১৯৮৫ সাল। মাহবুব জামাল শামীম, হিরণ্ময় চন্দ সহ কয়েকজন তরুণ মাত্র চারুকলার পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ফিরে গেছেন নিজ শহর যশোরে। সেখানে গিয়ে তারা ‘চারুপীঠ’ নামে একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেন। উদ্দেশ্য রঙ, পেন্সিল আর কাদামাটি দিয়ে শিশুদের শৈশব রাঙানো। এই চারুপীঠ থেকে তাঁদের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল প্রথম ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’- আর সেটা শুরু হয়েছিল ভৈরব নদের তীর ঘেঁষা শহর যশোরে।
কিন্তু শুরুটা হল কিভাবে? হুট করেই প্ল্যান হল, বাংলা নতুন বছরকে বরণ করে নিতে অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে। যেই ভাবা, সেই কাজ। সবাই চৈত্রের শেষ রাতে পুরো যশোর শহরের রাস্তা ও দেয়াল জুড়ে আলপনা আঁকতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তাঁরা । আরও প্ল্যান হল একটা মিছিল বের হবে, একটা শোভাযাত্রা। কেউ জানতেন না যে তাঁদের এই শোভাযাত্রা একদিন জাতীয় উৎসবে পরিণত হবে, বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হবে স্বীকৃতি পাবে ইউনেস্কোর (The United Nations Educational, Scientific and Cultural Organization- UNESCO)।
পরদিন ভোর বেলায় যশোর শহর দেখল এক অদ্ভুত দৃশ্য! একদল ছেলে মেয়ে পাঞ্জাবি আর শাড়ি পরে সানাইয়ের সুরে, ঢাকের তালে মুখোশ আর ফেস্টুন নিয়ে নেচে গেয়ে পুরো শহর ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর এভাবেই জন্ম হল মঙ্গল শোভাযাত্রার। শুরুতে যে উৎসবের নাম ছিল বর্ষবরণ শোভাযাত্রা।
পরের মঙ্গল শোভাযাত্রাটাও হল ঐ যশোরেই। এবার শহরের অন্য সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও চারুপীঠের এই আয়োজনে যোগ দিল। গঠিত হল ‘বর্ষবরণ পরিষদ’। তখন দেশে অগণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা চলছিল।ওরা চেয়েছিল,সেখানে একটা আঘাত করতে। আর তাই শোভাযাত্রায় রাক্ষসকে স্বৈরশাসকের প্রতিরূপ হিসেবে দেখানো হয়েছে। পাশাপাশি আমরা আমাদের সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছি কি না, সেটাও মাথায় রেখে সাড়ে তিন হাজার মুখোশ, বড় একটি হাতি,দশটি ছোট ঘোড়া সহ আরও অনেক কিছু তৈরি করা হল। কিন্তু প্রশ্ন হল, যশোরের সেই শোভাযাত্রা কিভাবে সারা বাংলাদেশের হয়ে উঠলো?
উত্তর হচ্ছে, মাহবুব জামাল ১৯৮৮ সালে পড়াশোনার জন্য আবার চারুকলায় ফিরে যান। তাঁর সঙ্গে ফিরে যান তাঁর চারুকলার অন্য বন্ধুরা যারা তাঁর সাথে যশোর চারুপীঠে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজনের সহযোদ্ধা ছিলেন। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৮৯ সালে চারুকলার শিক্ষার্থীদের মঙ্গল শোভাযাত্রা করতে উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করেন তারা।
আর এভাবেই ১৯৮৯ সালে বঙ্গাব্দ ১৩৯৬ বর্ষবরণের সময় শিক্ষার্থীদের আয়োজনে প্রথম ঢাকায় শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শুরু হলেও মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রথম হয় ঐ বছরে। প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রার পোস্টার করেছিলেন চারুকলার পেইন্টিং ডিপার্টমেন্টের ছাত্র সাইদুল হক জুইস। ‘লক্ষ্মীসরা’ ছিল সেই পোস্টারের প্রতিপাদ্য। তখন কেউ খুব ভালো মুখোশ বানাতে পারতেন না। অতঃপর দৃশ্যপটে হাজির হলেন তরুণ ঘোষ। বিদেশে মাস্টার্স করতে গিয়ে তিনি মুখোশ বানানো শিখে এসেছিলেন। ব্যাস আর কি লাগে!
