নাটোর সদর উপজেলা জুড়ে দুই থেকে তিন ফসলি জমিতে অবাধে চলছে পুকুর খনন। অবৈধ ট্রাক্টরে পুকুর খননের মাটি পরিবহনের কারণে সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সড়ক বিনষ্ট হচ্ছে অপরদিকে জনভোগান্তি বেড়েছে এমন অভিযোগ স্থানীয়দের।
পুকুর খননকারীরা বলছেন, প্রশাসনের লিখিত অনুমতি নিয়েই পুকুর খনন করা হচ্ছে। আর প্রশাসন বলছেন, ফসলি জমিতে পুকুর খননের কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি। তবে কেমন করে দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই ফসলি জমিতে চলছে পুকুর খনন। প্রশাসনের নীরবতার কারণই বা কি? এমন প্রশ্ন নাটোরের সচেতন মহলের।
নাটোর সদর উপজেলার বড়হরিশপুর ইউনিয়নের গাজীর বিলে ফসলি জমিতে চলছে পুকুর খনন। এমন তথ্য পেয়ে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দুইটি এস্কেভেটর (ভেকু) দিয়ে সদ্য কেটে নেওয়া ধানের জমিতে পুকুর খনন করা হচ্ছে। পাশেই রয়েছে পানি শুকানো একটি পুকুর।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুকুর খননকারী জাহাঙ্গীর জানান, সরকারিভাবে অনুমোদন নিয়েই পুকুর খনন করা হচ্ছে। লিখিত সেই কাগজ প্রতিবেদককে দেখানো হয়। কাগজে লেখা রয়েছে আবেদনকারী করিম মোল্লা, পিতা রমিজ উদ্দিন মোল্লা, সাং, দত্তপাড়া।
মৌজা মকরামপুর, জে এল নাম্বার ১৩০, খতিয়ান নাম্বার ১৬৫, ১৬৪, ১৫৭, ৯৬, ১৭৩ দাগ নাম্বার ৫৯১, ৫৯৪ শ্রেণী ধানি। মন্তব্য কলামে লিখা হয়েছে বর্তমান শ্রেণি পুকুর। বিগত ০৭ – ০৮ বছর আগে থেকে পুকুর হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমানে পুকুর সংস্কার ও পাড় বাঁধ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
১ নং খতিয়ানের ৬১৯ দাগের ভূমি রকম পরিমাণ ০.৩৭ একর জমি ভেঙে পুকুরের সঙ্গে একীভূত হয়ে আছে।সরকারি ডহর পুনরায় পূর্বের অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার শর্তে পুকুর খননের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। সেই কাগজে এমন আরো ১৮টি পুকুর সংস্কারের আবেদনকারীর নাম রয়েছে।
স্থানীয় কৃষক করিম উদ্দিন জানান, তিন বছর আগে এই পুকুর খনন করা হয়েছিল। এবং বিএডিসির সেচ প্রকল্পের আওতায় ছিল এই জমি। সেখানেই পুকুরটি আরও বড় আকার করে বিএডিসির পানি যাওয়ার ড্রেনের মধ্যে চলে এসেছে পুকুরের পাড়।
কাগজের কোথাও অনুমোদনের কথা লেখা নেই। যেখানে মন্তব্য কলামে পুকুর সংস্কারের অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে বলা হয়েছে, সেখানে কোনই কর্মযজ্ঞ হচ্ছেনা। আর যে শর্তে অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে সেই শর্তের কোন বালাই নেই। বরং তিনি সেই পুকুরের পাশে প্রায় ২ বিঘা সদ্য ফসলি জমিতেই পুকুর খনন করছেন।
সম্প্রতি নাটোর সদর উপজেলায় ইট প্রস্তুতের জন্য ১৯টি পুরাতন পুকুর সংস্কার করে মাটি সংগ্রহের অনুমোদন দেয়া যেতে পারে মর্মে ৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি চূড়ান্ত প্রতিবেদনের অনুলিপি প্রেরণ করেছেন ২২ টি ঠিকানায়।
বিএমডিএ প্রকৌশলী, উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এবং সহকারী কমিশনার (ভূমি) স্বাক্ষরিত এই তদন্ত কমিটি শ্রেণী ধানি জমি লেখা থাকলেও বর্তমান শ্রেণি পুকুর হিসেবে দেখিয়েছেন। এমনকি মন্তব্য কলামে অসমাপ্ত পুকুর হিসেবে সরেজমিনে তদন্ত ছাড়াই প্রতিবেদন পত্রে স্বাক্ষর দিয়েছেন।
তদন্ত প্রতিবেদনের ১ নম্বর আবেদনকারী জংলি মৌজার মো. মকবুল হোসেন। মন্তব্য কলামে লেখা হয়েছে জমির চারপাশে পাড় রয়েছে। জমির শ্রেণী পুকুর। সংস্কার করার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। স্থানীয় কৃষক মো. ইয়াকুব আলী জানান, ‘৩ বছর আগে এই জমিতে ফসল ফলতো। ২ বছর আগে জমি থেকে মাটি তুলে চারধারে পাড় বাধা হয়েছিল।
গত বছরে পুকুর কেটে মাটি বাহিরে বের করার চেষ্টা করলে প্রশাসন খনন কাজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। শুনেছি এই বছর প্রশাসন লিখিতভাবে অনুমোদন দিয়েছেন। তবে অনুমোদিত এই পুকুরের মাটি ইটভাটার দেওয়ার নামে, গ্রামীণ সড়কের দুইপাশের জলাশয়, বসতবাড়ির সামনের আঙিনা ভরাট করা হচ্ছে।’
তালিকার ৯ নম্বরে তেবাড়িয়া ইউনিয়নের কৈগাড়ী কৃষ্ণপুর। গ্রামের কৃষক আব্দুল কুদ্দুস জানান, ‘ গত বছর ফসলি জমির চারপাশে অল্প করে মাটি দিয়ে উঁচু করে, কলা গাছ রোপন করা হয়েছিল। চলতি বছরে সেই জমিতে পুকুর সংস্কারের নামে খনন করে মাটি বিক্রি করা হচ্ছে।
