অতুল প্রসাদ সেন: বাংলা সঙ্গীত ও সংস্কৃতির এক অমর নাম

রায়হান চৌধুরী
5 মিনিটে পড়ুন

অতুল প্রসাদ সেন (২০ অক্টোবর, ১৮৭১ – ২৬ আগস্ট, ১৯৩৪) বাংলা সংগীতের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন একজন সংগীতজ্ঞ, গীতিকার, সঙ্গীত শিল্পী, আইনজীবী, সমাজকর্মী, শিক্ষাবিদ এবং লেখক। তাঁর গানগুলো আজও বাংলা সংস্কৃতির এক অমূল্য রত্ন হিসেবে সমাদৃত। কিন্তু অতুল প্রসাদ সেনের জীবন শুধু সঙ্গীতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তাঁর অবদান ছিল নানা ক্ষেত্রে। চলুন, বিস্তারিতভাবে জানি তাঁর জীবন ও কর্মের নানা দিক।

প্রারম্ভিক জীবন

অতুল প্রসাদ সেনের জন্ম ১৮৭১ সালের ২০ অক্টোবর, দক্ষিণ বিক্রমপুরের মাগর গ্রামে, যা বর্তমানে বাংলাদেশের ফারিদপুর জেলায় অবস্থিত। তাঁর পিতার নাম রাম প্রসাদ সেন এবং মাতার নাম হেমন্তা শশী। অতুল প্রসাদ তার মায়ের ভাইয়ের বাড়িতে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন, যা সে সময়ের একটি প্রচলিত রীতি ছিল। অতুলের শৈশবের শুরুতে তার মায়ের পক্ষ থেকে সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ গড়ে ওঠে। তাঁর মাতৃকুলের অনেকেই সঙ্গীতের প্রতি অত্যন্ত অনুরাগী ছিলেন। তাঁর মাতাপিতার মধ্যে সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত গাঢ়, এবং তার মায়ের দ্বিতীয় বিয়েতে কিছুটা বিরোধ তৈরি হলেও সময়ের সাথে তিনি তার সৎপিতা দুর্গামোহন দাসের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন।

শিক্ষা জীবন

১৮৯০ সালে অতুল প্রসাদ কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন এবং একই বছর নভেম্বর মাসে ইংল্যান্ডে আইন শিক্ষা নিতে যান। সেখানে তিনি শ্রী অরবিন্দ ঘোষ, চিত্তরঞ্জন দাস, সারোজিনী নাইডু ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে পরিচিত হন। অতুল প্রসাদ ১৮৯৫ সালে কলকাতা হাই কোর্টে ব্যারিস্টার হিসেবে যোগদান করেন এবং আইন পেশায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।

প্রথম জীবন পেশা: কলকাতা

কলকাতা ফিরে এসে অতুল প্রসাদ সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহী হন এবং পাশাপাশি আইন পেশাতেও তাঁর ক্যারিয়ার শুরু করেন। ১৮৯৭ সালে তাঁর সৎপিতা দুর্গামোহন দাসের মৃত্যুর পর তিনি রংপুর আদালতে আইন পেশা শুরু করেন। সঙ্গীতের প্রতি তাঁর আগ্রহ কখনও কমেনি, তিনি নিয়মিত সঙ্গীত রচনা এবং গাওয়ার কাজে মনোনিবেশ করেন।

- বিজ্ঞাপন -

বিবাহিত জীবন

অতুল প্রসাদ সেন ১৯০০ সালে তাঁর আত্মীয় হেম কুসুমের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। যদিও তাঁদের বিবাহের বিষয়টি পরিবারের অনেক সদস্যের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না, কিন্তু অতুল ও হেম কুসুম একে অপরের প্রতি ভালোবাসায় পূর্ণ ছিলেন। তাঁদের দাম্পত্য জীবন খুবই যন্ত্রণাময় ছিল, এবং অতুলের জীবনের দুঃখজনক অভিজ্ঞতাগুলো তার গানের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে।