চারুকলার ছাত্রদের তৈরি বঙ্গাব্দ ১৩৯৬ সালের (১৯৮৯ খৃস্টাব্দ) প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রার পোস্টার। শুধুমাত্র নিজেদের উৎসাহ আর ইচ্ছা থেকে সেই শোভাযাত্রা হয়েছিল। তারা নিজেরা নিজেরাই সব কাজ করলেন, পরিচিত বন্ধু বান্ধবদের কাছ থেকে টাকা জোগাড় করলেন। হুট করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সহ জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলো এই আয়োজন নিয়ে উৎসাহী হয়ে উঠল। মানুষের মুখে মুখে তখন এই শোভাযাত্রার আলাপ। পেপারে প্রকাশিত হল শোভাযাত্রার ফটো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা বঙ্গাব্দ ১৩৯৬ সাল (১৯৮৯ খৃস্টাব্দ) তার পরের বছর মানে ১৯৯০ সালে চারু শিল্পী সংসদ সহ নবীন-প্রবীণ সব চারুশিল্পী মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেন। ছিলেন সালেহ মাহমুদ, ফরিদুল কাদের, ফারুক এলাহী, সাখাওয়াত হোসেন, শহীদ আহমেদ সহ সকল স্বনামধন্য শিল্পী। আর তাঁদের সঙ্গে অংশ নেন চারুকলার তৎকালীন সকল ছাত্ররা।
সিদ্ধান্ত হল চারুকলার শিল্পীরা তাদের তৈরি করা মুখোশ, ভাস্কর্য নিয়ে থাকবেন শোভাযাত্রার একদম সামনের অংশে। কিন্তু এমন একটি অনুষ্ঠান করার মতো টাকা পয়সা তখন চারুশিল্পী সংসদের কাছে ছিল না। তাহলে উপায়? তখন এগিয়ে আসলেন সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ফয়েজ আহমেদ। তিনি বিভিন্ন জায়গা থেকে কিছু টাকার ব্যবস্থা করলেন। আর সেই শোভাযাত্রার পুরো পরিকল্পনা ছিল শিল্পী ইমদাদ হোসেনের। প্রথমে নাম ঠিক করা হয়েছিল: বৈশাখী শোভাযাত্রা কিন্তু একদম শেষ মুহূর্তে যশোরের মঙ্গল শোভাযাত্রা নামটাই চূড়ান্ত করা হল।
১৯৯১ সালে পুরো অনুষ্ঠানের সাথে যুক্ত হয় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। ঐ বছরই সবার অংশগ্রহণে একটি জাতীয় উৎসবের পরিকল্পনা শুরু হয়। সেই শোভাযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর, বিশিষ্ট লেখক, শিল্পীগণ-সহ সাধারণ নাগরিকরা অংশ নেয়।
চারুকলার ছাত্রদের তৈরি বঙ্গাব্দ ১৩৯৮ সালের (১৯৯১ খৃস্টাব্দ) মঙ্গল শোভাযাত্রার পোস্টার।
১৯৯১ সালের মঙ্গল শোভাযাত্রায় ছিল বিশালকায় হাতি সহ বেশ কিছু বাঘের প্রতিকৃতির কারুকর্ম। কৃত্রিম ঢাক আর অসংখ্য মুখোশ দিয়ে তৈরি প্ল্যাকার্ডসহ মিছিলটি নিয়ে একদল ছেলে মেয়ে নাচে গানে উৎসব মুখর পরিবেশ সৃষ্টি করে। ১৯৯২ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রার একদম সামনে ছাত্র ছাত্রীদের কাঁধে ছিল বিরাট আকারের একটি কুমির। বাঁশ এবং নানা রং এর কাপড় দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল কুমিরটি।
১৯৯৩ সালের বর্ষবরণ ছিল বঙ্গাব্দ ১৪০০ সালের সূচনা। আর সে উপলক্ষ্যে ‘১৪০০ সাল উদযাপন কমিটি’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরর চারুকলা ইন্সটিটিউটের সামনে থেকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করে। শোভাযাত্রার আকর্ষণ ছিল বাঘ, হাতি, ময়ূর, ঘোড়া সহ আরও বিভিন্ন ধরনের মুখোশ। চারুকলার সামনে থেকে শোভাযাত্রাটি শুরু হয়ে শাহবাগ মোড় দিয়ে শিশু একাডেমি হয়ে আবার চারুকলায় এসে শেষ হয়।
১৯৯৩ সাল থেকেই মঙ্গল শোভাযাত্রা একটি জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়। আর এরপর দাবানলের মত সেটি ছড়িয়ে পরে পুরো বাংলাদেশে। জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কো ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর বাংলাদেশের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।
