দিনাজপুরে সবাই তাকে ইদু মাস্টারনি নামে চিনলেও তার পোশাকি নাম হাসিনা বানু। তিনি স্বাধীনতার পূর্বে দিনাজপুর হাই মাদ্রাসা-কাম-হাই স্কুল, অধুনা যা দিনাজপুর উচ্চ বিদ্যালয়, এখানেই সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে চাকুরি করেছেন। আদর্শ ও নীতিবান শিক্ষিকা হিসেবে সেসময় তার নামডাক ছিল পুরো শহর জুড়ে। এছাড়াও তিনি বাড়ীতে বাড়িতে টিউশনিও করতেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি নার্সিং বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। এরপরে আসে ১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে হাসিনা বানু বা ইদু মাস্টারনি দিনাজপুর সদর হাসপাতালে নার্স হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
দিনাজপুরের কোতোয়ালি থানার ভাটপাড়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মোসলেম উদ্দিন পেশায় একজন কৃষক ছিলেন। মা আখিরোন বানু ছিলেন গৃহিনী। দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ছোট, বড় বোনের নাম মফিজানবানু। স্বামী ও তিন শিশুপুত্রকে নিয়েই ছিল তাঁর সুখের সংসার।
১৯৭১ সালে দিনাজপুরে মুক্তিযুদ্ধে পাকসেনাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ইদু মাস্টারনি খ্যাত এই শিক্ষিকা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে আজ পথে পথে হাঁটছেন। কেউ খাবার বা সাহায্য দিলে তার খাবার জোটে, নইলে উপোস করেই দিন কাটে। দিনাজপুর পৌরসভায় বসবাসরত সবার কাছেই একাত্তরের নির্যাতিত এবং সর্বস্য হারানো বীরঙ্গনা ইদু মাস্টারনি পরিচিত মুখ।
বীরঙ্গনা ইদু মাস্টারনির বয়স এখন ৮৫ বছরের উর্ধ্বে। বয়সের ভারে আজকাল তিনি খুব একটা হাঁটাচলা করতে পারেন না। হাড় জিরজিরে শরীর। পরনে জরাজীর্ণ ময়লা শাড়ি। নেই তিনবেলা দুমুঠো খাবারের নিশ্চয়তা। অন্যের দান পেলে জোটে তাঁর দিনের আহার, না পেলে নেই। নেই থাকার জায়গা। এক বাড়ির কোণে একটুখানি জায়গায় রোদ, ঝড়-বৃষ্টি নিয়েই তাঁর আশ্রয়স্থল। চিকিৎসা সেবা থেকেও বঞ্চিত দুর্দশা গ্রস্থ বীরঙ্গনা ইদু মাস্টারনি। তবে আশ্চর্যের বিষয়, হতভাগ্য বীরঙ্গনা ইদু মাস্টারনি কারও কাছে হাত পেতে কখনোই সাহায্য চান না। এমনকি সাহয্য পাবার উদ্দেশ্যে কারও দিকে তাকিয়েও করুনার দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন না। তবে কেউ নিজ থেকে সাহায্য দিলে তিনি সেটি গ্রহণ করেন।
১৯৭১ সাল। দিনাজপুরকে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে, পাকসেনারা হায়েনার চেয়েও হিংস্র এবং নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। মানুষ হত্যা-নির্যাতন এবং পাশবিক উল্লাসে মেতে ওঠে তারা। