উন্নয়নের সেকাল একাল অথবা উন্নয়নের এপিঠ ওপিঠ বা শিল্পের উন্নয়নে শ্রমিকের রক্ত ঘামের আস্থা, যাই বলি না কেনো পৃথিবী উন্নয়নের পিছনে যাদের রক্ত ঝরা ঘাম রয়েছে তারা হলেন শ্রমিক, উন্নয়নের ফল যারা ভোগ করছেন তারা হলেন মালিক। রসায়নে পড়েছিলাম ইলেকট্রন আদান প্রদান হয় জারণ-বিজারণ বিক্রিয়ায়। প্রেম করলেও একজন নারী এবং অন্যজন পুরুষ লাগে। অর্থাৎ যে কোনো কাজ বা উন্নয়নে দু’পক্ষের প্রয়োজনীয়তা অত্যাবশ্যক। শ্রমিকের বিনা শ্রমে যেমন উন্নয়ন সম্ভব নয়, তেমনি মালিকের অর্থ বিনিয়োগ বিনে উন্নয়নের দ্বার উন্মোচন সম্ভব নয়। শ্রমিক-মালিক উভয়ই উন্নয়নের এপিঠ ওপিঠ। এই শ্রমিক আর মালিক হচ্ছেন পৃথিবীর উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। যদিও এখন উন্নত বিশ্বে স্বয়ংক্রিয় মেশিনের বদৌলতে শ্রমিকগণকে সরাসরি চাকা ঘোরাতে হয় না। তথাপিও এসব স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি তৈরিতে শ্রমিকের দু’হাত বিনে সম্ভব হচ্ছে না।
বহু সংগ্রাম পেরিয়ে এই দিনটি সারা বিশ্বের শ্রমিকদের কাছে এক গৌরবময় উজ্জ্বল দিন হিসেবে সমাদৃত। শ্রমিকদের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রতিদিন প্রায় ১৬ ঘণ্টা ধরে কাজ করতে হত। এই সমস্যা নিয়ে ১৮৮৬ সালের আজকের দিনেই দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাজার হাজার শ্রমিক দেশব্যাপী ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন। আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমিকদের বিশাল জমায়েত ও বিক্ষোভ হয়েছিল। আন্দোলনরত শ্রমিকদের রুখতে পুলিশ সেখানে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন বেশ কয়েকজন শ্রমিক এবং আহত হয়েছিলেন অনেকে। এছাড়া গ্রেপ্তারও করা হয় অনেককে এবং ফাঁসি দেওয়া হয় বেশ কিছুজনকে। তীব্র আন্দোলনের মুখে পড়ে শ্রমিকদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় তৎকালিন সরকার। এরপর ১৮৮৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে মে মাসের ১’তারিখকে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
তবে কে কখন শ্রম ঘণ্টা নির্ধারনের জন্য ক’জনই বা প্রাণ বির্সজন দিয়ে আন্দোলন করে মে দিবসকে আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডারে স্থান দিয়েছেন। সাধারণ মানুষ তা জানতে আগ্রহী নয়। সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ একটি কাজই ভাল করে জানে। আর সেটি হচ্ছে শ্রম দিতে এবং শ্রমের পর ঠিক ঠিক মজুরি পেতে। আর এটি সঠিক নিরসন না হওয়ায় প্রায়শই লেগে আছে শ্রমিক ও মালিক পক্ষের সুপ্ত দ্বন্দ আবার কখনও প্রাকাশ্যে। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সমাজ এবং রাষ্ট্র উভয়ই। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও শ্রমিক মহলের অভিযোগ থেকে উঠে আসা তথ্যের ভিত্তিতে বলতে দ্বীধা নয় যে, শ্রমিকের অধিকার আদায়ের নামে কিছু রেডিমেড শ্রমিক আছেন যারা সুযোগ বুঝে কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে শ্রমিকদের কাছ থেকে নগদ অর্থ আদায় করে থাকেন। কিন্তু আদায়কৃত অই অর্থ প্রকৃতপক্ষে শ্রমিকের অধিকার আদায়ে আর ব্যয় করেন না। বরং সমস্যা সমাধানের নামে আদায়কৃত টাকায় কিছু সংখ্যক ব্যক্তিগন বিলাশবহুল জীবন যাপন করেন। এই শ্রমিকের নামে অশ্রমিকরাও প্রকৃত শ্রমিকের জন্য বড় এক সমস্যা হয়ে দাঁড়ান। এরা শ্রমিক ও রাষ্ট্রের জন্য এক ধরনের ভাইরাস, এই ভাইরাসকে এ্যান্টি ভাইরাস দিয়ে ধ্বংস করা জাতির জন্য মঙ্গলজনক। এদেরকে চিহ্নিত করে সংস্লি¬ষ্টদের ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ বলে ভুক্তভোগীরা মনে করেন।
