দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ডায়রিয়া। এক মাস আগেও যেখানে আইসিডিডিআর,বিতে প্রতিদিন ৪৫০ থেকে ৫০০ রোগী ভর্তি হতো, এখন সেখানে ভর্তি হচ্ছে ১২৫০ জন থেকে ১৩০০ জন। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, হাসপাতালের বিছানায় রোগীদের আর ঠাঁই হচ্ছে না। আইসিডিডিআর,বিতে তাঁবু টানিয়ে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
আইসিডিডিআর,বি’র হাসপাতাল শাখার প্রধান ডা. বাহারুল আলম এ বিষয়ে বলেন, “দুই মৌসুমে বাংলাদেশে ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ে। একটা গরমের শুরুতে, আরেকটা শীতের শুরুতে। এখন গরমের মৌসুম শুরু হচ্ছে, ফলে ডায়রিয়ার রোগী কিছুটা বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গত কয়েকদিনে এই বৃদ্ধির হারটা একটু বেশি। দুই মাস আগের তুলনায় এখন অন্তত আড়াই গুণ রোগী বেশি ভর্তি হচ্ছে। সবার মধ্যে একটা ভুল ধারণা আছে, সেটা হলো ডায়রিয়া হলেই আইসিডিডিআর,বিতে যেতে হবে। ফলে আমাদের এখানে রোগীর চাপ এতটাই বেশি যে, আমরা স্বাভাবিক চিকিৎসা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারছি না। সরকারি যে কোনো হাসপাতালে গেলেই ডায়রিয়া রোগের চিকিৎসা পাওয়া যায়। সব জায়গাতেই একই ধরনের চিকিৎসা।”
গরমের মৌসুম শুরু হলে ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ে, এটা তো আগে থেকেই জানা তাহলে কেন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না? এর জবাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজীর আহমেদ বলেন, “এর জন্য একটা সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। আমি যখন দায়িত্বে ছিলাম, তখন স্বাস্থ্য বিভাগের পাশাপাশি সিটি করপোরেশন ও ওয়াসাকে সঙ্গে নিয়ে কিছু যৌথ উদ্যোগ নিয়েছিলাম। সেগুলোর আর বাস্তবায়ন হয়নি। মূলত আইসিডিডিআর,বি এই উদ্যোগগুলো নিতে পারে। তাদের মূল কাজ তো ডায়রিয়া নিয়ে গবেষণা করা। কিন্তু তারা এখন এই কাজের বাইরে আরো অনেক রোগ নিয়ে গবেষণা করছে। ফলে মূল কাজ থেকে ফোকাস হারিয়ে যাচ্ছে। এখন এদিকে তাদের মনোযোগ দরকার।”
আইসিডিডিআর,বি’র হিসাবে গত এক সপ্তাহে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সেখানে ভর্তি হয়েছে সাড়ে আট হাজারেরও বেশি রোগী। গত মঙ্গলবার ১ হাজার ২৭২, বুধবার ১ হাজার ২৩৩, বৃহস্পতিবার ১ হাজার ১৭৬, শুক্রবার ১ হাজার ১৩৮, শনিবার ১ হাজার ২৪৫, রবিবার ১ হাজার ২৩০, সোমবার ১ হাজার ২০৭ জন রোগী ভর্তি হয়েছে এই হাসপাতালে। সাত দিনে এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট সাড়ে আট হাজার ডায়রিয়া রোগী, অর্থাৎ দৈনিক গড়ে ১ হাজার ২১৪ জন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, “মহামারির বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর মানুষের অসাবধানতা, বাইরের খাবার ও পানীয় গ্রহণে অসতর্কতার কারণে এবার ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়েছে। বিশেষ করে ঢাকার নির্দিষ্ট কয়েকটি এলাকা থেকে রোগী বেশি আসে। ঢাকার যাত্রাবাড়ী, মুগদা, শনিরআখড়া, মানিকনগর, উত্তরখান, দক্ষিণখান, কড়াইল, মোহাম্মদপুর, মিরপুরে ডায়রিয়ার প্রকোপটা বেশি। ওইসব এলাকায় এখন খাবার জলের তীব্র সংকট। ফলে ওই এলাকার বাসিন্দারা যে পানি খাচ্ছেন, সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দূষিত। এখন ওয়াসাকে দ্রুত ওইসব এলাকায় খাবার পানির ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।”
তিন দিন আগে পেট ব্যথা আর পাতলা পায়খানা শুরু হলে মিরপুরের ভাসানচরের সাকিলা পারভিনকে আইসিডিডিআর,বিতে নেওয়া হয়। মূল হাসপাতালে জায়গা না হওয়ায় তাকে তাবুতে থাকতে দেওয়া হয়েছে। তার মতো কয়েকশ রোগী এখন তাবুতে চিকিৎসা নিচ্ছে।
গৃহবধূ সাকিলার স্বামী রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমাদের বাসার কল দিয়ে যে পানি আসছে তাতে কয়েকদিন ধরেই গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। পানি ফুটানোর পরও গন্ধ যায় না। এর মধ্যে আবার ওই দিন বিকেলে ঘুরতে বেড়িয়ে ফুচকা খেয়েছে। রাতেই পেট ব্যথা শুরু হয়। সকাল থেকে পাতলা পায়খানা আর বমি। একদিন বাসায় রেখে চেষ্টা করেছি, কিন্তু পায়খানা বন্ধ না হওয়ায় আমরা তাকে আইসিডিডিআর,বি’তে নিয়ে আসি।”
শুধু কি খাবার জলের কারণেই এমনটা হচ্ছে? ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, “এটা প্রধান কারণ। কিন্তু এর বাইরেও অনেকগুলো কারণ আছে। গত দুই বছর করোনাভাইরাসের কারণে আমরা অত্যন্ত সতর্ক ছিলাম। ফলে সবাই মাস্ক পরে চলেছি, কিছুক্ষণ পরপর সাবান দিয়ে হাত ধুয়েছি। ফলে জীবাণু আর পেটে যেতে পারেনি। এখন বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর এসব কিছু আর মানছি না। ফলে ডায়রিয়াটা বেড়ে গেছে। পাশাপাশি বায়ু দূষণের কারণেও কিন্তু ডায়রিয়া হতে পারে। ঢাকার রাস্তায় এখন যে পরিমাণ ধূলা, তাতে বায়ু দূষণ বেড়ে গেছে। এর সঙ্গে অনেকেই বাইরের খাবার বেশি খাচ্ছেন। বাচ্চারা স্কুলের সামনে থেকে যা পাচ্ছে, সেগুলো খাচ্ছে। এতে ডায়রিয়া ছড়িয়েছে বেশি। আমার পরামর্শ হলো, বাইরের খাবার, পানি না খাওয়া। বাইরে কোথাও গেলে খাবার এবং পানি বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া। সবচেয়ে বড় কথা হলো, খাবার আগে সাবান দিয়ে হাত ধোঁয়া দরকার। মাস্কটাও পরতে হবে।”