পুরো ম্যাচ গোল দেখেছে ৭টা, তবে হতে পারতো কমপক্ষে আরও তিন গোল। সেসব হয়ে গেলে হয়তো ম্যাচ শেষে ম্যানচেস্টার সিটি কোচ পেপ গার্দিওলার চিন্তিত চেহারার দেখাটা মিলত না। সেটা হতে হতে হয়নি সিটি আক্রমণভাগের দোষে। তাই রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সেমিফাইনালে প্রথম লেগের ‘থ্রিলারে’ সিটির জয়টা এল মোটে এক গোলের ব্যবধানে। ৪-৩ গোলে হেরেও রিয়াল মাদ্রিদ তাই টিকে রইল ভালোভাবেই।
সাত গোলের থ্রিলারের প্রথমটা যখন এলো, সিটির মাঠ এতিহাদে তখন হয়তো দর্শকরা ধাতস্থ হয়ে ঠিকঠাক বসতেও পারেননি। ম্যাচের বয়স যখন মোটে ৯৩ সেকেন্ড, ঠিক তখন রিয়াদ মাহরেজ ডান প্রান্তে পেয়ে যান বল; গোটা দুই চ্যালেঞ্জ এড়িয়ে ক্রস বাড়ান বক্সে, সেটাই রিয়াল বিপদসীমায় ‘লেট রান’ নেওয়া কেভিন ডি ব্রুইনা পেয়ে যান ফাঁকায়, নিচু হেডারে বলটাকে আছড়ে ফেলেন জালে। দ্বিতীয় মিনিটেই নিঁখুত শুরু পেয়ে যায় সিটি।
প্রথম গোলে ডি ব্রুইনার মুন্সিয়ানা যেমন ছিল, তেমনি ছিল রিয়াল রক্ষণের ভুলও। দানি কারভাহালের নাগালেই যে ছিল বলটা! তেমন এক ভুল ১১ মিনিটে আবার করল রিয়াল রক্ষণ, এবার খলনায়ক ডেভিড আলাবা, চোটের কারণে যার ম্যাচ খেলা নিয়েই ছিল শঙ্কা। বাম প্রান্ত থেকে করা ডি ব্রুইনার ক্রস বিপদমুক্ত করতে পারেননি সাবেক বায়ার্ন মিউনিখ ডিফেন্ডার, তা গিয়ে পড়ে গ্যাব্রিয়েল জেসুসের পায়ে। আগের লিগ ম্যাচে চার গোল করা ব্রাজিলিয়ান এই স্ট্রাইকার চকিতেই ঘুরে গিয়ে রিয়াল গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়াকে ধোঁকা দিতে ভুল করেননি। ১২ মিনিট না যেতেই ২ গোলে এগিয়ে গিয়ে সিটি যেন তখন রীতিমতো পা রেখে ফেলেছিল স্বপ্নের জগতেই!