ভেদরার এই বিলে এখন ফসলি জমিতে পুকুর খনন করতে করতে ফসলি জমি সব ফুরিয়ে যাচ্ছে।’ পুকুর খননকারি ডাঃ মো. মহসীন আলী জানান, প্রশাসনের অনুমতি নিয়েই এই পুকুর খনন করা হচ্ছে।’ পাশেই চলছে আরও একটি ফসলি জমিতে পুকুর খননের কর্মযজ্ঞ।
তালিকার ১৩ নম্বরে আবেদনকারী বাবলু সরদার। মৌজা মাঝদিঘা। তবে মাঝদিঘা মৌজা তন্ন তন্ন করে খুঁজে কোথাও পাওয়া যায়না আবেদনকারীর অস্তিত্ব। অবশেষে ছাতানী ইউনিয়ন ভূমি অফিসে যোগাযোগ করা হলে, ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন জানান, জে এল নাম্বার ৫৮ মূলত কেশব পুর মৌজা।
মন্তব্য কলামে লেখা রয়েছে অসমাপ্ত পুকুর বর্তমানে মাছ এবং ফসল চাষের অনুপোযোগী সুতরাং পুকুর খননের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। পাশেই ক্যানেল থাকায় আশেপাশে জলবদ্ধতা সৃষ্টির আশঙ্কা নেই। তবে সেখানে পাশাপাশি মোট ৩ টি পুকুর খনন করতে দেখা গেছে।
নাটোরের গণমাধ্যমকর্মী রাশেদুল ইসলাম জানান, “তদন্ত কমিটি বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে পুকুর খননকারী ও ভাটার মালিকদের পক্ষপাতিত্ব করে ফসলি জমিতে পুকুর খনন করা যায় বলে মন্তব্য কলামে লিখেছেন। এতে করে মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনাকে তারা বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়েছেন।”
নাটোর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মেহেদুল ইসলাম জানান, ‘সরোজমিনে আমরা কয়েকটা পুকুর পরিদর্শন করেছি তবে আমি সবগুলো পুকুর পরিদর্শন করতে পারিনি।’ অর্থের বিনিময়ে এই ১৯টি পুকুর সংস্কারের তদন্ত প্রতিবেদনে স্বাক্ষরের বিষয়ে তিনি জানান, ‘প্রশ্নই আসে না এখানে কোনো অর্থের বিনিময় স্বাক্ষর করা হয়নি।’
সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুজিত কুমার মুন্সী জানান, “৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি কর্তৃপক্ষ গঠন করেছেন। বিভিন্ন স্পটে গিয়ে দেখেছি যেটা দেওয়ার মত মনে হয়েছে এবং দেওয়ার মত মনে হয়নি, মন্তব্য কলামে আমরা স্পষ্ট লিখে দিয়েছি। সরোজমিনে সবগুলো না দেখলেও মোটামুটি ভাবে অনেকগুলোই দেখেছি।”
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) নাটোর জোন’এর সহকারী প্রকৌশলী মুহাম্মদ আহসানুল করিম জানান, “চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ১৯ টির মধ্যে প্রায় ১৭ টি স্থানে সরোজমিনে গিয়েছি। বেশ কিছু পুকুর দেখেছি যা সংস্কার করা প্রয়োজন। কিন্তু কয়েকটি পুকুর ছিল না এবং সেগুলোর জন্য আমি অমত পোষণ করেছি। তার মধ্যে কয়েকটি তালিকায় রয়েছে ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক তদন্ত প্রতিবেদন আমি সাক্ষর করেছি।”
নাটোর সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোছা: রনি খাতুন জানান,”সরোজমিনে পরিদর্শন করে চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন জেলা প্রশাসক মহোদয়ের দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদনের কপি চাইলে তিনি অপারগতা শিকার করে, জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।”
ইউনাইটেড প্রেসক্লাবের সভাপতি রেজাউল করিম রেজা বলেন, ‘ সরকারি উন্নয়ন কার্য সম্পন্ন বিষয়ে জেলা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।কোনক্রমেই আবাদি জমিতে পুকুর খনন করা যাবে না।
তারপরেও প্রশাসন যদি তদন্ত ছাড়া কাউকে অনুমোদন দিয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই সেটা বাংলাদেশের আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং নিন্দনীয়।যদি কোথাও ফসলি জমিতে পুকুর খনন চলমান থাকে সেই সমস্ত জায়গায় অবিলম্বে পুকুর খনন বন্ধ করে, খননকারী বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।’
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন ‘তিন ফসলি জমিতে পুকুর খনন নাটোরের একটি বড় সমস্যা। ফসলি জমিতে পুকুর খননের অনুমোদন কাউকে দেওয়া হয়নি। ফসলি জমিতে যেন পুকুর খনন না হয় সেই লক্ষ্যে জেলা প্রশাসন সর্বদাই কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিনিয়তই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অব্যাহত রয়েছে।