বিগত কিছুদিন ধরে ঢাকার বড় বাজারগুলোতে অল্পবিস্তর বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া গেলেও অলিগলির দোকানগুলোয় বেশ স্বল্পতা ছিল। একই পরিস্থিতি অব্যাহত ছিল রবিবারেও (১ মে)। এদিন কারওয়ান বাজারে দু-একটি ছাড়া অন্য দোকানগুলোতে ছিল না সয়াবিন তেল। ধারণা করা হচ্ছিল, সরবরাহ আর গুদামে সয়াবিন তেলের সংকটের কারণে বাজারে এ স্বল্পতা।
তবে বেলা গড়িয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানের পর বাজারের চিত্র পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায় সে ধারণাও। অভিযানে দেখা যায়, বাজারে বেশি দামে বিক্রির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দোকানের গুদামে বিপুল পরিমাণ সয়াবিন তেল মজুত করে রাখা হয়েছে। পরবর্তীতে সয়াবিন তেল মজুত করায় বিভিন্ন ব্যবসায়ী আর প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়। একইসঙ্গে মজুত করা তেল বাজারে সরবরাহ করার নির্দেশও দেওয়া হয়।
রবিবার বেলা ১১টার পর কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযান শুরু হয়। নিচতলার মুদিদোকানে তেলের সংকট দেখে ওই কর্মকর্তা তিনতলায় ডিলার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের গুদামে গেলে সেখানে কার্টনভর্তি সয়াবিন তেল পাওয়া যায়।
পরে সেই তেল নিচতলার মুদিদোকানিদের কাছে বিক্রি করা হয়। সেই সঙ্গে সয়াবিন তেল মজুত করায় তিন ব্যবসায়ীকে ২ লাখ ১০ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়।
এদিকে, অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বিসমিল্লাহ জেনারেল স্টোর নামের তেলের এক ডিলারের গুদামে অভিযান চালিয়ে ৫ লিটারের ১০০ কার্টন বা ৪০০ বোতল (মোট ২ হাজার লিটার) সয়াবিন তেল উদ্ধার করেন। পরে সেই প্রতিষ্ঠানকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয় করে তাৎক্ষণিকভাবে সেই অর্থ আদায় করা হয়। পাশাপাশি মজুত করা দুই হাজার লিটার সয়াবিন তেল মার্কেটের নিচতলার খুচরা ব্যবসায়ীদের সরবরাহ করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ফাহমিনা আক্তারের নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানে ছিলেন মো. মাগফুর রহমান ও পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার।
অভিযানের পর ফাহমিনা আক্তার বলেন, “ডিলারদের গতকাল শনিবার খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে তেল সরবরাহ করার কথা ছিল। কিন্তু তারা সেটি না দিয়ে আজ মে দিবসের ছুটিতে সুযোগ নিয়ে বাড়তি দামে বিক্রির চেষ্টা করছিলেন। তাই গোডাউনে অভিযান চালিয়ে সব তেল বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। আজ থেকে তেল গোডাউনে নিতে পারবেন না ডিলার ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা। মার্কেটের নিচ থেকেই খুচরা ব্যবসায়ীদের সরবরাহ করতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা খুচরা ও পাইকারি বাজারের পাশাপাশি চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জে সয়াবিন তেল পরিশোধনকারী কোম্পানির মিলগেটেও তদারকি করছি। সেখান থেকে প্রতিদিন রেকর্ড পরিমাণ তেল সরবরাহ করা হচ্ছে। বোতলের গায়ে উল্লেখ করা দামের চেয়ে কেউ এক টাকা বেশি দামে বিক্রি করলে জরিমানা করা হবে। কোনো ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে এক হাজারবার অভিযোগ এলে এক হাজারবারই জরিমানা করা হবে।”
