[ঢাকা ১৪ মে ২০২২] তামাক নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন রাজনৈতিক অঙ্গীকার। এ অঙ্গীকারের অংশ হিসেবে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাক মুক্ত করতে হলে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানিতে থাকা সরকারের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিতে হবে, তামাক কর নিয়ে এক গবেষণা ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে বক্তারা এ কথা বলেন। তারা বলেন, সরকারকে সমন্বিত ও কার্যকর তামাক কর নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে। কর নীতিমালায় সরকারকে, বিশেষ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে তামাক কোম্পানির প্রতি আনুকূল্য প্রদর্শন বন্ধের আহ্বান জানান তারা।
শনিবার “বাংলাদেশে তামাকজাত পণ্যের কর নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ” শীর্ষক গবেষণার ফলাফল উপস্থাপনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে অধিকার-ভিত্তিক গবেষণা এবং অ্যাডভোকেসি সংস্থা ভয়েস গবেষণা ফলাফল প্রকাশ উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে। অনুষ্ঠানটিতে সভাপতিত্ব করেন পিকেএসএফ-এর সভাপতি এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলিকুজ্জামান আহমদ।
বাংলাদেশে তামাক কর নীতিমালা তৈরির ক্ষেত্রে তামাক কোম্পানিগুলোর হস্তক্ষেপের ধরন বোঝার জন্য সাংবাদিক, নীতি নির্ধারক, গবেষক এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজ করেন এমন ২৩ জনের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে গবেষণাটি পরিচালনা করা হয় ২০২১ সালের মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে।
সভায় বক্তারা আরো বলেন তামাক মুক্ত দেশ বাস্তবায়ন করতে হলে তামাক কোম্পানির লাভের রাজস্ব আয়ের চেয়ে জনস্বাস্থ্যকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। আলোচনায় অংশ নিয়ে তামাক নিয়ন্ত্রণ ও নাগরিক অধিকার কর্মীরা বলেন এ লক্ষ্যে বৃটিশ আমেরিকান টোবাকো কোম্পনিতে থাকা সরকারের সমস্ত শেয়ার বিক্রি করে দিতে হবে এবং তাদের সাথে সরকারের ঘনিষ্ট সম্পর্ক ত্যাগ করতে হবে।
ভয়েস-এর নির্বাহী পরিচালক আহমেদ স্বপন মাহমুদ গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করে বলেন, কর নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় তামাক কোম্পানির অবৈধ হস্তক্ষেপের অনেক তথ্য প্রমাণ বের হয়ে এসেছে গবেষণায়। গবেষনায় অংশগ্রহণকারীরা বলেন তামাক কর নীতিমালা সংস্কার প্রক্রিয়ায় তামাক কোম্পানিগুলোকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। অনুসন্ধানে অংশগ্রহণকারীরা জানান যে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ততক্ষণ পর্যন্ত তামাক পণ্যের উপর নতুন করে কর নির্ধারন করবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তামাক কোম্পানিগুলোর সাথে কোন চুক্তিতে না আসে। এর কারণ হিসাবে দেশের অর্থনীতিতে তামাক কোম্পনির অবদান উল্লেখ করা হয়।
গবেষণা ফলাফলে পাওয়া যায়, বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা এবং উচ্চপদস্থ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সাথে তামাক কোম্পানিগুলোর খুব ঘনিষ্ট এবং পারস্পরিক লাভালাভের সম্পর্ক রয়েছে। অংশগ্রহণকারীরা জানান যে, তামাক কোম্পানিগুলো কর সংস্কার প্রক্রিয়ায় জড়িত এনবিআর ও অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের নগদ এবং বিভিন্ন ধরনের উপহার দিয়ে থাকেন। এমনকি তাদের জন্য বিদেশ ভ্রমণের ব্যবস্থাও করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ সরকার তামাক কোম্পানির বিভিন্ন অনুদানসহ তাদের কর্পোরেট সামাজিক দায়িত্বের (সিএসআর) কাজকর্মকে সমর্থন দিয়ে থাকে।