১৯৮৩ সালে বরিশালে প্রথম আয়োজন হয় বৈশাখী মেলার। অধ্যাপক বদিউর রহমান, ভাষা সৈনিক নিখিল সেন, সাংবাদিক ও আইনজীবী মানবেন্দ্র বটব্যাল, অধ্যাপক দীপংকর চক্রবর্তী, অধ্যাপক অনুতোষ ঘোষ, গণসঙ্গীতশিল্পী মুকুল দাস, নারায়ণ সাহা, তরুন চন্দ, বিশ্বনাথ মুন্সি, বীর উত্তম মহিউদ্দিন মানিক, শামসুদ্দিন কামাল, অধ্যাপক রমেশ চক্রবর্তী, কাজল ঘোষ, আমান সেরনিয়াবাত, মুরাদ আহমেদ সহ আরও অনেকে মেলা উদযাপনের উদ্যোগ নেন। উদ্যোক্তারা সবাই বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। উদ্যোক্তারা সকলে একমত হয়ে বাংলাদেশের বৃহত্তম সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ব্যানারেই মেলা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেন।
বরিশালে প্রথমবারের মেলা ছিল সাদামাটা স্বল্প পরিসরের। নগরীর জগদীশ সরস্বতী মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে বিকাল ৪টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মেলা বসেছিল। মেলায় বই, মিষ্টি ও মাটির দ্রব্য নিয়ে ১০টি স্টল ছিল। সে সময় বরিশাল শহরের হাটখোলা রোডে চৈত্রসংক্রান্তি মেলা অনুষ্ঠিত হতো। পরের বছর ১৯৮৪ সালে একই জায়গায় মেলার পরিসর আরও বাড়ানো হয়। পরিবর্তন আনা হয় সময়সূচিতে। বিকাল ৪টার বদলে শুরু হয় সকাল ৮টা থেকে। দ্বিতীয় বছরও বিদ্যালয় মাঠে বসে ৩০টি স্টল। দর্শনার্থীর উপচেপড়া ভিড়ে জমে থাকে বৈশাখী মেলার তিন দিন। ১৯৮৫ সালে তৃতীয় উদীচীর বৈশাখী মেলার সামান্য পটপরিবর্তিত হয়। মেলা স্থানান্তর করা হয় নগরীর ব্রজমোহন (বিএম) স্কুল মাঠে। দীর্ঘ ৩৮ বছর ধরে বরিশাল উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী আয়োজন করে আসছে এ মেলার। প্রতি বছর তিন দিনব্যাপী উদীচীর বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয় বরিশালের বিএম স্কুল মাঠে। এসব মেলায় গ্রামীণ খেলাধুলার আয়োজন ছাড়াও প্রদর্শন করা হয় কবিগান, পালাগান, জারিগান, বায়োস্কোপ, জাদু প্রদর্শন ইত্যাদি। এ ছাড়া গৃহস্থালির বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, মসলা, খেলনাসহ এমন কিছু নেই যা এ মেলাগুলোতে পাওয়া যায় না। মেলায় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পজাত হরেক রকম পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রি ছাড়াও আগতদের মনোরঞ্জনের জন্য নানা ব্যবস্থা করা হয়। অতীতে মেলা উপলক্ষে আয়োজন করা হতো কবিগান, জারিগান, পালাগান, বাউলগান, পুতুলনাচ, যাত্রা, গাজীর পটসহ অন্যান্য গান। বিনোদনের জন্য থাকত বায়োস্কোপ, নাগরদোলা, কুস্তি, কাবাডি, ঘুড়ি ওড়ানো ও ঘোরদৌড় প্রতিযোগিতা, ষাঁড়ের লড়াই ও মোরগের লড়াই। এর সবকিছু না হোক কোনো কোনোটি এখনও টিকে আছে। অতীতে বিভিন্ন স্থানে বৈশাখী মেলায় কাঠের আসবাবপত্র, কৃষিপণ্য, কৃষি উপকরণ, বীজ পাওয়া যেত। এখন এগুলো তেমন আর দেখা যায় না। ১৯৯৩ সালে যোগ হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। টানা প্রায় ৩ দশকের বেশি সময় ধরে এ মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রতি বাংলা নববর্ষে বের হচ্ছে। আগে শোভাযাত্রার আয়োজন সীমিত হলেও এখন এ শোভাযাত্রায় যোগ দিতে ভিড় করেন নগরীর হাজার হাজার মানুষ। নারী-পুরুষ, তরুণ-তরুণী, শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সামিল হন বর্ণাঢ্য এই মঙ্গল শোভাযাত্রায়। অসাম্প্রদায়িক চেতনার এই উৎসব আয়োজনে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন চারুকলা, উদীচী সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিগণ।
