শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার এক ঐতিহাসিক দিন। শ্রম ও শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিকের আত্মত্যাগের সংগ্রামের দিন। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও দাবি আদায়ের দিন। মেহনতি মানুষের বিজয়ের দিন, আনন্দ ও সংহতি প্রকাশের দিন।
১৮৮৬ সালের পহেলা মে দৈনিক ১২ ঘণ্টার পরিবর্তে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে শ্রমিকরা ফুঁসে উঠেন। হে মার্কেটের কাছে তাদের বিক্ষোভে পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে ১০ শ্রমিক নিহত হন। শুরু হয় ৮ ঘন্টা কার্যদিবস করার দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলন যা “হে মার্কেট অ্যাফেয়ার” নামে পরিচিত। উত্তাল সেই আন্দোলনের মুখে কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় এবং বিশ্বব্যাপী দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের সময় চালু করা হয়।
১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সমাবেশে পহেলা মে দিবসকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এর পরের বছর থেকে বিশ্বব্যাপী এ দিনটি পালিত হচ্ছে।
যদিও আমেরিকার সরকার এই ঘটনার কোনো স্বীকৃতি দেয়নি এবং শ্রমিকদের আট ঘণ্টা কাজের দাবিকেও গুরুত্ব দেয়নি। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯১৬ সালে আমেরিকা ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিকে আইনি স্বীকৃতি দেই। ১৯১৭ সালে দ্বিতীয় নিকোলাসের পতনের ৪ দিন পর আমেরিকা সরকারি ঘোষণার মাধ্যমে ‘দিনে ৮ কর্মঘণ্টা’র স্বীকৃতি দেয়।
১৯১৭ সালের পর থেকেই সোভিয়েত ক্ষমতাবলয়ে থাকা দেশগুলোতে মে মাসের ১ তারিখে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বেশ জাকজমকতার সহিত পালন করা শুরু হয়। সোভিয়েত পতনের পরে রাষ্ট্রীয়ভাবে অনেক দেশেই পালন হয় না এখন আর মে দিবস। তবে এখনো বিশ্বের ৮০টি দেশে এই দিন সরকারি ছুটি হিসেবে চিহ্নিত। বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে পহেলা মে’কে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘মে দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেন। একইসঙ্গে সরকারি ছুটিও ঘোষণা করেন। বিশেষ করে, ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে পহেলা মে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরের বছর থেকে পহেলা মে বিশ্বব্যাপী পালন হয়ে আসছে ‘মে দিবস বা ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ হিসেবে।
স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালে জাতির পিতার উদ্যোগ ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। একইসঙ্গে আইএলও’র ৬টি কোর কনভেনশনসহ ২৯টি কনভেনশন অনুসমর্থন করে। এটি শ্রমজীবী মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও তাদের অধিকার রক্ষায় এক অনন্য মাইলফলক।
শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে এ দিবস পালনের এত বছর পরও শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য মজুরির দাবি এখনো উপেক্ষিত, এখনো তাঁদের বিরাট অংশ মৌলিক মানবাধিকার থেকেও বঞ্চিত। শ্রমিক ফেডারেশনের যে বড়বড় নেতৃবৃন্দ ‘মহান মে দিবস’ শীর্ষক আলোচনায় রাতের টকশো গরম করবে, জ্বালাময়ী বক্তব্য দিবে শ্রমিকের অধিকার আদায় নিয়ে, এই তাদেরই নিয়ন্ত্রিত, মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক ন্যায্য মজুরি, মূল্যায়ন পায়না। প্রতিবছর এই সময়টা যখন আসে, এই দিনটি আসা মাত্রই শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে সবাই তোড়জোড় শুরু করে দেয় মাত্র একদিনের জন্য। শ্রমিক নেতৃবৃন্দ একদিনের জন্য মিছিল, মিটিং, টকশো করে আর দায়িত্ব পালন করবেন না!
