২০০১ সালে রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ পাঁচজন নিহতের ঘটনায় জড়িত ছিলেন শফিকুল ইসলাম। ২০০৮ সাল পর্যন্ত হরকাতুল জিহাদের (হুজিবি) সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। একই বছর নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন আব্দুল করিম।এরপর নরসিংদীর এক চরের মসজিদে প্রতিমাসে পাঁচ হাজার টাকা বেতনে ইমামতি শুরু করেন।
ইমামতির আড়ালে তিনি মানুষকে ধর্মের নামে বিভ্রান্তিমূলক অপব্যাখ্যা চালাতেন। মাঝে মধ্যে কৌশলে বিভিন্ন জায়গায় তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতেন।গত ২১ বছর তিনি এভাবেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে বিভিন্নস্থানে আত্মগোপনে ছিলেন। তাকে শনাক্তে র্যবের গোয়েন্দারা বেশ কিছুদিন নজরদারি চালায়। সবশেষ বৃহস্পতিবার রমনা বটমূলে বোমা হামলার মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ও একাধিক মামলার পলাতক আসামী মুফতি শফিকুর রহমানকে কিশোগঞ্জের ভৈরব থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
বাহিনীটি জানায়, নিজের একমাত্র ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল মুফতি শফিকুর রহমানের। ছেলের সঙ্গে কখনও নরসিংদীতে দেখা করতেন না। জেলার বাইরে গিয়ে দেখা করত। ছেলেকে অনুসরণ করেই শফিকুলকে গ্রেপ্তার করা হয়।
আজ দুপুরে কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান চলাকালীন দুর্বৃত্তদের বোমা হামলায় দশজনের মৃত্যু হয়। আহত হন আরো অনেকে। এ ঘটনায় রমনা থানায় একটি হত্যা মামলা এবং বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা হয়। ওই হত্যা মামলায় ২০১৪ সালের ২৩ জুন আটজনকে মৃত্যুদন্ড এবং ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয় আদালাত। তাছাড়া বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইবুন্যাল-১ এ বিচারাধীন রয়েছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে একটি জনসভা চলাকালে প্রকাশ্য দিবালোকে গ্রেনেড হামলা হয়। হামলায় ২৪ জন নিহত হন এবং তিন শতাধিক মানুষ গুরুতর আহত হন। ওই ঘটনায় ঢাকার মতিঝিল থানায় একটি হত্যা ও হত্যাচেষ্টার সহযোগিতাসহ দুইটি পৃথক মামলা হয়। দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে গত ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইবুন্যাল ১৯ জনকে মৃত্যুদন্ড এবং মুফতি শফিকুর রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করেন। গ্রেপ্তার শফিকুর রহমান ওই গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। একই ঘটনায় ঢাকার মতিঝিল থানায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের করা অপর মামলারও পলাতক আসামী তিনি।
র্যাব মুখপাত্র বলেন, ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদর থানাধীন বৈদ্যের বাজারে গ্রেনেড হামলায় সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ পাঁচজন নিহত এবং কমপক্ষে শতাধিক লোক আহত হন। ওই হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার শফিকুর রহমান চার্জশিটভুক্ত আসামী। গ্রেপ্তার মুফতি শফিকুরের বিরুদ্ধে ভৈরব থানায় মোট ছয়টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।
গ্রেপ্তার শফিকুর জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, কিশোরগঞ্জের ভৈরবে নিজ গ্রামে ৫ম শ্রেণি পাস করার পর মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। ১৯৭৫ সালে ঢাকার চকবাজারে একটি মাদ্রাসা থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত হেদায়ায় পড়াশোনা করেন।এরপর পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত দাওরায়ে হাদিস (টাইটেল) পাস করে বাংলাদেশে ফেরত আসেন।
১৯৮৭ সালে পাকিস্তানের করাচিতে ইউসুফ বিন নুরী মাদ্রাসার ফতোয়া বিভাগে ভর্তি হন। সেখানে তিনি ৩ বছরের ইফতা (ফতোয়া) কোর্স সম্পন্ন করেন। করাচীর নিউ টাউনে পড়াশোনা করার সময় মুফতি হান্নানের সঙ্গে পরিচয় হয়। ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তানে যান তিনি। সেখানে গিয়ে তালেবানদের পক্ষে যুদ্ধ করেন। আফগানিস্তানে থাকাকালীন জঙ্গী সংগঠন ‘হরকাতুল জিহাদের’ সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। পরে ওই বছরের শেষের দিকে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। বাংলাদেশে আসার পর ঢাকার খিলগাঁওয়ে একটি মাদ্রাসায় পার্ট টাইম শিক্ষকতা শুরু করেন।
আফগানিস্তান থেকে দেশে এসে ‘হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজিবি) নামে একটি জঙ্গি সংগঠন গড়ে তোলার চিন্তা করেন। ১৯৯০ সালে সমমনাদের সাথে নিয়ে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে ‘হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ(হুজিবি) সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯০ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি ‘হরকাতুল জিহাদ (বি)’ এর প্রচার সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯৩ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তিনি হরকাতুল জিহাদের আমীর ও ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত হরকাতুল জিহাদের সুরা সদস্য ছিলেন।
২০০১ সালে রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা এবং ২০০৫ সালের ২৭শে জানুয়ারি হবিগঞ্জের বৈদ্যের বাজারে গ্রেনেড হামলায় সাবেক অর্থ মন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ ৫ জন নিহত এবং শতাধিক লোক আহতের ঘটনায় সম্পৃক্ত মুফতি শফিকুর। ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত রমনা বটমূলে হামলার পর তিনি আত্মগোপনে থেকে সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন। ২০০৮ থেকে নরসিংদীতে একটি মাদ্রাসায় অবস্থান করে আত্মগোপনে চলে যান।
নাম পরিচয় গোপন করে ২১ বছর আত্মগোপন: শফিকুর রহমান নরসিংদী থাকাকালীন নিজের পরিচয় গোপন করে ‘আব্দুল করিম’ ছদ্মনামে চলা ফেরা করতেন। সেখানকার একটি চরে মসজিদে মাসিক পাঁচ হাজার টাকা বেতনে ইমামতির চাকরি করতেন। ইমামতির আড়ালে তিনি মানুষকে ধর্মের নামে বিভ্রান্তিমূলক অপব্যাখ্যা প্রচার করতেন। তিনি অত্যন্ত কৌশলে মাঝে মধ্যে ভিন্ন স্থানে তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। বিগত ২১ বছর তিনি এভাবেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে ছিলেন।