বাণিজ্যমন্ত্রীর অভিযোগের পরও চাঁদাবাজি থামছে না পণ্যবাহী ট্রাকে। খোদ পুলিশের বিরুদ্ধেও এই চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। আর এই চাঁদার ভার শেষ পর্যন্ত বইতে হচ্ছে সাধারণ ক্রেতাদের।
এই কারণেই ঢাকায় তরমুজ ৫০০ টাকায়, বেগুনের কেজি ১২০ টাকা আর লেবু ৬০ টাকায় বিক্রি হয় বলে জানান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহনশ্রমিক সমিতির সভাপতি মো. হানিফ খোকন।
তিনি জানান, চাঁদা মেটাতে গিয়ে পণ্য পরিবহন খরচ অনেক বেড়ে যায়। সাতক্ষীরা থেকে একটি মাছের ট্রাক চট্টগ্রাম রিয়াজউদ্দিন বাজারে যেতে তিন-চার হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। পঁচনশীল দ্রব্য হলে চাঁদার পরিমাণ বেড়ে যায়।
চট্টগ্রামের রিয়াজুদ্দিন বাজারে সকাল সাতটার মধ্যে মাছ নিয়ে যেতে না পারলে সেই মাছ বিক্রি করা সম্ভব নয়। আবার ঢাকার কারওয়ান বাজারেও মাছ, শাকসবজি সকাল সাতটার মধ্যে নিয়ে আসতে না পারলে আর উপায় নেই, তাই বাধ্য হয়েই চাঁদা দিতে হয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
আন্তঃজেলা ট্রাক চালক মেহাম্মদ নিয়ামত আলী জানান, প্রতিটি ট্রিপে নানা পর্যায়ে চাঁদা দেওয়া ছাড়া মাসিক ভিত্তিতে চাঁদা দিতে হয়। তিনি বলেন,“চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় একটি ট্রাক পণ্য নিয়ে এলে চার-পাঁচ জায়গায় চাঁদা দিতে হয়। এর মধ্যে মালিক- শ্রমিক ইউনিয়ন, পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, বিভিন্ন এলাকার প্রভাবশালীরা রয়েছেন। এক ট্রিপে দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। আর পুলিশকে মাসিক চাঁদা দিতে হয় দুই হাজার টাকা। এজন্য তারা আমাদের কার্ড বা টোকেন দেয়।”
তিনি বলেন, “আমরা যখন ভাড়া ঠিক করি তার মধ্যে এই চাঁদার টাকা ধরেই ভাড়া ঠিক করি। ফলে পরিবহন খরচ বেড়ে যায়৷ আর এই কারণে শাক-সবজি, মাছ বা কাঁচামালের দামও বেড়ে যায়।”
পণ্য পরিবহন ট্রাক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোতালেব বলেন, “পুলিশের কেন্দ্রীয় চাঁদা ছাড়াও হাইওয়ে পুলিশকে আলাদাভাবে চাঁদা দিতে হয়। বিভিন্ন স্পটে নানা অজুহাতে ট্রাক দাঁড় করিয়ে পুলিশ চাঁদা নেয়। এর বাইরে এখন পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন, ফেরির সিরিয়াল পেতে ফেরির লোজনকে চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা না দিয়ে আমাদের উপায় নেই।”
অবশ্য মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের ৩০টাকা করে মোট ৬০ টাকা করে চাঁদা আদায় বৈধ বলে দাবি করেন তিনি।
একাধিক সূত্র জানায়, এখানে একটি অশুভ আঁতাতও রয়েছে। ফিটনেসহীন বা চলাচলের অনুপযোগী ট্রাক পুলিশের সঙ্গে সমঝোতা করে পণ্য পরিবহন করে। তারা মাসিক ভিত্তিতে টাকা দিয়ে কার্ড সংগ্রহ করে। এই কার্ড তাদের ‘অবৈধতার বৈধতা’ হিসেবে কাজ করে এবং সারাদেশেই তাদের পণ্য পরিবহনের অনুমতি দেয়।
তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের মোট সংখ্যা প্রায় তিন লাখ৷ প্রতিটি ট্রাক যদি ট্রিপ প্রতি দুই হাজার টাকা করেও চাঁদা দেয় তাহলে মোট চাঁদা আদায় হয় ৬০ কোটি টাকা। যদি দুই দিনে একটি ট্রিপ ধরা হয় তাহলে মাসে আদায় হয় কমপক্ষে ৯০০ কোটি টাকা। এই পরিমাণ চাঁদা অবিশ্বাস্য কী না জানতে চাইলে শ্রমিক নেতা হানিফ খোকন বলেন, “মোটেও অবিশ্বাস্য নয়। আরও অনেক খাতে চাঁদা আদায় হয়। এখন মৃত মানুষের জন্যও চাঁদা নেওয়া শুরু হয়েছে।”
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি( মিডিয়া এন্ড প্ল্যানিং) হায়দার আলি খান বলেন, “চাঁদাবাজির কোনো অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিকভাবে আমরা ব্যবস্থা নিই। আর কেউ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করলেও আমরা ব্যবস্থা নিই। ৯৯৯-এ অভিযোগ করা যায়। হাইওয়ে পুলিশ ফেসবুকে প্রচার করেছে, নম্বর দেওয়া আছে। পুলিশ সদর দপ্তর থেকেও প্রচার করা হচ্ছে, নম্বরগুলোতে অভিযোগ করলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এটা তো আমাদের জানাতে হবে। জেলার এসপি আছেন, রেঞ্জ ডিআইজি সাহেব আছেন, হাইওয়ে পুলিশের আলাদা ইউনিট আছে সেখানে অভিযোগ করতে পারেন।”
মাসিক চাঁদার কার্ড প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমরা এই অভিযোগ অনুসন্ধান করে দেখছি।”
ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সভাপতি রুস্তম আলী খান বলেন, “আমরা সব জায়গায়ই অভিযোগ দিয়েছি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও অভিযোগ দিয়েছি৷ আর কার কাছে দেব? পুলিশ ছাড়াও এখন সিটি কর্পোরেশন চাঁদা নেওয়া শুরু করেছে। হাইওয়েতে ট্রাক দাঁড় করিয়ে চাঁদা নেওয়া হয়।” তবে মালিক সমিতির চাঁদার নেওয়া এখন বন্ধ রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
(সূত্র ঢাকা ট্রিবিউন)