এছাড়া, তিনি ভোক্তাদের অধিদপ্তরের হটলাইনে (১৬১২১ নম্বরে) অভিযোগ করতে আহ্বান জানান।
মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, “আমরা খোঁজ-খবর নিয়ে জানলাম, ভোজ্যতেলের মিলগুলো চাহিদা অনুযায়ী তেল সরবরাহ করছে। তাহলে তেল যাচ্ছে কোথায়? পরে কয়েকজন ব্যবসায়ীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রবিবার সকালে কাওরান বাজারের দোতলা মার্কেটে অভিযান পরিচালনা করি। এ সময় দেখি, বিসমিল্লাহ স্টোর নামের প্রতিষ্ঠানটির গোডাউনের সামনে সিগারেটের প্যাকেট রেখে পেছনে তেল মজুত করে রাখা হয়েছে। অথচ তারা ক্রেতাদের বলছে, তাদের গোডাউনে তেল নেই, সরবরাহ কম। এই বলে তারা অবৈধভাবে মজুত করছে। এই অপরাধে প্রতিষ্ঠানটিকে আমরা দুই লাখ টাকা জরিমানা করেছি।”
ক্রেতারা প্রতিদিন বাজার তদারকি করার জন্য জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, “আপনারা আজ অভিযান চালিয়েছেন বলে তেল কিনতে পেরেছি।”
মঞ্জিল হোসেন তালুকদার নামের এক ক্রেতা বলেন, “কারওয়ান বাজারের কোনো দোকানে গতকাল (শনিবার) সয়াবিন তেল পাইনি। দুই-একজন ব্যবসায়ী ৫ লিটারের বোতল প্রতি ৫০-১০০ টাকা বাড়তি দাম চেয়েছেন।”
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানের পর বাজারে তেল আসা শুরু হওয়ার পর সিরাজুল ইসলাম নামের এক খুচরা ব্যবসায়ী বলেন, “৭-১০ দিন ধরেই সয়াবিন তেল চাহিদা অনুযায়ী পাচ্ছি না। প্রতিদিন আমার দোকানে কমপক্ষে ৫০ লিটার সয়াবিন বিক্রি হয়। কিন্তু পাই ১০ লিটার। ডিলারদের কাছে তেল এলেও তাঁরা চুপিচুপি বেশি দামে বিক্রি করে দেন।”
তিনি আরও বলেন, “কিছুক্ষণ আগে এক লিটার ও দুই লিটারের দুই কার্টুন তেল পেয়েছি। এক লিটারের বোতল ১৫৮ টাকা ও ২ লিটারের বোতল ৩১২ টাকায় কিনতে হয়েছে।”
কত টাকায় সয়াবিন তেল বিক্রি করবেন জানতে চাইলে সিরাজুল ইসলাম বলেন, “১ লিটার ১৬০ টাকা ও ২ লিটার ৩১৬ টাকায় বিক্রি করব।”
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাব অনুযায়ী, গত ১ মার্চ থেকে গতকাল পর্যন্ত প্রায় দুই মাসে ৯২ হাজার টন সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে, যা বিগত সাত বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। একই সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলো ১ লাখ ৩৭ হাজার টন সয়াবিন তেল বন্দরের কাস্টম বন্ডেড ট্যাংক টার্মিনাল থেকে খালাস করেছে।
দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদার ৮০%-এর বেশি আমদানি করে পূরণ করা হয়। সাত থেকে আটটি প্রতিষ্ঠান অপরিশোধিত তেল আমদানি করে পরিশোধন করে বাজারে ছাড়ে। কেউ কেউ বীজ আমদানি করেও তা ভাঙিয়ে তেল উৎপাদন করে। আমদানিতে উৎসাহ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বিশ্ববাজারের সঙ্গে দেশে দামের পার্থক্যকে দায়ী করছেন। তাঁরা বলছেন, বিশ্ববাজারে দাম অনেক বেশি। কিন্তু দেশে সরকার মূল্য সমন্বয় করতে দিচ্ছে না।