এখন দেশের প্রায় সকল জেলায় প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে সকাল বেলায় মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়। অশুভ শক্তির বিরূদ্ধে শান্তি, গণতন্ত্র ও বাঙ্গালী জাতিসত্বার ঐক্যের প্রতীক হিসেবে মঙ্গল শোভাযাত্রা আজ বাঙালি জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।আমাদের এই শোভাযাত্রা বিশ্বের বিস্ময়। ১৯৮৯ সালে বিশ্ববিখ্যাত নায়িকা অড্রে হেপবার্ন ঢাকায় আসেন। বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রার ঠিক কয়েক দিন পর। তখনো চারুকলার সর্বত্র শোভাযাত্রায় বহন করা জিনিস সাজানো ছিল। সেগুলো দেখে তিনি পাগল হয়ে যান।
এপ্রিল মাস বাঙালি জাতির কাছে একটা গুরুত্বপূর্ণ ও অনেক গৌরবের মাস। ১৪ ই এপ্রিল শুধু বাংলা নববর্ষ নয়। মুজিবনগর (পূর্বনাম: বৈদ্যনাথতলা), বাংলাদেশের মেহেরপুর জেলায় অবস্থিত এটি একটি ঐতিহাসিক স্থান।মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার যা ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে গঠন করা হয়। তৎকালীন ভবেরপাড়ার বৈদ্যনাথতলায় বর্তমান মুজিবনগরের আম্রকাননে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ এই অস্থায়ী সরকার বা প্রবাসী সরকার শপথ গ্রহণ করে।এই সরকারের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে যদি সরকার গঠন না হতো। তাহলে আমরা কি আজ ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ বা শোভাযাত্রা করতে পারতাম?
এখানে বলে রাখা ভাল, পূর্বপাকিস্তান সব সময়ই বাঙালি সংস্কৃতিকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করত। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারীর প্রতিবাদে ১৯৬৫ সাল ( ১৩৭৫ বঙ্গাব্দে) ছায়ানট নামের একটি সংগঠন রমনা পার্কে পহেলা বৈশাখ বর্ষবরণ উৎসব পালনের আয়োজন করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এসো হে বৈশাখ……এসো , এসো….গানের মাধ্যমে তারা স্বাগত জানাতে শুরু করে নতুন বছরকে।বর্ষবরন এগিয়ে যায় আরো এক ধাপ। বিস্তৃত হতে শুরু করে ছায়ানট নামের সংগঠনটির। যা এখন বাংলাদেশের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটি মহিরূহে পরিণত হয়েছে। ১৯৭২ সালের পর থেকে রমনা বটমূলে বর্ষবরণ জাতীয় উৎসবের স্বীকৃতি পায়। ১৯৮০ সালে বৈশাখী মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে এক ধাপ বাড়তি ছোঁয়া পায় বাংলা নববর্ষ বরণের অনুষ্ঠান। ছড়িয়ে পড়ে সবার অন্তরে অন্তরে। আচ্ছা আমরা কি পারি না, বৈশাখের শোভাযাত্রায় বাংলার ঐতিহ্য পেঁচা, বাঘ,হাতি,পাখির সঙ্গে মুজিব নগরের চিত্র টি ফুটিয়ে তুলতে!?
বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্যবাহী শুভেচ্ছা বাক্য হল “শুভ নববর্ষ”- বাংলা নববর্ষের সময় বাংলাদেশে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। ২০১৬ সালে, ইউনেস্কো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত বর্ষবরণ উৎসবের এই শোভাযাত্রাকে “মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য” হিসেবে ঘোষণা করে।
পরের মঙ্গল শোভাযাত্রাটাও হল ঐ যশোরেই। এবার শহরের অন্য সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও চারুপীঠের এই আয়োজনে যোগ দিল। গঠিত হল ‘বর্ষবরণ পরিষদ’। তখন দেশে অগণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা চলছিল। ওরা চেয়েছিল, সেখানে একটা আঘাত করতে। আর তাই শোভাযাত্রায় রাক্ষসকে স্বৈরশাসকের প্রতিরূপ হিসেবে দেখানো হয়েছে। পাশাপাশি আমরা আমাদের সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছি কি না, সেটাও মাথায় রেখে সাড়ে তিন হাজার মুখোশ, বড় একটি হাতি, দশটি ছোট ঘোড়া সহ আরও অনেক কিছু তৈরি করা হল। কিন্তু প্রশ্ন হল, যশোরের সেই শোভাযাত্রা কিভাবে সমগ্র বাংলাদেশের হয়ে উঠলো?
