প্রযুক্তি বদলে দিয়েছে মানুষের জীবনধারা। পরিবর্তন এসেছে সংবাদ মাধ্যমগুলোতে। প্রিন্ট মিডিয়ায় এবং অনলাইন মিডিয়ার লড়াইয়ের মাঝেও পুরোনো পদ্ধতির হাতে লেখা পত্রিকা স্থান করে নিয়েছে পটুয়াখালির হাসান পারভেজ এর সম্পাদনায় প্রকাশিত একমাত্র হাতে লিখিত পত্রিকা আন্ধারমানিক। আঁধারের মানিক হয়ে তিনি ছুটে চলেছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে এবং যার লেখনী ও পত্রিকার মাধ্যমে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে সমাজের মানুষের ওপর।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত নীলগঞ্জ ইউনিয়নের পশ্চিম সোনাতলা গ্রামের মোস্তফা কামাল হোসেনের পুত্রসন্তান হাসান পারভেজ। স্ত্রী, দুইকন্যা আর অভাব নিয়েই অন্যের ভিটেয় একটি ছোট্ট কুটির বানিয়ে বসবাস করছেন তিনি। তার পরিবার ছিল বরিশালের হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ অঞ্চলের অধিবাসী, নদী ভাঙনের কবলে তাদের বাড়িঘর হারিয়ে একদম খালিহাতে পরিবারের সঙ্গে আসেন পটুয়াখালির কলাপাড়ায়।
নানা গুণে গুণান্বিত প্রতিভাধর হাসান পারভেজ অভাবের সাথে যুদ্ধ করে এগিয়ে চলেছেন। পরিবারের দুবেলা দুমুঠো খাবারের জন্য শুরু হয় তার সংগ্রাম। কখনও বা মাছ ধরা, মাটি কাটা, ইটভাটায় দৈনিক শ্রমমুজুরীর বিনিময়ে কাজ করে যাচ্ছেন। এর পাশাপাশি তিনি আন্ধারমানিক নামে একটি কমিউনিটি পত্রিকার সম্পাদক, লেখক, প্রকাশক। ১৯৯৬সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী হলেও অর্থাভাবে বসতে পারেননি পরীক্ষায়। এরপরে প্রায় কুড়ি বছর পর ২০১৫ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেন তিনি এবং ২০১৭ সালে পাশ করেন এইচএসসি। বর্তমানে তিনি কলাপাড়া সরকারি কলেজের ‘ব্যাচেলর অব আর্টস’ নিয়ে পড়াশুনা করছেন।
কিশোর বয়স থেকেই তিনি গল্প, কবিতা লিখতেন। কিন্তু কখনো কোন পত্রিকায় তার লীখা স্থান পায়নি। একদিন উপকূল সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম মন্টুর সাথে আলাপকালে তাঁর কাছে বিষয়টা খুলে বলেন। তিনি একটা কমিউনিটি পত্রিকা খোলার পরামর্শ দেন। উপকূলীয় অঞ্চল হওয়ায় এই এলাকার মানুষেরা রেডিও, টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রকাশিত খবর বা সংবাদের উপর নির্ভরশীল। হাতে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায় হাসান সিদ্ধান্ত নেন, পুরোনো পদ্ধতিতে হাতে লিখেই তিনি পত্রিকাটি প্রকাশ করবেন।
সংকল্প অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ১ মে উপকূলীয় এই গ্রামের সুবিধা বঞ্চিত স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী এবং পিছিয়ে পড়া মানুষকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনতে কমিউনিটি পত্রিকা ‘আন্ধারমানিক’ এর যাত্রা শুরু। এরপরে সোনাতলা গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীর নামানুসারে পত্রিকার নাম রাখা হয় আন্ধারমানিক। আজ অবধি তিনি পত্রিকাটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। পত্রিকার শুরু থেকেই গ্রামের পিছিয়ে পড়া শ্রমজীবী বসবাসকারী মানুষের সুখ দুঃখের জীবনকথা প্রকাশ আসছে, ফলে খুব দ্রুতই স্থানীয় মানুষের মাঝে হাতে লেখা এই পত্রিকাটি স্থান করে নিয়েছে। আঁধারে মানিক হয়ে হাসান পারভেজ প্রকাশ করে চলেছেন আন্ধারমানিক পত্রিকার একের পর এক সংখ্যা।
