কেঁদে ওঠে লতা পাতা’ (মলিন সবুজ), ‘আমি-আসি ঊসা-সম’ (সিঁদুরে লাল), ‘রাঙা নিশিভোর’ (উজ্জ্বল লাল). ‘চৈতি রাতের চাঁদনী’ (উজ্জ্বল রূপালি), ‘মোর বুকে জ্বালায়েছ আলো’ (উজ্জ্বল লাল), ‘তারায় তারায়’ (উজ্জ্বল রূপালি), ‘আকাশ ছাওয়া’ (হাল্কা নীল), ‘শিউলি ঢাকা’ (সাদা), ‘রাজহংসী’ (সাদা), ‘চির-শুদ্ধা তাপস-কুমারী’ (সাদা), ‘দোলন চাঁপা’ (সাদা) ইত্যাদি রঙ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

একইভাবে ‘বিজয়িনী’ কবিতাটি কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ‘ছায়ানট’ (১৯২৪) কাব্যগ্রন্থের আর একটি অন্তরঙ্গ বর্ণিল প্রেমের কবিতা। এ কবিতায় কবি তাঁর পূজারিনীকে বিজয়িনী বেশে পাওয়ার প্রবল আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছেন। পূজারিনী কবির নিকট আত্মসমর্পণ করায়, কবি বিজয়ীবেশে পূজারিনীকে বিজয়িনী ঘোষণার মাধ্যমে বরণ করে নিয়ে আনন্দ-উল্লাসে- উচ্চারণ করেন: ‘আজ বিদ্রোহীর এই রক্ত- রথের চুড়ে / বিজয়িনী! নিলাম্বরীর আঁচল তোমার উড়ে।’

- বিজ্ঞাপন -

‘বিজয়িনী’ কবিতায় নজরুল তাঁর কবিরানীকে অপরূপ রূপে সাজিয়ে তুলতে যে-সকল বাস্তব, উপমা ও প্রতীকী রঙ এবং তার নানা আভার মিশ্রণ ঘটিয়েছেন তারমধ্যে ‘রক্ত রথের চুড়ে’ শব্দবর্ণের উপমাটি ব্যাখ্যায় আনা যাক। কবিতায় ব্যবহৃত ‘রক্ত’ শব্দটি শোনামাত্র আমাদের মনে বিষাদযুক্ত লালের (ক্রিমসন রেড) আভা জাগ্রত হলেও, রক্ত ঝরিয়ে রথের চুড়া: বিজয়ের রঙ (প্রেমিকাকে পাওয়া) অর্থাৎ সিঁদুরে লালকে (ভারমিলিয়ন রেড) কবি বুঝাতে চেয়েছেন। একজন চিত্রী যে রঙ ভালোবাসার রঙ, আনন্দের রঙ, উৎফুল্লের রঙ হিসেবে ব্যবহার করেন।  

একইভাবে নজরুলের ‘বিজয়িনী’ কবিতায় ব্যবহৃত বিজয়িনীর নীলাম্বরী আঁচলের নীল রঙ- কোনোক্রমেই গাঢ় নীল বা পুরশিয়ান ব্লু (বিষাদের রঙ) হতে পারে না; হবে ময়ুরপুচ্ছের নীল- যা মানবমনে প্রেম অথবা আনন্দাভাব জাগিয়ে তুলতে সক্ষম। কবির বিজয়িনী কবিতায় ব্যবহৃত ‘বিজয়-কেতন লুটায়’ শব্দবর্ণে অমাদের মনে যে বিজয় পতাকার রঙের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে- তা অবশ্যই সাদা। কারণ শান্তির প্রতীক হিসেবে আমরা সাদা রঙ ব্যবহার করি।

প্রেমের কবিতা ‘বিজয়িনী’-তে কবি অন্যান্য যে-সকল শব্দবর্ণ ব্যবহার করে তাঁর কবিতাকে বর্ণময় করে তুলেছেন তা এরকম: ‘হে মোর রানী’ (গোলাপি), ‘তোমার কাছে হার মানি’ (গাঢ় বিষাদযুক্ত নীল), ‘বিজয়-কেতন’ (সাদা), ‘অমর তরবারি’ (উজ্জ্বল রূপালি), ‘ক্লান্তি আনে’ (ধূসর), ‘হার-মানা-হার’ (মলিন হলুদ), ‘ফেললে চোখের জল’ (গাঢ় নীল), ‘বিশ্ব-জয়ীর বিপুল দেউল’ (সোনালি), ‘রক্ত-রথের চূড়ে’ (সিঁদুরে রঙ), ‘নিলাম্বরীর আঁচল’ (ময়ূরী নীল), ‘যত তূণ’ (মলিন হলুদ), ‘মালার পূরে’ (লাল-নীল-হলুদ) ইত্যাদি।

‘আল্তা-স্মৃতি’ কবিতাটি কবি নজরুলের আর একটি বিখ্যাত প্রেমের কবিতা। কবিতাটি কবির ‘ছায়ানট’ কাব্যের অর্ন্তগত একটা রোম্যান্টিক প্রেমের কবিতা। এ কবিতায় কবির চির-চেনা, চিরন্তনী প্রিয়া পূজারিনী কবি-রানী- পায়ে আলতা পারে পরের ঘরনি হতে যাচ্ছে জেনে কবি প্রিয়াবিচ্ছেদের বুকফাটা এক প্রেমের আহাজারি প্রকাশ করেছেন। কবিতায় ‘রাঙা পায়ে রাঙা আল্তা প্রথম যেদিন পড়েছিলে- / সেদিন তুমি আমায় কিগো ভুলেও মনে করেছিলে- / আল্তা যেদিন পড়েছিলে?’ কবির এহেন উচ্চারণে  এমন এক অদ্ভুত রঙিন রোমান্টিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে- যা কল্পনাতীত এবং নজরুল ব্যতীত আর কারো পক্ষে এরকম উচ্চারণ অসম্ভব।