আমাদের সমাজে যাদের শ্রমিক হিসেবে দেখি অধিকাংশই স্কুলের গণ্ডি অতিক্রান্ত করতে পারেনি। ভালোমন্দের পার্থক্য, নৈতিকতা, আদর্শের গালগল্প কোনকিছুই অনুধাবন করতে পারেনি৷ এর দায় কি শ্রমিক নেতৃবৃন্দ এড়াতে পারেন? এই রাষ্ট্রের জন্য সমাজের জন্য একটা যোগ্য শ্রমিক কখনোই শ্রমিক নেতৃবৃন্দ তৈরি করেনি৷ তারপর ও তারা তাদের অভিভাবক হিসেবে একদিনের জন্য শ্রমিক দিবসে খিস্তিখেউড় করে। অথচ শ্রমিক নেতৃবৃন্দ কখনোই কি শিশু শ্রমিকদের খুঁজে নিয়ে স্কুলে পাঠানোর মত একটা দায়িত্ব পালন করেছে? একটা মাদকাসক্ত শ্রমিককে নিরাময় করে ভালো রাস্তা দেখিয়েছে?
আমার জানা নেই৷ জেনে থাকলে বলবেন।
শ্রমিক নেতৃবৃন্দের একটাই দায়িত্ব মে দিবস নিয়ে সেটা হলো শ্রমজীবী মেহনতী ভাইবোনদের জন্য এই করেছি, ঐ করেছি বলে বক্তব্য দেওয়া। পাশাপাশি যারা আমজনতা আছে তারাও শ্রমজীবী মানুষদের ভালোবাসা দেখিয়ে একটা স্ট্যাটাস দিয়ে দেওয়া!
খেটে খাওয়া মানুষ গুলো পড়াশোনা করার সুযোগ লাভ করতে পারেনি৷ যারা শ্রমিক নেতা, তারা অল্পস্বল্প হলেও পড়াশোনা করেছে৷ ব্রেইন টাকে কাজে লাগিয়ে শ্রমিকদের ঘামে উঠানো টাকা খুব সুন্দর সিস্টেমে বঁড়শি দিয়ে তুলে নিচ্ছে।
শুধু একটা সেক্টরে তাকালেই বুঝা যায়৷ ঢাকার গণপরিবহন ও অন্যান্য বাসস্ট্যান্ড থেকে ওয়েবিল বা যাতায়াতের হিসাব এবং জিপি বা গেট পাস, পার্কিং চার্জ, মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নের চাঁদা এসব নামে প্রতিদিন গড়ে ১০০০ টাকার চাঁদা দিতে হয় প্রতিটা বাসের। মেইনটেইন চার্জের চাঁদা আছে আবার। প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার লেনদেন!
এই যে এত বছর হাজার হাজার কোটি টাকা শ্রমিকদের কাছ থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে এই টাকা, কয়জন শ্রমিকদের পিছনে ব্যবহার করা হয়েছে? হিসেব দিতে পারবেন প্রভাবশালী শ্রমিক নেতৃবৃন্দ?
গার্মেন্টস সেক্টরের দিকে তাকালেও একই দৃশ্য দেখা যায়৷ গার্মেন্টস মালিকেরা শোষণ করে নিচ্ছে, তাদেরকে আবার বিজিএমই শোষণ করছে। এই কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন গার্মেন্টস মাফিয়ারা!
মিশরীয় পিরামিড থেকে শুরু করে পৃথিবীর সব প্রাসাদ, সৌধ, আকাশচুস্বী বিখ্যাত দালানকোঠা, এমনকি জমকালো ধর্মালয়ের দেয়ালে কান পাতলে শোনা যায় শ্রমিকের কান্না, মিশে আছে শ্রমজীবীদের রক্তের প্রলেপ কিংবা দীর্ঘশ্বাস! আমার আপনার আশেপাশে থাকা বঞ্চিত, শোষিত নিপীড়িত প্রতিটা শ্রমিকের পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক দিবস।
একদিন এভাবেই পৃথিবী বদলে যাবে। সেদিন প্রয়োজন হবেনা মে দিবস পালনের কিংবা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস উদযাপনের। প্রতিটা শ্রমিক তার প্রাপ্য অধিকার পাক এটাই চাই। ভালো থাকুক দেশ বিনির্মাণের মানুষগুলো। যাদের শ্রম, ত্যাগে অর্থনীতি গড়ে উঠে, বেগবান হয় দেশ। এই দীর্ঘশ্বাস বা রক্তের দাগের প্রতি শ্রদ্ধা বিশেষ কোন দিনের জন্য বন্দী না থাকুক। প্রতিটি দিনই সবাইকে ভালোবেসে, সহমর্মিতা নিয়ে এগিয়ে চলাই হোক আমাদের সকলের প্রতিজ্ঞা।