‘ঈদের আনন্দ, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজা পার্বন আর বিভিন্ন মেলায় দেখা যেত বাইস্কোপ। এগুলো এখন শুধুই স্মৃতি। ছোট্ট শিশু থেকে আরম্ভ করে বুড়োরাও দেখতো একটা বক্সের মধ্যে সুন্দর করে পোস্টার সাজানো বাইস্কোপ’। এ কথা বলছিলেন নাটোরের সিংড়া উপজেলার শেরকোল ইউনিয়নের খরমকুড়ি গ্রামের বৃদ্ধজন আব্দুল করিম মোল্লা।
গ্রামাঞ্চলে ভ্রাম্যমাণ সিনেমা হলের ছবি নামে পরিচিত। গাঁয়ের ছেলে-বুড়োরা ছুটত তার পেছন পেছন। আবার কেউ কেউ তাকে ছবিওয়ালাও বলত। হাতে থাকতো তার একটা ডুগডুড়ি। বাজাতে বাজাতে গ্রাম্য মেঠো পথ ধরে হাঁটতো। দল বেঁধে সবাই একখানে জড়ো হতো গাঁয়ের শিশু-কিশোর ও কুলবধুরা। তারপর শুরু হতো সিনেমা।
তার আগে অবশ্যই টিকিট কিনে নিতে হতো। বক্সের চারখানা ফুটোয় আট জোড়া চোখ লাগিয়ে সেই স্বপ্নের সিনেমা দেখতো গাঁও-গেরামের মানুষরা। সে সবই এখন সূদুর অতীত। কারো মনে পড়ে, কারো পড়ে না। এখন আর দেখা যায় না সেই ছবিওয়ালাকে। কালেরগর্ভে কোথায় যে হারিয়ে গেলো তারা তা বর্তমান প্রজন্মের কেউ জানে না।’
গণমাধ্যমকর্মী দেবাশিস সরকার বলেন, ‘ছোটবেলায় বাইস্কোপ অনেক দেখেছি, আমাদের গ্রামে আসতো। একটা টিনের বাক্সের ভিতরে সমসাময়িক ঘটনার ছবি এপার থেকে ওপারে রিল টেনে দেখানো হতো। আমরা পাড়ার ছেলেরা সবাই আট আনা চার আনা দিয়ে বাক্সের ভিতর চোখ লাগিয়ে ছবি দেখতাম।
আর চৈত্র-বৈশাখ মাসে আরো বেশি দেখা যেত বিভিন্ন মেলাতে। সে মজার স্মৃতিচারণ পয়সা তো বাড়িতে পেতাম না কালাই অথবা মসুর বাড়ি থেকে চুরি করে নিয়ে গিয়ে বায়োস্কোপওয়ালাকে দিয়ে দেখতাম। পাড়ার ছেলে ছেলেরা আমরা সবাই লাইন ধরে দাড়িয়ে থাকতাম।
দেখতাম, শুনতাম বাইস্কোপআলা খঞ্জন বাজাতো আর সুরে সুরে বলতো ‘কি চমৎকার দেখা গেল, অমুক নায়িকা এসে গেল, তারপরেতে দেখেন ভালো তমুক নায়ক এসে গেল।’ নেতাজি সুভাষ বসুকে দেখাতো, শহীদ মিনার দেখাতো। খঞ্জনি হাতে নিয়ে বাজাতেন আর এই সমস্ত গীত গাইতেন।
সেই দিন আর কোনদিনই ফিরে আসবেনা ! এখন স্মৃতির জানালায় শুধু উকি দিয়ে দেখা। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে টেলিভিশন মোবাইলেই মানুষ পাচ্ছে বিনোদন। তখনকার সময় মানুষের বিনোদন ছিলনা। গ্রামের মানুষ শহরে এসে সিনেমা হলে বসে সিনেমা দেখাও দুষ্কর বিষয় ছিল। সেই বায়োস্কোপের প্রয়োজনীয়তা আজ আধুনিকতার ছোঁয়ায় ফুরিয়ে গেছে।’