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা তামাক কোম্পানির, বিশেষ করে, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানীর সুপরিচিত বনায়ন, বিশুদ্ধ পানীয় জল (প্রবাহ), এবং সৌরবিদ্যুৎ (দীপ্ত) কর্মসূচিগুলোকে উন্নয়নের অগ্রগতি হিসেবে দেখায় এবং এগুলোর মাধ্যমে ভোটারদের সমর্থন পেতেও সচেষ্ট হন।
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা / উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাগণ তাদের পাবলিক ইমেজ বাড়ানোর জন্য ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানিসহ অন্যান্য তামাক কোম্পানির বিভিন্ন সিএসআর কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে থাকেন। তামাক কোম্পানি এবং সরকারের মধ্যে বেশ কিছু স্বার্থের সংঘাত রয়েছে। যেমনঃ বাংলাদেশ সরকার ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি)-এর প্রায় ১০ শতাংশ শেয়ারের মালিক। ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো বাংলাদেশ-এর ১০ জন বোর্ড সদস্যদের মধ্যে ৬ (ছয়) জন বোর্ড সদস্য বর্তমান অথবা সাবেক সরকারি কর্মকর্তা।
অংশগ্রহণকারীরা জানান যে, তামাক কোম্পনিগুলো কর এড়িয়ে চলার জন্য বেশ কিছু অভিনব পন্থা অবলম্বন করেন, সম্ভবত জাতীয় রজস্ব বোর্ডের জ্ঞাতসারেই তা হয়ে থাকে।
সভাপতি হিসেবে আলোচনায় অংশ নিয়ে পিকেএসএফের চেয়ারম্যান, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলিকুজ্জামান আহমদ বলেন, দেশকে তামাকমুক্ত করতে হলে প্রথমেই সরকারকে বৃটিশ আমেরিকান টোবাকো কোম্পনিতে থাকা তাঁর সমস্ত শেয়ার বিক্রি করে দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তামাকের একক সুনির্দিষ্ট কর কাঠামো তামাক ব্যবহারকারীদের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস ও তামাক ব্যবহার কমাতে অধিক কার্যকর হবে।
বাংলাদেশ সরকারের অবসরপ্রাপ্ত সচিব এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সভাপতি; নাসিরুদ্দিন আহমেদ বলেন, তামাকজাত পণ্যের কর নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় তামাক কোম্পানিগুলো অনেক আগে থেকেই সুপরিকল্পিত ভাবে হস্তক্ষেপ করে আসছে। “এমনকি লকডাউনের মধ্যেও তারা বাংলাদেশের “ প্রয়োজনী পণ্য আইন ১৯৫৬” নামক একটি পুরাতন আইনের প্রশ্রয় নিয়ে এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সাথে লবিং করে অনুমতি নিয়ে তাদের উৎপাদন, বাজারজাতকরণ এবং বিতরণ চলাকালীন সময়েও নিয়মিত রাখেন,” তিনি বলেন। তিনি বলেন, এই আইনটিতে সিগারেটের মত ক্ষতিকর পণ্যকেও বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় পণ্য হিসেবে দেখানো হয়েছে।
এনবিআরের আরেকজন সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ বলেন তারুণ্য, জনশিক্ষা বা তামাক নিয়ন্ত্রণের যে কোন কাজে তামাক কোম্পানির অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করতে হবে। তিনি তামাক কোম্পানির পরিচালিত সিএসআর কর্মকাণ্ডও পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানান।
অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক সিটিএফকে-এর সিনিয়র পলিসি অ্যাডভাইজার আতাউর রহমান মাসুদ এবং সিটিএফকে-এর গ্রান্টস ম্যানেজার আবদুস সালাম মিয়া, উন্নয়ন গবেষক ফজলুল হক মজুমদার এবং শারমিন রিনি প্রমুখ।