অস্থির সময় পার করছে দেশের ভোজ্যতেলের বাজার। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। তবে সরকারের এসব পদক্ষে বন্ধের দাবি ব্যবসায়ীদের।ভোজ্যতেল আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের দাবি, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাজারে সরকারের হস্তক্ষেপ পরিস্থিতি জটিল করে তুলছে। বরং বাজারকে বাজারের ওপর ছেড়ে দিলেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর ডাকা ভোজ্যতেল নিয়ে এক মতবিনিয়ম সভায় এই দাবি তোলেন তারা।
করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে ভোজ্যতেলের বাজারে অস্থিরতা শুরু হওয়ার পর ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সেটি আরও বাড়তে থাকে৷ এই পরিস্থিতিতে ভোজ্য তেল আমদানি, পরিশোধন, বিপণন পর্যায়ে ৩০% ভ্যাট তুলে নেয় সরকার। আমদানি পর্যায়ে ৫% ভ্যাটই কেবল রয়েছে এখন।
এরপর ব্যবসায়ীরা দাম আরও বাড়াতে চাইলেও সরকার সায় দেয়নি। তার মধ্যেই এ মাসের শুরুতে ঈদের আগে খুচরা বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় সয়াবিন তেল। তারপর সরকার সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৪০ টাকা বাড়ালেও আগের তেল অনেক ব্যবসায়ী মজুত রেখে বাড়তি দরে বিক্রি করছেন বলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানে দেখা যায়।
এই পরিস্থিতিতে খুচরা বাজার স্বাভাবিক না হওয়ার মধ্যে বুধবার মতিঝিলে ফেডারেশন ভবনে ভোজ্য তেলের আমদানি, মজুদ, সরবরাহ, ও মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে সভায় আসেন ব্যবসায়ীরা। সভায় সভাপতিত্ব করেন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন।
এফবিসিসিআই‘র জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ বাবু, তেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান টিকে গ্রুপের পরিচালক মো. শফিউল আতহার তাসলিম, এস আলম গ্রুপের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক কাজী সালাহ উদ্দিন এবং সিটি গ্রুপের উপদেষ্টা অমিতাভ চক্রবর্তী, মৌলভী বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা এবং দোকান মালিক সমিতির সহ সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম তালুকদারসহ আরও অনেকে ছিলেন সভায়।
আলোচনায় টি কে গ্রুপের পরিচালক আতহার তাসলিম বলেন, “এই মার্কেট যদি স্থিতিশীল রাখতে হয়, তাহলে প্রথমেই মার্কেটকে মার্কেটের মতো প্লে করতে দিতে হবে।আজকের এই পরিস্থিতির জন্য আমরা মিলমালিক, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ী একে অন্যকে ব্লেইম করছি (দোষ চাপাচ্ছি), এটা মার্কেটের ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেলটাকে টুডে অর টুমরো ধংস করে দিবে। এটা ব্যবসার জন্য একটা অশনি সংকেত।”
মিল মালিক প্রতিনিধিদের মধ্যে এস আলম গ্রুপের কাজী সালাহ উদ্দিন আহমদ মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাজারে হস্তক্ষেপ বন্ধের পক্ষে মত দেন। তিনি বলেন, “প্রত্যেক বছর রমজানের আগে সরকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে পণ্যের দাম কমানোর নির্দেশনা দেন। এই নির্দেশনার কারণে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়৷ ২০০৯-১০ সালেও এরকম একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও এরকম হয়েছিল৷ কিন্তু পরে বিষয়টি ব্যবসায়ীদের ওপর ছেড়ে দেওয়ায় বাজার ঠিকই নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।”
সিটি গ্রুপের উপদেষ্টা অমিতাভ চক্রবর্তী বলেন, “ব্যবসাকে তার নিজের মতো চলতে দিতে হবে। সে তার ধারা অনুযায়ী চলবে। তাকে বাধা দিলে অস্থিরতা তৈরি হবে। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়েছে বলেই দেশের বাজারে বেড়েছে। এটা বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। তাহলে আস্তে আস্তে বাজার নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। সরকার যদি মনে করে ব্যবসায়ীরা বেশি লাভ করছে, তাহলে টিসিবির মাধ্যমে তেল আমদানি করুক। আমরা সহযোগিতা করব। এরপর সরকারই বাজারজাত করুক।”
টি কে গ্রুপের তাসলিম বলেন, “মিল মালিকরা স্বচ্ছভাবে কাজ করছে কি না, তার জন্য টিসিবির মাধ্যমে দেশের ভোজ্যতেলের চাহিদার অন্তত ২০% তেল আমদানি করার প্রস্তাব করছি। যাতে সরকার জানে যে টিসিবি কত দামে আমদানি করছে। তখন সরকার আমাদের আমদানি দরও জানতে পারবে।”
মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা বলেন, “আন্তর্জাতিক বাজারে ৭৫০ ডলারের তেল এখন ১৯০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে৷ এই পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে আলোচনা করে বাজার পরিচালনা করা। কিন্তু চাপাচাপি করলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে। তখন পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।”
ব্যবসায়ীদের দোকান-গুদামে অভিযানের বিরোধিতা করে তাসলিম বলেন, “একজন পাইকার যদি ৫০ ড্রাম তেল বিক্রি করে, তার কাছে ৩০ ড্রাম থাকতে পারে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আইন অনুযায়ী ওই ব্যবসায়ী ২ মাস পর্যন্ত ওই মাল রাখতে পারে। এখন যদি ওই মালকে মজুদ দাবি করে ওই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সেটা অন্যায়।”
দুইদিন আগে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ব্যবসায়ীদের আচরণে হতাশা প্রকাশ করে বলেছিলেন, “আমরা ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করেছিলাম এটাই আমাদের ব্যর্থতা। বিশ্বাস করা ভুল হয়েছে। মিল মালিকরা কথা রাখলেও খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছে।”
বুধবারের আলোচনায় এফবিসিসিআই সভাপতি জসিমও ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন, “এরকম সংকটময় সময়ে আপনাদের লাভ কম করা উচিত। এই পরিস্থিতি তো অবশ্যই স্বাভাবিক হবে। তখন আপনার স্বাভাবিক লাভ করতে পারবেন। অল্প কয়েকজন অসৎ ব্যবসায়ীদের কারণে পুরো ব্যবসায়ী সমাজের বদনাম হতে পারে না। তাই আপনারা নিজেদের উদ্যোগে যারা এরকম মজুত করে বেশি দামে তেল বিক্রি করছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন।”
সভায় টি কে গ্রুপের তাসলিম বলেন, “দেশের ৯৯% ব্যবসায়ী সৎ হওয়া সত্ত্বেও অসাধু ব্যবসায়ী শুনতে হচ্ছে। আমরা অসাধু ব্যবসায়ী শোনা থেকে পরিত্রাণ চাচ্ছি।”