বর্তমানে ষোলজন (নারী ও পুরুষ) এই পত্রিকায় সংবাদ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন এবং তারা প্রায় সকলেই শ্রমজীবী মানুষ। কেউ ইটভাটার শ্রমিক, কেউ কৃষিজীবী, কেউ মৎসজীবী। সংবাদকর্মী হিসেবে আছেন নারী, এমনকি শারীরিক প্রতিবন্ধীও। বিনা পারিশ্রমিকে তারা পত্রিকায় সংবাদ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে থাকেন। যখন তারা উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় কাজের জন্য যান, তখন সেসব এলাকার মানুষের সুখ দুঃখের গল্প শুনে সেগুলোই লিখে পাঠিয়ে দেন হাসান পারভেজের কাছে। এরপরে হাসান পারভেজ দিনে শ্রমিকের কাজ শেষ করে সন্ধ্যা কিংবা রাতে যতটুকু সময় পান, সেই সময়টুকু কাজে লাগান পত্রিকার প্রতিনিধিদের পাঠানো লেখাগুলো সম্পাদনার কাজে।পত্রিকাটির লোগো এবং প্রকাশিত লেখার শিরোনামগুলো কম্পিউটারে কম্পোজ করা হলেও সংবাদগুলো হাতে লেখা হয়। চার পৃষ্ঠার এ-থ্রি সাইজের এ পত্রিকাটি স্থানীয় ফটোকপির দোকানে গিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী নির্দিষ্ট সংখ্যক কপি প্রকাশ করা হয়। এরপরে পত্রিকার কপিগুলো প্রতিনিধি এবং সম্পাদক হাসান পারভেজের মাধ্যমে পৌছে যায় মানুষের হাতে হাতে। বর্তমানে তিনি মাসে ৩০০ কপি পত্রিকা ছাপান। এ পর্যন্ত আন্ধারমানিকের ১১টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। এই পত্রিকা ছাপাতে খরচ পড়ে প্রায় ৭ টাকা এবং বিক্রয়মূল্য ১০টাকা। কিছু কপি বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। তাই সবমিলিয়ে কোনো লাভ হয় না। তবুও মনের তাগিদে আর সামাজিক দায়বোধ থেকে তিনি পত্রিকাটি প্রকাশ করে চলেছেন।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাদের কথা কেউ শোনার কেউ নেই, হাসান তাদের কথা অন দিয়ে শোনেন এবং লেখেন। এক দিন তিনি লিখেছিলেন, তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী রুবিনার কথা। রুবিনার মানসিক প্রতিবন্ধী মাকে শিকল দিয়ে বেঁধে বৃদ্ধা ‘নানি’ যেতেন খাবার খুঁজতে। মাকে দেখাশুনা করার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকত ছোট্ট রুবিনা। জসীমউদ্দীনের সেই বিখ্যাত ‘আসমানী’ কবিতা অবলম্বনে হাসান আন্ধারমানিক পত্রিকায় লেখেন, ‘রুবিনাকে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও, তৈয়বআলীর ছোট্ট বাড়ি হোসেনপুরে যাও’- সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায় হাসানের এই কবিতা। ছড়িয়ে পড়ে তার নাম এবং রুবিনারও ভাগ্য ফেরে। গণমাধ্যমে রুবিনার কষ্টের কথা ছড়িয়ে পড়তেই মেলে আর্থিক সহায়তা। এ ভাবেই তার লেখনীর মাধ্যমে একের পর এক মানুষের ভাগ্য বদলে চলেছেন পারভেজ।
এভাবেই উপকূলের সুখ-দুঃখের ইতিবাচক কথা উঠে আসে আন্ধারমানিকের পাতায় পাতায়। অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত হয় অত্র অঞ্চলের মানুষেরা। এই পত্রিকার মাধ্যমে গ্রামবাসী জানতে পারছে, তাদের আশেপাশে কী হচ্ছে! এখান থেকেই এই গ্রামের ইতিবাচক পরিবর্তন শুরু। আন্ধার মানিক পত্রিকায় খবর প্রকাশের পর তিনজন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে বাড়ি পেয়েছেন। উন্নতি হয়েছে কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিজীবী মানুষের। তারা একজন কৃষকের চাষাবাদ ও পশুপালনের সাফল্য উৎসাহিত হচ্ছেন নিজেরাও পশুপালন কিংবা কৃষিকাজে।
গত ২০২১ এর জানুয়ারীতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে প্রচার করা হয় হাসান পারভেজ ও তার আন্ধারমানিক পত্রিকার গল্প। এ অনুষ্ঠানে তিনি প্রশংসিত হয় এবং তাকে দুই লাখ টাকাও দেওয়া হয়। এই টাকা দিয়ে তিনি এক টুকরো জমি কিনেছেন এবং সেখানে বাড়ি বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এছাড়াও তিনি ২০০৫ সালে বরিশালের গণ স্বাক্ষরতা কর্মসূচি থেকে ‘স্বভাব কবি’র উপাধি পেয়েছেন।
আত্মপ্রচারের লোভ নেই, আছে হাসান পারভেজের স্বপ্ন, তার লেখা পড়ে সমাজের বিত্তবান মানুষেরা উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসরত অসহায় মানুষের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবেন। আর তার সংবাদপত্রটি টিকে থাকুক উপকূলের দরিদ্র ও সংগ্রামী মানুষের মুখপত্র হয়ে।