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহের কোনো একটি দিনে বিহারি রাজাকাররা ইদু মাস্টারনিকে ধরে আনেন ইদু মাস্টারনিকে, সঙ্গে তার মা (আখিরোন বানু) এবং দুই শিশুসন্তান স্বপন (১১) এবং কুপন (৮) সহ মোট চারজনকে ধরে পাকি খানসেনাদের ক্যাম্পে। এরপরে রাজাকারদের সহযোগিতায় পাক সেনারা ইদু মাস্সেটারনি ও তাঁর মা আখিরোন বানুকে দড়ি দিয়ে বেঁধে তাঁদেরই সামনে দুই শিশুসন্তান স্বপন ও কুপনকে কুপিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলে। এটিই ছিল বোধহয় মুক্তিযুদ্ধে দিনাজপুরেরর ইতিহাসের পাতায় চরম বীভৎস অধ্যায়। সন্তানের বাঁচাতে হতভাগ্য মা (ইদু মাস্টারনি) ও (নানী আখিরোন বানু) হাউমাউ করে কান্নাকাটি করলেও মন গলেনি পাকসেনাদের।
শিশুসন্তান দুটিকে নৃশংস হত্যার পরে এরপরে শুরু হয় তাঁদের উপর পাশবিক শারীরিক নির্যাতন ইদু মাস্টারনি ও তাঁর মা’কে (আখিরোন বানু) পাকসেনা ও রাজাকারেরা মিলে গণধর্ষণ করে। ধর্ষণ শেষে পাকসেনারা রাইফেলের বাট দিয়ে তাঁদের সমস্ত শরীরে উপর্যুপরি আঘাত করে। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করে, এর ফলে তিনি জ্ঞান হারিয়ে মূর্ছা যান। আর তাঁর মা আখিরোন বানুর মৃত্যু হয়।
এরপরে বর্বর পাকিস্তানি সেনারা দুজকে মৃত ভেবে ইদু মাস্টারনি ও তাঁর মায়ের দেহ ট্রাকে তুলে নিয়ে দিনাজপুরের বধ্যভূমির কাঞ্চন নদীর পাড়ে ফেলে দেয়। দীর্ঘ সময় পরে তাঁর জ্ঞান ফিরে এলেও তিনি উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটার শক্তি তাঁর ছিল না। বিবস্ত্র, রক্তাক্ত শরীর নিয়েই ইদু মাস্টারনি হামাগুড়ি দিয়ে শেষরাতের দিকে তাঁর হরিরামপুরে বড় বোনের (মফিজান বানু) বাসায় পৌঁছে গোঙ্গাতে থাকেন। তাঁর বোন গোঙ্গানীর শব্দ শুনে বাইরে এসে তাঁ্র বড় বোন এবং বোনের স্বামী বোনের স্বামী মোঃ মোবারক আলী বাইরে বেরিয়ে এসে ইদু মাস্টারনিকে দেখতে পান। এরপরে তাঁকে (ইদু মস্টারনি) ঘরের ভেতরে নিয়ে যান। তাঁর শরীরের জমাটবাধা রক্ত, বালু ও কাদা পরিস্কার করেন এবং প্রাথমিক সেবা শেষে তাঁকে (ইদু মাস্টারনি) অতি গোপনে পশ্চিমবঙ্গের বালুরঘাট হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করিয়ে দেন তারা। হাসপাতালে ভর্তির পর ইদু মাস্টারনীর খোঁজ আর কেউ নেয়নি। তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনেরা ভারতের শরনার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানা গেলেও আর তাদের দেখা মেলেনি। জানা যায়, সেসময়ে ইদু মাস্টারনির স্বামী বেঁচে থাকা একমাত্র বড় সন্তান তপনকে সঙ্গে নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্য রওয়ানা হয়েছিল সত্য, কিন্তু তারা আর দেশে ফিরে আসেনি। হয়তো পালানোর সময়ে তারা খান সেনাদের দ্বারা ধৃত হয়ে নিহত হয়েছেন, আজ অব্দি তাদের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।
হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা পাওয়ায় ধীরে ধীরে শারীরিক সুস্থতা ফিরে পান তিনি। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে স্বাধীনাত্তোর বাংলাদেশে ফিরে আসেন ইদু মাস্টারনি। দিনাজপুরে ফিরে স্বামী সন্তানকে না পেয়ে তিনি (ইদু মাস্টারনি) প্রায় অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘ ৫১ বছর তিনি বহু প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করেই বেঁচে আছেন এ মহিয়সী শিক্ষক ও সেবিকা, অথচ রাষ্ট্র তার খবর রাখেনি।