শ্রমিক ও মালিকের মধ্যকার প্রচলিত দ্বন্দ যদি দূর হয়, তাহলে উন্নয়ন হবে অরো তরান্বিত হবে সেই সাথে সরকারের রাজস্ব চাকার গতি সচল থাকবে।। অন্যথায় উন্নয়ন হবে ব্যাহত যা কোনো ব্যক্তি মালিক দেশ বা জাতির কাম্য নয়। শ্রমিককে না ঠকিয়ে আর মালিকের পিঠের চামড়া না তুলে বরং শ্রমিক-মালিক অধিকারের বিষয়ে স্বচেতনতাই কাম্য। সু-সম্পর্কের বন্ধনে উন্নয়নের ঢেউ ছড়িয়ে বিশ্বকে এগিয়ে নেয়ার প্রয়াশই একমাত্র বাস্তব প্রতিজ্ঞা দু-পক্ষরই থাকা বাঞ্জণীয় বলে উয়নের দু’পিঠের কাছে সাধারণ জনগনের প্রত্যাশা।
বাংলাদেশের কল-কারখানায় যত শ্রমিক নিয়োজিত প্রায় একই সংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিক হিসেবে বিদেশেও কর্মরত আছেন। তাদের কাজের ক্ষেত্রেও অনিশ্চিত, নির্যাতন ও প্রতারণায় ভরা। যা সরকারের প্রতিনিধিদের নজরদারি কাম্য। বাংলাদেশে বেশ বড় বৈদেশিক মুদ্রার মজুত তৈরি হয়েছে, এর পিছনে যে মূল অবদান পোশাক শ্রমিক ও বিদেশে কর্মরত শ্রমিকগণ। এসব শ্রমিকগণের জীবনও সব চেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। দেশব্যাপী পুরোনো রাষ্ট্রয়ত্ত শিল্পসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের আন্দোলনের ব্যাপক শক্তি ছিল কিন্তু বর্তমানে শ্রমিকগনের নানা সমস্যা থাকা সত্ত্বেও শ্রমিক আন্দোলন মালিক শ্রেণির রাজনৈতিক অধিনস্থের কারণে আন্দোলন, সংগঠন ও যৌথ মঞ্চ সবই ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। পোশাক শ্রমিকদের অধিকাংশ নারী হওয়ায় যৌন নিপিড়নসহ নারী সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় ক্রমেই সামনে আসছে। শ্রমিকগণ সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হলেও মজুরীসহ বঞ্চনা ও নিপিড়নের মাত্রার কারণে ক্ষোভে ও প্রতিবাদ প্রায় ফেটে পড়ে। শ্রমিক আন্দোলনের একটি নতুন চেহারা আমরা দেখতে পেয়েছি। এই আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্ত, অনেক বিস্তৃত, তবে সাংগঠনিক শক্তি ও যথাযথ দিক নির্দেশনার অভাবে অধিকাংশই ক্ষেত্রেই পর্যুদস্ত। অধিনস্থ না থেকে উপায় নেই। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে অধিকাংশ রাজনৈতিক বড় বড় নেতাগণ ধনী ব্যবসায়ী। শুধু তাই নয়, ব্যাংক-বীমা, মিডিয়া জনমতের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী সংস্থা ও সংগঠনের মালিকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সংসদে ধনী ব্যবসায়ীদের উপস্থিতি বাড়ছে। রাষ্ট্রের কাছে সুযোগ-সুবিধা অর্জনের জন্য চাপ প্রয়োগকারী নানা ধরণের সংস্থা ও সংগঠন গড়ে উঠায় শ্রমিক বরাবরই বঞ্চনার শিকার হচ্ছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শ্রমজীবী মানুষ এবং শ্রমিক সংগঠনসমূহ রাজপথে সংগঠিতভাবে মিছিল ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে দিবসটি পালন করে থাকে। বাংলাদেশেও ব্যতিক্রম নয়, “জয় হোক সাম্যের, জয় হোক মেহনতি মানুষের” এ শ্লোগানে দিনভর মুখরিত থাকে দিবসটি। এ দিবসটি পালনের বার্তা যারা পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে সারা দেশের মানুষের কাছে পৌঁছান তাদের শ্রমের মূল্য কতটুকু তাও খতিয়ে দেখা দরকার। খতিয়ে দেখতে গেলে ভয়াবহতার কথা ওঠে আসে। আর তা হচ্ছে, প্রতিনিয়ত লাঞ্চিত-বঞ্চিত হচ্ছেন মালিক পক্ষের কাছ থেকে এক শ্রেণির শ্রমিক। যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সারাদেশে ধনী-গরীব সব শ্রেণির মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। সম্মানিত হচ্ছেন সমাজে কিন্তু লজ্জায় বলতে পারছেন না