লখনৌর পেশাগত জীবন

১৯০২ সালে অতুল প্রসাদ লখনৌ চলে যান, যেখানে তিনি আইনি পেশা চালিয়ে যান এবং সেখানকার বাঙালি সমাজের মধ্যে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেন। তিনি ১৯২২ সালে কলকাতার বাইরে প্রথম বাংলা সাহিত্য সম্মেলন আয়োজন করেন, যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সভাপতিত্ব করেছিলেন।

সঙ্গীতের প্রতি অবদান

অতুল প্রসাদ সেন বাংলা সঙ্গীতের এক নতুন ধারা তৈরি করেছিলেন। তিনি সংগীতের বিভিন্ন শাখায় অবদান রেখেছেন, যেমন: শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, তুমরি, গজল, কীর্তন এবং বাউল গীতি। তিনি প্রথমবারের মতো বাংলায় গজল শৈলী প্রচলন করেন এবং শাস্ত্রীয় রাগ সংগীতের সঙ্গে বাংলা সঙ্গীতের সংমিশ্রণ ঘটান।

তাঁর গানের মধ্যে ছিল গভীর অনুভূতির প্রকাশ, বিশেষ করে প্রেম, পবিত্রতা এবং দেশের প্রতি ভালোবাসা। তিনি বাংলার জনপ্রিয় সঙ্গীত রচয়িতা হিসেবে পরিচিত, এবং তাঁর গানগুলো আজও মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে।

গানের রচনাশৈলী

অতুল প্রসাদ তার গানগুলোর মধ্যে প্রেম, দেশপ্রেম, ধর্মবিশ্বাস এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন। তিনি গান রচনা করেছিলেন দেবতা, প্রকৃতি, স্বদেশ, মানবতা এবং অন্যান্য বিভিন্ন থিমে। তাঁর গানগুলো ছিল বহুমাত্রিক এবং প্রায় সব ক্ষেত্রেই গভীর আবেগের প্রকাশ।

- বিজ্ঞাপন -

প্রেমের গান: অতুল প্রসাদ তার জীবনের যন্ত্রণাকে তাঁর প্রেমের গানে তুলে ধরেছেন। তাঁর গানে একাকিত্ব, বিচ্ছেদ, দুঃখের বহিঃপ্রকাশ ছিল।

ধর্মীয় গান: তিনি ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী ছিলেন এবং তাঁর অনেক গান ব্রাহ্ম ধর্মের প্রতি নিবেদিত ছিল। তিনি শিব, বিষ্ণু, কালী এবং শাক্ত ধর্মের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন।

দেশপ্রেমের গান: অতুল প্রসাদ ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ছিলেন এবং তাঁর গানগুলো দেশপ্রেমে ভরপুর ছিল। “উঠ গো ভারত-লক্ষ্মী” এবং “মোদের গরব, মোদের আশা” এর মতো গানগুলো ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় উজ্জীবিত করেছিল।

- বিজ্ঞাপন -

অতুল প্রসাদ সেনের অবদান

অতুল প্রসাদ সেন কেবল সঙ্গীত রচনাতেই নয়, তিনি শিক্ষামূলক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও অবদান রেখেছেন। তিনি লখনৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর অবদান আজও সমাদৃত।

অতুল প্রসাদ সেন ছিলেন একজন সঙ্গীতজ্ঞ, সমাজকর্মী, আইনজীবী, এবং সাহিত্যিক, যিনি বাংলা সংস্কৃতিকে অনবদ্য ভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর গানগুলো আজও আমাদের হৃদয়ে জীবিত, এবং তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমেই বাংলার সঙ্গীতজগত একটি নতুন দিগন্তে পৌঁছেছে। অতুল প্রসাদ সেনের অবদান বাংলা সংস্কৃতির ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় থাকবে।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

একটি অ্যাকাউন্ট নেই? নিবন্ধন করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!