সে দিন প্রাণে বেঁচে যাওয়া হাসিনা বানু ওরফে ইদু মাস্টারনির সৌভাগ্য নাকি দুর্ভাগ্য!? এই প্রশ্ন সমাজের বিবেকবান ও প্রগতিশীল মানুষদের কাছে রাখলাম। ইদু মাস্টারনি আজ বয়সের ভারে ন্যুব্জ। সব হারিয়ে সর্বহারা মানসিক ভারসাম্যহীন এই বীরঙ্গনা নারী অসহায় ও মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এদেশে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার ক্ষমতায় আসীন। আছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। দিনাজপুরে আছেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ড ও মুক্তিযোদ্ধা, আছে সমাজের দর্পণ সংবাদপত্র এবং সমাজের বিবেক সাংবাদিক- কেউ তাঁকে নিয়ে আজ অব্দি কোন সংবাদ/প্রতিবেদন করেছেন কি? আরও আছে স্থানীয় প্রশাসন, আছেন বিবেকবান মানুষ। তবুও এই বীরঙ্গনা নারী পাশে দাঁড়াননি কেউ। মানসিক ভারসাম্যহীন বলে নেই তার ভোটাধিকার, পাননি তিনি জাতীয় পরিচয়পত্র বা আইডি কার্ড। এ বিষয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা নেয়নি কোন উদ্যোগ। কেন নেয় নি?
এছাড়াও তিনি কত ছাত্রছাত্রী তিনি পড়িয়েছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো কর্মস্থলে বড় বড় পদে আসীন আছেন, তারা কি একদিনের জন্যও তাঁর (ইদু মাস্টারনি) খবর নিয়েছেন? বাড়িয়েছেন তাদের এই শিক্ষকের প্রতি মমতার হাত?
সকল প্রকার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত পাক খান সেনাদের দ্বারা চরমভাবে নির্যাতিতা ও নিষ্পেষিতা ইদু মাস্টারনি বেঁচে আছেন পথচারী সাধারণ জনতার ২/৪টাকার করুণা ভিক্ষার দান গ্রহণ করে। ভাবা যায়, একসময়ে এই দিনাজপুর শহরের পাহাড়পুর এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা হওয়া সত্বেও তাঁর (ইদু মস্টারনি) নেই নাগরিক অধিকার! আজাবধি কেউ তাকে জাতীয় পরিচয়পত্রটিও পর্যন্ত করিয়ে দেয়নি। যা সত্যিই দুঃখজনক। স্বাধীনতার ৫১ বছর পেরিয়ে গেলেও বীরঙ্গনা ইদু মাস্টারনি পাননি স্বীকৃতি ও যোগ্য মর্যাদা। কেন পান নি?
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশে হৃতসর্বস্ব ও অকিঞ্চন একজন বীরঙ্গনা কি অমৃত্যু ঠিকানাহীন ও পরিচয়হীন হয়েই বাঁচবেন?
এ লজ্জা কোথায় রাখি?
নরওয়ে থেকে প্রকাশিত বাংলা সংবাদপত্র ‘সাময়িকী’র মাধ্যমে আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি- অচিরেই যাতে এই হতভাগ্য ও সর্বহারা বীরঙ্গনা নারী ইদু মাস্টারনি ওরফে হাসিনা বানু যোগ্য মর্যাদার সাথে স্বীকৃতি পান এবং সকল প্রকারের রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা লাভ করেন। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, স্থানীয় প্রশাসন এবং দিনাজপুরের জনপ্রতিনিধি সহ সমাজের বিবেকবান মানুষের প্রতি অনুরোধ রইলো।