দ্বিজেন্দ্রলাল রায়: বাঙালি কবি, নাট্যকার এবং সুরকার

রায়হান চৌধুরী
5 মিনিটে পড়ুন

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, বা ডি. এল. রায় (১৯ জুলাই ১৮৬৩ – ১৭ মে ১৯১৩), ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাঙালি কবি, নাট্যকার, এবং সুরকার। তিনি ১৮৬৩ সালের ১৯ জুলাই নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাঙালি সঙ্গীত ও সাহিত্য জগতে বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন তাঁর সুরকৃত গানগুলির জন্য, যেগুলি “দ্বিজেন্দ্রগীতি” নামে পরিচিত, এবং যা বাঙালি সংগীতের একটি বিশেষ শাখা তৈরি করেছে। তাঁর গানের সংখ্যা পাঁচশোরও বেশি এবং এদের মধ্যে অনেক গানের মধ্যে জাতীয়তাবাদী এবং পৌরাণিক বিষয়ের প্রতি তাঁর গভীর প্রেম প্রতিফলিত হয়েছে।

প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জন্ম এক সাংস্কৃতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশে। তাঁর পিতা, কার্তিকেয়চন্দ্র রায়, ছিলেন কৃষ্ণনগর রাজবংশের দেওয়ান (প্রধান কর্মকর্তা)। সেই পরিবেশে তিনি একাধিক গুণীজনের সংস্পর্শে এসেছিলেন। তাঁর মা, প্রসন্নময়ী দেবী, ছিলেন অদ্বৈত আচার্যের বংশধর, যিনি ছিলেন চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রধান শিষ্যদের একজন।

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ছেলেবেলা ছিল চিন্তাশীল, অন্তর্মুখী, এবং প্রকৃতিপ্রেমী। তিনি কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং পরে হুগলি কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করেন। এরপর প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা থেকে ইংরেজি বিভাগে এম.এ. পাশ করেন। তাঁর মেধার জন্য তিনি উচ্চশিক্ষায় বৃত্তি পেয়েছিলেন এবং ১৮৮৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ. পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন।

ইংল্যান্ডে জীবন

১৮৮৪ সালে, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ইংল্যান্ডে কৃষিবিদ্যা অধ্যয়ন করার জন্য সরকারি বৃত্তি পান। ইংল্যান্ডে থাকার সময় তিনি ব্রিটিশ সমাজের সংস্কৃতি, খাবার, পোশাক, এবং আচার-ব্যবহারের প্রতি গভীর আগ্রহী ছিলেন, যা পরবর্তীতে তাঁর “বিলেটার পত্র” (Letters from England) গ্রন্থে প্রকাশিত হয়। তবে ইংল্যান্ডে থাকাকালীন তিনি শোক সংবাদ পান যে তাঁর প্রিয় পিতা-মাতা দুজনেই মারা গেছেন। ১৮৮৬ সালে তাঁর ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ The Lyrics of Ind প্রকাশিত হয়।

- বিজ্ঞাপন -

প্রশাসনিক কর্মজীবন

ইংল্যান্ড থেকে ফিরে এসে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ১৮৮৬ সালে ভারতবর্ষের সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন এবং কৃষি, জরিপ, ভূমি রেকর্ড, এক্সাইজ ইত্যাদি বিভাগে কাজ করেন। তাঁর কাজের মধ্যে তিনি কৃষকদের অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন এবং বর্ধমান জেলার সুজামুতা পরগনায় ভূমি সংস্করণ অফিসার হিসেবে কাজ করার সময় অতিরিক্ত করের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন।

১৮৮৭ সালে তিনি সুরবালা দেবীকে বিয়ে করেন, যিনি ছিলেন প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের কন্যা। তবে ১৯০৩ সালে সুরবালা দেবীর মৃত্যু হয়।

সাহিত্যকর্ম

দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ছিলেন একজন দক্ষ কবি, নাট্যকার, এবং সুরকার। তাঁর সৃষ্টির মধ্যে রয়েছে বহু দেশপ্রেমিক গান, নাটক, এবং কবিতা। তাঁর গানগুলি দ্বিজেন্দ্রগীতি নামে পরিচিত, এবং এগুলোর মধ্যে অনেকগুলি আজও মানুষের হৃদয়ে অমর। তাঁর বিখ্যাত গানগুলির মধ্যে “ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা” এবং “বঙ্গ আমার! জননী আমার! ধাত্রী আমার! আমার দেশ” অতি জনপ্রিয়।

তাঁর নাটকগুলি বেশ কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত: প্রহসন, কাব্যনাট্য, ঐতিহাসিক নাটক এবং সামাজিক নাটক। তাঁর কিছু বিখ্যাত নাটকের মধ্যে “একঘরে”, “কল্কি অবতার”, “সীতা”, “রাণা প্রতাপসিংহ”, “মেবার পতন”, “চন্দ্রগুপ্ত”, “নূরজাহান” ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

জাতীয়তাবাদী কর্ম

দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ছিলেন একজন উচ্চকণ্ঠ জাতীয়তাবাদী। ১৯০৫ সালে বাংলা বিভাজনের পর তিনি একাত্তীকরণের জন্য সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যোগ দেন। তাঁর গান “ধনধান্য পুষ্প ভরা” তখনকার যুগে এক বিরাট জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল, এবং এটি স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়কে চিত্রিত করেছিল।

- বিজ্ঞাপন -

তিনি নারী অধিকার এবং হিন্দু ধর্মের অন্ধ আচার-ব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর মত প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর গ্রন্থ হাসির গান একটি তীব্র সামাজিক সমালোচনা ছিল, যা উচ্চবর্ণ হিন্দু ধর্মীয় প্রথার বিরুদ্ধে একটি রসাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছিল।

শেষ সময়

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের শারীরিক অবস্থা খারাপ হওয়ার পর তিনি ১৯১২ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন এবং কলকাতায় চলে আসেন। তিনি ভারতবর্ষ নামক একটি পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন, তবে তিনি দু’মাস পরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৭ মে ১৯১৩ তারিখে কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়।

উত্তরাধিকার

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সাহিত্য, সঙ্গীত, এবং নাট্যকর্মের মধ্যে তাঁর জাতীয়তাবাদী দৃষ্টি, শৈল্পিক প্রতিভা এবং সামাজিক চিন্তা প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর দ্বিজেন্দ্রগীতি এবং নাটকগুলি আজও বাঙালি সংস্কৃতির একটি অমূল্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। তিনি শুধু একজন সুরকার এবং কবি নন, তিনি বাঙালি সমাজের উন্নতির জন্য যে তীব্র আত্মবিশ্বাস এবং দেশপ্রেম প্রদর্শন করেছেন, তা আমাদের প্রেরণা যোগায়। তাঁর জীবন এবং কর্মের মাধ্যমে তিনি আজও বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাসে চিরকালীন স্থানে অধিষ্ঠিত রয়েছেন।

- বিজ্ঞাপন -

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

একটি অ্যাকাউন্ট নেই? নিবন্ধন করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!