এ পর্যন্ত রিয়াল হজম করেছিল দুই গোল, তবে রিয়ালের রক্ষণ যেমন অস্তিত্বহীনতায় ভুগছিল, তাতে সফরকারী শিবিরে আরও বড় কিছুর শঙ্কাও উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল ভালোমতোই। ২৬ আর ২৯ মিনিটে মাহরেজ আর ফিল ফোডেন দুটো মোক্ষম সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে হয়তো সেটা হয়েও যেত। তবে রিয়ালের সৌভাগ্য, সুযোগ দুটো বেরিয়ে গেছে কানের পাশ দিয়ে।
দুটো মিসের পরই ক্যামেরা সরে গিয়েছিল ডাগ আউটে। তীব্র আক্রোশে তখন ফেটে পড়ছিলেন কোচ গার্দিওলা। কেন ফেটে পড়ছিলেন সেটা বোঝা গেল একটু পরই। ৩৩ মিনিটে বাম প্রান্ত থেকে ফেরলান্দ মেন্দির ক্রসে দারুণ এক গোল করে বসেন কারিম বেনজেমা। সেই গোল স্কোরলাইন করল ২-১, আর রিয়ালকে দিলো ম্যাচে ফেরার সঞ্জীবনী সুধা।
বিরতির পরই দারুণ একটা সুযোগ এসেছিল সিটির সামনে। গোলের খোঁজে হন্যে হয়ে আক্রমণে ওঠা রিয়ালকে প্রতি আক্রমণে প্রায় বিপদে ফেলেই দিচ্ছিলেন রিয়াদ মাহরেজ৷ তবে তার শটটা গিয়ে কাঁপায় বাম প্রান্তের পোস্টটা, ফিরতি সুযোগে ফোডেনের শট গোললাইন থেকে ফেরান কারভাহাল, সে যাত্রায় বিপদ থেকে মুক্তি মেলে রিয়ালের।
সে ‘মুক্তির’ স্থায়িত্ব অবশ্য ছিল কেবল মিনিট পাঁচেক। আগের আক্রমণে গোলবঞ্চিত ফোডেন ফের্নান্দিনিওর ক্রসে মাথা ছুঁইয়ে করেন দারুণ এক গোল। রিয়ালও জবাব দিল ১২০ সেকেন্ডের কম সময়ে। রক্ষণ থেকে আসা পাস থেকে দারুণ এক ডামিতে মার্কার ফের্নান্দিনিওকে ছিটকে দেন ভিনিসিয়াস জুনিয়র, তার গতির কাছে হার মানে সিটির ‘হাইলাইন’ মানা রক্ষণ; সিটি বিপদসীমায় উঠে এসে ঠাণ্ডা মাথায় জালে জড়ান ব্রাজিলিয়ান এই স্ট্রাইকার। ৫৫ মিনিটে ৩-২ স্কোরলাইন তখন অপেক্ষায় আরও গোলের।
মিনিট বিশেকের মধ্যে সে অপেক্ষা ফুরোলোও। বক্সের বাইরে ওলেক্সান্দ্র জিনচেঙ্কো ফাউলের শিকার হয়েছিলেন; রিয়াল রক্ষণ তো বটেই, সিটির খেলোয়াড়রাও তখন ভাবছিলেন ফ্রি কিকের কথা। তবে সেই সুযোগটাই নেন বার্নার্ডো সিলভা, বক্সের বাইরে থেকে বল নিয়ে ঢুকে করে বসেন দারুণ একটা গোল, থিবো কোর্তোয়াসহ রিয়ালের রক্ষণকে তখন মনে হচ্ছিল রীতিমতো ‘অস্তিত্বহীন’।
রিয়াল এর পরও হাল ছাড়েনি। ৮২ মিনিটে ফল পায় দলটি। বক্সে ভেসে আসা ক্রসে ভুলে হাত ছুঁইয়ে বসেন রুবেন ডিয়াজ। পেনাল্টি থেকে পানেনকা শটে বল জালে জড়ান বেনজেমা। যার ফলে শুরুটা যাচ্ছেতাই হলেও শেষটা ৪-৩ স্কোরলাইন নিয়ে করতে পারে রিয়াল। শেষ চারের বৈতরণী পেরোনোর আশাটাও টিকে রইলো ভালোভাবেই।
তবে ৪-৩ গোলের এই জয় সিটিকে খানিকটা কৌলিন্যের স্বাদও এনে দিয়েছে বৈকি। বায়ার্ন মিউনিখ আর জুভেন্তাসের পর ইতিহাসে মাত্র তৃতীয় দল হিসেবে টানা তিন ইউরোপীয় লড়াইয়ে হারিয়েছে রিয়ালকে। ফিরতি লেগের আগে পেপ গার্দিওলার দলকে খানিকটা সুখানিভূতি দেবে যা।
সুখানুভূতি আরও এক কারণে পেতে পারে সিটি। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে এ নিয়ে ষষ্ঠ লড়াইয়ে প্রথম লেগে হারল রিয়াল, আগের পাঁচ বারই বিদায় নিতে হয়েছিল প্রতিযোগিতা থেকে। সংখ্যাটাকে যে এবার ছয়ে উন্নীত করতে চাইবে সিটি, তা বলাই বাহুল্য।