নাটোরের লালপুর উপজেলার দুড়দুড়িয়া গ্রামের মহসিন আলী বলেন, ‘ওই দেখা যায় কেমন মজা, তাকদি না দিন জাবেদের ঘোড়া চইল্যা গেলো, ইলিয়াছ কাঞ্চন আইস্যা গেলো, চম্পাকে নিয়ে চইল্যা গেলো। আরে আরে কেমন মজা, দেখেন তবে মক্কা মদিনা, তার পরেতে মধুবালা, এক্কাগাড়ীতে উত্তম কুমার আর সুচিত্রা সেন।’
এরকম কথা সুরের ধারা বর্ণনা দিয়ে গ্রাম্য জনপদে বাইস্কোপ দেখাতেন বাইস্কোপওয়ালারা। ‘আমি নিজে দেখেছি ওই বাইস্কোপ। দুপুরে বাড়ির উঠানে বক্সটা নিয়ে বসত। বাড়ির সবাই পর্যায়ক্রমে দেখতাম। মজাই লাগতো। সেই ছবিওয়ালা আজ আর নেই। আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছে আমাদের অতীতের সব ঐতিহ্য। আমরা এখন আপসংস্কৃতির ঘেরাটোপে বন্দী।’
নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার ব্রহ্মপুর গ্রামের সুব্রত শীল জানান, ‘মজার বাইস্কোপ এখন আর দেখা যায় না। ছোট্টবেলায় হাট-বাজারে, মেলায় দেখা যেতো বাইস্কোপ। আধুনিক বিজ্ঞানের মডার্ণ সময়ে সেলুলয়েডের রঙিন যুগে এখন আর চোখেই পড়ে না এ মজার বাইস্কোপ। এখন শুধুই স্মৃতি।
হাটবাজার মেলা ছাড়াও বাইস্কোপওয়ালারা মাথায় করে গ্রামে গ্রামে, বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বাইস্কোপের বাক্সটা নিয়ে মানুষকে ছবি দেখাত। তার হাতে থাকতো বাজনা বাজানোর জন্যে একটা বিশেষ ধরনের বাদ্যযন্ত্র। যে কারো বাড়িতে পৌছেই সেই বাজনা বাজিয়ে আওয়াজ দিত। বলতে শোনা যেত বাইস্কোপ দেখবেন গো বাইস্কোপ।
তখন আশপাশের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা মা-দের কাছে কাকুতি মিনতি করতো ওই বাইস্কোপ দেখার জন্যে। মায়েরা তখন বিরক্ত হয়ে ধানের গোলা থেকে বা চালের মটকা থেকে এক সের ধান বা চাল দিতেন। ‘আর পাবি না কিন্তু’ এও বলে দিত। ছেলে মেয়েরাও রাজী হয়ে বলতো হাঁ মা আর লিবোনা, আর দেকপো না।
এই বলেই ধান নিয়ে ছুটে যেতো বাইস্কোপওয়ালার কাছে। বাইস্কোপওয়ালা তার ব্যাগের মতো থলেতে ধান ঢেলে রেখে দিত। ধান নিয়ে বাইস্কোপের কাছে হাঁটু গেড়ে বসতে দেরি হতো না। পর্দা ওঠলো বাইস্কোপের, মুখের মাঝে দুই হাত দিয়ে চুপি দিয়ে দেখতে থাকতো বাইস্কোপ।
বাইস্কোপওয়ালা এক হাতে বাইস্কোপের রিল ঘুরাতে থাকতো আর বলতে থাকতো কি যাচ্ছে আর সামনে কি আসছে। বলতে শোনা যেতো ‘কি সুন্দর দেখা গেলো, আলোমতি আইস্যা গেলো, কি সুন্দর দেখা গেলো প্রেমকুমার আইস্যা গেলো’ ইত্যাদি।
বর্তমান সেলুলয়েডের রঙিন ফিতা, অনলাইন আর ইন্টানেটের যুগে এখন আর সেই মনোরম বাইস্কোপ দেখাই যায় না। ছোট্টবেলার সেই বাইস্কোপ এখন শুধুই স্মৃতি। মাত্র দশ পয়সা দিয়ে অথবা এক হেড় বা এক পট ধান বা চাল দিয়ে দেখা যেতো এই বাইস্কোপ…