উল্লেখ্য, আলতার রঙ সিঁদুরে লাল হলেও কবি তাঁর প্রেমিকার পায়ে যে আলতা পরিয়েছেন সে আলতার রঙ গাড় লাল বা ক্রিমসন রেড- যা ক্ষোভ ও প্রতিহিংসার প্রতিকী রঙ। তবে ‘আমার রক্ত-বুকে অধর আঙুর নিঙড়েছিলে’ উপমায়- কবি বাস্তব আঙুরের সতেজ-সবুজ রঙের পরিবর্তে নিঙড়ানো আঙুরের মলিন সবুজের প্রতীকী রঙটি ব্যবহার করেছেন। ফলে নজরুলের কবিতায় এত সব অদ্ভুত রঙ ব্যবহারের পরও  নজরুলকে একজন দক্ষ চিত্রীর আসনে না বসিয়ে উপায় নেই।

‘আল্তা-স্মৃতি’ কবিতায় কবি তাঁর প্রিয়াকে উল্লিখিত রঙ ব্যতীত অন্যান্য যে-সকল রঙ দিয়ে প্রিয়াকে অপরূপ করে রাঙিয়ে তুলেছেন তার মধ্যে রয়েছে ‘রাঙা পায়ে রাঙা আল্তা’ (সিঁদুরে লাল), ‘আমার রক্তে চরণ রেখে তাহার বুকে মরেছিলে’ (কালছে লাল), ‘সে-খুন সখায় অর্ঘ্য দিলে যুগল চরণ-পদ্মে পুরি’ (গোলাপি), ‘আমার প্রাণের রক্ত-কমল / নিঙড়ে হ’ল লাল পদতল’ (কালছে লাল), ‘আমার রক্ত-বুকে অধর-আঙুর নিঙড়েছিলে’ (কালছে লাল ও কালছে সবুজ), ‘আল্তা সে নয়, সে যে খালি / আমার যত চুমোর লালী’ (সিঁদুরে লাল), ‘আমার বুকের রক্ত-ধারায়’ (গাঢ় লাল), ‘মরণ-শোষা রক্ত আমার’ (কালছে লাল), ‘কাহার পুলক-অলক্তকের রক্তধারায় ডুবিয়ে চরণ’ (কালছে লাল). ইত্যাদি রঙ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

‘ছায়ানট’ কাব্যের ‘প্রিয়ার-রূপ’ কবিতায় কবি তাঁর প্রিয়া আশালতা সেনগুপ্তার (প্রমীলা দেবী) দেহজরূপ বর্ণনায় পঞ্চমুখ হয়ে উচ্চারণ করেছেন, ‘অধর নিস্পিস্ / নধর কিস্মিস্ / রাতুল্ তুল্তুল্ কপোল’, ‘সিঁদুর মুখটুক / হিঙুল টুকটুক’ ইত্যাদি শব্দবর্ণ। যেখানে কবি তার অসংখ্য বাস্তব, উপমা ও প্রতীকী রঙের সমাবেশ ঘটিয়ে তা দিয়ে তার প্রিয়াকে সাজিয়ে অপরূপ করে তুলেছেন।

নজরুল তাঁর কবিতায় অতীত স্মৃতি মন্থন করতে গিয়ে কবিপ্রিয়াকে যে-সকল বিষাদময় রঙে রাঙ্গিয়ে তুলেছেন তার মধ্যে- কালো, ভ্রমর, কৃষ্ণ, নীল, অন্ধকারের মতো রঙ অন্যতম। একইভাবে সিঁদুর, হিঙুল, ঝল্ম্ল্, টিপটি টলটল, দীপটি জ্বল্জ্বল, আনার লাল লাল, নাসায় তিলফুল (সাদা) ইত্যাদি শব্দযুক্ত রঙ ব্যবহার করে কবি স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর মনের আনন্দ ভাব প্রকাশ করে একজন যথার্থ চিত্রীর পরিচয় দিয়েছেন।

ফলে, নজরুলের কবিতা; বিশেষ করে তাঁর প্রেমের কবিতার পর্যালোচনায় বলা যায়- রঙ ফলাতে কবি নজরুল ছিলেন একজন রঙপারদর্শী কবি। কবিতায় তাঁর সৃষ্ট লাল, নীল, হলুদ শব্দবর্ণসহ অসংখ্য প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও তৃতীয় স্তরের অপরূপ শব্দবর্ণের মধ্যে নিহিত রয়েছে নজরুলের  কবিমানসের কামনা-বাসনা ও অনুভূতির রঙ। তাঁর প্রেমের কবিতার অবেগতাড়িত শব্দবর্ণগুলো নজরুলকে একজন রূপদক্ষ, বর্ণদক্ষ কবি হিসাবে  পৃথক করে  চিহ্নিত করতে সাহায্য করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। একইভাবে কবি পাঠককূলকে সাহায্য করেছে তার বর্ণবৈচিত্র্যের ভূবণে বিচরণ করে অবেগতাড়িত করে তুলতে। আর সে কারণেই  কবি কাজী নজরুল ইসলাম যুগের কবি হয়েও যুগকে অতিক্রম করে যুগান্তরের অমর জীবনীশক্তি লাভ  করতে সমর্থ হয়েছেন; সমর্থ হয়েছেন প্রেমের কবিতার বর্ণবৈচিত্র্যের অপ্রতিরোধ্য চিত্রীর আসন দখল করে নিতে।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
চিত্রকর, লেখক ও গবেষক।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!