তাদের মজুরির কথা। তারা আর কেউ নন্ সমাজের দর্পন। এই দর্পন দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা কাজ করেন। কোনো র্নিদিষ্ট সময় সীমা নির্ধারন সম্ভব নয় এ ধরনের শ্রমিকের। এমনকি সাপ্তাহিক ছুটিও পর্যন্ত নাই। সংবাদ পৌছাতে দেরি হলে ফোনে গালা-গালি শুরু হয়। নানা ঝোক্কি-ঝামেলা নিয়ে এবং খেটে-খুটে সংবাদ ফ্যাক্স এবং ই-মেইল করে বারংবার জানানো হয়। অথচ মাস গেলে মজুরি পান ৭’শ টাকা আবার কোথাও কোথাও পনের শ টাকা। পাঠক সমাজের এ দর্পন আর অন্য কেউ নন তারা হলেন তৃণমূলের সংবাদকর্মী। ঢাকার প্রতিষ্ঠিত জাতীয় দৈনিকে কর্মরত তৃণমূলের সংবাদ কর্মীদের (শ্রমিক) মজুরি প্রদানের ক্ষেত্রে শোষক মালিকগণ হচ্ছেন ধনী ব্যবসায়ী।
মুনাফালোভী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অমানবিক নিপীড়নের শিকার শ্রমজীবী মানুষের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে অব্যাহত সংগ্রামের স্মারক মহান মে দিবস। অথচ দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য একবিংশ শতাব্দীতে পদার্পণ করে আজও আমাদের দেশে মহান মে দিবসের চেতনা এবং শিক্ষার প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয়নি। যে কর্মঘন্টা, ন্যায্য মজুরির দাবিতে সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল বহু বছরের প্ররিক্রমায় আজও সেই অতিরিক্ত কর্মঘন্টা, মজুরি বৈষম্য, শোষণ, বঞ্চনা বিদ্যমান। কারখানার দুর্ঘটনায় নামমাত্র তদন্ত, নেই কোনো বিচার, সুবিচার সূদূও পরাহত। শ্রমিকরা বঞ্চিত হচ্ছে যথাযথ চিকিৎসা এবং ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তি হতে। নিয়মানুযায়ী গ্র্যাচুইটি না পাওয়া, প্রয়োজন অনুযায়ী ছুটি না পাওয়া, বিনা বেতনে ছুটি এবং বিনা কারণে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদে আজও নামতে হয় শ্রমিকদের রাস্তায়। ফলস্বরূপ আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে মালিকপক্ষ বন্ধ ঘোষণা করে তাদের কারখানা, হাজার হাজার শ্রমিকের নামে ফৌজদারি মামলা হয়, শত শত শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয় এবং বহু শ্রমিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। আমাদের দেশের পরিবহন শ্রমিকদের কর্মঘন্টা এবং কর্মপরিবেশ বর্ণনার অতীত। কর্মঘন্টার বাইরে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের কারণে সড়ক দুর্ঘটনাসহ শ্রমিকেরা শারীরিক, মানসিক ও অসংখ্য সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। তবে আমরা আশাবাদী, অন্ধকার ফুঁড়ে আলোর রেখা বেরিয়ে আসবেই, মে দিবসের ইতিহাস ও শিক্ষা অনাগত ভবিষ্যতে বিশ্ব তথা এদশের মেহনতি জনগণকে ন্যায্য দাবি আদায়ের সকল প্রয়াসে উদ্দীপনা যুগিয়ে যাবে। শুধু একদিনের জন্য নয়, ৩৬৫ দিনই শ্রমিকদেরকে মে দিবসের শিক্ষা ও চেতনায় উজ্জীবিত করে শ্রমিক ও মালিকের বন্ধুর সম্পর্ক গড়ে উঠুক।
পরিশ্রম মানুষের জীবনে সম্মান বয়ে আনে। সেই সাথে জাতিকে উন্নতির সোপানে পৌছাতে পারে। আর এ পরিশ্রম শুধু শ্রমিকই নয়, যে কোনো মানূষ করতে পারে। আধুনিকতার শব্দে কখনও বলা হয় মালিক ও শ্রমিক, কখনও বা কর্মী ও কর্মকর্তা আবার কখনও গৃহকর্মী ও গৃহকত্রী। শ্রম বিনা যেমন উন্নয়ন সম্ভব নয়, তেমনি শ্রমের মূল্য বিনা সমাজ গঠনও সম্ভব নয়। এইসব শ্রমিকগণ যখন উচ্চবাচ্য করেন তখন তাকে খুন হতে হয় নানাভাবে। গড়িয়ে যায় রক্ত, যা এতদিনে বাংলার নদ-নদীর গন্ডি পেরিয়ে মিশে যায় সাগর থেকে মহা সাগরে। শত শত কল-কারখানা আর স্মার্ট শব্দের মিল ফ্যাক্টরি ও ইন্ডাষ্ট্রীর চার দেয়ালের ভেতোরের চাপা-কান্নার খোঁজ খবর কে রাখে?