কুমিল্লার দেবীদ্বারের শাহীনুর বেগম। তিন সন্তানের এই জননী কখনও বাসে চড়ে রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত যাননি। অথচ তিনিই প্রায় ৭ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলির একটি দ্বীপে মাফিয়া চক্রের হাতে বন্দি ছেলেকে মুক্ত করে দেশে ফিরেছেন।
অভাবের সংসারের হাল ধরার জন্য বাসত ভিটার একটি অংশ বিক্রি করে ছেলে ইয়াকুব হাসানকে লিবিয়া পাঠিয়েছিলেন শাহিনুর বেগম। তার স্বামী আবুল খায়েরও লিবিয়া প্রবাসী। সেখানে তারা রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন।
তবে, সেখান থেকে অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে মাফিয়া চক্রের হাতে অপহরণের শিকার হন ইয়াকুব।
দীর্ঘ ৬ মাস ধরে ছেলের খোঁজ না পেয়ে শাহীনুরের সংসারে অশান্তি নেমে আসে। ছেলের শোকে স্বামী আবুল খায়ের বেশ কয়েকবার হৃদরোগে আক্রান্ত হন।
এরপরই দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত নেন শাহীনুর বেগম। প্রবাসী স্বামীর সহযোগিতায় পাসপোর্ট ও ভিসা নিশ্চিত করে ছেলের সন্ধানে নিজেই চলে যান লিবিয়ায়।
বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা না জানা শাহীনুর লিবিয়া গিয়ে প্রবাসী, বাংলাদেশ দূতাবাস এবং জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সহযোগিতায় মাফিয়াদের হাতে বন্দি ছেলেকে উদ্ধার করে দেশে ফেরেন। একই সঙ্গে মাফিয়াদের হাতে আটকে পড়া আরও প্রায় ২৫০ বাঙালি উদ্ধার করা হয়।
মা শাহিনুরের এমন সাহসী ভূমিকা ও ভালোবাসার দৃষ্টান্ত কুমিল্লাজুড়ে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে । গত ২১ মার্চ ছেলেকে নিয়ে কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার কালিকাপুর গ্রামে নিয়ে আসেন।
সোমবার (১১ এপ্রিল) সরেজমিনে উপজেলার কালিকাপুর শাহিনুরের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে অনেক মানুষের সমাগম। সবাই মা-ছেলেকে দেখতে এসেছেন। শাহিনুর বেগম ও তার ছেলে ইয়াকুব হাসানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল তাদের দুঃসাহসী অভিযানের কাহিনি।
শাহিনুর বেগম বলেন, “সবাই বলেছিল আমার ছেলে মারা গেছে। তাকে মেরে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। চার দফায় ছেলেকে উদ্ধারের জন্য আমি ও আমার লিবিয়া প্রবাসী স্বামী দালালকে প্রায় ২০ লাখ টাকা দিয়েছি। ছয় মাসেও ছেলের কোনো খোঁজ না পেয়ে পাসপোর্ট ও ভিসা নিশ্চিত করে নিজেই লিবিয়ায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।”
তিনি জানান, পরিবারের অভাব দূর করতে ২০১১ সালে দালালের মাধ্যমে লিবিয়ায় পাড়ি জমান তার স্বামী আবুল খায়ের। এর মধ্যে তার দুই মেয়ের বিয়ে হয়। সংসারে আরও একটু স্বচ্ছলতা আনতে সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ২০১৯ সালের মে মাসে একমাত্র ছেলে ইয়াকুব হাসানকেও পাঠান লিবিয়ায়।
ইয়াকুব লিবিয়ায় বেনগাজি শহরের কনস্ট্রাকশন ফার্মে কর্মরত তার বাবার কাছে থাকতেন। প্রথম দুই বছর ভালোই চলছিল। ইয়াকুব প্রথম এক বছর আল হারুজ তেলের পাম্পে ৩৫ হাজার টাকায় এবং পরের এক বছর হাকজিলতন তেলের পাম্পে ৪৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন।
পরে হবিগঞ্জের দালাল জাহাঙ্গীরের খপ্পরে পড়ে অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ত্রিপোলি থেকে নৌকায় করে আরও প্রায় ১৫০ জনের সঙ্গে ইতালি যাওয়ার পথে লাম্পেদুসা দ্বীপে কোস্টগার্ডের কাছে ধরা পড়ে তারা। সেখান থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য এক বাঙালি দালাল ধরে বাবার সহযোগিতায় চার লাখ টাকায় মুক্তি পান।
সেখান থেকে ফিরে এসে আট মাস পরে আবারও অবৈধ পথে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করে আরেকটি মাফিয়া চক্রের হাতে ধরা পড়েন তিনি। সেখানে চলে অমানবিক জীবন। একটি কক্ষে প্রায় ৬০-৭০ জনকে রাখা হয়। খাদ্যসংকট, শারীরিক নির্যাতনসহ নানা কারণে প্রতিদিনই মারা যেতে থাকেন বন্দিদের কেউ না কেউ। লাশের পচা গন্ধ, ক্ষুধা, পানিসংকট আর টাকার জন্য চলে অমানবিক নির্যাতন।
শাহিনুর জানান, তিনি এ বছরের ৯ জানুয়ারি লিবিয়ার উদ্দেশে পাড়ি দেন। স্বামীর সঙ্গে লিবিয়ায় বেনগাজিতে অবস্থান করে দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এছাড়া সেনাবাহিনী ও আইওএমের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় দালালদের কাছ ছেলেসহ অন্য বন্দিদের ছাড়িয়ে আনেন।
ইয়াকুব বলেন, “জেলে আমাদের খুব অত্যাচার করা হতো। খাওয়ার জন্য একটা রুটি আর পানি দিত। ২২ দিন জেলে থাকার পর কোস্ট গার্ডকে চার লাখ টাকা দিয়ে আমি ছাড়া পাই। প্রায় আট মাস পর আবারও ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু সেবার বিপদ আরও বেড়ে যায়। এ সময় মাফিয়ারা আবার বন্দি করে নিয়ে যায়।”
শাহিনুর বলেন, “আইওএম কর্মকর্তারা লিবিয়া সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইয়াকুবকে উদ্ধার করেন। তারা ফোনে আমার সঙ্গে ওর কথা বলিয়ে দেন। ফোনে ছেলের কণ্ঠ শুনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠি। আমার ছেলেও ওপাশ থেকে কাঁদতে থাকে। ছেলেকে দেখার জন্য বুকটা ফেটে যাচ্ছিল।”