উত্তর হচ্ছে, মাহবুব জামাল ১৯৮৮ সালে পড়াশোনার জন্য আবার চারুকলায় ফিরে যান। তাঁর সঙ্গে ফিরে যান তাঁর চারুকলার অন্য বন্ধুরা যারা তাঁর সাথে যশোর চারুপীঠে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজনের সহযোদ্ধা ছিলেন। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৮৯ সালে চারুকলার শিক্ষার্থীদের মঙ্গল শোভাযাত্রা করতে উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করেন তারা।
আর এভাবেই ১৯৮৯ সালে বঙ্গাব্দ ১৩৯৬ বর্ষবরণের সময় শিক্ষার্থীদের আয়োজনে প্রথম ঢাকায় শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শুরু হলেও মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রথম হয় ঐ বছরে। প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রার পোস্টার করেছিলেন চারুকলার পেইন্টিং ডিপার্টমেন্টের ছাত্র সাইদুল হক জুইস। ‘লক্ষ্মীসরা’ ছিল সেই পোস্টারের প্রতিপাদ্য। তখন কেউ খুব ভালো মুখোশ বানাতে পারতেন না। অতঃপর দৃশ্যপটে হাজির হলেন তরুণ ঘোষ। বিদেশে মাস্টার্স করতে গিয়ে তিনি মুখোশ বানানো শিখে এসেছিলেন। ব্যাস আর কি লাগে!
চারুকলার ছাত্রদের তৈরি বঙ্গাব্দ ১৩৯৬ সালের (১৯৮৯ খৃস্টাব্দ) প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রার পোস্টার। শুধুমাত্র নিজেদের উৎসাহ আর ইচ্ছা থেকে সেই শোভাযাত্রা হয়েছিল। তারা নিজেরা নিজেরাই সব কাজ করলেন, পরিচিত বন্ধু বান্ধবদের কাছ থেকে টাকা জোগাড় করলেন। হুট করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সহ জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলো এই আয়োজন নিয়ে উৎসাহী হয়ে উঠল। মানুষের মুখে মুখে তখন এই শোভাযাত্রার আলাপ। পেপারে প্রকাশিত হল শোভাযাত্রার ফটো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা বঙ্গাব্দ ১৩৯৬ সাল (১৯৮৯ খৃস্টাব্দ) তার পরের বছর মানে ১৯৯০ সালে চারুশিল্পী সংসদ সহ নবীন-প্রবীণ সব চারুশিল্পী মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেন। ছিলেন সালেহ মাহমুদ, ফরিদুল কাদের, ফারুক এলাহী, সাখাওয়াত হোসেন, শহীদ আহমেদ সহ সকল স্বনামধন্য শিল্পী। আর তাঁদের সঙ্গে অংশ নেন চারুকলার তৎকালীন সকল শিক্ষার্থীরা ।
সিদ্ধান্ত হল চারুকলার শিল্পীরা তাদের তৈরি করা মুখোশ, ভাস্কর্য নিয়ে থাকবেন শোভাযাত্রার একদম সামনের অংশে। কিন্তু এমন একটি অনুষ্ঠান করার মতো টাকা পয়সা তখন চারুশিল্পী সংসদের কাছে ছিল না। তাহলে উপায়? তখন এগিয়ে আসলেন সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ফয়েজ আহমেদ। তিনি বিভিন্ন জায়গা থেকে কিছু টাকার ব্যবস্থা করলেন। আর সেই শোভাযাত্রার পুরো পরিকল্পনা ছিল শিল্পী ইমদাদ হোসেনের। প্রথমে নাম ঠিক করা হয়েছিল: বৈশাখী শোভাযাত্রা কিন্তু একদম শেষ মুহূর্তে যশোরের মঙ্গল শোভাযাত্রা নামটাই চূড়ান্ত করা হল।
অনেক সুন্দর লিখেছেন। তথ্য বহুল লেখা। বেশ ভালো লেগেছে। লিখতে থাকুন।